গল্প - দেবাশিস দেব


বারুদের গন্ধ


এক

 

হঠাৎই ঠিক হয়ে যায় বিয়েটা। অবশ্য খাদিজার মাথায় যে চিন্তাটা ঘুরছিল না তাও নয়। ঘুরছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। তবে কারণটা অন্য। একদিন হঠাৎ চোখে পড়ে গিয়েছিল প্রস্ফুটিত পদ্মের মত ফেলানির উন্মুক্ত বুকদুটো। পনের বছরের মেয়ের জন্যে একটু বড়ই বটে। সাঁঝের বেলা খালি ঘরে ভাঙ্গা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের বুক দেখছিল ফেলানি। নিচু ছনের ঘর, রোদ চলে গেলে আলো বিশেষ ঢোকে না। ছোট জানালা দিয়ে আসা ওই আবছা আলোয় নিজেকে নিরীক্ষণ করছিল খাদিজার পনের বছরের মেয়েটা। উঠোনে গরু ছাগল গুলো ঘুরঘুর করছে। অসভ্য ছাগলটা লাদি ছেড়ে দিল মাঝখানে। একটু আগেই উঠোনটা ঝাঁট দিয়ে খাদিজা সাফ করেছে একবার। ফেলানি! কোথায় তুই? এগুলোকে গোয়ালে ঢোকা, খাদিজা চেঁচিয়ে বলল। কিন্তু ফেলানির কোন সাড়াশব্দ নেই। কোথায় গেলি? বলতে বলতে ঘরে ঢুকতেই থমকে গিয়েছিল খাদিজা। বুকের কাপড় সরিয়ে হাঁ করে নিজের স্তনের দিকে তাকিয়ে আছে ফেলানি। হাত বুলোচ্ছে। অসভ্য মেয়ে! খাদিজার ইচ্ছে হচ্ছিল চুলের মুঠি ধরে মেয়েটাকে আগাপাশতলা ঝাঁটাপেটা করেকিন্তু খাদিজা কেন কেজানে চুপ মেরে গেল। সরে গিয়ে চিলের মত কানফাটান গলায় চেঁচিয়ে বলল, ফেলানি, ওই পোড়ারমুখী, গরু ছাগল গুলোকে গোয়ালে তুলে দে।

 

এরপর হাট থেকে একজোড়া ব্লাউজ কিনে দিয়েছে মেয়েকে। উদলা গায়ে আর থাকা যাবে না। সঙ্গে একটা ব্রা, যদিও সেটা  সবসময় পড়ার জন্য না, তুলে রাখা আছে। ঈদে পরবে। অথবা অন্য কোন সময় পরবে। রথের মেলা বা দুর্গাপূজায়, যখন মেয়েরা নূতন কাপড়জামা পরে, চোখে কাজল দিয়ে দল বেঁধে ঘুরতে বেরোয়। ক্লাস অবদি স্কুলে গেছে ফেলানি, তারপর আর পাঠায়নি খাদিজা। এত কাজ বাড়িতে, একা কি করে পারে? ডজন খানেক হাঁসমুরগি, গরু, ছাগল আর সঙ্গে দুটো বিচ্ছু ছেলে, কাসিম আর রহিম। আট বছরের যমজ। এরপর ইসমাইলের মাথায় কিভাবে যেন সুবুদ্ধি এসেছিল। সরকারি হাসপাতালে গিয়ে নাসবন্দি করে এসেছিল নিজের। পাশের দু ঘর ইসমাইলের দুই ভাইয়ের। সাকিব আর আকিব। কিন্তু ওই বাড়ির মরদগুলো কিছু করায়নি। নাসবন্দি করালে নাকি মরদাঙ্গি কমে যায়! যতসব বুজরুকি! ইসমাইলের যে কমেনি তা খাদিজা হলফ করে বলতে পারে। বছর বছর বাচ্চা হওয়ার পর রক্তশূন্য আমিনা আর সাকিনাকে নিয়ে খাদিজা গিয়েছিল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। নার্সদিদি সরকারী গাড়ি করে শহরে নিয়ে গিয়ে দূরবীন অপারেশন করিয়ে এনেছে। এনিয়ে অশান্তি হয়েছে কিন্তু খাদিজা বেপরোয়া। 

 

ইসমাইলের সাইকেল সারাইয়ের দোকান বাজারে। হাতের কাজ ভালো জানে। চত্বরের সবাই ইসমাইলের কাছেই সাইকেল সারায়। ওই দোকানেই একদিন সাকিবের সঙ্গে এসেছিল রকিবুল। সাকিব শহরে এক দালাল কোম্পানিতে কাজ করে। কি কাজ করে ইসমাইল জানে না কিন্তু মেলা লোককে চেনে। চা খেতে খেতে দাদাকে বলেছিল ফিসফিস করে, একটা পাত্র হাতে আছে, দেবে নাকি তোমার ফেলানিকে?

হাতের কাজটা রেখে দিয়ে ভুরু কুঁচকে ইসমাইল বলেছিল, কে সেটা

ওই যে চা খাচ্ছে, আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছিল সাকিব। 

মাঝারি উচ্চতার বেশ শক্তপোক্ত চেহারার লোকটি। বয়স তিরিশের কাছাকাছি হবে। কুৎসিত নয় আবার সুদর্শন নয়। তবে মেয়ের জন্য কোন রাজপুত্র আশা করেনা ইসমাইল। চায়ের ভাঁড় ফেলে দিয়ে বিড়ি ধরাচ্ছিল লোকটা। 

কি করে? কোথায় থাকে? ইসমাইল জিজ্ঞেস করেছিল যদিও লোকটিকে ভাবী জামাই বলে ভাবতে ওর ইচ্ছে করছিল না। 

বিজনেস করে কাপড়ের। ঢাকায় থাকে। 

ঢাকা? সে তো বিদেশ। 

তো কি হয়েছে? নিজের জাতের লোক, টাকা পয়সা আছে, স্বাস্থ্য খারাপ না। আর এদিকে ফেলানিও বড় হয়ে গেছে। বিয়ে দিতে হবে, বাড়িতে আর কতদিন বসিয়ে রাখবে? সাকিব দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল।

 

বয়সে একটু বেশি হয়ে যাবে না? ফেলানি মাত্র পনের। ইসমাইল মুখ ঘুরিয়ে আরেকবার লোকটার দিকে তাকায়। বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে পায়চারি করছে। পরনে শার্ট প্যান্ট, পায়ে কালো জুতো, কব্জিতে চকচকে ঘড়ি। ইসমাইলের মনে হল সাকিব ওকে বলেই এনেছে। 

আচ্ছা, আজ রাতে খাদিজার সাথে কথা বলে দেখি, ইসমাইল বলল।

রকিবুল বিকেলে চলে যাবে শহরে। ওখানে হোটেলে উঠেছে। দু এক দিন আছে এখানে। রাজি থাকলে জানিও, আমি কথা বলব। 

রাতে বারান্দায় বসে বিড়ি টানতে টানতে খাদিজাকে বলল, একটা সম্বন্ধ এসেছে ফেলানির জন্য। 

তাই নাকি? খাদিজা চোখ বড় করে জিজ্ঞেস করল। কি করে ছেলেটা? বাড়ি কোথায়?

নাম রকিবুল, থাকে ঢাকায়। 

ঢাকা শুনে খাদিজা দমে গেল। সে তো বিদেশ, ওখানে বিয়ে দিলে মেয়েটা পর হয়ে যাবে না?

 

কিছুটা তো বটেই, মাথা চুলকে ইসমাইল বলল। বিদেশ যেতে পাসপোর্ট, ভিসা করতে হয়। সে অনেক ঝামেলার ব্যাপার, অনেক টাকা লাগে। আমাদের এই ছোট শহরেও হবে না, অনেক দূরে বড় শহরে যেতে হবে। শুধু একবার না, প্রতিবার। এত ঝামেলা করে ওই বা কতবার আসতে পারবে? আর আমরা কোনদিনই ওকে দেখতে যেতে পারব না।

 

তাহলে কি না বলে দেব? ইসমাইল বউয়ের দিকে তাকাল। মনে মনে চাইছিল খাদিজা না করে দিক। কেন যে জানে ইসমাইলের মন চাইছিল না মত দিতে। বিদেশ-বিভূঁই বলে কথা। অনেককাল আগে - সে প্রায় সাত দশক হতে চলল - ইসমাইলের আব্বু রহমত মিয়া এদেশে চলে এসেছিল। তখনও ইসমাইলের জন্ম হয়নি, বাবার কাছে ইসমাইল গল্প শুনেছে। পড়শিরা বলেছিলভুল করছ রহমত মিয়াঁ, ওটা হিঁদুদের দেশ, যেওনা। একদিন ফিরে আসতে হবে মুখ কালা করে। রহমত শোনেনি। আর কেনই বা শুনবে? মোছলমানের দেশ বলে কি দিয়েছে পাকিস্তান? দু'মুঠো দুবেলা পেট ভরে খেতেও দেয়নি। রহমত শুনেছে দেশে আসামে অনেক জমি পড়ে আছে। নদীনালা, জল, বৃষ্টি অফুরন্ত। ওখানে গেলে ওদেশের সরকার জমির পাট্টা করে দিচ্ছে। সেই রহমত ময়মনসিংহ ছেড়ে এদেশে চলে এসেছিল। নতুন ভাষা শিখে নিয়েছিল, অনর্গল বলতে পারত। তখন থেকে এটাই ওদের দেশ বলে মেনে নিয়েছিল রহমত। ইসমাইল এদেশেই জন্মেছে। কাগজপত্র সব আছে। কিন্তু তবুও শান্তি নেই। কিছুদিন পরপর সরকারের বাই ওঠে। বাড়ি বাড়ি লোক পাঠায়। এই দেখাও সেই দেখাও, কবে এসেছ পাকিস্তান থেকে? দিন ধরে আবার শোনা যাচ্ছে নতুন লিস্টি হবে। মাঝখানে একবার খুব গণ্ডগোল হল। সেও প্রায় চল্লিশ বছর হতে চলল। ইসমাইল তখন ছোট।বিদেশি তাড়াওআন্দোলন। তখন একদিন রহমত ট্রাঙ্ক খুলে দেখিয়েছিল ছেলেকে, এই দেখ কাগজপত্র, সব যত্ন করে রেখেছি। তুমিও রাখবে। কোনদিন দরকার পড়ে! ইসমাইল একদিন সব কাগজপত্র বের করে দেখেছিল। উনিশশো একান্ন সালের কাগজ, হলুদ হয়ে এসেছে। ওতে বলা আছে, রহমত মিয়াঁ, পিতা মরহুম ইস্কন্দর মিয়াঁ, গ্রাম পুরাদিয়া, জিলা ময়মনসিংহ, পূর্বপাকিস্তান এখন গ্রাম কচুখালি, জিলা গোয়ালপাড়া, আসামের স্থায়ী বাসিন্দা। একবার যে ইসমাইলের ইচ্ছে হয়নি ওই ময়মনসিংহে ফিরে যেতে তা নয়, কিন্তু কি হবে গিয়ে। আব্বু তো শিকড় শুদ্ধু তুলে নিয়ে এসেছিল। যে দেশের সঙ্গের নাড়ির টান কেটে গেছে সেখানে আবার নূতন করে সম্পর্ক করা কি ঠিক হবে

 

সাকিবভাইকে বল ছেলেটাকে নিয়ে আসতে বাড়িতে। একবার চোখে দেখলে ভাল বুঝতে পারব, খাদিজা বলেছিল।

 

সেই রকিবুল এল, হাতে করে মিষ্টির বাক্স, ফলমূল, একটা বরিশালি লুঙ্গি আর জামদানি শাড়ি। তারপর আর বেশি দেরি হয়নি। এক সপ্তাহের মধ্যেই তড়িঘড়ি করে নিকাহ হয়ে গেল। দুদিন বাদে রকিবুল ঢাকা চলে গেল, ওর ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে।   

 


দুই

 

 

রকিবুল চলে যাওয়ার প্রায় মাস হতে চলল। সে ফোনে যোগাযোগ রাখে কিন্তু ফেলানিকে নিয়ে যাবার কোন উদ্যোগ নেই। বেচারি ফেলানি! মাঝখানে তিন চার দিনের ধুমধাম ছাড়া ওর জীবনের কোন পরিবর্তন হয়নি। সেই বাড়ির কাজ, গরু ছাগলের যত্ন, দুটো বদমাইশ ছোট ভাইকে চোখে চোখে রাখাই যদি করতে হবে তাহলে আর নিকা কেন? এইসব ভেবে ফেলানির রাগ ওঠে, কিন্তু কাকে কি বলবে? এতদিন যেভাবে কাটছিল সেটা গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল কিন্তু হঠাৎ নিকা করিয়ে দিয়ে শরীরের ঘুমন্ত কামনাবাসনা গুলো জাগিয়ে দিয়ে পালিয়ে যাওয়া লোকটার ওপর প্রচণ্ড রাগ উঠেছিল ওর। মাসখানেক আগে রকিবুল ফোন করে বলেছিল, চেষ্টা করছি বিবি, কিন্তু রাস্তা পাচ্ছি না তোমাকে নিয়ে আসার? 

কেন?  

বেআইনি হয়ে গেছে কাজটা। মেয়েদের আঠেরো বছর না হলে বিয়ে দেওয়া যায় না। তোমাকে দেখে বুঝতে পারিনি যে তোমার মাত্র পনের।  

এখন তাহলে কি হবে? তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে?

দেখছি, কি করা যায়? জানাব। 


কিন্তু কিছু করেনি রকিবুল। মাঝখানে কানাঘুষো শুনতে পেয়েছিল, রকিবুল লোকটা নাকি সুবিধার নয়। অনেক গরিব মেয়েদের নাকি বিয়ে করে ঢাকা নিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে। একদিন সাকিব কে ডেকে পাঠিয়েছিল ইসমাইল। উঠোনে বসে অনেক সময় ধরে আলোচনার পর ঠিক হয়েছিল অন্য রাস্তা ধরা হবে। যেহেতু কাগজপত্র করে আইনিভাবে যেতে দেরি হচ্ছে তাই একটু বাঁকা পথেই এগোতে হবে। সাকিব বলে গেল লোকজন জানা আছে। হাজার তিনেক টাকা খরচ করলে ফেলানিকে ঢাকায় রকিবুলের বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে। 

কি করবি? খাদিজা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিল।

লন্ঠনের আলোয় মেয়েটার হতাশ মুখের দিকে তাকিয়ে খাদিজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল।

আমি আবার কি বলব? তোমরা নিকা দিয়েছ, তোমরা জানো, ফেলানি দেশলাইয়ের কাঠির মত ফস করে জ্বলে উঠে নিভে গিয়েছিল। 

এভাবে রাতের অন্ধকারে কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে যাওয়া নিরাপদ হবে? খাদিজার বুক কেঁপে উঠেছিল। বর্ডারে বিএসএফ বন্দুক হাতে পাহারা দেয়। কিভাবেই বা ওদের চোখে ধুলো দিয়ে ওপারে যাবে

সেই নিয়ে চিন্তা নেই। লোক যাচ্ছে আসছে রোজ, ইসমাইল বলল। সাকিব সব বন্দোবস্ত করে দেবে। আমি ভাবছি সঙ্গে যাব। এই সুযোগে একবার ময়মনসিংহ দেখে আসবো। বাপদাদার জন্মস্থান একবার না দেখলে জীবনটা বৃথা। 

পরের সপ্তাহে মাঝরাতে ইসমাইল ফেলানির হাত ধরে বেরোল। বড় রাস্তায় আলো নিভিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। ওরা কাছে আসতেই একজন সিরিঙ্গে চেহারার লোক এগিয়ে এল।

ইসমাইল ভাই? অন্ধকারের মধ্যে লোকটার ধূর্ত শেয়ালের মত চোখ দুটো দেখতে পাচ্ছিল ফেলানি।

ইসমাইল মাথা নাড়ল। 

সেলাম আলেকুম, আমি ইরফান। সাকিবভাই আমার সাথেই কথা বলেছিল।

আলেকুম সেলাম, ইরফান ভাই! কোন ভয় নেই তো

আরে প্রতি সপ্তাহে তিন চার জন আমার হাত দিয়ে এপারওপার করে। ওপারে আমার লোক আছে, ফোন নম্বর দিয়ে দেব। ফোন করলেই এসে পৌঁছে দেবে

আচ্ছা।   

তোমরা দুজন পেছনে বস। আমি সামনে ড্রাইভারের সঙ্গে বসছি, ইরফান বসে গাড়ি স্টার্ট করতে বলল।  

আমরা কিন্তু দুজন যাচ্ছি, ইসমাইল বলল। আগে একজনের কথা হয়েছিল। 

কোন অসুবিধা নেই। টাকাটা এখনি দিয়ে দাও তাহলে। দুজনের হাজার হয়, তুমি পাঁচশ কম দিতে পার। সাকিবভাইএর জন্য এইটুকু করতেই পারি।  

 

দু ঘণ্টা পর ওরা বর্ডারের কাছে এসে গেল। বড় রাস্তায় গাড়ি থেমে গেল। রাস্তা থেকে নেমে ধানক্ষেতের আল ধরে হাঁটতে হবে আধঘণ্টা। 

ফেলানি সালোয়ার কামিজ পরেছে। চলাফেরায় সুবিধা হবে। নীল রঙের কামিজ আর গোলাপি রঙের সালোয়ার, সঙ্গে গোলাপি ওড়না। ওড়নাদিয়ে মাথাটা ঢাকা। হাতে একটা ব্যাগ, ওতে দুটো শাড়ি ব্লাউজ, আর মেয়েলি টুকিটাকি। ইরফান টাকা গুনে নিয়ে বলল আমার লোক একটা লম্বা সিঁড়ি নিয়ে আসবে। তোমরা ওই সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাবে, ওদিকেও লোক আছে, ওরা নামিয়ে নেবে। শুধু তাড়াতাড়ি কাজ টা সারতে হবে। অনেক সময় পাবে, তাড়াহুড়ো করতে হবে না। বিএসএফ আর বিডিআরের লোকেরা সব জানে, শুধু সামনাসামনি যেন না হয়।

ইসমাইল মাথা নাড়াল। 

আল্লা হাফিজ ইসমাইল ভাই, ইরফান পেছন ফিরে গাড়িতে উঠে পড়ল। 

 

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আকাশে শেষরাতের মরা চাঁদ। বাতাসে একটা সোঁদা গন্ধ। ইসমাইল আগে ফেলানি পেছনে হেঁটে চলেছে। একটু বাদে কাঁটাতারের বেড়া দেখা গেল। দুটো ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে ওদের অপেক্ষায়। সামনে আসতেই পাশের ঝোপ থেকে একটা লম্বা বাঁশের মই নিয়ে এল ওরা। টপাটপ  দাঁড় করিয়ে ওদের ইশারায় ডাকল। ইসমাইল চটপট মই বেয়ে উঠে গেল, ওপারে পৌঁছতেই ওদিক থেকে দুটো ছায়ামূর্তি অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় নামিয়ে নিল মইটা। ঝোপের আড়ালে থেকে ফেলানি দেখল এবার ওপার থেকে একজন এপারে আসছে। তাহলে এবার ওর পালা। লোকটা নেমে যেতে ফেলানি মইয়ে ওঠা শুরু করল। আকাশ একটু পরিষ্কার হওয়া শুরু হয়েছে। মইয়ের মাথায় উঠে ফেলানি একবার শেষবারের মত ঘুরে তাকাল। নিজের দেশ ছেড়ে যাচ্ছে ফেলানি, আর কবে আসবে কে জানে! ঠিক তক্ষুনি তীব্র টর্চের আলো ওর চোখে পড়ল। চোখ ধাঁধিয়ে গেল ফেলানির। একটা পা মই থেকে ফসকে গেল আচমকা। পড়ে যেতে যেতে কাঁটাতারে আটকে গেল ফেলানির কামিজ। বড়শিতে গাঁথা মাছের মত ঝুলতে লাগল ফেলানি। আতংকে চিৎকার দিল ফেলানি, আব্বু বাঁচাও

 

ইসমাইল নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে দেখছিল। যদিও অন্ধকারে দেখা যাচ্ছিল না বিশেষ কিছু। কিন্তু হঠাৎ অন্ধকার নৈঃশব্দ্য খানখান করে ফেলানির চিৎকারে ওর বুকের ভেতরটা ছাঁৎ করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গেই  বিএসএফের সার্চলাইটের আলোয় ভেসে উঠল কাঁটাতারের বেড়া। ইসমাইল দেখল ওর মেয়েটা কাঁটাতার থেকে ঝুলছে। দিকবিদিকশূন্য হয়ে ইসমাইল ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করতেই একজন ছায়ামূর্তি ওর মুখ চেপে ধরে মাটিতে ফেলে দিল। মাটিতে শুয়ে থেকে ইসমাইল শুনতে পেল বন্দুকের গুলির আওয়াজ। পরপর অনেকগুলো। ফেলানির চিৎকার তখন থেমে গেছে। বাতাসে তখন বারুদ আর টাটকা রক্তের গন্ধ।

Comments

  1. মানব জীবনের সকরুণ প্রতিচ্ছবি ৷ পড়তে পড়তে বুকটা যন্ত্রণায় ভরে উঠলো ৷.... এমন অনেক ফেলানির স্বপ্ন এভাবে নিঃশব্দে হারিয়ে যায়, কেউ খোঁজ রাখে না! খুব ভালো একটা লেখা পড়লাম ৷

    ReplyDelete

Post a Comment