গদ্য - শুভময় সরকার


"... নিশিথ রাতের বাদলধারা"!


সে ছিল এক আকাশভাঙ্গা বৃষ্টিদিনের কথা। মাটির সোঁদাগন্ধ পেরিয়ে, দিগন্ত থেকে উঠে আসা মেঘেদের গল্প ডিঙিয়ে, কালো হয়ে যাওয়া আকাশ দেখে ছুটতে ছুটতে বিরহীর রাস্তা ধরে বাড়ি ফেরার সন্ধেগুলো পেরিয়ে, ফুটবল মাঠের কাদাজলের ডজ কাটিয়ে হঠাৎ যেদিন যুবক হলাম, তখন রহস্যময় হয়ে উঠলো বৃষ্টির ফোঁটাগুলো, অনুভব করলাম প্রতিটি বৃষ্টিফোঁটাই আসলে একেকটা গল্প, প্রতিটি মেঘই আসলে বিষণ্ণতার আপাত ঘেরাটোপ, প্রতিটি বিদ্যুৎঝলকই কারো হেঁটে যাওয়া। হ্যাঁ, ঠিক সেদিনই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিল...! আমি ভিজেছিলাম, আমরা ভিজেছিলাম।


সেদিনই কি নেমেছিল বৃষ্টি, নাকি একটা যাপনজুড়েই চলেছে নিরন্তর এক বৃষ্টি ধারাপাত...! হয়তো সেটাই সত্যি, তবু সেদিন আকাশ ভেঙেই নেমেছিল বারিধারা। আমরা হেঁটেছিলাম অনেকটা পথ। কতোটা পথ হেঁটে, পথিক হয়ে পথের শেষ খুঁজেছিলাম  জানা নেই, হয়তোবা পথই সন্ধান করেছিল পথিকের, অপেক্ষায় ছিল আমাদের।


'তারপর যেতে যেতে যেতে এক নদীর সঙ্গে দেখা', কিংবা নদীটাই পথ হয়ে দেখা দিয়েছিল আমাদের!  তপ্ত গ্রীষ্মের দিনগুলো পেরিয়ে মাটি তখন গর্ভবতী। বাতাসে বারুদের গন্ধ নেই, স্নিগ্ধ চারপাশ, মানুষ শান্ত, প্রকৃতিও চরাচরজোড়া স্তব্ধতা নিয়ে অপেক্ষায়। এক অবিশ্রান্ত কথোপকথনের সেই তো শুরু - মানুষ, বৃষ্টি আর নদীর কথোপকথন...!


নদীর সঙ্গে কথোপকথন  নাকি নদী শুধুই শ্রোতা! গল্প কি একপাক্ষিক হয় নাকি নীরব শ্রোতা কখনো কখনো কথক হয়ে ওঠে? তবে নদী কিন্তু চিরকালই কথা বলেছে, সেদিনও বলেছিল। আমাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে, কথা বলতে বলতে উড়াল দিয়েছিল ডানা মেলে, উড়ে গিয়েছিল সে নদী। মুহূর্তে আমাদের সাহু, তিস্তা, করলা, নীল কিংবা টেমস হয়ে আমাদের বর্ষাযাপনের বিষণ্ণ সুর পৌঁছে দিয়েছিল কীটসের দেশে, গল্প শুনিয়ে এসেছিল পিরামিডের সেইসব ঘুমন্ত ফারাওদের। আমরা কথা বলি, নদী শোনে, নদী গল্প বলে, আমরা স্তব্ধ হয়ে শুনি!  বৈকুন্ঠপুরের আরও গভীর থেকে উড়ে আসে পাখিগুলো, চুপ করে শোনে আমাদের কথা কিংবা স্তব্ধতা আর পারাপারজুড়ে তখন নৈঃশব্দের বর্ণমালা।


"আজি শ্রাবণঘন গহন মোহে..."! বিকেল ফুরিয়ে সন্ধে নামে। গয়েরকাটার সেই স্কুলমাঠ, কাঠের বাংলো, সারা মাঠজুড়ে জল থৈথৈ,  এপাশে-ওপাশে ইতস্তত কাঠের লগ উঁচু করে সাজানো! আর ওদিকে তখন গান ধরেছেন বড়ে গোলাম!!!  না না, সে তো আরও অনেক পরে পূর্ণেন্দু পত্রী শুনেছিলেন কথোপকথনকালে, আমাদের সেই কাঠের বাংলোবাড়িতে গান ধরেছিলেন এক আপনজন!  প্রাগৈতিহাসিক সন্ধে নামছে তখন ডুয়ার্সজুড়ে, সেই সন্ধের সঙ্গে সুর মিলিয়ে রঙ বদলাচ্ছে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়ারা...! কাঠের সেই বাংলোবাড়ির ভেতর জমে উঠছে বড়দের আড্ডার আসর। চা আসছে কাপের পর কাপ, মুড়ি-চানাচুরমাখা, আমরা ছোটরাও আনাচেকানাচে থেকে গুটিগুটি পায়ে জড়ো হয়েছি সে আসরে। রহস্যময় সন্ধ্যায় তিনি গাইছেন একের পর এক, আর ওদিকে তখন মেঘের পরে মেঘ জমেছে, গানের পরে গান...! রাত বাড়ে, বৃষ্টি বাড়ে, বিষণ্ণতা বাড়ে, বয়েস বাড়ে।  আমার বর্ষাযাপনের সেই তো শুরু। আজও তো আমি একইভাবে  কান পেতে রই...!


সময় এগোয়, বয়েস এগোয় কিন্তু বৃষ্টিধারাপাত শেষ হয় না! আরও অনেক অনেক দিন পর এরকমই কোনো এক বৃষ্টিদিনেই তো শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম জংগলের অনেক গভীরে দেবীচৌধুরাণীর মন্দিরে। সীমাহীন এক নিস্তব্ধতার মাঝেই জেগে উঠেছিল ইতিহাস, শেষ রাতে বজরায় ফিরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তিনি, আমরা বারিধারার মাঝেই বসেছিলাম চাতালে, গুনে নিচ্ছিলাম ইতিহাসের পাতা, অধ্যায়। পড়ে নিচ্ছিলাম দীর্ঘ একটা সময়...! আস্তে আস্তে বেলা গড়িয়ে দুপুর, বিকেল।  মেঘলাদিনে সব কিছুই ঘটে অগোচরে। ফেরার পথে শিকারপুর হাট, খাপছাড়া সেদিন, জমেনি তেমন আর আমরা হাটের মাঝে ইতস্তত দাঁড়িয়ে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ প্রত্যক্ষ করি...! অঝোরধারায় বৃষ্টি, সন্ধে নামার একটু আগেই পৌঁছে যাই সেই ছোট্ট রেলস্টেশনে। নিঝুম স্টেশনে প্রাত্যহিক ট্রেনটা আসতে তখনো কিছুটা সময় বাকি। শেডের নীচে বেঞ্চে বসে কেউ গান ধরেছিল - 'রিমিঝিমি গিরে সাওন'...! বম্বের সি-সাইড রোড দিয়ে ভিজতে ভিজতে এগিয়ে চলেছেন অমিতাভ, পাশে টপহিলের মৌসুমী, সিগারেট খুঁজে পাচ্ছেন না অমিতাভ, ভেজা কোটের পকেট হাতড়ে বেড়াচ্ছেন, আর ব্যাকগ্রাউন্ড সুরে তখন ফ্ল্যাশব্যাকে নেমে আসছে হিলসাইড, সুরেশের গ্যারেজের পাশের পুজোপ্যান্ডেল, পালিওয়ালদের ভুজিয়া ফ্যাক্টরির নেশা লাগা গন্ধ, ভট্টদার স্ট্যন্ডিং ট্রাক, সেইসব লাজুক চোখ আর আমার অনন্ত বয়েসসন্ধি...!


হে সময়, অশ্বারোহী হতে নেই, ধীরে চলো...! আমি যে আজও কান পেতে রই, অপেক্ষায় থাকি, বৃষ্টিফোঁটায় রহস্যময়তা খুঁজি।

Comments

  1. খুব সুন্দর গদ্য। পরিপাটি বুননে সুখপাঠ্য।

    ReplyDelete

Post a Comment