প্রবন্ধ - দিব্যেন্দু ভৌমিক


কোচবিহারের লিটিল ম্যাগাজিন 

- সেকাল একাল

                   

"সেই ধন্য নরকূলে 

লোকে যারে নাহি ভুলে 

       মনের মন্দিরে সদা সেবে সর্বজন "         

                              

                                      মাইকেল মধুসূদন দত্ত

 

স্রষ্টা অমরত্ব লাভ করেন তাঁর সৃষ্টির জন্য। সাহিত্য সৃষ্টিও সৃজনশীলতার অন্যতম দিক। আর সাহিত্য সৃষ্টির "আঁতুড় ঘর" লিটিল ম্যাগাজিন। "লিটিল" বা ছোট অর্থে আজ আর এর হিসেব হয় না। মুল পত্র পত্রিকা এবং সমান্তরাল সাহিত্যের গতি পথ বেয়েই চলে লিটিল ম্যগাজিন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে লিটিল ম্যগাজিনে  বিপ্লব আনেন সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী তাঁর "সবুজ পত্র" মধ্যে দিয়ে।  সাল ১৯১৬। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি লিটল ম্যাগাজিনকে। তবে এরও অনেক আগে কোচবিহারের রাজনগরে লিটল ম্যাগাজিনের যাত্রা শুরু হয়েছে রাজ অন্তঃপুর থেকে। মহারাজা ন্রিপেন্দ্রনারায়ন ভুপ বাহাদুরের দ্বিতীয় পুত্র কুমার নিত্যেন্দ্র নারায়নের স্ত্রী রানি নিরুপমা দেবী ১৮৭৭ সালে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন "পরিচারিকা" পত্রিকা। একসময় রাজ অন্তঃপুর ছেড়ে বেড়িয়ে আসে "পরিচারিকা" মহারানী সুনীতি দেবীর উপস্থিতিতে ল্যন্সডাউন হলে আরও কিছু পড়ে কোচবিহার সাহিত্য সভায় পরিচারিকা অন্যান্য পত্রপত্রিকা নিয়ে সাহিত্য আলোচনা শুরু হয়। 

 

সে সময় কোচবিহারে সাহিত্য আসরে হাজির হন স্যর আশুতোষ মুখারজী, মানিক বন্দ্যপাধায়, হেমচন্দ্র বড়ুয়া প্রমুখ। নাম না জানা গাছের মতই রানি নিরুপমা দেবীর হাত ধরে বাংলার ১৩২৩ সালে এভাবেই কোচবিহারে যাত্রা শুরু করে লিটিল ম্যাগাজিন। প্রায় একই সময়ে প্রকাশিত হয় শরৎচন্দ্র ঘোষাল জানকিবল্লভ বিশ্বাস সম্পাদিত পত্রিকা "কোচবিহার দর্পণ" এটি ছিল পাক্ষিক সাহিত্য পত্রিকা। এর কিছু পড়ে কৃষ্ণ সুন্দর সেন সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় মাসিক সাহিত্য পত্রিকা "সুকথা" 

 


কোচবিহারে এই সাহিত্যের বলা ভালো লিটিল ম্যাগাজিনের ধারাপথ বেঁধে দেন  কোচবিহারের রাজপরিবার। যার যাত্রাপথে এসেছে পাঁচশোরও বেশি লিটিল ম্যাগাজিন। কোনোটা থেমে গেছে। কোনোটা পঞ্চাশ বছর পার করেও আজ চলছে। প্রতি বছরই জেলা কোচবিহারের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নতুন নতুন লিটিল ম্যাগাজিনের আত্মপ্রকাশ ঘটে চলেছে। কোনটা বার্ষিক, আবার কোনটা ত্রিমাশিক, আবার কেউ তো প্রতি মাসেই পত্রিকা তুলে দিচ্ছে পাঠকের হাতে! সব মিলিয়ে রাজনগর কোচবিহার তার মহকুমাগুলোতে বর্তমান সময়ে লিটিল ম্যাগাজিন বঙ্গে বিপ্লব এনেছে। উঠে আসছে নতুন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক - গল্পকার। 

 


জেলা কবি অরুনেশ ঘোষ, ঔপন্যাসিক অমিয়ভূষণের। নীরজ বিশ্বাসের "আমাদের পত্রিকা " (১৯৫০), কালিদাস বাগচির "জাগরন" (১৯৫১), তপেশ বসুর "মশাল" (১৯৫৪) , অপরাজিত গপ্পির "নাগরিক" (১৯৫৬), তপন দেবের "কালপুরুষ" (১৯৬০) , গপেশ দত্তের "বল্মিক" (১৯৬৮) , অনিল কুমার সেনগুপ্তের "দেশবার্তা" (১৯৬৯) - এগুল আর প্রকাশ পাচ্ছেনা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কারন সম্পাদকের প্রয়ান। তবে তাঁদের সৃষ্টির ধারা আজও অভ্যাহত। উঠে এসেছে নতুন নতুন পত্রিকা, সম্পাদক আর যার মধ্যে দিয়ে উঠে আসছে নতুন নতুন প্রতিভা। ১৯৭০ সাল থেকে রণজিৎ দেব সম্পাদিত "ত্রিবিত্ত" পত্রিকা কিন্তু রাজনগর থেকে আজও নিয়মিত প্রকাশ পেয়ে চলেছে। পত্রিকার নামে কোচবিহার শহরের সম্পাদকের বাড়ির এলাকা - " ত্রিবিত্ত সরনি" ! যা বলে দেয় এই শহরের লিটিল ম্যাগাজিনের প্রাসঙ্গিকতা, জনপ্রিয়তা! কোচবিহার সাহিত্য সভা পত্রিকার ৬১ তম সংখ্যা প্রকাশ পেয়েছে সম্প্রতি। এটি প্রাচীন পত্রিকা। স্যর আশুতোষ মুখারজী, অরুনেশ ঘোষ, অমিয়ভূষণ মজুমদাররা এই পত্রিকায় লিখেছেন বিভিন্ন সময়ে। আজও এখানে লেখেন সাহিত্যিক দিগ্বিজয় দে সরকার, ইতিহাসবিদ নৃপেন্দ্র নাথ পালরা। গত ৩৫ বছর যাবত সমানভাবে প্রাসঙ্গিকতা বজায় রেখে চলেছে কবি অমর চক্রবর্তীর "চিত্রকল্প" বছরে একটি সংখ্যা নিয়মিত প্রকাশ পায় চিত্রকল্প। ৪১বছরের পত্রিকা "তমসুক" সম্পাদনা করেন কবি সমীর চট্টোপাধ্যায়। আজকের বহু প্রথিস্থিত কবি - লেখক তুলে এনেছে 'তমসুক' সমীরবাবু এখন অসুস্থ্য। "কথালহরী" এই লেখনীর মাধ্যমে ওনার আরোগ্য কামনা করছি। 

 


মাথাভাঙ্গার সঞ্জয় সাহা সম্পাদিত "তিতির" দুই দশক ধরে চলা এক অনবদ্য লিটিল ম্যগাজিন। ২০১৮ সালের সংখ্যায় উঠে এসেছে উত্তরবঙ্গের চা-বলয়ের সামগ্রিক চিত্র, জানা - না জানা বহু কথা। এই মাথাভাঙ্গারই অন্যতম পত্রিকা "বিব্রিতি" সম্পাদক দেবাশিস দাস। ভালো কাগজ। নিয়মিত লেখেন ডঃ আনন্দগোপাল ঘোষ, রাজর্ষি বিশ্বাস। লিখতেন কবি পুণ্যশ্লোক দাসগুপ্ত। মেখলিগঞ্জের ১৬ বছর ধরে চলা লক্ষ্মী নন্দী সম্পাদিত "অপরাজিত অর্পণ" এবং আশির দশক থেকে প্রকাশিত হয়ে আসা "উন্মেষ" নাড়া দিয়ে যায় প্রতি সংখ্যাতে। বর্তমানে "উন্মেষ" সম্পাদনা করছেন রানা সরকার। নিশিগুঞ্জ থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হয় উত্তম বসাক সম্পাদিত ত্রৈমাসিক "নৈষ্ঠিক"  

 


"রসিকবিল", "রায়ডাক", "চিতলগড়" - এই তিনটি পত্রিকা তুফানগঞ্জ থেকে প্রকাশিত উল্লেখ্য। হরিদাস পাল "রসিকবিল", ক্ষিতিমোহন সরকার "রায়ডাকএবং যতীন বর্মা সম্পাদনা করেন "চিতলগড়" পত্রিকা। সাহিত্যে - লিটিল ম্যাগাজিনে অনেকটাই এগিয়ে কোচবিহার জেলায় দিনহাটা মহকুমা। টানা ১৯ বছর ধরে প্রতিমাসে প্রকাশ পাচ্ছে "বিবর্তন" বছরে দুটি বিশেষ সংখ্যা। সামাজিক বিভিন্ন দিক তুলে ধরাই এই পত্রিকার বিশেষত্ব। সম্পাদনা করেন ডঃ উজ্জ্বল আচার্য। সঞ্জয় কুমার নাগ সম্পাদিত দিনহাটা থেকে প্রকাশিত "বকলম" শারদ সংখ্যা প্রকাশ করে নিয়ম করে প্রতি বছর। আর হাতে লেখা বাংলার প্রথম লিটিল ম্যাগাজিন! হ্যাঁ, আমিনুর রহমান ৩৪ বছর ধরে হাতে লেখা পত্রিকা "বৈঠা" প্রকাশ করে চলেছেন। সমাদৃত হয়েছে জেলা ছাড়িয়ে সারা বাংলায়। 

 


রাজনগর কোচবিহারে কুড়িটিরও বেশি পত্রিকা প্রকাশ পায়। তার মধ্যে কতগুলো ইতিমধ্যেই তুলে ধরা হয়েছে। শৌভিক রায় সম্পাদিত "মুজনাই" এক শক্তিশালী পত্রিকা। নবীন থেকে প্রবীণের সমান বিচরণ মুজনাইতে। বছরে চারটি সংখ্যা প্রকাশ পায় মুজনাইয়ের। ২৫ বছর অতিক্রম করেছে ২০১৮ সালে গৌরাঙ্গ সেন সম্পাদিত "উত্তর ভুমিকা" এবং অবশ্যই সগৌরবে! দেবব্রত চাকি সম্পাদিত "উত্তর প্রসঙ্গ" জেলার অন্যতম সাহিত্য পত্রিকা। রূপক স্যন্যালের "খোঁয়াড়ের নৌকো", কিশরনাথ চক্রবর্তীর "সমান্তর", সুনীল সাহা সম্পাদিত "সাহিত্য নবলিপি" অন্যধারার পত্রিকা। চার বছর হল যাত্রা শুরু করেছে দিব্যেন্দু  ভৌমিক সম্পাদিত "মোহনা'' সাহিত্য পত্রিকা। বছরে চারটি সংখ্যা প্রকাশ পেত। কোরোনা কালে দুটি সংখ্যা করছে মোহনা। বিশেষ সংখ্যা  মোহনা শারদীয়া। দিগ্বিজয় দে সরকার, কাবেরি রায় চৌধুরী, অমিতাভ সিরাজের মত প্রথিথযশা লেখকের পাশাপাশি মোহনায় লেখেন নতুন প্রজন্ম। একসময় সম্পাদনা করতেন পুণ্যশ্লোক দাসগুপ্ত। পত্রিকা - "গোল্লাছুট" আজ গোল্লাছুটকে ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন কবি মাধবী দাস। 

 


সব মিলিয়ে কোচবিহারের লিটিল ম্যাগাজিনের জয়যাত্রা সেই রাজ আমল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অব্যাহত। জেলার বহু লিটিল ম্যাগাজিন ওপার বাংলায় পৌঁছে যায় নিজ গুনে। আজ জেলা পশ্চিমবঙ্গের বহু প্রথিতযশা লেখক এই লিটিল ম্যগাজিনে হাত পাকিয়েছেন। তাই লিটিল ম্যগাজিন কিন্তু আজ সমান্তরাল সাহিত্যের আঙিনায় সমহিমায় উজ্জ্বল। তবে আর্থিক প্রতিবন্ধকতা অনেক ক্ষেত্রেই লিটিল ম্যাগাজিনকে যবনিকার অন্তরালে নিয়ে চলে যায়। আর ততদিনে প্রথিস্থিত কোন লেখক - কবি পিছন ফিরে তাকায় না তার  আঁতুড় ঘরের পানে            

Comments