গল্প - সঞ্জয় কুমার নাগ


মংলুকে নিয়ে


গাঁ নয়, পাড়াগাঁ- বলা ভালো। রেললাইনের কাছে ছোট্ট একটা টিনের চালাঘর। ঐ চালাঘরে মংলু আর ওর মায়ের দিনযাপন। ঘরের চালভর্তি লাউ অথবা কুমড়োর লিকলিকে ডগা। নান্টু পঞ্চায়েত এবার একটা পাকা পায়খানা সহ টিউবওয়েল বসিয়ে দিয়েছে। পঞ্চায়েতের বাড়ির হাট-বাজার থেকে যাবতীয় ফুট ফাই ফরমায়েশ- মংলুই। চুয়াল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরের মংলু বিয়ে বা সংসারের কথা কল্পনাও করতে পারে না। একেবারে বাউন্ডুলে।

 


কিন্তু হঠাৎ ওর মাথায় কী ঢুকলো কে জানে, শহরে কাজের খোঁজে বেরোতে লাগলো নিয়মিত।মা খুশি হলেন। কিন্তু পাড়ার লোকের বেজায় অসুবিধে হয়ে গেল। নান্টু পঞ্চায়েতের বেশী। আসলে ফ্রী তে খাটার আর লোক কোথায়?

 


'দিনের মধ্যেই একটা কাজ জুটে গেল। থানাপাড়ার হারান ডিলার। সেখানে চাল-গম মাপার কাজ। ঠিক হলো-সপ্তাহে সাতশো টাকা। আর টিফিন বাবদ প্রতিদিন দশ টাকা। হারান জিতে গেলেন। আর মংলুও বেঁচে গেল। আজকাল বেশ উনুন জ্বলছে বাড়িতে। ভাজা-পোড়ার গন্ধে করছে চারদিক। পঞ্চায়েতের মাথাটা খিঁচড়ে আছে -- শালার খুব বাড় বেড়েছে। আজকাল আর প্রয়োজনে পাওয়া যায় না। একদিন পঞ্চায়েতের দুই শাগরেদ এসে বুড়িকে গরম দিয়ে গেছে। টিউবওয়েল তুলে নিয়ে যাবে বলেছে। মংলু মাকে বোঝায় -- যেই কুত্তা ভোগে, সেই কুত্তা কাটে না। তুই চুপ করি থাক।

 


এমনি চলছে। সেদিন সন্ধেবেলা গাঁয়ে শোরগোল পড়ে গেল। মংলুর ঘরে টুনিবাল্ব জ্বলছে!? চালাঘরের বারান্দা দিয়ে একটা ঘর বানানো হয়েছে!! পঞ্চায়েতের কানে খবরটা পৌঁছয়।

 


নান্টু ভাবে -- হারামজাদা কি তবে লটারি পেয়ে গেলো?? কৌতূহলে গাঁয়ের লোকের পেট ফেটে যাবার উপক্রম।   

                   

*          *         *         *

 

পরদিন সাতসকালে পাড়ার কাকি-জেঠিরা ভিড় জমায়। মংলু তখন কলপাড়ে ব্যস্ত। বাঁশ আর সুপাড়ির ঢোঙা দিয়ে ঘেরা দিচ্ছিলো। ঘর থেকে নতুন বউ বেরিয়ে এলো। সকলকে প্রণাম করলো। চিনিবালা কে দেখে বিনোদিনী কাকি বলে উঠলেন-- ওরে মংলু, তোর বউয়োক চেনা চেনা নাগে ক্যান্? মংলু বলে-- নাইগবার পায়। সেবা নার্সিংহোমৎ কাম করে।

 


বিকেল হতেই সাইকেলের ক্যারিয়ারে চিনিবালাকে বসিয়ে পঞ্চায়েতের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় মংলু। বিয়েতে পাওয়া নতুন সাইকেল গাঁয়ের এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় কচর-মচর আওয়াজ করতে থাকে। নান্টু আর গিন্নিমা বাঁশের মাচায় বসে পান-সুপারি খাচ্ছিলেন। ওদের দেখেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন পঞ্চায়েত -- শালা হারামি, যায় করে চক্ষুদান, তারে করিস অপমান!!? অ্যালা তোর টিকির নাগাল পাং না। মোক না জানেয়া বিয়া করলু। আর তুই আচ্চিস মোক দ্যাখাবার?? গিন্নিমাও কোনো কথা বললেন না। মাথা নিচু করে মংলু আর ওর বাড়ি ফিরে এলো।

 


এর বেশ কিছুদিন পর হেলথের দিদিমণিরা পঞ্চায়েত অফিসে ক্যাম্প বসিয়েছে। গায়ে পি পি কিট্। মুখে হেলমেটের সামনের মতো কী একটা! মংলুর কৌতুহল বাড়ে। এদিকে কাজের তাড়া আছে। তবুও দাঁড়ায়। শোনে নান্টু পঞ্চায়েত করোনা পজিটিভ! পঞ্চায়েত কে নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হলো। এদিকে 'দিন হলো চিনিবালা বাড়িতে ফেরে না। দিন-রাত ডিউটি। নান্টুর দেখভালের দায়িত্ব পড়লো চিনিবালার উপরে। টানা পনেরো দিন অক্লান্ত সেবা করার পর সেরে উঠলেন নান্টু পঞ্চায়েত। ছুটির দিন চিনির হাতদুটো খপ্ করে ধরে বললেন -- বৌমা, মোক মাফ করি দ্যাও। মংলুক সাথ করি বাড়িৎ আইসো।

 


এর ঠিক দু'দিন পর থেকে মংলুর অসুস্থ হয়ে পড়লো। প্রবল শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো। ওর করোনা পজিটিভ।মংলুর কাজে মন নেই। সারাদিন হাসপাতালের সামনে। একটিবার চিনিকে দেখবার উপায় নেই। প্রতিদিন সন্ধেবেলা নোকিয়া মোবাইলে চিনির সাথে কথা বলার সময় মনটা হু হু করে ওঠে মংলুর। চিনিই কিনে দিয়েছিলো ওকে হ্যান্ডসেটটা। মনে মনে ভগবানকে ডাকে -- হেঁই বুড়ীমাতা, হেঁই মাশানবাবা মোর উটাক্ ঠিক করি দে। 

 


বাড়িতে ফিরলে আর চিনিকে কাজে যেতে দেবে না মংলু। তাছাড়া ওকে বেশ কিছুদিন বিশ্রামে থাকতে হবে। এখন একটা মোটা টাকার দরকার।অন্তত হাজার দশেক। টাকা চাইতেই হারান বলে -- হাজার দুয়েক হলে নে। মংলুর মাথায় কিছু কাজ করে না। সাইকেলে উঠে প্যাডেল চালায়। ওকে যেভাবে হোক দশ হাজার টাকা জোগাড় করতে হবে।

Comments

Post a Comment