নিবন্ধ - রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

 

যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার কবিকন্ঠ


কাব্য-আলোচকদের মতে বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম যুদ্ধ বিরোধী কবিতা লেখেন গ্রিসের মহাকবি হোমার। তার অনেক শতাব্দী পরে ভারতে যাঁর কন্ঠে যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হল তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ।  ১৯৩৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর নানকিং শহরের পতন ঘটে এবং জাপানী সৈন্যদের হাতে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায়। এর বিরুদ্ধে ২৫ ডিসেম্বর সোচ্চার হল কবির কলম। তিনি লিখলেন প্রান্তিকের সেই বিখ্যাত কবিতা - 'নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস'। ইটালী যখন অবিসিনিয়া আক্রমণ করল, কবি লিখলেন 'আফ্রিকা' কবিতাটি। বাংলা কবিতাটির ইংরেজী অনুবাদ করে তিনি পাঠিয়ে দিলেন লন্ডনে অমিয় চক্রবর্তীর কাছে।  যুদ্ধে নিহত কবি উইলফ্রেড আওয়েনের পকেটবই থেকে পাওয়া গেছে ইংরেজি অনুবাদে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির কবিতার লাইন - "When I leave, let these be my parting words: what my eyes have seen, what my life received, are unsurpassable.' কবির শোকাতুরা জননী সে কথা রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন।


যুগে যুগে যুদ্ধের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন কত কবি - আর্তুর র‍্যাঁবো থেকে শুরু করে বের্ল্টোল্ট ব্রেশট, সিগফ্রায়েড স্যাসুন থেকে উইলফ্রেড আওয়েন। লেখা হয়েছে বহু অবিস্মরণীয় যুদ্ধ-বিরোধী কবিতা - যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দশকে লেখা রুপার্ট ব্রুকের 'The Soldier', জন ম্যাকক্রির 'In Flanders Field', সিগফ্রায়েড স্যাসুনের 'Christ and the Soldier', উইলফ্রেড আওয়েনের 'Anthem for Doomed Youth'। আসলে যে প্রশ্নটা দেশ-কাল নির্বিশেষে বরাবরই কবিদের ভাবিয়েছে সেটা হল - "যুদ্ধ কেন হয়?" এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে সকলেই যুদ্ধের অসারতার প্রতি  আঙুল তুলেছেন।


যে সময়ের কথা বলছি সেটা একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক। আমেরিকার সঙ্গে ইরাকের বিরোধ তখন তুঙ্গে। যুদ্ধ বিশেষজ্ঞরা অনেকেই মনে করছিলেন আমেরিকার জর্জ বুশ প্রশাসন ভিতরে ভিতরে ইরাক আক্রমণের জন্য প্রস্তত হচ্ছে। ঠিক সেই সময়েই আমেরিকার ফার্স্ট লেডি সে দেশের অগ্রগণ্য কবিদের ২০০৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী হোয়াইট হাউসে এক চা চক্রে আমন্ত্রণ জানালেন। অবশ্য অনুষ্ঠানটির পোশাকি নাম ছিল 'Poetry and the voice of America'। 


মোটামুটিভাবে সেই সব কবিদেরই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল যাঁরা ছিলেন তৎকালীন জর্জ বুশ প্রশাসনের পছন্দের লোক এবং সরকারী নীতির সমর্থক। কিন্তু নিমন্ত্রিতদের তালিকায় একজন  কবি ছিলেন ব্যতিক্রমী চরিত্রের। তাঁর নাম স্যাম হ্যামিল। তিনি বুঝেছিলেন যুদ্ধ বিরোধী আওয়াজ তোলার এই হল মোক্ষম সুযোগ। কিন্ত কী করে তা করা যায়? হ্যামিল ভেবেচিন্তে একটা রাস্তা খু্ঁজে বের করলেন, প্রতিবাদের পন্থা হিসেবে যা বেশ অভিনব। তিনি কবিদের আহ্বান জানালেন ই-মেলে যুদ্ধ-বিরোধী কবিতা পাঠানোর জন্য। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কবিরা ই-মেলে যুদ্ধের বিরুদ্ধে কবিতা পাঠাতে লাগলেন। এভাবে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ১৩০০০-এর বেশি কবি তাঁদের কবিতা পাঠালেন। 


কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আমেরিকার এই আন্দোলন ফুলে-ফেঁপে উঠে আন্তর্জাতিক ঘটনায় রূপ নিল। এই ঘটনায় হোয়াইট হাউস কর্তৃপক্ষের কপালে ভাঁজ পড়ল। তাঁরা বুঝলেন ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অতএব সেই অনুষ্ঠান ও চা চক্র বাতিল হল। কিন্তু কবিদের কী আর এ ভাবে থামানো যায়! ততদিনে আন্দোলন গতি পেয়ে গেছে। নির্ধারিত দিন ১২ ফেব্রুয়ারী হোয়াইট হাউসের সামনে  বহু কবি-লেখক জড়ো হলেন। পড়া হল একের পর এক যুদ্ধ বিরোধী কবিতা।  স্যাম হ্যামিল, অ্যান্ড্রু হিমেস ও এমিলি ওয়ার্ন তৈরি করলেন কবিদের সংগঠন - 'Poets Against the War'। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন অসংখ্য কবি।  তারপর বাকিটা ইতিহাস।


যুদ্ধের বিরুদ্ধে কবিদের এই আন্দোলনের অনুপ্রেরণায়  ২০০৪ সালে তৈরি হয়েছিল একটি ডকুমেন্টারী ছবি - 'Voices in Wartime'। আরও কয়েক বছর পরে ২০১০ সালে এই সংগঠনের ওয়েবসাইটে জমে থাকা কবিতাগুলি আর্কাইভ করে রাখা হয়। যুদ্ধের বিরুদ্ধে কবিদের এভাবে একযোগে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠা ইতিহাসে স্হান পেয়েছে। এই প্রসঙ্গে যুদ্ধ-বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা স্যাম হ্যামিল যেন আধুনিক কবির মনের কথাটি বলেছেন - "Poetry transcends the nation-state. Poetry transcends government. It brings the traditional concept of power to its knees. I have always believed poetry to be an eternal conversation in which the ancient poets remain contemporary, a conversation inviting us into other languages and cultures even as poetry transcends language and culture, returning us again and again to primal rhythms and sounds.

Comments