নিবন্ধ - সুতপা সাহা



স্বপ্নের হরেকরকম


              
ছোটোবেলা থেকে নিয়ে আজ অব্দি দুটো স্বপ্ন আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। একটি হল প্রচুর জলরাশি, যেন গ্রাস করে ফেলছে, দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং আরেকটি হল পরীক্ষা, সবাই লিখে খাতা জমা দিয়ে ফেলেছে কিন্তু আমার কলম যেন আটকে গেছে, একচুলও নড়ছে না। দুটো স্বপ্ন থেকেই আমার ঘুম ভাঙ্গে অসম্ভব ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে, আজও। ফ্রয়েডবাবু হয়তো  বলবেন স্বপ্ন মূলত মানুষের গোপন আকাঙ্ক্ষা এবং আবেগের প্রকাশ। কিন্তু জলে ডুবে মরা কিংবা পরীক্ষায় ফেল করা কোনোটাই আমার গোপন আকাঙ্ক্ষার বা আবেগের মধ্যে পড়ে না। অতএব এর কোনো সঠিক ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। তবে ফ্রয়েডবাবুও এইধরণের একটি স্বপ্ন নিজেও দেখেছিলেন তাঁর জীবদ্দশায়, তাঁরই জবানবন্দীতে, "আমার গায়ে ঠিকমত কাপড়চোপড় ছিল না। নীচতলার ফ্ল্যাট থেকে সিঁড়ি বেয়ে আমি উপরের ফ্ল্যাটে যাচ্ছিলাম। উপরে ওঠার সময় আমি একেকবারে তিনটে করে সিঁড়ির ধাপ টপকাচ্ছিলাম। এত দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পেরে আমি খুবই খুশি। হঠাৎ খেয়াল করলাম, একটা কাজের মেয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে নীচে নামছে, অর্থাৎ আমার দিকে। আমি খুব লজ্জা পেলাম, এবং তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু এরপরই আমার মনে হলো আমি যেন থমকে গেছি, আমি যে আঠার মতো আটকে আছি সিঁড়ির সঙ্গে, সেখান থেকে নড়ার শক্তি আমার নেই"। তবে  ফ্রয়েড  এখানে যেভাবে তাঁর স্বপ্নের অবিকল বর্ণনাকে অর্থাৎ স্বপ্নে দেখা যৌনতা এবং সংঘাতকে অবচেতন মনের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখিয়েছেন, সেটা অনেক পাঠক অবশ্য শেষ পর্যন্ত  মেনে নিতে পারেননি।


স্বপ্নবিষয়ে ফ্রয়েডের প্রথম প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনার নাম ছিল, দ্য ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমস।  মানুষ ঘুমের মধ্যে যে স্বপ্ন দেখে, তার ব্যাখ্যা। ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল এই বই। এখানে তিনি বলেন, স্বপ্ন হচ্ছে মানুষের অবচেতন মনের গভীরে যাওয়ার রাস্তা। অবচেতন মনে যা ঘটে তার প্রতিফলন হচ্ছে স্বপ্ন।


তবে এটা ঠিক যে সেই আদিকাল থেকেই স্বপ্নের ব্যাখ্যার একটা প্রচেষ্টা আজও জারি রয়েছে। তবে বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন যে স্বপ্ন হচ্ছে মানুষের এমন এক মানসিক অবস্থা যাতে ঘুমের মধ্যে অবচেতনভাবে অনুভব করা যায় কিছু ঘটনা। সেইসব ঘটনা কাল্পনিক হলেও স্বপ্ন দেখার সময় সত্যি বলে মনে হয়। পুরানো অভিজ্ঞতার টুকরো টুকরো স্মৃতি (সম্ভব বা অসম্ভব) সব স্বপ্নের ঘটনার রূপ নেয়। 


অ্যালবার্ট  আইনস্টাইন কিশোর বয়সে একদিন একটা স্বপ্ন দেখেছিলেন।  একটা মাঠের মধ্যে দিয়ে তিনি হেঁটে যাচ্ছেন আর সেই মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে পালে পালে গরু। সামনেই একটা বিশাল বড় তার‚ যেমন থাকে কাঁটাতারের বেড়া সেইরকম। কিন্তু এই তার আবার বৈদ্যুতিক তার। গরুগুলো এগিয়ে আসছে তারের দিকে। তারের পেছনে দাঁড়িয়ে আইনস্টাইন আর তারের অন্য পারে গরুদের মালিক‚ এক কৃষক। হঠাৎ কি যে মাথায় আসল কৃষকের, দুম করে টিপে দিল সুইচ‚ বিদ্যুত বয়ে গেল তারের মধ্যে দিয়ে আর সব গরু গুলো একই সাথে ঝটকা খেয়ে পিছিয়ে চলে এল। অনেকটা synchronised aerobatics  যেমন হয়। কিন্তু স্বপ্নের মধ্যেই আইনস্টাইনের মনে হল উনি যা দেখলেন সেই কৃষক সেটা দেখেন নি। কৃষকের চোখে একেকটা গরু একসাথে নয়, একের পর এক করে পরপর ঝটকা খেয়েছে। মানে একটা গরু উঠছে পড়ছে‚ তার পরে আর একটা গরু, এই রকমভাবে। কোনো ফুটবল খেলাতে স্টেডিয়ামে  লোকে যেমন ওয়েভ বানায় সেইরকম। আইনস্টাইনের মনে হল ঐ ওয়েভ ফর্মেশন দেখবে বলেই কৃষক গরুগুলোকে শক দিল। এবারে তো স্বপ্ন ভেঙে গেল। অন্য কেউ হলে ধুরছাই কি দেখেছি বলে কাটিয়ে দিত‚ ফ্রয়েডবাবু হলে ভাবতে শুরু করে দিতেন নিশ্চয়ই আমার মনে মনে প্রচুর গরুর মাংস খাওয়ার শখ তাই এমনটা দেখেছি। কিন্তু আইনস্টাইন তো আইনস্টাইন। উনি সবকিছুতেই ফিজিক্স দেখতেন‚ উনি ভাবলেন এ স্বপ্ন যখন দেখেছি এরমধ্যে নিশ্চয়ই কোনো ফিজিক্সের প্রবলেম আছে যেটা আমাকে সমাধান করতে হবে আর এই ভাবেই তৈরী হয়ে গেল Theory of Relativity। যেহেতু উনি এবং কৃষকটি বস্তু অর্থাৎ গরু থেকে ভিন্ন দূরত্বে‚ তাই আলো এসে পৌঁছবে ভিন্ন সময়ে এবং এইজন্য হতেই পারে যে দুজনে একই জিনিস দেখবেন না।


বিজ্ঞানের ইতিহাসে এরকম স্বপ্ন নিয়ে বেশ কিছু মজার ঘটনা আছে।

রসায়নের মূল ভিত্তি পর্যায় সারণীর উদ্ভাবন ঘটেছিলো স্বপ্নের মধ্য দিয়ে। দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্ডেলিফ একদিন পর্যায় সারণী নিয়ে গবেষণা করতে করতে ডেস্কেই ঘুমিয়ে যান এবং স্বপ্নে দেখতে পান মৌলগুলোর বিন্যাস কৌশল। ঘুম ভাঙ্গার পর তিনি একটি কাগজে তা লিখে ফেলেন এবং পরবর্তী সময়ে এর সংশোধিত রূপই হচ্ছে আজকের পর্যায় সারণী। এ নিয়ে মেন্ডেলিফ বলেছিলেন,

"স্বপ্নে আমি দেখলাম একটা ছকে সবগুলো উপাদান জায়গামতো বসে যাচ্ছে এবং ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথেই আমি একটি কাগজে তা লিখে ফেললাম।"


শুধু এই ঘটনাই নয়, জৈব রসায়নের বেনজিন চক্রও এসেছিলো এমনই একটি স্বপ্নের পথ ধরে। বেনজিন চক্রের বিন্যাস নিয়ে বিজ্ঞানীরা যখন ভীষণ চিন্তিত, ১৮৬৫ সালে বিজ্ঞানী অগাস্ট কালকুলেল গবেষণার এক পর্যায়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন এবং স্বপ্নে দেখতে পান একটি লম্বা সাপ চক্রাকারে ঘুরছে ও নিজের লেজ খেয়ে ফেলছে, সাপটির দেহে তিনি দেখতে পান কার্বন ও হাইড্রোজেনের সঠিক অনুপাত ও ঘুম ভাঙ্গার পর এই  সাপের এই চক্রাকার রূপ থেকেই বের করে ফেলেন বেনজিন চক্র।


রামানুজন আচার্যের কথা সবাই আমরা শুনেছি। একটু অদ্ভুত ধরণের গণিতবিদ ছিলেন এই রামানুজন, তিনি নাকি স্বপ্নে গণিতের নতুন নতুন সূত্র পেয়ে যেতেন! রামানুজন তার স্বপ্নপ্রাপ্ত সূত্র নিয়ে প্রায়ই বলতেন,


"ঘুমানোর সময় আমার অদ্ভূত এক অভিজ্ঞতা হয়। আমি দেখি রক্তে বয়ে যাওয়া লাল একটি পর্দা, যাতে হঠাৎ করেই একটি হাত এসে লিখতে শুরু করে। হাতটি উপবৃত্ত সম্পর্কিত কিছু সূত্রও লিখে ফেলে। জেগে ওঠার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি আর একটি  কাগজে তা লিখে ফেলি।"


প্রাচীন গ্রীক ও রোমানরা ভাবতেন, স্বপ্ন হচ্ছে মৃত ব্যক্তির কাছ থেকে সরাসরিভাবে প্রাপ্ত কোন বার্তা যা কিনা ভবিষ্যদ্বাণীও হতে পারে। 


চীনদেশের ইতিহাসেও স্বপ্ন নিয়ে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। চীনারা ভাবতো ঘুমালে আত্মা দেহকে ছেড়ে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে এবং এই ভ্রমণের দৃশ্যগুলোকেই বলা হয় স্বপ্ন।


উপনিষদে স্বপ্নের দুটো দিকের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। একদিকে স্বপ্নকে সুপ্ত আকাঙ্খার প্রকাশ বলে ব্যক্ত করা হয় এবং অন্যদিকে মানা হয় যে, ঘুমন্ত অবস্থায় আত্মা দেহকে পাহারা দেয় এবং এ থেকেই স্বপ্নদর্শন ঘটে। 


গ্রীক দার্শনিক হিপোক্রেটিস স্বপ্নের খুব সহজ-সরল একটি তত্ত্ব দিয়ে গেছেন - “ দিনের বেলা আত্মা বার্তা গ্রহণ করে ও রাতে তা থেকে দৃশ্য উৎপন্ন করা হয় ”। আরেক গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল বিশ্বাস করতেন, স্বপ্ন শারীরিক সমস্যা বা রোগ-বালাই এর পূর্বাভাস দিয়ে থাকে।


স্বপ্ন সম্বন্ধে অনেক দর্শন, বিজ্ঞান, কাহিনী ইত্যাদি আছে। মজার বিষয় হল, পেটে কোনও সমস্যা থাকলে বা উল্টো পাল্টা বেশি কিছু খেয়ে নিলেও স্বপ্নের মাত্রা বাড়তে পারে বলে ধারণা গবেষকদের। 


ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেন না, এমন মানুষ বোধহয় পৃথিবীতে নেই। আমাদের জীবনের ৩৩ শতাংশ সময় আমরা ঘুমিয়ে কাটাই। আসলে আমাদের ঘুমের মাঝেই রয়েছে তিনটি পর্যায়। দুঃস্বপ্নের মুহূর্ত হল র‌্যাপিড আই মুভমেন্ট অর্থাৎ ঘুমন্ত পর্যায়ের শেষ তৃতীয়াংশ। প্রথম পর্যায় হল স্লিপ অনসেট, দ্বিতীয় পর্যায় পড়ে লাইট স্লিপ, তারপর তৃতীয় এবং চতুর্থ পর্যায় নিয়ে হয় ডিপ স্লিপ বা র‌্যাপিড আই মুভমেন্ট স্টেজ। এই পর্যায়েই মূলত দুঃস্বপ্নগুলো দেখা হয়।


ক্যারল ওয়াশারম্যান  নামের এক গবেষক জানিয়েছেন যে, যে রাতে তিনি চিংড়ি মাছ দিয়ে ডিনার সারতেন, সেসব রাতেই তিনি ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের সময় পার করতেন। পরবর্তীতে তিনি চিংড়ি খাওয়া বন্ধ করে দেন এবং সে সব দুঃস্বপ্নের ইতি ঘটান। 


আমরা স্বপ্ন দেখি অবচেতন মনে, সেটা সত্যি হয়ে গেলে নিশ্চয়ই তা কাকতালীয় ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষ এখনো স্বপ্নের ব্যাখ্যা খুঁজতে বসে। অনেক বই আছে যেখানে স্বপ্নের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।  আশেপাশের কে কি স্বপ্ন দেখলো, তার প্রতিটির আলাদা ব্যাখ্যা অনেকে দিতে ভালোবাসেন। কারো সঙ্গে কোনো স্বপ্নের কিছু অংশ মিলে গেলেও ধরে নেওয়া হয় যে স্বপ্ন বোধহয় সত্যি হয়। কেউ বলে স্বপ্নে মাছ দেখাটা সৌভাগ্যের লক্ষণ। মাছ ধরলে নাকি অর্থপ্রাপ্তি হয়। কেউ বলেন স্বপ্নে গরু দেখা মানে হলো ধনসম্পত্তি লাভ। আর যদি মরা গরু দেখেন তাহলে সম্পদ হাতছাড়া হবে। জলে ডুবে যাওয়ার অর্থ বিপদগ্রস্ত হওয়ার আভাস। তবে বৃষ্টি হতে দেখা মানে নতুন কিছু পাওয়া বা আগমনের পূর্বাভাস। স্বপ্নে সাপ দেখার অর্থ হলো শত্রু বৃদ্ধি। দাঁত নড়তে দেখলে পন্ডিতব্যক্তি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়বেন। আর দাঁত পড়ে যাওয়া দেখলে পন্ডিত লোক কেউ মারা যাবেন। এরকম অসংখ্য ব্যাখ্যা রয়েছে। বিশ্বাস করবেন কিনা তা আপনার ওপর।


মৃত ব্যক্তিকে স্বপ্নে দেখলে এখনো ভিখিরি খাওয়ানোর রেওয়াজ রয়েছে। তাছাড়া মৃত ব্যক্তিকে স্বপ্নে দেখলে যে দেখে তার আয়ু বেড়ে যায়, এমন ধারণাও প্রচলিত রয়েছে। 


স্বপ্ন নিয়ে সর্বশেষ তথ্য যেটি জানা গিয়েছে, সেটি হল প্যানডেমিক ড্রিম।


মনে করুন আপাত  নিরীহ কাকের দল তাড়া করেছে খুদেদের। কিংবা আঁচড়ে-কামড়ে-ঠুকরে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে সকলকে। কি ভয়ংকর দৃশ্য বলুন তো। আলফ্রেড হিচককের ‘দ্য বার্ডস’-এর নাম করলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এরকম দৃশ্য। এ বার ভাবুন, যদি ওই কাকেদের মতো কোনও পতঙ্গের দল এগিয়ে আসত আপনার দিকে? বা অগুনতি আরশোলা চোখের সামনে হেঁটে বেড়াত? না, শিউরে ওঠার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, কারণ লকডাউনে পঙ্গপালের ঝাঁকের উড়ে এসে বসা আমাদের স্মৃতি থেকে একেবারেই মুছে যায় নি। যদিও তা আমরা অনেকেই প্রত্যক্ষ করি নি, তবে স্বপ্নে কিন্তু হচ্ছে আখছার। তেমনই দাবি হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের মনোবিদ প্রফেসর ব্যারেটের। তাঁর ব্যাখ্যা মানলে, এর নেপথ্যে রয়েছে বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণজনিত উদ্বেগ। এ হেন ‘বাগ ক্লাস্টার’ স্বপ্নের তাই নয়া নাম ‘প্যানডেমিক ড্রিম।’


বহু ক্ষেত্রে স্বপ্নের কথা মনেও থাকে না। তবে অনেক ক্ষেত্রে তা স্পষ্ট মনে থেকে যায়। এই তফাৎটা এখন মনে করিয়ে দিচ্ছে ঘুম, যার স্বাভাবিক ছন্দ এলোমেলা করে দিয়েছে করোনা। এক মার্কেটিং গবেষণা সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে সম্প্রতি ‘স্লিপ সাইকল’-এর উপর গবেষণা চালিয়েছিল লন্ডনের কিংস কলেজ। তাতে দেখা গিয়েছে, ব্রিটেনে প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে দু’জনই ঘুমে ব্যাঘাতের কথা জানিয়েছেন। গবেষক দলের ব্যাখ্যা, এই ব্যাঘাতের সঙ্গে করোনাজনিত স্ট্রেসের যোগসূত্র রয়েছে। কারণ ওই সমীক্ষাতেই উঠে এসেছে, বর্তমান পরিস্থিতিকে যাঁরা ‘স্ট্রেসফুল’ মনে করছেন, তাঁদের ৫৩ শতাংশের ঘুমে এখন ব্যাঘাত ঘটছে।


সাধারণ ভাবে  স্বপ্ন নিয়ে আমাদের চর্চার পরিধি দিগন্তবিস্তৃত। তার মধ্যে, ভবিষ্যতের আগাম সঙ্কেত (শুভ বা অশুভ, সে যা-ই হোক না কেন) হিসেবে স্বপ্নকে ব্যাখ্যা করার রীতি বহু পুরনো ও পরিচিত। কিন্তু বিষয়টি যে ভবিষ্যৎ নয়, বরং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অতীতের সঙ্গে খানিকটা হলেও জড়িত সে কথা কিন্তু প্রথম প্রকাশ্যে বলেছিলেন সিগমন্ড ফ্রয়েড। সহজ করে বললে, অবচেতন বা আনকনশাস অংশের চেপে-ঢেকে রাখা ইচ্ছা (যার সিংহভাগই অসামাজিক ও সে কারণেই সেগুলি সম্পর্কে সচেতন হলে সমূহ বিপদ), মনোজগতের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, ভুলে যাওয়া স্মৃতি ইত্যাদি নিয়েই তৈরি হয় স্বপ্ন। এ ক্ষেত্রে দু’টি নিয়মের কথা বলে গিয়েছিলেন ফ্রয়েড। এক, স্বপ্ন আসলে ছদ্মবেশী ফকিরের মতো। এমন ভাবে সেজেগুজে সে  সামনে আসে যাতে তার আসল, ভিতরের গল্পটা ঠাহরই করতে পারি না আমরা। দুই, যে তাড়না বা ইচ্ছা থেকে স্বপ্নের জন্ম, সেটি-ই আমাদের ড্রিমল্যান্ডে গুটিয়ে এত ছোট হয়ে যায় যে তাকে চেনাটা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।


একাংশের ধারণা, করোনার সময়ে তাঁরা স্বপ্নও অনেক বেশি দেখছেন। হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের  ব্যারেটের  ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ‘এখন ঘুমের সুযোগ ও সময় আমাদের কাছে অনেক বেশি। তাই স্বপ্নে কী দেখেছি, তা মনে করার হারও বেড়ে গিয়েছে। তবে সে জন্য স্বপ্ন দেখার মাঝেই জেগে ওঠা প্রয়োজন। করোনা-জনিত স্ট্রেসের কারণে সেটাই হচ্ছে। রাতে প্রায়ই ঘুম ভেঙে যাচ্ছে আমাদের।’ আপাতত, ২০০০ জনেরও বেশি মানুষের প্রায় চার হাজার ‘প্যানডেমিক ড্রিম’ বিশ্লেষণ করছেন তিনি। সে সূত্রেই জানালেন, ট্রমা বা বিপর্যয়ের সময়ে মানুষের স্বপ্নজগতের বিষয়বস্তুগুলির মধ্যে অনেক মিল পাওয়া যায়। তার মধ্যে কিছু বেশ চেনা, আশপাশের সঙ্গে তার মিল ধরা পড়ে সহজে। ব্যারেট এমন একাধিক স্বপ্নের হদিস পেয়েছেন, যেখানে বহু মানুষকে জ্বরে বা শ্বাসকষ্টে ভুগতে দেখা গেছে।  ব্যারেটের কথায়, অনেকে ভূমিকম্প দেখেছেন, অনেকে আবার জোয়ার বা টর্নেডোও দেখেছেন। অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণাতীত বিপর্যয়। তবে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বড় ড্রিম ক্লাস্টার পতঙ্গ বা পোকামাকড় নিয়েই দেখা গিয়েছে। কোথাও পতঙ্গ হামলা করেছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে, কোথাও আবার আরশোলার দল হেঁটে বেরিয়েছে চোখের সামনে। কেউ কেউ আবার কৃমির ঝাঁককে কিলবিল করতে দেখেছেন। মনোবিদের ব্যাখ্যা মানলে, এ সবই করোনাজনিত উদ্বেগের প্রকাশ, তবে ছদ্মবেশে। অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতি অনুযায়ী স্বপ্ন-সম্পর্কিত আরো নানা পর্যবেক্ষণ ও ব্যাখ্যা উঠে আসবে, এমনটা আশা করা বাতুলতা নয় বলেই মনে করি।


"গভীর ঘুমের স্বপ্নগুলি অন্যরকম হয়, স্বপ্ন আর স্বপ্ন থাকে না। বাস্তবের কাছাকাছি চলে যায়। হালকা ঘুমের স্বপ্নগুলি হয় হালকা, অস্পষ্ট কিছু লজিকবিহীন এলোমেলো স্বপ্ন। গাঢ় ঘুমের স্বপ্ন স্পষ্ট, যুক্তিনির্ভর।"        
                    হুমায়ূন আহমেদ।

Comments