গল্প - প্রগতি মাইতি


ঈশ্বর


আমাদের বাড়ি দক্ষিণমুখো। দক্ষিণ দিকে একটা গলি আছে। গলিটা ধীরে ধীরে এঁদোগলি। হয়ে গেল। ওখানে মানুষজন পেচ্ছাপ করে, থুতু ফ্যালে, নাক ঝাড়ে - এমনকি কুকুরও বাদ যায় না। বহু মানুষ বাড়ি থেকে পলিপ্যাকে আবর্জনা এনে এই গলির মুখে ছুড়ে দেয়। দেখতে দেখতে আবর্জনা জমতে জমতে একটা টিলা হয়ে গেছে। এভাবে চললে টিলা পাহাড় হতে কতক্ষণ ! অগত্যা আমরা দক্ষিণের দরজা জানলা বন্ধ রেখে উত্তরের সরু গলি দিয়ে ঘুরপথে যাতায়াত করি। সে যে কি বিড়ম্বনা! দক্ষিণের হাওয়ায় দুর্গন্ধে টেকা দায়। ব্যাপারটা প্রথম স্থানীয় কাউন্সিলরকে জানালাম। কাউন্সিলর সব শুনে বললেন, দেখছি কী করা যায়। কাউন্সিলরের দীর্ঘ নীরবতা দেখে পৌরসভার চেয়ারম্যানের কাছে গিয়ে সব বললাম। উনি আমার কথা মন দিয়ে শুনলেন। তারপর ব্যাপারটা লিখিত ভাবে জানাতে বললেন। আমি তাই করলাম। দু'মাস তিনমাস গেল। কোনো কাজ হলো না। এরপর স্থানীয় ক্লাবের প্রভাবশালী সেক্রেটারিকে সমস্যার কথা জানাতে তিনি উদাসীন ভাবে উত্তর দিলেন, দেখুন মশাই, কে কোথায় পেচ্ছাপ করে বা থুতু ফ্যালে সেটা দ্যাখা আমাদের কাজ নয়। অন্য কোনো সমস্যা থাকলে বলুন। দেশে এখন অনেক সমস্যা।


ভাবলাম পরিবেশ দপ্তরে যাই। কারণ গলির মুখে এই দুষ্কর্মে তো পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। এই এলাকা দিয়ে যে-ই যাক না কেন, নাকে হাত বা রুমাল চাপা দেয়। অথচ কি অদ্ভুত, কেউ কোনো প্রতিবাদ করে না। যেন গা সওয়া হয়ে গেছে। তাছাড়া কিছুদিন আগে কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান ও ক্লাবের সেক্রেটারির কাছে যাওয়ার অভিজ্ঞতা মনে পড়ে যেতে পিছিয়ে এলাম। পরিবেশ দপ্তরে আর যাওয়া হলো না।


আমার বাবা একজন রিটায়ার্ড শিক্ষক। ঐ এলাকায় বাবার কিছু প্রতিষ্ঠিত ছাত্র আছে। তারা কেউ কেউ বাবাকে মৌখিক সহানুভূতি জানিয়েছেন। আবার কেউ কেউ 'ব্যাপারটা দেখছি' বলে দায় এড়িয়ে গেছে। এরমধ্যে একজন ছাত্র কিছুটা এগিয়েছিল। ক'দিন বাদে আমাদের বাড়িতে এসে বাবাকে বললো, কী বলবো স্যার, সমাজটা পচে গেছে। কাউন্সিলর আর ক্লাব সেক্রেটারির মধ্যে গাঁটছড়া বাঁধা আছে। দু' জনের কাছেই শুনলাম, আপনি নাকি জায়গা কেনা বা বাড়ি তৈরির সময় কোনও টাকাই দেননি। তাই ওরা মুখ ফিরিয়ে আছে। কে বলতে পারে ওদের মদতেই হয়তো গলিটা নরক করে তোলা হয়েছে। বাবা সেই ছাত্রকে তার প্রচেষ্টার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিল, তুমি তো জানো বাবা আমি স্কুলে কিরকম আদর্শে বিশ্বাসী ছিলাম। প্রয়োজন হলে এখান থেকে চলে যাবো, তাও ভালো। কিন্তু টাকা আমি দেবো না। তাছাড়া কেনই বা দেবো? এবার বুঝলাম ক্লাব থেকে আমাদের বাড়িতে দুর্গাপুজোর চাঁদা কেন নিতে আসে না। ছাত্রটি মন খারাপ করে আমাদের বাড়ি ছেড়েছিল।


দক্ষিণ খোলা বাড়ি সবাই চায়। বাবা যখন জায়গাটা প্রথম দেখেছিল তখন দক্ষিণের কথা চিন্তা করেই কিনেছিল। কিন্তু ঘটনা পরম্পরা আমাদের সবার মন খারাপ। দক্ষিণ দিক দিয়ে আমরা যাতায়াত করতে পারি না বলে অনেকটা ঘুরপথে উত্তরের গলি দিয়ে যাতায়াত করি। আমরা যখন বাড়ি বিক্রি করে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার কথা ভাবছিলাম - প্রায় ঠিক তখন আমার বাবার একটা উদ্যোগ চমকে দিল আমাদের। স্থানীয় লোকজনও তারিফ না করে পারেনি।


বাবা দক্ষিণের ঐ গলির দু'দিকে মাটি কুপিয়ে একটা একটা করে গাছের চারা লাগলো। বাবার অবসর জীবনে এই কাজটা বাবাকে অতিরিক্ত আনন্দ দিল। গলির দু' পাশে গাছের পরিচর্যায় বাবা বিভোর হয়ে থাকলো। বাবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় গাছগুলো তরতরিয়ে বেড়ে উঠলো। এখন দক্ষিণের ঐ গলিতে আশ্চর্য সুন্দর ফুল ফুটেছে। কত পাখি প্রজাপতি মৌমাছি আসে। এখানে এখন মানুষ কেন কুকুরও ভুল করে কোনো দুষ্কর্ম করে না।


স্থানীয় মানুষ বাবার শুধু তারিফ করাই নয়, ক্লাবের সেই সেক্রেটারি আবেগে আপ্লুত হয়ে বাবাকে সংবর্ধনা ও পরিবেশ বান্ধব পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। পৌরসভার চেয়ারম্যান নাকি সভাপতি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। ক্লাব সেক্রেটারির ঐ প্রস্তাব বাবা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে বলেছিল, এ আর এমন কি? এর জন্য আবার পুরস্কার বা সংবর্ধনা কিসের? বরং এই বাগান দেখভাল করতে আপনারাও এগিয়ে আসুন। ক্লাব সেক্রেটারি তবুও নাছোড়। তখন বাবা বলেছিল, আমার দীর্ঘ কর্মময় জীবনের শেষ দিনে স্কুলের ছাত্র - শিক্ষকরা আমাকে বিদায় সংবর্ধনা দিতে চেয়েছিল - আমি রাজি হইনি। আমার এই আনুষ্ঠানিক আড়ম্বর ভালো লাগে না। আমি আনন্দ পাবো, যদি ক্লাব এগিয়ে এসে বাগান পরিচর্যা করে। আমিও থাকবো। আপনারা বরং একটা সাইনবোর্ড টাঙানোর ব্যবস্থা করুন। তাতে লেখা থাকবে "সৌন্দর্যায়নে নবোদয় সংঘ"। ক্লাব সেক্রেটারি বললেন, সবকিছু আপনি করলেন, আর নাম দেবো ক্লাবের? বাবা হাসতে হাসতে বলেছিল, এই ক্লাবটা তো আমারও।


আমার বাবা কোনোদিন কোনো মন্দিরে যায়নি। কখনও কোনো দেবতার সামনে হাতজোড় করেনি। বাবা এখন নিজেই ঈশ্বর।


Comments

  1. গল্পটা শুরু করেছিলাম l বেশ আকর্ষন আছে l পড়া শেষ হলো l ভালো লাগলো গল্পটি l

    ReplyDelete

Post a Comment