প্রবন্ধ - তুষারকান্তি রায়



অক্ষরে অক্ষরে সময়ের জবাবদিহি

  

সারা রাত জেগে থাকতেন ঠাকুর্দা

মাঝে মাঝে শোনা যেতো রাতপ্রহরীর উঁচু হাঁক;

সজাগ আছেননি কর্তা?’

ঠাকুর্দা সাড়া দিতেন; ‘আছি আছি। আছি।আমি

ভেবে ভেবে মরতাম তখন

গেরস্ত জেগেই যদি থাকে সারারাত

এতসব প্রহরার এমন কী দরকার তবে আর!

 

 

আজ এতদিন পরে আমাদেরও ঘুম নেই চোখে

সচল চৌকির শব্দ মাঝরাতে পৌঁছে যায় আমাদেরও কানে

আজ মনে হয়, ঠিক। ঠিকই

নিজেই নিজেকে যদি পাহারা না দিই বার বার

এসব টহলদারি এতদূর বাইরে থেকে কতটুকু করতে পারে আর!

 

- শঙ্খ ঘোষ, টহল,

গোটাদেশজোড়া জউঘর

 


আমাদের  কৈশোর বা যৌবনকাল থেকে কবি শঙ্খ ঘোষের কথা বলার মতো করে ভাবা এবং সেই মতো করে লেখা কবিতা থেকেই আমরা শিখেছি কিভাবে নিজেই নিজেকে পাহারা দিতে হয়। জাগিয়ে রাখতে হয় আমার আমিকে।  ভিতরের এই জাগরণের জন্য কখনোই তাঁকে বিরাট আয়োজন করতে দেখি না। তাঁর কবিতার কথারা চিরকাল চলনে স্থির এবং সমাহিত। খুব শান্ত আর নীচু গলায় বলা তাঁর কবিতায় কখনই কোনও আড়ম্বর থাকে না। তাঁর বলার মধ্যে থাকে না আরোপিত বাগ্মিতা, কিন্তু একটা জোর থাকে, আর থাকে সরল (কখনই তরল নয়একটা কথোপকথনের ভঙ্গি। যা সহজেই অন্তর্ভেদী শক্তি নিয়ে পৌঁছে যায় আমাদের গভীরে। এই যেটহলকবিতায় কবি প্রাত্যহিক জীবন থেকে তুলে আনা রাতপাহারার দৃষ্টান্ত এনে ঠাকুর্দার সারারাত জেগে থাকার মধ্য দিয়েআজ এতদিন পরেনিজের বুঝতে পারার কথা বললেন সেখানে পাঠকের উপর  চাপিয়ে দেওয়ার কোনও ইচ্ছা কিন্তু দেখা গেলো না। অথচ সহজ সংযোগের ব্যাকুলতাটুকু উপেক্ষা করা যায় না। যা মৃদুতার মধ্য দিয়ে, শান্ত স্বরের মধ্য দিয়ে, কথা বলবার মতো করে আমাদের কাছে এলো। এলো শুধু না, মর্মে পৌঁছে গেলো। এখানেই কবি হিসেবে তাঁর সার্থকতা।



কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা ভুমিকায় বলছেন, ‘সত্যি কথা বলা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই কবিতার এটি যেমন সত্যি তেমনই এই প্রশ্নটিও খুব প্রাসঙ্গিক যে কীভাবে খুব সহজে কবির কবিতার ভাবনাকে পাঠকের কাছে  পৌঁছে দেওয়া যাবে। একজন কবিকে এটাও বুঝতে হবে যে তিনি কি কেবল জানাতে চান? না কি তাঁর বোঝাটা পাঠককে বোঝাতে চান? কবি শঙ্খ ঘোষ অতি বিনীত ভঙ্গিতে দ্বিতীয় কাজটিই করে গেছেন সারাজীবন। অনেক কবির ক্ষেত্রে অনেকসময়েই সেটা ঘটে ওঠে না।

 

আজ সকাল থেকে কেউ আমাকে সত্যি কথা বলেনি

কেউ না

চিতা, জ্বলে ওঠো

 

সকলেরই চোখ ছিল লোভে লোভে মনিময়

মুখে ফোটে খই

চিতা, জ্বলে ওঠো

 

যা, পালিয়ে যা

বলতে বলতে বেঁকে যায় শরীর

চিতা

 

একা একা এসেছি গঙ্গায়

জ্বলে ওঠো

 

অথবা চণ্ডাল

দেখাও যেভাবে চাও সমীচীন ছাইমাখা নাচ

-         চিতা’, আদিম লতাগুল্মময়

 

মিথ্যাভাষণের মধ্য থেকে জেগে উঠেছে সত্যির আগ্রহ।সকাল’, মানে সেই প্রথম থেকেই , ‘কেউ সত্যি কথা বলেনিঅথচ সকলের  ‘মুখে ফোটে খই, অবিরাম কথা আর কথা। অনবরত অজস্র এইসব কথার মধ্যে মিথ্যাই যে বড় হয়ে ওঠে। আসল কথা তো একটিই। যা হলো–  নিঃসঙ্গতা, ‘একা একা এসেছি গঙ্গায় আর, সত্যি হলো চিতা। কথার ভিড়ে সত্যি যায় হারিয়ে। তিনি বলছেন,  ‘ওদের বলো / চিতা সাজাবার সময়ে / এত বেশি হল্লা ভালো নয়।’  (‘ধর্ম’, মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়) সর্বত্র সর্বদা এই মাত্রাবোধের অভাব তাঁকে কষ্ট দিতো।

 

আর এই কষ্টের কথা অপূর্ব ভাবে ফুটে ওঠতে দেখি যখন তিনি বলেন

 

ঘরে ফিরে মনে হয় বড়ো বেশি কথা বলা হলো?

চতুরতা, ক্লান্ত লাগে খুব?

 

মনে হয় ফিরে এসে স্নান রে ধুপ জ্বেলে চুপ করে নীলকুঠুরিতে

সে থাকি?

 

মনে হয় পিশাচ পোশাক খুলে রে নিই

মানবশরীর একবা?

 

দ্রাবিত সময় ঘরে বয়ে আনে জলীয়তা, তার

ভেসে-ওঠা ভেলা জুড়ে অনন্তশয়ন লাগে ভালো?

 

যদি তাই লাগে তবে ফিরে এসো। চতুরতা, যাও

কী - বা আসে যায়

লোকে বলবে মূর্খ বড়ো, লোকে বলবে সামাজিক নয়! – মূর্খ বড়ো সামাজিক নয়

চলে আসিগোটাদেশজোড়া জউঘর’  এরচমক’  কবিতায়। যেখানে তিনি বলছেন

 

কথা বলে যাও সবার সঙ্গে

তার মধ্যে ঝলক দিয়ে উঠতে থাকে গমক

চমকের পর চমক

আমরা দূর্বাহাতে গোল হয়ে শুনি আর ততই ফুলে উঠতে থাকে তারা

সেসব দিয়ে সাজিয়ে তোল তোমার দিনরাত্রিগুলি

তোমার শুভ-অশুভ

তুমি কথা বলতে থাকো

তার মাঝখানে

গোপনে কখন খোয়া যায় তোমার সর্বস্ব, ঘরবাড়ি

আর তখনও

রক্তাক্ত মুখে হাসতে থাকে শুধু চমকগুলি, হাসতে থাকে

হেসে যেতেই থাকে তারা -

এই যে, তুমি! যাকেআমরা দূর্বাহাতে গোল হয়ে শুনি’  সুযোগ বুঝে তুমিও, ‘সাজিয়ে তোল তোমার দিনরাত্রিগুলিআর, ‘গোপনে কখন খোয়া যায় তোমার সর্বস্ব আমরা দেখি , ‘রক্তাক্ত মুখে হাসতে থাকে শুধু চমকগুলিকিন্তু তুমি কোথায়! শুধু কথায় সত্যিটা হারিয়ে যায়। আর, সত্যিকে আড়াল করে মূর্তির মতো প্রকটিত মিথ্যেটাই আমাদের সামনে বড় হয়ে ওঠে। যা কখনই কাম্য হতে পারে না। সমর্থনে কবির একটি বক্তব্যই তুলে ধরছি। যেখানে তিনি বলছেন, ‘আমরা অনেকসময়েই সকলের করা কাজটাকে বলতে শুরু করি আমার কাজ। ব্যক্তিগত স্তর থেকে সামাজিক রাজনৈতিক স্তর পর্যন্ত আমি তখন হয়ে ওঠে এক ঘোষণা-শব্দ, চিৎকার-শব্দ, যার মধ্য দিয়ে এগোতে থাকে  অবারণ একটা জোর দিয়ে বলবার প্রতাপভঙ্গি। আর সেই চোরাপথে এগিয়ে আসে ফ্যাসিবাদ। ফ্যাসিবাদ আমাদের স্বভাবের একটা অনিয়ন্ত্রিত চিৎকার।’ – (অন্ধের স্পর্শের মতো, প্রণবেশ সেন স্মারক বক্তৃতা ২০০৭)

 

এই অনিয়ন্ত্রিত চিৎকারের বিরুদ্ধে আমরা তুলে ধরতে পারি কবির ভাষায় আমাদের করুণ পরিণতি

 

আমাকে হতে হবে ওদের মতো? / বেশ তো হবো তা-ই। সমুদ্যত / বর্শাফলকের সামনে বুক পেতে / একাই তুলে নেবো শতেক ক্ষত / জড়াব পাকে পাকে মিথ্যে জালে / নিজেকে ছুঁড়ে দেব -জঞ্জালে / অসাড় চোখ মেলে দেখব দিকে দিকে / শেষের লগ্ন কে কেমন জ্বালে! / এভাবে নিজেকেই মারছি? না তো।  / লুকোনো আছে সেই প্রত্যাঘাতও / যা দিয়ে তোমাদের বানানো স্বপ্নকে / ধুলোয় টেনে নিই যেখানে হাঁটো। / এমনই হবে ভুল তীর্থগামী / পাবে না খুঁজে কোনো সর্বনামই / কেবল দেখবে যে আজ রাজপথে / আমারই শব হয়ে হাঁটছি আমি।

 

– ‘চলন’, গোটাদেশজোড়া জউঘর।

 

 

কবি শঙ্খ ঘোষের ব্যক্তিত্বের মধ্যে, ব্যক্তিত্বপ্রকাশের প্রকরণের মধ্যে এক অসাধারণ শান্ত স্থির প্রত্যয়ের বিচ্ছুরণ দেখা যেতো। লেখাতেও ছিলো তাঁর এই মাত্রাবোধের জ্ঞান। তিনি নিজে রবিঠাকুরের যে বক্তব্যের কথা বলতেন এবং নিঃসন্দেহ যে তিনি তা আত্মস্থ করেছিলেন। সেটি হলো, ‘আমরা সমস্ত দিন কতরকম করে যে শক্তির অপব্যয় করে চলি তার ঠিকানা নেইকত বাজে কথায়, কত বাজে কাজে। নিষ্ঠা হঠাৎ স্মরণ করিয়ে দেয়, এই যেজিনিসটা এমন করে ফেলাছড়া করছ এটার যে খুব প্রয়োজন আছে। একটু চুপ করো, একটু স্থির হও, অত বাড়িয়ে লোনা, অমন মাত্রা ছাড়িয়ে লো না।রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছিলেন, ‘সিদ্ধিলাভের কাছাকাছি গেলে প্রেমের সহজ প্রাজ্ঞতা লাভ হয়, তখন মাত্রাবোধ আপনি ঘটে।’  এই মাত্রাবোধ থেকেই হয়তো তিনি এসে দাঁড়ান একনির্জন আত্মস্থতা ঐতিহ্যে, যা ছিলো তাঁর আজীবনের সাধনা। তবুও দেশের মধ্যে দেশহীনতার ভয়ঙ্কর পরিমণ্ডলে তাঁর গভীর উচ্চারণ কিন্তু ঠিক জেগে ওঠে

 

কী আমার পরিচয় মা?

দারুন কুঠারে কেউ ছিঁড়ে দিয়েছিল দড়ি

 

*    *   *

 

দ্রুত খুলে যায় সব তরী

টেবিলে গেলাস রেখে উঠে আসে প্রণয়িনী হাত ভাঁজ রে বলে, এসো,

কনুই বাঁকিয়ে ওরা মিশে যায় ক্রিসমাস ভিড়ে

টুইস্ট টুইস্ট টুইস্ট  . . .

 

*   *   *

 

আজ মনে পড়ে মাগো তোমার সিঁদুর এই নিখিল ভূবনে

জন্মেছিলো ভর্তৃহীনা জবালার ক্রোড়ে

ভাষায় না পোশাকে না মুখের রেখায় নয় চোখের রেখায় নয় চোখের নিহিত জলে নয়

আমি খুব নীচু হয়ে তোমার পায়ের কাছে বলি, আজ ক্ষমা করো প্রভু

আয়তনহীন এই দশ দিকে আজ আর আমার দুঃখের কোনো ভারতবর্ষ নেই।

 

– ‘জাবাল সত্যকাম’, শ্রেষ্ঠ কবিতা

 

 

কবিকে যখন দেশ ছাড়িয়ে বহুদুর যেতে হয় তখনও তাঁকে স্বদেশের আকাশবাতাস-মাটির দিকে ফিরে তাকিয়ে বলতে হয়, ‘এই দশ দিকে আজ আর আমার দুঃখের কোনো ভারতবর্ষ নেই।’  তিনি যে সত্যকাম।তুমি দিয়েছিলে ভার আমি তাই নির্জন রাখাল মনে পড়ে রবি ঠাকুরের ছিন্নপত্রাবলী --  যেখানে তিনি লিখছেন – ‘ দেশে এসে আমাদের সেই হতভাগ্য বেচারা ভারতভূমিকে সত্যি আমার মা বলে মনে হয়। দেশের মতো তার এত ক্ষমতা নেই, এত ঐশ্বর্য নেই, কিন্তু আমাদের ভালোবাসে আমার আজন্মকালের যা কিছু ভালোবাসা, যা কিছু সুখ, সমস্তই তার কোলের উপর আছে। এখানকার আকর্ষণ চাকচিক্য আমাকে কখনোই ভোলাতে পারবে নাআমি তার কাছে যেতে পারলে বাঁচি। সমস্ত সভ্য সমাজের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত থেকে আমি যদি তারই এক কোণে বসে মৌমাছির মতো আপনার মৌচাকটি ভরে ভালোবাসা সঞ্চয় করতে পারি তা হলেই আর কিছু চাইনে।’ – লন্ডন, অক্টোবর।

 

 

যখন কবি নিজেই বলেন, ‘আমারও হাত যদি ছেড়ে দেন রবীন্দ্রনাথ তবে সেই মুহূর্তে ছিন্ন হয়ে যাবে আমার সমস্ত অস্তিত্ববোধ।’ (আইয়ুবের সঙ্গে বিচার, নিঃশব্দের তর্জনী) তখন এই সত্যভাষণ থেকে আমরা বুঝতে পারি তাঁর অস্তিত্বের কেন্দ্রে বসে আছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। আধুনিক কবিতার সঙ্গে পরিচয়ের বহু আগেই যে তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এই চেনাপরিচয়। প্রকৃতি-প্রেম-ঈশ্বর, ধুলো-দুয়ারহারা পথ, আলো-বাতাস-আকাশ-সন্ধ্যা-ভোর  কিংবা দুঃখ আনন্দ সবই যে রবীন্দ্রদীক্ষিতের রুদ্রাক্ষমালা।

 

এই যে ভালো ধুলোয় ধুলোয় ছড়িয়ে আছে দুয়ারহারা পথ ,

এই যে স্নেহের সুরে-আলোয় বাতাস আমায় ঘর দিল রে দিল

আকাশ দুটি কাঁকন বাঁধে, বলে, আমার সন্ধ্যা আমার ভোর

সোনায় বাঁধাভুলে যা তুই যা তোর মৃত্যুমনোরথ!

সেই কথা এই গাছ বলেছে, সেই কথা এই জলের বুকে ছিল,

সেই কথা এই তৃণের ঠোঁটেভুলে যা তুই, দুঃখেরে ভোল্ তোর,

ধুলোতে তুই লগ্ন হলে আনন্দে এই শূন্য খোলে জট !  - ‘‘বলো তারেশান্তি শান্তি’ ’’, দিনগুলি রাতগুলি

 

 

তারপর তিনি যখন জটিল আধুনিকতার শিক্ষায় নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছেন তখনই তাঁর রবীন্দ্রমনন সবচেয়ে গভীরে শিকড় ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। তাইদিনগুলি রাতগুলিপ্রকাশের দশ বছর পরেরনিহিত পাতালছায়া আমরা পাই

 

একদিন দূরের বয়সে

ভেসে চলেছিলাম সাগরে।

মাসি, ছিলাম সাগরে।

তখন ঘরের কোন নিভৃত মা এসে

দিল গভীর অভিশাপ?

জলে বড় চাপ, বড় চাপ,

দ্রুত জল লহরে লহরে।

 

মাসি, যাব না সাগরে।  - ‘যাব না সাগরে

কবি যখন বলেন, ‘জলে বড় চাপ, বড় চাপ, / দ্রুত জল লহরে লহরে। / মাসি, যাব না সগরে।তখন দেবতার গ্রাস কিন্তু আর বাইরের সম্ভাবনা থাকে না, তখন সেই আকুলতা গভীরের চাহিদায় পরিণত হয়। সমসাময়িক তাঁর আর একটি কবিতায় দেখি

 

আমি যখন নীচু হয়ে পাথরকুচি কুড়াই

কয়েকটা জটিল গুল্মের ছায়া পড়ে আমার মুখে

আড়াআড়ি।

আর যখন শূন্যমুখে উল্টোমুখে আকাশে তুলে দিই হাত

মুখের কিনার ঘিরে ঢেউ দেয় জয়ন্ত ঈথার আভাময়

অদৃশ্যতা।

 

এমন একই সঙ্গে দু-রকম কেন?’ – ওরা ভাবে। - গুল্ম ঈথার, নিহিত পাতালছায়া

আমি যখন নীচু হয়ে পাথরকুচি কুড়াই। উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে স্মরণে সাড়া দেয় রবীন্দ্রনাথেরআমি যখন তাঁর দুয়ারে ভিক্ষা নিতে যাই কিন্তু ঠিক তারপরেইজটিল গুল্মের ছায়াআরআড়াআড়িবলার সঙ্গে সঙ্গে ছন্দ পালটে যায়। মুহূর্তে মানবিকসামাজিক সম্পর্কের জটিলতা ভাষা ছন্দের মহাপয়য়ারীয় পরিধিতে ব্যাপ্ত হয়ে যায় দ্বিতীয় স্তবক। অস্তিবাদের প্রাচীন প্রজ্ঞা এখানে আধুনিক পরিভাষা পায়জয়ন্ত ঈথার আভাময় অদৃশ্যতা।

 

 

কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতার শান্ত আত্মস্থ প্রত্যয় চিরকাল একটা আভা ছড়িয়ে গেছে আমাদের মনে। সেখানে অদ্ভুতভাবে তাঁর ব্যক্তিত্বের নমনীয়তা আর যুক্তির দৃঢ়তা একসঙ্গে আসে। যাতে নিজেরই বিচারবোধের জাগরনে যথার্থ একটা লক্ষ্যে এসে পৌঁছতে পারে পাঠক। তাঁর লেখার স্বরগ্রাম সাধারনত খুব উঁচু হতে দেখি না। সময়কে বুঝতে চাইতেন এবং পাঠককে বোঝাতে চাইতেন প্রসারিত এক স্থৈর্য নিয়ে, লাবণ্যময় দৃঢ়তায় ভরপুর এক উচ্চারণ নিয়ে। তাঁর কবিতার আর একটি গুণ হলো সময়টাকে চমৎকার করে তুলে ধরা। জীবনকে এক অপূর্ব লাবণ্যসূত্রে গেঁথে দিতেন তিনি এই প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘আধুনিক শিল্পীর কাজ এই যে তিনি তাঁর দেশনিহিত সময়কে স্পষ্টভাবে এনে দাঁড় করিয়ে দেন দেশোত্তর সময়ের মুখোমুখি। নদী এসে মিলে যায় সমুদ্রে। কোনো ঐতিহ্য নয়, তখন তিনি চান প্রবহমান বিশ্বকালকে তাঁর মধ্যে বহন করতে, আর দুইয়ের নিরন্তর সংঘর্ষ থেকে দেখা দিতে থাকে আজকের দিনের আধুনিকতা। কবি কখনোই ভুলে যান না যে এক হাতে দেশোত্তর কাল ধারণ করবার মুহূর্তেও তিনি পা রেখে দাঁড়িয়ে আছেন অস্থির সমসময়ের সংকটের ওপর।এই যে সময় এই যে কাল প্রতিমুহূর্তে ব্যক্তিসত্তাকে ক্ষুদ্র করে খণ্ড করে দিতে চাইছে তারই একটা প্রতীক হিসেবে পাই তাঁরআয়নাকবিতাটি

 

আয়নায় আমার মুখ?   দু-আনার উদগ্রীব সেলুনে

আয়নায় আমার মুখ?   করোটি পর্যন্ত দেখা যায়।

পাড়ার ছেলেরা তবে যা নিয়ে ডুগডুগি বাজায়

সেও কি আমার মুখ?   তবে কেন আগেই এলি নে?

এখন জড়িয়ে দিলি বহুজনে মোছানো তোয়ালে

সামনের উদ্যত ক্ষুরে নাচে চিকন চিৎকার।

 

কবিতার জন্ম নিয়ে কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছেন, ‘আমাদের একটা ব্যক্তিগত সত্য আছে , সমাজের সত্য আছে, গোটা জীবনেরও কোনো সত্য প্রচ্ছন্ন আছে কোথাও। তিনদিক থেকে এসে কোনো এক বিন্দুতে এদের সংঘর্ষ হয় একটা, আর সেটাই হয়ে ওঠে কবিতার সত্যের মুহূর্ত। যোগ্য কোনো ভাষা যদি হঠাৎ ছুঁতে পারে সেই মুহূর্তটিকে, একবার কিংবা বারে বারে, তার থেকেই তবে জন্ম নিতে পারে সত্যিকারের কবিতা।’  তিনি মনে করতেন, সমাজ যদি মৌন হয়ে যায় তাহলে কবিতার অধিকার আছে তার মুখে ভাষা জুগিয়ে দেওয়ার। তাই হয়তো তিনি লিখে ফেলেন

 

প্রতিদিনই মনে হয় কিছু একটা ঘটতে চলেছে।

যা ছিল, ঠিক সেইরকম নয়

যা হবে, তা খুব অন্যরকম।

হঠাৎ সেই অন্যরকমের মুখোমুখি হব আমরা আজ।

নীলাভ একটা আলো থাকবে তার

কল্লোলের ওপার থেকে ভেসে আসা স্তব্ধ কোনো স্বর

সেই স্বর যার স্পর্শসুখ আছে

যার আছে তরঙ্গভঙ্গিল যাওয়া আসা।

কিন্তু

দিনগুলি

আগের আগের দিন থেকে আরো বেশি খর্ব হতে হতে

নিজেকে নিজের মধ্যে খেয়ে নিতে নিতে

চিহ্নহীন হয়ে যেতে যেতে

আমাকেই প্রশ্ন করে যায়;

তুমি কর্তা? না কি অন্য কারো

ক্রিয়াকর্ম তুমি?


যখন সমাজ প্রতিবাদ করতে ভুলে যায় তখন কি কবিতা এভাবেই প্রশ্ন তুলে জাগাবে না, মানুষকে? প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে যে আমি আছে তাকে তো জাগতে হবে, বলতে হবে কোনটা আমার অধিকার! অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, অধিকার কেড়ে নিতে হয় --- সত্যটি যে তবে মিথ্যে হয়ে যাবে। হয়তো তাই সমাজেরও একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিলো যে, আত্মমর্যাদাহীন সমাজকে তিনি পথনির্দেশ করবেন। আর, সমকালীন বঙ্গসমাজ কবন্ধের মতো, মতাদর্শহীন, সহজিয়া সাধনায় অভ্যস্ত, এই জেনে শ্রদ্ধেয় কবি শঙ্খ ঘোষ বারে বারে মিছিলের মুখ হয়ে উঠলেন। জনবোধ্য সুগম শব্দাবলী প্রণয়ন করা তাঁর কর্তব্য হয়ে দাঁড়ালো। তিনি সমাজের জন্য, সময়ের জন্য, আমাদের জন্য অকাতরে সানন্দে জীবনের সেরা অনেক প্রহর দিয়ে গেলেন। যদিও তিনি নিজের সঙ্গে কথা বলার সময় লিখে ফেলেন

 

হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয়

সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয়

কথা খুব সহজ, কিন্তু কে না জানে

সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়।

 

পায়ের ভিতর মাতাল, আমার পায়ের নীচে

মাতাল, এই মদের কাছে সবাই ঋণী

ঝলমলে ঘোর দুপুরবেলাও সঙ্গে থাকে

হাঁকরা ওই গঙ্গাতীরের চণ্ডালিনী।

 

সেই সনাতন ভরসাহীনা অশ্রুহীনা

তুমিই আমার সব সময়ের সঙ্গিনী না?

তুমি আমায় সুখ দেবে তা সহজ নয়

তুমি আমায় দুঃখ দেবে সহজ নয়। 

 

(সঙ্গিনী, ‘মূর্খ বড় সামাজিক নয়’)

 

আনন্দের এমনই গভীর উপলব্ধি যেহাঁ-করা ওই গঙ্গাতীরের চণ্ডালিনীকিংবাসনাতন ভরসাহীনা অশ্রুহীনাকিংবা এই সঙ্গিনী কেউই আর তাঁকে সুখদুঃখ দিতে পারেন না সহজেই।

 

 

কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর বলেছিলেন, ‘সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর।এই বিস্তর কথাকে সংহত করার শিক্ষা নিজের স্বভাবসুলভতা এবং সৃজনবিশ্বের মধ্যে সংযত, সংহত সমীহতায় ধারণ করেছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। এমন একজন কবিমানুষ আমাদের মধ্যে ছিলেন, আমাদের মনপ্রাণজুড়ে। তিনি চলে গেলেন। এই কবি প্রতিভাকে  আমার শ্রদ্ধা আর প্রণাম।


Comments