প্রবন্ধ - মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য



অনন্তের অভিমুখী বিবেকানন্দ 


১৯০২ সালের ৪ জুলাই। আর পাঁচটা দিনের মতো সেদিনও স্বামীজি সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন। বেলুড় মঠের প্রার্থনা গৃহে এলেন প্রফুল্লচিত্তে। সেখানে তিন ঘন্টা ধ্যান করলেন তিনি। এরপর ছাত্রদের শুক্লা-যজুর্বেদ, সংস্কৃত ব্যাকরণ ও দর্শনশাস্ত্র শেখালেন। এরপর স্বামীজি প্রেমানন্দের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন। আলোচনা করলেন রামকৃষ্ণ মঠের ভবিষ্যৎ নিয়ে। সেদিন বেলুড়ঘাটে জেলের নৌকো ভিড়েছিল। নৌকো ভর্তি গঙ্গার ইলিশ। মহা উৎসাহে  সেই ইলিশ কেনালেন বিবেকানন্দ। সকলের সঙ্গে বসে দুপুরে খেলেন ইলিশের নানা পদ। সন্ধে সাতটা নাগাদ চলে গেলেন নিজের ঘরে। বলে গেলেন, তাঁকে যেন কেউ বিরক্ত না করে।


ঘরে গিয়ে ধ্যানে বসলেন তিনি। ধ্যান করতে করতেই আনন্দলোকে যাত্রা করলেন বিবেকানন্দ। তাঁর শিষ্যদের মতে বিবেকানন্দ মৃত্যর আগে মহাসমাধি লাভ করেছিলেন। যদিও মস্তিস্কের রক্তনালী ফেটে যাওয়াই মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ  হিসেবে দাবি করেছে ডাক্তারি রিপোর্ট। তবে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ  ডাক্তারেরাও নিশ্চিত  করে বলতে পারেননি। স্বামীজি নিজেই জানিয়েছিলেন যে তাঁর বয়স ৪০ পেরোবে না। বিবেকানন্দর যখন মৃত্যু হয় তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৯ বছর, ৫ মাস, ২৫ দিন। বেলুড়ে গঙ্গার ধারে চন্দনকাঠের চিতায় দাহ করা হল তাঁকে। ১৬ বছর আগে এর  উল্টোদিকেই তো দাহ করা  হয়েছিল শ্রীরামকৃষ্ণকে।


এক অনন্ত জীবনের নাম বিবেকানন্দ। তিনি একাধারে জাগরণের অগ্রদূত, ভারতাত্মার মূর্ত বিগ্রহ, বৈপ্লবিক সন্ন্যাসী, সংগ্রামের পূজারি, কল্যাণব্রতী, স্বদেশপ্রেমিক, বিশ্বপ্রেমিক, চিন্তানায়ক এবং যুগনায়ক। তাঁর সম্পর্কে উচ্চারিত প্রতিটি বিশেষণই বলে দেয় তিনি কে, তিনি কী, তিনি কত ব্যপ্ত। বিবেকানন্দর সমগ্র জীবনদর্শন অবধারণ করার ক্ষমতা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের নেই। ১২ জানুয়ারি তাঁর জন্মদিবস। ১৮৬৩ সালের সেই দিনটিতে আবির্ভাব হয়েছিল তাঁর। বিপুল  উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে দেশজুড়ে আমরা পালন করে থাকি বিবেকানন্দর জন্মদিন। ঘরে ঘরে পুজো করি তাঁকে। কিন্তু তারপর কি তাঁকে সযত্নে কুলুঙ্গির ওপর তুলে রাখি না? বিবেকানন্দর ভাব ও আদর্শের কথা কি যথারীতি বিস্মৃত হই না আমরা? ক'জন জানি যে, এমনই বর্ষার মেঘমন্দ্রিত এক রাতে পরমাত্মায় বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন বেদান্ত দর্শনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক স্বামী বিবেকানন্দ? এই নিবন্ধটির অবতারণা ঠিক সেই জায়গা থেকে। যদি তাঁকে নিয়ে যৎসামান্য চর্চা করতে পারি, তাঁর অনন্ত জীবনটিকে একবার ফিরে দেখতে পারি, সেটুকুই হতে পারে স্বামীজির প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধার্ঘ্য।


এক আশ্চর্য আত্মোৎসর্গের নাম বিবেকানন্দ 

এক আশ্চর্য আত্মোৎসর্গের নাম বিবেকানন্দ। আধুনিক ভারতের ইতিহাস যাঁরা রচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে তিনি অন্যতম। মানবমহিমাকে তিনি শীর্ষ স্থান দিয়েছিলেন। মানুষকে ঈশ্বরের আসনে বসিয়েছেন নির্দ্বিধায়। স্পষ্টভাষায় বলেছেন, 'জগতের সমুদয় ধনরাশির চেয়ে মানুষ বেশি মূল্যবান ...। মানবপ্রকৃতির মহিমা কখনও ভূলো না। আমরাই সর্বোচ্চ ঈশ্বর।' মানুষের ভেতরের শক্তিকে জাগ্রত করা ও তাকে সম্মানিত করার কঠিনতম কাজটিও তিনি সম্পন্ন করেছিলেন। বজ্রনির্ঘোষে বলেছিলেন, 'লোকে কি বলল- সে দিকে আমি ভ্রুক্ষেপ করি না। আমার ভগবানকে, আমার ধর্মকে, আমার দেশকে- সর্বোপরি - নিপীড়িত, অশিক্ষিত ও দীনহীনকে আমি ভালবাসি'। দেশ ও দশের প্রতি ওঁর এই নিঃস্বার্থ ও অতলান্ত ভালবাসা মাপা যাবে না কখনও। তিনি নিজেই বলেছেন, 'যদি আর একটা বিবেকানন্দ থাকতো তবে বুঝতে পারতো, বিবেকানন্দ কি করে গেলো।'


আত্মবিশ্বাসী হওয়ার জন্য এতভাবে তিনি আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন, স্বপ্ন দেখতে ও তার বাস্তবায়নে ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্র শিখিয়েছেন, আত্মত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন, সেই মহামানবকে উপেক্ষা করার কোনও অবকাশ নেই। আমাদের আশ্বস্ত করে তিনি বলছেন, 'দেখছিস না, পূর্বাকাশে অরুণোদয় হয়েছে, সূর্য ওঠবার আর বিলম্ব নাই...। 'আমার ভিতরে যে আগুন জ্বলছে, তোমাদের ভিতরে সেই আগুন জ্বলে উঠুক'। সত্যিই তো তাই। আমাদের চারপাশে যে 'ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা' স্তূপীকৃত হয়ে উঠেছে, তাকে পুড়িয়ে ফেলার শক্তিসঞ্চয়ের জন্য আজ বিবেকানন্দকে আমাদের চাই।


বাংলা সাহিত্য ও বিবেকানন্দ 

বহুমুখী ও বহুমাত্রিক প্রতিভা ছিল বিবেকানন্দর। ওঁর আধ্যাত্মিকতা, সৃজনক্ষমতা, বাগ্মিতা, দেশপ্রেম, সাহস ও তেজস্বিতার কথা সকলের জানা। এই সবের পাশাপাশি সাহিত্য ইতিহাস দর্শনের প্রতিও ছিল তাঁর গভীর ভালবাসা। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে সাহিত্যের এক যথার্থ সমঝদার। বাংলা সাহিত্যে চলিত ভাষায় নতুন শক্তি, মাত্রা, ও গতিবেগ সঞ্চার করেছিলেন স্বামীজি। বাঙালির মানসলোককে ইতিবাচক ও শক্তিশালী চিন্তা, ভাব ও আদর্শ দিয়ে প্রদীপ্ত করার ও সার্বজনীন মূল্যবোধে উদ্দীপ্ত করার লক্ষ্যও তাঁর ছিল।


স্বামীজি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, পরিব্রাজকের মতো মৌলিক বাংলা রচনা লিখেছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর 'সবুজপত্র' প্রকাশের আগে থেকেই তিনি চলিত বাংলা গদ্যের যথার্থ রূপ পরিকল্পনা করেছিলেন। গদ্যরচনার পাশাপাশি কবিতা, গান, স্তোত্র রচনাতেও তিনি ছিলেন সুদক্ষ। তাঁর রচিত 'সখার প্রতি', 'গাই গীত শুনাতে তোমায়', 'নাচুক তাহাতে শ্যামা' প্রভৃতি কবিতা সহজেই আমাদের অন্তঃস্থলকে স্পর্শ করে যায়। 


আমাদের অন্তরের প্রতিচ্ছবি যেমন চোখের আলোয় ধরা দেয় তেমনি পত্রলেখকের মনের কথা ধরা পড়ে চিঠিপত্রের মাধ্যমে। স্বামীজির গদ্যশৈলী ওজোগুণসম্পন্ন ও মুখের ভাষার মতোই দ্রুতচলনে সমৃদ্ধ। তাঁর ব্যক্তিত্বের অন্তর্নিহিত গতিশীলতা তাঁর গদ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে। বেদান্তের মুক্ত স্বচ্ছ দৃষ্টি ও জীবনের দিক থেকে কলকাতার কথ্যভাষার সঙ্গে এই দুটি জিনিস মিলে বোধ হয় তাঁর চিঠিপত্রের ঝরঝরে গদ্যভাষাকে গড়ে তুলেছে।  


অনুবাদের কাজেও তিনি ছিলেন স্বচ্ছন্দ। থমাস এ কেমপিস- এর 'দ্য ইমিটেশন অব ক্রাইস্ট'- এর বাংলা অনুবাদ 'ঈশানুসরণ' তাঁর উল্লেখযোগ্য অনুবাদকর্ম। বাংলা ১২৯৬ সালের 'সাহিত্যকল্পদ্রুম' পত্রিকার প্রথম বর্ষের প্রথম থেকে পঞ্চম সংখ্যায় স্বামীজির এই অমর অনুবাদটি প্রকাশ পেয়েছিল। পিতৃবিয়োগের পর অনুবাদ করে উপার্জনের সংকল্প করে স্বামীজি জয়দেবের 'গীতগোবিন্দ' গ্রন্থটি মূল ও বঙ্গানুবাদ সহ মতিলাল বসুকে লিখে দিয়েছিলেন। মতিলাল বসু নিজের প্রেস থেকে সেটি প্রকাশ করেছিলেন। এছাড়াও হার্বাট স্পেন্সরের 'এডুকেশন : ইনটেলেকচুয়াল, মরাল অ্যান্ড ফিজিকাল' নামে বইটির ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ স্বামীজি করেছিলেন 'শিক্ষা' নামে। 'বসুমতী' পত্রিকার প্রকাশক উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের পত্রিকা ও গ্রন্থপ্রকাশনার ক্ষেত্রে স্বামীজির উৎসাহ ও প্রেরণা অনেকখানি কার্যকর ছিল। প্রকৃতপক্ষে স্বামী বিবেকানন্দ বাংলা সাহিত্যের বিকাশে ও সমৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। 


শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ 

শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন, সাধনা ও বাণীতে সর্বত্র  মানুষের জয়গান। সমগ্র অন্তর দিয়ে তিনি মানুষকে ভালবাসতেন। সে ভালবাসার স্বার্থচিন্তা বা ভেদবুদ্ধি ছিল না। তাঁর  অমোঘ আকর্ষণে সমাজের সব স্তর থেকে ছুটে এসেছেন অজস্র মানুষ। ছুটে গেছেন দক্ষিণেশ্বরে। কেউ জমিদার,কেউ ধর্মপ্রবক্তা, কেউ পন্ডিত, কেউ নাট্যকার বা সাহিত্যিক। তাপিত, ব্যথিত, অসহায় মানুষও এসেছেন। কেউ এসেছেন জীবনজিজ্ঞাসা নিয়ে, কেউ জ্ঞানের অন্বেষণে, কেউ বা শান্তির আশায়। তাঁর হৃদয়দুয়ার খোলা ছিল সকলের জন্যই।


অনন্তমনা শ্রীরামকৃষ্ণের সেবাভাবনার  মূল হাতিয়ার হয়ে উঠেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। সিমলাবাসী  তরুণ নরেনকে দেখেই শ্রীরামকৃষ্ণ বুঝতে পেরেছিলেন, এই সেই যুবক যে দেশে দেশে 'শিক্ষে দিয়ে' মানুষকে আত্মবিশ্বাসী হতে, আপন পায়ে দাঁড়াতে ও দুস্থ-তাপিত মানুষদের সেবা করতে নির্দেশ দেবে। তাইতো দক্ষিণেশ্বরে নরেন্দ্রনাথকে দেখে তিনি বলে উঠেছিলেন, 'মা তোকে তাঁর কাজ করবার জন্য সংসারে টেনে এনেছেন, তোকে আমার পশ্চাতে ফিরতেই হবে, তুই যাবি কোথায়? তুই শিক্ষে দিবি।' ঠাকুরের সেই কথা পরবর্তী কালে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়।


স্বামী বিবেকানন্দর বাণী সর্বজনীন উদারতায় ভরা। সকলেই তাঁর বাণী গ্রহণ করতে পারেন। সেখানে কোনও মহাদেশ, দেশ, ধর্ম, সম্প্রদায়, জাতির প্রশ্ন নেই। স্বামীজির কাছে মানুষই শেষ কথা। মানুষের সেবাই ঈশ্বরের পূজা। শ্রীরামকৃষ্ণের থেকে পৃথক কোন সত্ত্বা নরেন্দ্রনাথের ছিল না। শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রনাথের থেকে নিজেকে অভিন্ন জানতেন। নরেন্দ্রনাথের রচনার মধ্যেও  প্রকাশ পেয়েছে অভিন্নতা। নরেন্দ্রনাথের পরবর্তীকালে লেখা একটি রচনা : 'প্রভু তুমি প্রাণসখা তুমি মোর। / কভু দেখি আমি তুমি, তুমি আমি'। এমন সাযুজ্যবোধ নিয়েই নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবধারার ব্যাখ্যা, প্রচার ও ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করাকেই তাঁর জীবনের প্রধান ব্রত বলে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর নিজের কথা: 'যে সকল ভাব আমি প্রচার করিতেছি, সেগুলি তাঁহার চিন্তারাশিরই  প্রতিধ্বনি মাত্র।'


প্রকৃতপক্ষে দুজনেই নিজ-নিজ প্রাপ্ত চাপরাশ সনিষ্ঠভাবে পালন করেছেন, দু'জনেই শ্রী জগন্মাতার  নির্দেশ অনুযায়ী জীবনব্রত পালন করেছেন এবং দু'জনেই 'লোকশিক্ষক'। এই পরিপ্রেক্ষিতেই সম্ভবত শ্রীরামকৃষ্ণ চাপরাশে লিখেছিলেন, 'জয়রাধে পৃমমেহি  নরেন সিক্ষে দিবে - জখন ঘরে বাহিরে হাঁক দিবে জয়রাধে'। আইনের দৃষ্টিতে চাপরাশ ব্যক্তিবিশেষকে অধিকার দেয়, বলা বাহুল্য ব্যক্তির যোগ্যতা বিবেচনা করে। চাপরাশের অন্তর্ভুক্ত বিষয় ও তার পরিধি সম্বন্ধে মতবিভিন্নতা স্বাভাবিক। স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ এবং বিবেকানন্দ যা  করেছিলেন, তার মধ্যে মতভিন্নতা ছিল না।


ভারতবর্ষের পুনর্জাগরনের জন্য নারীজাগরণ ও জনসাধারণ স্বনির্ভর হওয়ার শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় কর্মসূচীগুলি আধ্যাত্মিক মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শ্রীরামকৃষ্ণের 'জীবশিববাদ' তত্ত্বের সাহায্যে। এর জন্য প্রয়োজন সমস্ত নরনারীকে নারায়ণজ্ঞানে সেবা করা। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে সেবা করলে সেব্য ও সেবক এই দুয়েরই আধ্যাত্মিক উন্নতি সুনিশ্চিত। আমাদের এ কথা মনে রাখতে হবে যে, নরেন্দ্রনাথ চাপরাশ-ধারী পেয়াদা বা আরদালি মাত্র ছিলেন না। তিনি ছিলেন স্বতন্ত্রপুরুষ, প্রতিভাবান এক ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব।


শিকাগো বক্তৃতা

১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে শিকাগো বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে   স্বামীজির ভাষণ বিশ্বের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। তাঁর বক্তৃতায় স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, সব ধর্মের সারমর্ম এক ও প্রত্যেক ধর্মই তার নির্দিষ্ট পথে সেই একই লক্ষ্যের দিকে চলেছে। স্বামীজি তাঁর ঐশ্বরিক বাগ্নিতা ও অসামান্য ব্যক্তিত্বের মধ্যে দিয়ে সকলের সামনে তুলে ধরেছিলেন হিন্দু ধর্মের শাশ্বত সত্য, তার পবিত্রতা ও সনাতন মহিমা। অন্য ধর্মের প্রতিনিধিরা যেখানে নিজের নিজের ধর্ম সম্বন্ধেই বলেছিলেন, স্বামীজি সেখানে দেখালেন যে, সব ধর্মই সত্য। কারণ, প্রতিটি ধর্মই মানুষকে একই ভগবানের কাছে নিয়ে যায়। ধর্মমহাসভায় তাঁর বক্তৃতাটি তিনি শুরু করেন, 'সিস্টারস অ্যান্ড ব্রাদার্স অফ আমেরিকা' এই সম্বোধনের মধ্য দিয়ে। তাঁর এই হৃদয়স্পর্শী সম্ভাষণ উপস্থিত কয়েক হাজার শ্রোতাকে আবেগে উদ্বেল করে তুলেছিল। টানা দু'মিনিট তাঁরা করতালি দিয়ে অভিনন্দিত করেছিলেন স্বামীজীকে। তাঁর প্রতিটি ভাষণের সারমর্ম ছিল সমন্বয়, শান্তি, পরমতগ্রহীষ্ণুতা ও  বিশ্বজনীনতা। বস্তুত এগুলি যেমন শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী, তেমনি ভারতবর্ষেরও বাণী। সংবাদপত্রগুলি একযোগে তাঁর সম্বন্ধে বলেছিল, তিনিই ধর্মমহাসভায় শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ও তাঁর বাণী আকাশের মতোই উদার। বিবেকানন্দর সেই বক্তব্য আজও সমান প্রাসঙ্গিক। 


স্বামীজির সংগঠনশৈলী 

শ্রীরামকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ, ত্যাগী ও গৃহী সন্তানেরা সকলেই ছিলেন আধ্যাত্মজগতের মহারথী। তা সত্ত্বেও তাঁরা প্রত্যেকেই স্বামীজীর বহুমুখী ভাস্বর ব্যক্তিত্বের প্রভাবে কমবেশি প্রভাবিত হয়েছেন। রামকৃষ্ণ মঠের অনেক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক স্বামীজির হাতেই তৈরি। সংস্থা সংগঠনের ক্ষেত্রে তিনি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন এই দু'টি সংস্থা স্থাপন করেছিলেন। ১৮৯৭ সালে শ্রীরামকৃষ্ণের ৪০ জন গৃহী ও সন্নাসী শিষ্যদের একটি সভায় স্বামীজি প্রস্তাব করেন যে, জগতের কল্যাণের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর জীবন ও সাধনার মাধ্যমে যে-সনাতন সত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছেন, সেই সত্যের প্রচারের জন্য তাঁর নামাঙ্কিত একটি সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠিত হোক। প্রস্তাবটি গৃহীত হলে এই সঙ্ঘটির নাম রাখা হয় রামকৃষ্ণ মিশন অ্যাসোসিয়েশন। বেলুড়ে মঠ স্থাপন করে আইন অনুযায়ী ১৯০১ সালে রামকৃষ্ণ মঠ নামে একটি দেবোত্তর ট্রাস্ট রেজিস্ট্রি করা হয়। এই দুটি সংস্থা স্থাপন করার পর স্বামীজি স্থির করলেন, সমাজের নিম্নস্তরের তথাকথিত নীচজাতিদের যত শীঘ্র সম্ভব উন্নত করতে হবে এবং এই কাজের দায়িত্ব উচ্চবর্ণের মানুষদেরই  বহন করতে হবে। দ্বিতীয়ত নারীজাতির দুরবস্থা দূর  করে সমাজে তাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।


১৮৯৫ সালে স্বামী বিবেকানন্দ  রামকৃষ্ণকে লিখলেন, 'জগতের কল্যাণ নারীজাতির অভ্যুদয় না হইলে সম্ভাবনা নাই; এক পক্ষে পক্ষীর উত্থান সম্ভব নহে'। তৃতীয়ত, সমাজের অবদমিত শ্রেণীর উন্নতির উপায় হিসাবে স্বামীজি স্থির করলেন সংসারত্যাগী সাধুসন্ন্যাসীরা শাস্ত্রব্যাখ্যা ও ধর্মশিক্ষার সঙ্গে ব্যবহারিক এবং কার্যপ্রদ শিক্ষার বিস্তার করলে সমাজের আর্থিক উন্নতি দ্রুত হবে। চতুর্থত, ধ্যাননেত্রে ভারতের সমগ্র ইতিহাস সমীক্ষা করে স্বামীজি অনুভব করলেন ভারতের বৈশিষ্ট্য সংঘাত নয়, সহনশীলতা ও সমন্বয়। সংঘাতদীর্ণ বিশ্বের দরবারে ভারতকে পুনঃপ্রতিষ্ঠ করার প্রকৃষ্ট উপায় ভারতের এই বৈশিষ্ট্য এবং তার আধ্যাত্মিক অবদান প্রচার।


স্বামীজি বলেছিলেন যে, সমগ্র মানবজাতির সমূহ চিন্তাধারা প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যেই নিহিত আছে এবং এই প্রচ্ছন্ন জ্ঞানভান্ডারকে শিক্ষা ও সাধনার দ্বারা জাগ্রত করা যায়। আমাদের জ্ঞানের সীমিত পরিধির মধ্যেও আমরা দেখতে পাই যে, আমাদের  শাস্ত্র, বিশেষত বেদান্ত, পুরাণ, ন্যায় ও নীতিশাস্ত্রের মধ্যেই সংহতির মহৎ সত্য গুলি নিহিত আছে। সুতরাং বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, অসীম শাস্ত্রজ্ঞান ও গভীর চিন্তাশক্তির ব্যবহার করে স্বামীজি একটি সুদূরপ্রসারী সংস্থার সৃষ্টি করেছিলেন।


ধর্ম, ঈশ্বর ও বিবেকানন্দ
 
আমার এক বরিষ্ঠ বন্ধু বিবেকানন্দ নিয়ে চর্চা করেন। বিবেকানন্দকে নিয়ে মনের মধ্যে কিছু প্রশ্ন আলোড়িত হচ্ছিল। একদিন সেই বন্ধুটির সঙ্গে দেখা করলাম। জানতে চাইলাম, ধর্ম ও ঈশ্বরকে স্বামীজি তাঁর ব্রত উদযাপন থেকে কখনও বাদ দেননি। কী মনে হয়, আজকের দিনে দেশ ও দশের উন্নতিকল্পে কি ধর্ম ও ঈশ্বর প্রাসঙ্গিক? উত্তরে তিনি বললেন, ভারতের মানুষের জীবন ঈস্বরকেন্দ্রিক। ভারত আধ্যাত্মিকতা বলে বলীয়ান বলেই ভারতীয় সভ্যতা সেই বৈদিক যুগ থেকে আজও পৃথিবীতে টিকে আছে। স্বামীজি নিজেই বলতেন, ভারতের ধর্ম ও ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে ভারতের উন্নতি হবে না। তবে ধর্ম বলতে স্বামীজি পূজা, পাঠ, উৎসব, ধর্মীয় আলোচনা, ব্রত অনুষ্ঠান এসব বোঝাননি। তিনি বলেছেন, মানুষের মধ্যে যে দেবত্ব আছে অর্থাৎ মানুষের সদগুণ আছে, সেগুলিরই প্রকাশ করার নাম হল ধর্ম। বাকি সব গৌণ। এই গৌণ  বিষয়গুলি মানুষকে ধর্মীয় পথে সাহায্য করে মাত্র। আর ঈশ্বর বলতে স্বামীজি বলেছেন সেই এক অখণ্ড সত্ত্বা  বা চৈতন্যশক্তির বিভিন্নরূপের  প্রকাশ।


আমার কৌতুহলী মন জানতে চাইল, ভারতীয় আদর্শের মধ্যে সত্য ও ত্যাগকে স্বামীজী সর্বোচ্চ আসন দিয়েছিলেন। কিন্তু রাজনীতি-জর্জর এই দেশে আজ বড় অভাব এই দুটি আদর্শের। তাহলে কীভাবে সত্য ও ত্যাগের প্রতিষ্ঠা সম্ভব?  তিনি স্মিতমুখে বললেন, সত্য আর  ত্যাগই  ভারতীয় আদর্শের ভিত্তিভূমি। স্বামীজি তো বলেছেন, সত্যের জন্য সব কিছু ছাড়া যায়। সত্যের কাছে সমাজ মাথা নোয়াবে, সত্য তা করবে না। তা না হলে আদর্শ টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। ত্যাগের অর্থ নিজের স্বার্থ বিসর্জন দেওয়া অর্থাৎ নিঃস্বার্থপরতা। স্বামীজি এও বলেছেন, নিঃস্বার্থপরতাই  হল ভগবান। এই দুটি আদর্শ অধিকাংশের মধ্যে আছে বলে ভারত এখনও সগর্বে মাথা তুলে আছে। নইলে তার পতন অবশ্যম্ভাবী ছিল।


স্বামীজি অর্থনৈতিক চিন্তাচেতনার স্তর জুড়ে ছিল বেদান্তবাদী দর্শন। এই দর্শনের চর্চা কি আজকের জীবনযাত্রায় অনুসরণ করা সম্ভব? আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বললেন, নিশ্চয়ই সম্ভব। এই পথে এগোলেই দেশ ও সমাজের মঙ্গল হবে। স্বামীজীর বেদান্তবাদী  দর্শন এই কথা বলে যে, মানুষের মধ্যেই সেই একই চৈতন্যের সত্ত্বা আছে। মানুষের শক্তির তারতম্য অনুসারে সেই চৈতন্যের প্রকাশ বিভিন্ন ভারত পরিব্রাজক কালে স্বামীজি দেখেছিলেন কীভাবে মানুষ অত্যাচারিত হচ্ছে কীভাবে মানুষ গভীর দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছে। এই দৃশ্য তাকে ব্যথিত করল, তিনি বেদান্তর একত্বের কথা অনুভব করলেন আপন অন্তরে।


স্বামীজি বুঝলেন, এসব মানুষের আর্থিক উন্নতি না করতে পারলে এদের উন্নতি হবে না। আর এদের উন্নতি না হলে দেশ ও সমাজের উন্নতি হবে না। তাই স্বামীজি বললেন, শুধুমাত্র বেদান্তের বাণী প্রচার করলে হবেনা। বেদান্তের বাণীকে প্রাত্যহিক জীবনের ও ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করতে হবে। তিনি এই প্রয়োগের নাম দিলেন ব্যবহারিক বেদান্ত বা ফলিত বেদান্ত। কিন্তু কীভাবে তা প্রয়োগ করা যায়? সমষ্টিগত বা ব্যক্তিগতভাবে তো করা যায়ই, সংগঠনের মাধ্যমেও মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি করা সম্ভব। শুধু রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন নয়, মঠ- মিশনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সারা দেশে বেশ কয়েক হাজার সংগঠন নীরবে কাজ করে যাচ্ছে মানুষের অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য।


বিবেকানন্দ ও যুবসমাজ 

যুবসমাজের একটি বড় অংশ আজ বিবেকানন্দ সম্পর্কে উদাসীন। অথচ শতবর্ষ আগেও তরুণ প্রজন্ম উদ্ভূত হয়েছিল তাঁর বাণী ও আহ্বানে। সাগ্রহে জানতে চাইলাম, এখান থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী? বন্ধুটি স্মিতমুখে বললেন এটা একেবারে ভুল ধারণা যে যুব সমাজের অনেকেই বিবেকানন্দ সম্পর্কে উদাসীন। একশো বছর আগে স্বামীজীর আদর্শ মুষ্টিমেয় সংগঠন ছিল। আজ সেখানে কয়েক হাজার সংগঠন হয়েছে। সংগঠনের যুবকরাই করছে। স্বামীজীর বাণীতে উদ্বুদ্ধ হওযার প্রবণতা, মানুষের জন্য কিছু করবার তাগিদে যুবকদের মধ্যে আগেও গভীর আগ্রহ দেখা দিয়েছে। এখনও দিচ্ছে। কারণ স্বামীজীর বাণীতে বা আহ্বানে যাদের উদ্দীপনা হয়েছে তারা যদি ঠিকমতো চলেন, তাহলে বলতে হবে না, নবীন প্রজন ঠিকই এঁদের হাত ধরে নেবে।


বরিষ্ঠ বন্ধুটির থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে আসতে আসতে ভাবছিলাম, এই অস্থির সময়ে মানুষ হয়ে ওঠার ভাবনাটাই সকলের জীবনে, দেশের ও রাষ্ট্রের কাছে সব থেকে বেশি অগুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে।  আর এই মনুষ্যত্ব অর্জনের প্রধান সাধনাই হল সত্য, পরমতসহিষ্ণুতা,  অপরকে সন্মান দেওয়া, এগিয়ে চলার সাহস দেখানো। এগিয়ে চলা মানে শুধু প্রথাগত ধর্মীয় চেতনায় আবদ্ধ হওয়া নয়, তা দেশের শিল্পে, সাহিত্যে, সঙ্গীতে, খেলাধুলায়, সুন্দর সমাজ চেতনায়, পরস্পর সহানুভূতিতে, যথার্থ ভালবাসার বহুমুখী মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হওয়া বোঝায়।


স্বামীজির ওপর তাঁর  এই আলোচনা ঋদ্ধ করল আমাকে। সম্যক উপলব্ধি হল, স্বামীজির মন ছিল এক বহতা নদী, যা সতত মানবকল্যাণের অভিলাষে অনন্তের অভিমুখী।  মানবতার মহান কর্মযজ্ঞে অংশ নিয়ে তাঁর স্বল্পায়ত জীবনে বিবেকানন্দ যে 'দাগ' রেখে গেছেন তা এতটাই গভীর, সত্য ও কালজয়ী যে, তাঁকে আমাদের জীবনধারা থেকে মুছে ফেলা অসম্ভব। যে-সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি সেখানে তাঁর ভূমিকা যেন দিন দিন অনিবার্য হয়ে উঠছে। এই একবিংশ শতকেও এদেশের মানুষের কাছে তাই তিনি সমান প্রাসঙ্গিক।

Comments

  1. অসম্ভব সমৃদ্ধ একটি প্রবন্ধ পড়লাম | মন ভরে গেলো |

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লিখেছ। স্বামীজীকে আরও বেশি করে জানা দরকার -- এই সময়কালে।

    ReplyDelete
  3. মানুষ যদি ধর্মান্ধ না হত তাহলে বিবেকানন্দের কথা কেউ শুনত না।বিবেকানন্দ মহাপুরুষ হলে জাকির নায়েকও মহাপুরুষ।

    ReplyDelete
  4. খুবই সুন্দর এবং বর্তমান সময়ের খুবই প্রাসঙ্গিক লেখা।

    ReplyDelete
  5. বাংলা তথা মানব সভ্যতার অভূতপূর্ব জীবন দর্শনের নাম স্বামীজি। শিকাগোর ধর্মসম্মেলনে উনিই সর্বপ্রথম সকলকে" ভাই বোন" সম্বোধন করেছিলেন। স্বামীজিকে নিয়ে আপনার এই অনন্য সাধারণ প্রবন্ধে প্রচুর অজানা তথ্য জানতে পারলাম। এমন প্রবন্ধ আপনার কলমে আরও চাই। শুভেচ্ছা জানবেন।

    ReplyDelete

Post a Comment