গল্প - অ্যাঞ্জেলিকা ভট্টাচার্য


অতলান্ত

     
“পৃথিবীতে কিছুই স্থায়ী হয় না।”  নীল কথাগুলো বলে জলন্ত সিগারেটটা খরস্রোতা নদীর জলে ফেলে দিলো। 

“আর সম্পর্ক,  ভালোবাসা!” ঐশী উত্তরের অপেক্ষায় নীলের দিকে তাকিয়ে। 

“কোন কিছুই না। হিমালয় গলছে। নদী শুকিয়ে যাচ্ছে।পাহাড় ক্ষয়ে মালভূমি হয়ে যাচ্ছে। আর সম্পর্ক! সব কিছুই  ক্রমশ হারিয়ে যায়। ফিকে হয়ে আসে। আজীবনের জন্য কিছু থাকে না। জোর করে আমরা ধরে রাখি। দুটো মানুষের মধ্যে শেষ পর্যন্ত যেটা থাকে সেটা নির্ভরতা। সামাজিক বন্ধন আমাদের একটা অভ্যাস তৈরী করে দেয়।”   

ঐশীর মনের ভিতর প্রশ্নের ঝড় উঠছে। কিন্তু ঠিক জিজ্ঞেস করবে কিনা বুঝে উঠতে পারছে না। 

“ঐশী, বোহেমিয়ানরা একেকটা জায়গায় থাকে, ঠিক ততদিন যতদিন ওদের ভাললাগে। তারপর আবার নতুন জায়গার খোঁজ। ওদের কোন বন্ধন নেই ।” 

“নীল তোমার বন্ধনে এত আপত্তি কেন বল তো ?”

“না ঠিক আপত্তি নয়। আমি তো চাই তুমি আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখো। প্রতিবার তো তাই চেয়েছি। কিন্তু থাকতে পারি কোথায় বল তো? ওই দেখো দিনের শেষে পাখিরা ঘরে ফিরছে। ওরা সারা জীবনে অনেক ঘর তৈরি করে। মনের ইচ্ছেতে সঙ্গীর সঙ্গে ঘর বাঁধে। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গী বদলে যায়। মানুষ ছাড়া কোন পশু পাখিকেই দেখবে না সারা জীবন এক সঙ্গী নিয়ে ঘর করে গেল।  কিন্তু জীবন দিয়ে ভালবাসতে জানে ওরা।   ঐশী মানুষের একটা গুন বল তো যা অন্য কোন প্রাণীর মধ্যে পাবে না।”   

“সে তো অনেক আছে। স্তন্যপায়ী জীবদের মধ্যে মানুষ সব থেকে বুদ্ধিমান। মানুষ দুপায়ে হাঁটে।” 

নীল কেমন বাচ্চা ছেলের মতো হোহো করে হেসে উঠল। “এতো তুমি স্কুলের পড়া বলছ।” 

“আর কী করব? আমি কি জুলজির স্টুডেন্ট? আমি তো ইতিহাসের ছাত্রী ছিলাম।” 
 
পাইন গাছের মাথায় অন্ধকার নেমে আসবে এখুনি পাহাড়ে ঝুপ করে কেমন সূর্য ডুবে যায়। কুয়াশারা চারিদিক ঘিরে রয়েছে। কোন জংলি ফুলের গন্ধ আসছে। মেঘের জন্য কাঞ্চনজঙ্ঘার রেঞ্জ দেখা জাচ্ছে না। নইলে এখান থেকে সূর্যাস্ত খুব ভালো লাগে দেখতে।  

নীল ঐশীর মাথার টুপিটা সরিয়ে কানের কাছে মুখটা এনে বলল – “মানুষ মিথ্যেকথা বলে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। কিন্তু আমি মনে হয় অমানুষ তাই মিথ্যেটা বলতে শিখলাম না ।” 
 
“দিদি,  কোল্ডড্রিঙ্কস নেবেন? দিদি!”   

ঐশী একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল। সামনে একজন মাঝ বয়েসি মহিলা দাঁড়িয়ে। সাজ পোশাক দেখে কাজের লোক মনে হচ্ছে না। ট্রেতে কোল্ডড্রিঙ্কসের গ্লাস। ঐশী সৌজন্য মুলক হেসে বলল – “আমি খাব না। গলা ব্যাথা।”  কথাটা যদিও সত্যি ছিল না ।

মহিলাটি তবু সামনে দাঁড়িয়ে আছে – “দিদি আপনার নাম ঐশী সেন না! এবারে বেস্ট এক্ট্রেস অ্যাওয়ার্ড পেলেন।”   

ঐশীর মুখে স্মিত হাসি ।  

“আমি সোহিনী রায়। নীলাঞ্জন রায় চৌধুরী সম্পর্কে আমার মামা ছিলেন। আমি দিল্লিতে থাকি।  বিশেষ আসা হয়না কলকাতায়।”   

ঐশী এই বাড়িতে আগে এলেও, এই মেয়েটিকে কখনও দেখেনি। কিন্তু মেয়েটি অনর্গল কথা বলে চলেছে। ঐশীর কোন কোন সিনেমা দেখেছে। তাকে কোথায় কেমন লেগেছে। ঐশীর একটু বিরক্ত লাগছিল – “শ্রাদ্ধের কাজ কি হয়ে গেছে? তবে একবার ও ঘরে যেতাম। আমি আসলে  চারটে নাগাদ বেড়িয়ে যাব।”  

সোহিনী নামে মেয়েটির চোখে মুখে এবার বিরক্তি ফুটে উঠেছে যেন –“শ্রাদ্ধের কাজ করতে করতে বিকেল গরিয়ে যায়। আর রায়চৌধুরি বাড়ির নিয়ম একটু বেশি। আপনার অবশ্য জানবার কথা নয়।বলে তেরছা করে দেখে নিল ঐশীকে। আপনি দুপুরেও কিছু খেলেন না। অন্তত একটু  মিষ্টি নিয়ে আসি।”  

ঐশী মাথা নাড়ল – “না আর থাকা যাবে না। এবার বেরোতে হবে। শ্রাদ্ধের ওখানে কি খুব ভিড়? মানে একবার যদি একটু ও ঘরে যেতে পারতাম।”  

সোহিনী কী ভেবে বলল – “দাঁড়ান দেখে আসছি।” পিছন ফিরেও থমকে দাঁড়ালো – “দিদি একটা সেলফি নেব আপনার সঙ্গে?” ঐশী হ্যাঁ না বলার আগেই সোহিনীর হাসি মুখের সঙ্গে ঐশীর মলিন মুখের সেলফি উঠে গেছে।

আজ ঐশী হাল্কা সবুজ রঙের একটা শাড়ি পরে এসেছে। নীলের প্রিয় রঙ। ঘাড়ের  কাছে হাত খোপা। চোখের কোনে কালি। যত্নহীন মুখের ভাঁজে মনের কষ্টটাও কি উঁকি দিচ্ছে !    

কত সিনেমাতে মেকি হাসি কান্নার অভিনয় করেছে ঐশী। কিন্তু আজ সোহিনীর জন্য একটু হাসতে পারল না!  এই ছবি হয়ত কিছুক্ষনের মধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যাবে। সোহিনীর টাইমলাইনে হজার হাজার কমেন্টস ছুটে আসবে।  
   
ঐশী দোতলার বারান্দা লাগানো ঘরটায় দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় দু'ঘণ্টা এসেছে। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে যেতে সাহস হয়নি। সেখানে চেনা মুখের ভিড়ও আছে। তাই এই ঘরে বসে অপেক্ষা করছে। এটাই বসার ঘর। দেওয়াল আলমারিতে নীলাঞ্জন রায়চৌধুরির অনেক পুরস্কার, ছবি। ঐশী আগেও দেখেছে এসব। আজ আবার নতুন করে দেখছে।    

ভিতরে অনেক্ষন হল খবর গেছে কিন্তু বাড়ির কোন লোক এসে তার সঙ্গে দেখা করেনি। দুজন অপরিচিত ভদ্রলোক এসে দুপুরে খাওয়ার জন্য আপ্যায়ন করে গিয়েছেন। ঐশী তাদের ফিরিয়ে দিয়েছে।    

শ্রাদ্ধের দিনও বেশ কিছু নিমন্ত্রিত ব্যক্তি রয়েছেন । সবার অগোচরে ঐশী তিন তলার ব্যালকনির গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। উপর থেকে নীচের বাগান দেখা যাচ্ছে। কৃষ্ণচূড়া গাছটার পাতা দেখা যাচ্ছে না। সারা গাছে যেন রঙ ছড়ানো। এই গাছটা নীলের খুব প্রিয় ছিল। এর তলায় বসে অনেক দিন কবি লেখকদেরও  আড্ডা চলেছে। সেই আড্ডায় অভিনেত্রী ঐশী সেনেরও নিমন্ত্রন থাকতো। 

দু'চারবার এই বাড়িতে এসেছে ঐশী। পরে মনে হয়েছে নীল ছাড়া এ বাড়ির লোক তেমন পছন্দ করছে না। কিন্তু নীলের বউ পামেলাদিকে  চিরকাল খুব মিশুকে, খোলা মনের মনে হয়েছে। ঐশীও বেশ কয়েকবার  প্রিমিয়ার শোয়ের টিকিট পাঠিয়েছিলো পামেলাদিকে। নীল না গেলেও পামেলাদি গেছিল।কিন্তু পামেলাদির সঙ্গেও সেদিনের পর থেকে আর দেখা হয়নি।  

“দিদি কাজ প্রায় হয়ে এসেছে। এখন যেতে পারেন।” সোহিনী কথাটা বলে আর দাঁড়াল না।
  
টেবিল এর উপর নীলাঞ্জন রায়চৌধুরির বিশাল এক ছবি। তাতে জুঁই ফুলের মালা দেওয়া। ঐশী তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টে। 

“নীল মুখ গোমড়া করে থাকবে না। তোমার ওই প্রান খোলা হাসিটা না দেখলে আমার ভালো লাগে না।”  

“উফ এই ছবি তোলা আমার দ্বারা হয় না। একবার বলবে হাসতে হবে। একবার বলবে মুখ এদিকে করো।”  

“একটু, এই ব্যাস। এটা তোমার বেষ্ট ছবি। কেউ পারবে না এমন তুলতে।”  

“কোথায়  দেখি? আরে দারুন। এটার প্রিন্ট বার করে বড় করে বাধিয়ে রাখব। যখন থাকবো না, তুমি এসে এটায় মালা পড়াবে।”  

“ঐশী কখন এলে? কী হল কথা বলছ না!”  পামেলাদি গায়ে হাত দিতেই ঐশীর ধ্যান ভঙ্গ হল।পামেলাদি একটা সাদা ঢাকাই পড়ে আছে। আজ কপালে বড় লাল টিপ নেই। মাথার সামনে অবিন্যাস্ত পাকা চুল।  সঙ্গে আনা রজনিগন্ধার মালা বার করে দিল পামেলাদির হাতে – “এটা একটু পরিয়ে দেবে নীলকে!” 

“তুমি পরিয়ে দাও।”  

“আমি পারব না।”  ঐশীর সারা শরীর যেন কাঁপছে। 

“হঠাৎ ভিতরের ঘর থেকে চিৎকার শোনা গেল। ও কেন এসেছে আমাদের বাড়িতে? আমি মেরে ফেলব। ওকে চলে যেতে বলো। মা তুমি ওকে চলে যেতে বলো।”  চিৎকারটা ক্রমশ এদিকেই আসছে। ঐশী বুঝতে পেরেছে এটা তিস্তা। নীলের অপ্রকৃতিস্থ উনিশ বছরের মেয়ে। তিস্তা এখন ঐশীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। 

“এই তুমি কেন এসেছ? একদম বাবার ছবি ধরবে না।”  

ঐশীর সঙ্গে এক সময় তিস্তার খুব ভাব হয়েছিল। দুজনে মিলে গান করত। ঐশী তিস্তার গায়ে হাত রাখল – “তিস্তা ভালো আছো ?” 

“তুমি ডাইনি। বাবাকে আমাদের থেকে কেড়ে নিয়েছ।” 

আশেপাশে অনেক লোক জমা হয়ে গিয়েছে। নীলের বাইশ বছরের ছেলে শ্রাদ্ধের মন্ত্র থামিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। ঐশীর এই মুহূর্তে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। কিন্তু কি আশ্চর্য পা যেন মাটির সঙ্গে জমে গিয়েছে। 

পামেলাদি  ঐশীর হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে এলো।  “এ বাড়িতে না এলেই ভালো করতে ঐশী।”  

“কিন্তু  আজ তো নীলের!” কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারল না। পামেলাদি  জলের গ্লাস এগিয়ে দিল। 

“নিলাঞ্জন রায় চৌধুরী জীবিত অবস্থায় সবটাই তো তোমার ছিল। মৃত্যুর পর নয় আমাদের থাক।” 

উত্তর কলকাতার অট্টালিকা, গলি, রাজপথ ছেড়ে গাড়ি এখন দক্ষিনের পথে। ঐশীর  চোখে সব ঝাপসা লাগছে। নীলের কি সবটা কোনোদিন দখল করতে পেরেছে ঐশী!

“ঐশী তোমার এখানে এই অমানুষটাকে  থাকতে দেবে ?”  

তখনও সূর্য ওঠেনি। আকাশ নীল হয়ে এসেছে, হয়ত একটু পরেই আলো ফুটবে। নীলের সঙ্গে শুধু একটা সাইড ব্যাগ। ঐশী একটু অবাক হয়েছিল। মুখে কোনও অ্যালকোহলের গন্ধ নেই। তাহলে সুস্থ অবস্থায় বলছে কথাগুলো!  

“আগে ঘরের ভিতরে এসো। এখনও সকাল হয়নি। তুমি বরং একটু রেস্ট নাও। ঘণ্টা তিনেক ঘুমিয়ে নাও। তোমায় দেখে মনে হচ্ছে সারা রাত ঘুমাওনি।”  

“ঠিক আমি ঘুমাইনি, খাইনি।”  

“এমা, তাহলে কিছু খাবে চলো।”  

কথা হয়ত আরও কিছু ছিল তার আগেই নীল ঐশীর বাসি ঠোঁট কামড়ে ধরেছিল। তার কদিন আগেই ঐশী আর নীল ঘুরে এসেছে উত্তরবঙ্গ থেকে। ঐশীর সিনেমার শুটিং ছিল। গল্পটা নীলের। উত্তর বঙ্গে শুটিং সেরে দুজনেই চলে গেছিল চটকপুর। ছোট একটা পাহাড়ি গ্রাম। যেখানে দুজনকে কেউ চেনে না। আগে যেটুকু কানাঘুষো চলছিল ব্যাপারটা। এবার মিডিয়া লুফে নিল – “অভিনেত্রি ঐশী সেনের সঙ্গে বিখ্যত কবি নিলাঞ্জন রায় চৌধুরীর পাহাড়ে গোপন প্রেম।”  তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আরও চটুল রঙ্গ তামাশা।প্রেমিকা তিরিশ, প্রেমিক ষাট। এবার কি নতুন কোন উপন্যাস ! নীল কবি হিসাবে বিখ্যাত হলেও বেশ কয়েকটা গল্প, উপন্যাসের জন্য ততিদিনে বিখ্যাত। পাহাড়ে যে আগুন লেগেছিল। তার ধোঁয়া রায় চৌধুরী পরিবার পর্যন্ত এসেছিল। পরিবারেও ঝড় শুরু হয়েছিল।

“ঐশী তুমি বললে না, আমায় থাকতে দেবে না?” 

“পরিবার? পামেলাদি, তোমার  ছেলে, মেয়ে। তারা!” 

“আমি তো অতো ভেবে কাজ করতে পারি না ঐশী। যেমন কবে, কোথায় তোমায় ভালবেসেছি বলতে পারবো না। পামেলা আমায় আজ জিজ্ঞেস করেছিল।” 

“কী ?” 

“তাকে আমি ভালোবাসি কি না? বললাম, না ভালোবাসি না।”  

“তুমি এটা বলতে পারলে নীল? তুমি দিনের পর দিন ভবঘুরের মতো  ঘুরেছ। শুধু কবিতা, কবিতা। চরিত্র খুঁজে বেরিয়েছ। পামেলাদি  তোমাদের একান্নবর্তী পরিবার সামলেছে। তোমার অসুস্থ মেয়েকে বুক দিয়ে আগলেছে। ছেলেকে ভালো ভাবে মানুষ করেছে।” 

“আমি জানি পামেলার যোগ্য আমি নই। ও ভীষণ ভালো। কিন্তু আমি মিথ্যে বলতে পারলাম না ঐশী।আমি তোমাকে প্রতি সময়ে ভীষণ মিস করি। আমার প্রতি লেখায় কেমন ভাবে খালি তুমি চলে আসছ। তাই তো বেরিয়ে এলাম। আমরা একসঙ্গে ঘর করতে পারি না?” 

“আর পামেলাদির  কী  হবে?” 

“ও আমায় বলেছে যদি ভালো নাই বাসো, তবে সমাজের চোখে শুধু সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার মানে হয় না।” 

“আমাদের সমাজটা খুব নোংরা নীল। একজন ডিভোর্সি মহিলাকে প্রতিক্ষণে জবাব দিহি করতে হবে। তোমার গায়ে কাদার ছিটে এসে লাগবে না। তুমি বিখ্যাত মানুষ। কিন্তু সে ? তাকে তার জায়গায় থাকতে দাও।” 

“তুমি কি তাহলে আমাকে ফিরিয়ে দেবে?” 

“সে ক্ষমতা আমার নেই।” ঐশী নীলের মাথাটা বুকের মধ্যে চেপে ধরেছিল।

দিদি স্টুডিওতে যাবেন তো? ঐশী কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল – না রতন, বাড়ি যাবো। আজ ভাললাগছে না। সিতেশদাকে সকালে মেসেজ করে দিয়েছিলাম। আজকে আর  শুটিঙে যাবো না। রতন কোন কথা বলল না। গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিলো। এর মধ্যে ঐশীর ফোন বেজে যাচ্ছে। কোনো ফোন ধরেনি। অপরিচিত নম্বর দেখে ফোন ধরতেই  “ঐশীদি আমি নিতু  বলছি। তোমার একটা ইন্টার্ভিউ হলে ভালো হত।”  

“আজকে পারবো না।”  

“না না কাল, পরশু।” 

“দেখছি।” ফোন কেটে গেছে। ঐশী জানে এখন তাকে অনেক প্রশ্নর মুখমুখি বসতে  হবে। এর মধ্যে বেশ আরও কয়েকটা চ্যনেল থেকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। একজন সাংবাদিক তো  ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন – “নীলাঞ্জন রায়চৌধুরির মৃত্যুর সময় আপনি কাছে ছিলেন না?”

ঐশী  নিজেকে প্রশ্ন করে – “নীল সেই সময় আমি  কেন ছিলাম না  তোমার কাছে? তবে কী এভাবে যেতে দিতাম তোমায় !” 

“নীল হয়ত বুঝেছিল তার সময় শেষ হয়ে আসছে তাই কি হুট করে না বলে হারিয়ে গেছিল?  কিন্তু হার্টে ব্লকেজ ছিল। ডাক্তার খুব তাড়াতাড়ি বাইপাস সার্জারিটা করে নিতে বলেছিল।”  

“আমি অক্ষত বুকে তোমার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমোতে চাই। ঐশী তুমি মাত্র পাঁচবছরেই আমার জীবনটা কেমন বদলে দিয়েছ। তোমার জন্যই হয়ত লিখেছিলাম – ‘অতলান্ত’।  তুমি এত ভালো অভিনয় করেছ। দেখবে এবার বেষ্ট এক্ট্রেস অ্যাওয়ার্ড পাবে।”  

ঐশী নীলের বুকে মাথা রেখে বলেছিল - “তুমি বুঝি সব জানো ?”  

“আমাদের ভালোবাসারও কেউ কোন তল পাবে না ঐশী।” 
  
খবরটা জানাতে পারেনি ঐশী। আজ পনের দিন ধরে ফোন সুইচ অফ। পামেলাদির কাছেও খোঁজ নিয়েছিল। কিন্তু কেউ কিছু জানে না। এরকম অনেক সময় না বলে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে নীল। তারপর এক নতুন সৃষ্টি হয়েছে। কালো কালো অক্ষরগুলো মানুষের মনে ঝড় তুলেছে।
   
কিন্তু এবার!  “কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দেখতে পাইন গাছে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল নীল। সে ঘুম আর ভাঙেনি।” শুটিং ফ্লোরে খবর পেয়েছিল ঐশী।খবরটা শুনে মাথাঘুরে পরে গেছিল। মাথায় দুটো স্টিচ পরেছিল। বিছানায় শুয়ে খবর পেয়েছিল রায়চৌধুরি বাড়িতে নীলের নিথর দেহ এসেছে। ঐশী যেতে পারেনি সেই বাড়িতে। বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদেছিল। 

রবীন্দ্র সদনেও কিছুক্ষনের জন্য দেহ রাখা হয়েছিল। ঐশী রবীন্দ্র সদনে মুখ ঢেকে কালো চশমা পরে ঢুকেছিল। কিন্তু ঢুকেও নীলের মুখমুখি হতে পারেনি। মিডিয়ার তীক্ষ্ণ নজর পড়ার আগেই  ফিরে এসেছিল। চোখ বন্ধ করে নীলের হাসিখুশি মুখটা হাত দিয়ে ধরতে চাইছিল।  

“মানুষটার কি খুব কষ্ট হচ্ছিল শেষ সময়ে!  একবার  বলে গেল না এবারের ঠিকানা!  নাকি বলতে চায়নি।”  

সিগন্যালে গাড়ি থেমেছে। চারিদিকটা হঠাৎ নিস্তব্ধ মনে হচ্ছে। শুধু নীলের গলাটা যেন শুনতে পাচ্ছে – “ঐশী আবার পরের জন্মে দেখা হবে। পাখি  হয়ে  ঘুরতে ঘুরতে চলে আসব। আমাদের দেখা হবে কোনো নদীর  ধারে নয়ত  পাইনের জঙ্গলে।” 


Comments

  1. অসাধারণ সুন্দর লেখা। মন টা উদাস করে দিলো।

    ReplyDelete

Post a Comment