প্রবন্ধ - পার্থ সারথি চক্রবর্তী


চিপকো আন্দোলন ও সুন্দরলাল বহুগুণা 



গত ২১ শে মে ভারতবর্ষ হারাল তাঁর এক কৃতী সন্তানকে। সুন্দরলাল বহুগুণা। প্রকৃতির সন্তান। পরিবেশের বন্ধু। সুন্দরলাল বহুগুণা আর পরিবেশ আন্দোলন যেন সমার্থক। তিনি  সারা বিশ্বজুড়ে পরিবেশ আন্দোলনের অভিধানে চিপকো আন্দোলনের নাম সংযোজন করে দিয়েছেন চিরকালের জন্য। তাঁর মৃত্যু ভারতের পরিবেশ আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

 

 

আমাদের দেশে বা সমাজে আমাদের চারপাশে যা কিছু উপস্থিত, তার সবটা নিয়েই পরিবেশ। নগরায়ন অপরিকল্পিত উন্নয়নের দাপটে সেই পরিবেশ আজ বিপন্ন। ক্রমবর্ধমান মানুষের বসতির চাপ লাগামহীন লোভ আজ পরিবেশের নাভিশ্বাস তুলে দিচ্ছে। দেশে পরিবেশ আন্দোলনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য পরিবেশের ক্ষতি দূষণ রোধ করা, মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করা। এছাড়া প্রাকৃতিক সম্পদের যথোপযুক্ত ব্যবহার করে টেকসই বা দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের পথ খোঁজাও এর উদ্দেশ্য। মনে করা যেতে পারে পরিবেশগত সমস্যা নিরসনের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭০ এর দশক থেকে এদেশে শুরু হয় পরিবেশ আন্দোলন। কার্যতঃ সত্তর দশক থেকেই গোটা বিশ্বে পরিবেশসংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। নির্বিচার অর্থনৈতিক বৃদ্ধির চাহিদায় প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার পরিবেশের ওপরে এক মারাত্মক প্রভাব ফেলতে থাকে। ১৯৬২ সালে Rachel Carlson নামক এক জীববিজ্ঞানীর লেখা 'Silent Spring' বইতে এক সাড়া জাগানো বিষয় উঠে আসে। আঙুরের ক্ষেতগুলোতে বেশি উৎপাদনের জন্য মাত্রাতিরিক্ত DDT ব্যবহার করা হত। এর ফলে জমির উর্বরতার পাশাপাশি ভীষনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল বাস্তুতন্ত্র মানুষের স্বাস্থ্য। এই বিষয়টিকে বিশদে তুলে ধরা হয়েছিল এই গ্রন্থে। ১৯৬২ সালে গঠিত হয় 'Club of Rome' নামক পরিবেশ সংগঠন। একইভাবে আমাদের দেশেও সংগঠিত হতে থাকে বিভিন্ন পরিবেশ আন্দোলন। ১৯৭২ সালে স্টকহোমে প্রথম বিশ্ব বসুন্ধরা সম্মেলনে গঠিত হয় 'The Stockholm Conference on Environment and Development' এর পরে ১৯৯২ সালে রিও বসুন্ধরা সম্মেলন, ২০০২ সালে জোহানেসবার্গ সম্মেলন ইত্যাদি অনেক সংস্থা গঠিত হয়েছে। ভারতে ১৯৬০ এর শেষভাগ থেকেই তথাকথিত উন্নয়নের নেতিবাচক প্রভাব দেখা যেতে থাকে। পরিবেশ অবনমন দূষণের বিরুদ্ধে পরিবেশগত বিভিন্ন ভাবনা সচেতনতামূলক আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। 'Right to Environment'- এর অধিকারকে সুরক্ষিত করার তাগিদ অনুভূত হয়। তার মধ্যে কোনোটা জল, জমি, বন শস্যবীজ রক্ষার্থে, আবার কোনোটা বড় বাঁধ, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের বিরুদ্ধে। কারণ এসব ক্ষেত্রে বহু মানুষ বাস্তু থেকে উৎখাত হয় জীবিকা হারায়। আবার কিছুক্ষেত্রে পরিবেশ দূষণ, প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষতির মত সমস্যা নেমে আসে। যা দীর্ঘমেয়াদে ডেকে আনে প্রভূত বিপদ। ভারতে সুন্দরলাল বহুগুণার সাথে 'চিপকো আন্দোলন' অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত হয়ে আছে। আমরা এই নিবন্ধে 'চিপকো আন্দোলন' এর উপরে আলোকপাত করার চেষ্টা করব।

 

 

সত্তর দশকেই এই আন্দোলনটি সংগঠিত হয় হিমালয়ের গাড়োয়াল কূমায়ুন অঞ্চলে, যা বর্তমানে উত্তরাখন্ডে অবস্থিত। 'চিপকো' কথার অর্থ- জড়িয়ে ধরা (Hugging or embracing) সেখানকার গ্রামবাসীরা গাছগুলোকে দু'হাতে জড়িয়ে ধরে কেটে ফেলা থেকে রক্ষা করতে আন্দোলনে নামে। তার থেকে এর নাম হয় 'চিপকো আন্দোলন' কাঠ ব্যবসায়ীদের দ্বারা ওই অঞ্চলে নির্বিচারে শুরু হয় বৃক্ষচ্ছেদন। ফলে বিপন্ন হয়ে পড়ে বিস্তীর্ণ এলাকার বাস্তুতন্ত্র। অর্থনীতির বিপর্যয় ডেকে আনে এলাকার মানুষের জীবনযাত্রায়। গোপেশ্বর, তেহরি, চামোলি নরেন্দ্রনগরকে কেন্দ্র করে শুরু হয় 'চিপকো আন্দোলন' স্থানীয় অধিবাসী সরকারনিযুক্ত ঠিকাদারদের মধ্যে অরণ্যের অধিকারের সংঘাত চরম আকার ধারণ করে।  চামোলির 'Dasuauli Gram Swaraj Sangha' দাবী করে যে, স্থানীয় যুবাদের কর্মসংস্থানের স্বার্থে ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপনের জন্য অরণ্যসম্পদ ব্যবহারের অধিকার দিতে হবে। সরকার তা মেনে না নেওয়ায় অভ্যুত্থানের উৎপত্তি হয়।  তা দমন করতে সক্রিয় হয়ে ওঠে সরকার। উল্টে বিভিন্ন কোম্পানিকে লিজ দেওয়া হয় বনাঞ্চলের। তারা গাছ কাটা শুরু করতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে গ্রামবাসীরা। গাছগুলোকে দু'হাতে জড়িয়ে ধরে কুঠারাঘাত থেকে রক্ষা করতে পথে নামে। গৌরা দেবী নাম্নী এক সাধারণ মহিলা প্রতিরোধের নেতৃত্ব দেন। সাময়িকভাবে সরকার পিছু হটলেও, স্থায়ী সমাধান অধরাই থেকে যায়। রাজ্য বনদপ্তর বাদিয়ারগড় অঞ্চলে বৃক্ষচ্ছেদনের পরিকল্পনা নেয়। এর প্রতিবাদে আন্দোলন তীব্রতর হতে থাকে। গান্ধীবাদী পরিবেশবিদ সুন্দরলাল বহুগুণা সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ১৯৭৯র জানুয়ারি থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন। শত শত মানুষ সংগঠিত হতে থাকে। সরকার বহুগুণাকে গ্রেফতার করায় জনরোষের আগুনে ঘৃতাহুতি হয়। ক্রমাগত তীব্রতর হতে থাকে আন্দোলন। শেষ পর্যন্ত সরকারকে পিছু হটতে হয়। মুক্তি পান বহুগুণা তার সমর্থকরা। গাড়োয়াল কূমায়ুনের পাহাড়ি অঞ্চলে একটি বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট উচ্চতার উপরের অংশের বনে গাছ কাটার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। এভাবে চিপকো আন্দোলন Indian Environmentalism-এর প্রতীক হয়ে ওঠে। চিপকো কিন্তু সেই অর্থে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কোন বিচ্ছিন্ন আন্দোলন ছিল না। স্বাধীনতা পূর্ব স্বাধীনতা উত্তর - দুই সময়েই এর ইতিহাস বিস্তৃত। চিপকো আন্দোলন নিছক পরিবেশ আন্দোলন না থেকে একটি আর্থ সামাজিক আন্দোলনে পর্যবসিত হয়েছে।

 

 

'গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়াও, দেখবে কত ছোটো'- কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এই পংক্তিটি সত্য হয়ে ওঠে। চিপকো আর সুন্দরলাল বহুগুণা যেন সমার্থক হয়ে উঠেছিল। আসলে ছিল অরণ্যের অধিকারের সংগ্রাম। বনজসম্পদকে সমতলের কাঠশিকারীরা কেটে লুঠ করত। এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে স্থানীয়দের অধিকার প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করাও ছিল এই আন্দোলনের লক্ষ্য। ১৯৮৫ সালের অরণ্য নীতিতে বলা হয়েছিল 'যদিও ১৯৭৩ এর চিপকো আন্দোলনের প্রধান দাবি ছিল জঙ্গলের সম্পদ আহরণে ঠিকাদারি প্রথা বাতিল স্থানীয় অরণ্যনির্ভর শিল্পে কম দামে কাঁচা মাল বন্টন' কিন্তু পরবর্তীকালে এটি চিরস্থায়ী অর্থনৈতিক পরিবেশ আন্দোলনে পরিণত হয়। বহুদিন আগে শুরু আন্দোলন বহুগুণার হাত ধরে জাতীয় রূপ ধারণ করে। সেইসঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বের দরবারে। অলকানন্দার তীরে দলে দলে মহিলারা প্রতিরোধে নেমে আসে, বুক দিয়ে গাছ রক্ষার্থে ব্রতী হয়ে ওঠে। সেখানে গৌরাদেবীর সাথে যুক্ত হন সুরক্ষা দেবী, বাচনি, সুদেষ্ণারা।

 

 

বহুগুণাকে এই আন্দোলনের সমার্থক মনে করা হলেও শোনা যায়, এই আন্দোলনের গোড়ায় তিনি ছিলেন না। ছিলেন তার স্ত্রী বিমলা দেবী। পরিচিত গান্ধীবাদী সুন্দরলাল তার স্ত্রীর পাশে এসে দাঁড়ান। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করতে বহুগুণা আড়াই বছর ধরে সাত হাজার কিলোমিটার পাহাড়ি পথ হেঁটে পরিবেশমূলক সচেতনতা গড়ে তোলেন। এমনকি ভাগীরথী নদীর উপর নির্মীয়মান তেহরি বাঁধ নিয়েও প্রতিবাদে সামিল হন। হিমালয় পাহাড় থেকে দিল্লীর রাজপথ অবধি তার সত্যাগ্রহ ছড়িয়ে দেন সুন্দরলাল। শেষে ১৯৮০ সালে ১৫ বছরের জন্য গাছ কাটায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

 

 

আরো এও শোনা যায়, চিপকো আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল আড়াইশো বছর আগে রাজস্থানের বিশনোই গ্রামে, জনৈকা অমৃতা দেবীর নেতৃত্বে। তার জন্য রাজদন্ডে ৩৬৩ জন নারী- পুরুষের শিরচ্ছেদ করা হয়েছিল। এই কাহিনী ঘুরে বেড়ায় গাড়োয়ালের পাহাড়ি গ্রামের বাতাসে বাতাসে।

 

 

তাই চিপকো আন্দোলন আজ পরিবেশ আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক বেঞ্চমার্ক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সুন্দরলাল বহুগুণার মৃত্যুর সঙ্গে এক মহান যুগের পরিসমাপ্তি ঘটেছে।

 

 

তবে তিনি যে পথ দেখিয়েছেন, সে পথে আজো হাঁটতে হবে, আরো হাঁটতে হবে। এই পরিবেশকে রক্ষা করতে না পারলে আমরাও রক্ষা পাব না। আমাদের উপরেও নেমে আসবে খাঁড়া। তাই পরিবেশ আন্দোলন একইভাবে, নিষ্ঠার সঙ্গে চালিয়ে যেতে হবে। নির্বিচারে বন ধ্বংস করা উন্নয়নের নামে পরিবেশকে আঘাত হানা থেকে বিরত থাকতে হবে।

 

 

আর সেটাই হবে সুন্দরলাল বহুগুণা সহ সমস্ত পরিবেশবিদদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।


Comments