প্রবন্ধ - শৌভিক রায়



ধ্বংসের মুখে ডুয়ার্সের অসামান্য সম্পদ রাঙামাটি  চা-বাগানের চাইবাসা সমাধিস্থল  





জন উইলিয়াম থমসন যখন এদেশে আসেন, তখন তিনি সদ্য যুবক। স্কটল্যান্ডের বাকি পাঁচটি তরুণের মতোই তাঁর চোখে ছিল এই দেশকে পাল্টে দেওয়ার স্বপ্ন।   


অবশ্য দেশ বলতে তখন চারদিকে মাইলের পর মাইল জুড়ে শ্বাপদ সংকুল দুর্ভেদ্য অরণ্য। উত্তরে হিমালয় ঝকঝক করে। পাহাড়ে  সৃষ্ট বরফগলা জলের বেগবান নদী ছাড়াও, অজস্র ঝোরা আর ছোট ছোট নদী সাপের মতো এঁকেবেঁকে বয়ে চলে সমগ্র অঞ্চল জুড়ে। এখানে কিছুদিন আগেও গিরিপথ ধরে দুর্দান্ত ভুটিয়ারা সমতলে নেমে  এসে, লুটতরাজ চালিয়ে ফিরে যেত তাদের নিষিদ্ধ দেশ, সাংগ্রিলা বা লস্ট হরাইজনে।


কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া, হিংস্র প্রাণী এখানকার আদি বাসিন্দাদের নিত্যসঙ্গী। এই বিরুদ্ধে প্রকৃতির সঙ্গে সংঘাতে মাত্র ৩৫ বছর লড়াই করতে পেরেছিলেন জন উইলিয়াম থমসন। তবে এই তালিকায় তিনি একাই নন, আছেন উইলিয়াম ভ্যালেন্টাইন শিয়ারার, ফ্রেডেরিক চার্লস জর্ডানের মতো আরও অনেকে।  এই একই জায়গায় খুব কম বয়সে মৃত্যুর পাশাপাশি, তাঁদের সবার মধ্যে আর একটি মিলও রয়েছে। এঁরা সকলেই ছিলেন টি-প্লান্টার। সবুজ সোনা বা চায়ের জন্য ইংল্যান্ড-সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে এদেশে ছুটে এসেছিলেন।  কিন্তু ডুয়ার্সের পরিবেশ তাঁদের বেশিদিন সহ্য হয় নি। ফল, অকাল মৃত্যু। মৃত্যুর পরে এঁরা সকলেই সমাধিস্থ হয়েছিলেন মালবাজারের কাছে রাঙামাটি চা-বাগানের চাইবাসা ডিভিশনে। পশ্চিম ডুয়ার্স তো বটেই, সম্ভবত সমগ্র ডুয়ার্সে এত প্রাচীন সমাধিস্থল আর একটিও নেই। সেদিনের সেই ডুয়ার্স আজ সম্পূর্ণ বদলে গেছে আর সেই বদলের সঙ্গে তাল রেখেই বোধহয় আমরা ভুলতে বসেছি প্রায় দেড়শ বছরের পুরোনো সমাধিস্থলটিকে। 


সবুজ সোনা বা চা একটা সময় ছিল শুধুমাত্র চিনের নিজস্ব উৎপাদন। সম্রাট শেঙের আমলে আবিষ্কৃত পানীয়টি, চতুর্দশ শতকে সমগ্র চিনে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং সপ্তদশ শতকে ইউরোপিয়ান অভিযাত্রীদের হাত ধরে পৌঁছে যায় ইউরোপে। উষ্ণ এই পানীয়টি ইউরোপেও অত্যন্ত সমাদর পায়। ইংল্যান্ডে তো চা প্রায় জাতীয় পানীয়তে পরিণত হয়! ১৮৩৩ অবধি ইংল্যান্ডের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চিন থেকে ইউরোপে চা চালানে একচেটিয়া রাজত্ব করত। কিন্তু এরপর ইউরোপের বিভিন্ন কোম্পানি এসে গেলে তাদেরকে কড়া মোকাবিলার সম্মুখীন হতে হয়। ফলে ব্যবসায়ী ইংরেজরা নিজেদের অধীনে চা-বাগান তৈরির ব্যাপারে সচেষ্ট হয়। ইংরেজদের ভাগ্যলক্ষ্মীও তাদের পক্ষে ছিল। কেননা ১৮২৩ সালে মেজর রবার্ট ব্রুস আসামের জঙ্গলে হঠাৎ করেই চা-গাছ আবিষ্কার করে ফেললেন। ভবিষ্যৎ বুঝতে পেরে, ধূর্ত ইংরেজরা ১৮২৫ সালে দ্রুত আসাম দখল করে নেয়। শুরু হয়ে যায় চা-চাষের উদ্যোগ আর তা সফল হয় ১৮৩৮ সালে।  সে বছর লন্ডনের আন্তর্জাতিক নিলামে আসামের চা বিক্রি হয় এবং সুগন্ধের জন্য অচিরে সেই চা ইউরোপে সাড়া ফেলে। ফলে আসামের চায়ের এক নতুন দিগন্ত খুলে যায় ও দলে দলে ইংরেজরা আসামে আসতে শুরু করে। আসাম তার চায়ের জন্য পৃথিবী-বিখ্যাত হয়ে ওঠে। 


আসামে চায়ের এই আবিষ্কার ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে চা-বাগান প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইংরেজদের উদ্যোগী করে তোলে। ১৮৪১ সালে ডঃ ক্যাম্পবেল দার্জিলিঙে নিজের বাড়িতে খানিকটা শখেই চা-গাছ পুঁতেছিলেন। সেই গাছ তরতরিয়ে বেড়ে ওঠায় ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিল যে, দার্জিলিঙের মাটি ও আবহাওয়া চা-চাষের অনুকূল। এরপর, দার্জিলিঙের সিভিল সার্জেন মেজর গ্রামলিনের হাত ধরে দার্জিলিঙে একের পার এক চা-বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ডুয়ার্সের মাটিও যে চা-চাষের অনুকূল সেটা ইংরেজরা তখনও বুঝতে পারে নি। ফলে, দার্জিলিঙে চা-বাগান প্রতিষ্ঠার বেশ কয়েক বছর পর, ১৮৭৪ সালে ডুয়ার্সের গজলডোবায় যখন রিচার্ড হাউটন প্রথম  চা-বাগান তৈরী করলেন। তাতে সাফল্য এলে, শুরু হল গভীর জঙ্গল কেটে চা-বাগান প্রতিষ্ঠার কাজ। মাত্র কয়েক বছরেই ডুয়ার্সের নানা অঞ্চলে গড়ে উঠলো ১৯টি জনপদ শুধুমাত্র চা-বাগানকে কেন্দ্র করে। 


সমগ্র ডুয়ার্সের মতো পশ্চিম ডুয়ার্সের মালবাজারকে কেন্দ্র করে একে একে প্রতিষ্ঠিত হল মিনগ্লাস, বেদগুড়ি, সাতখাইয়া, বাগরাকোট, কাঠামবাড়ি,সামসিং, আনন্দপুর, রাঙামাটি, গুরজং, নিদাম, বড়দিঘি, সোনগাছি, ইত্যাদি সহ অজস্র চা-বাগান। সেই চা-বাগান তৈরির কাজে ছোটনাগপুর, নেপাল ও সিকিম থেকে নিয়ে আসা হল শ্রমিকদের। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে ডুয়ার্সের চা-শ্রমিকদের মধ্যে ৮০ শতাংশ ছোটনাগপুর অঞ্চল থেকে নিয়ে আসা শ্রমিকেরা। বাকি ২০ শতাংশ শ্রমিক নেপাল ও সিকিম থেকে আনা হয়। এল বাঙালি কেরানিকুল, নেপালি চৌকিদার, পাঞ্জাবি দফাদার, চিনা কার্পেন্টার। তবে চিনাদের আনার পেছনে আরও একটা কারণ ছিল। চা-চাষের ব্যাপারে তারা ছিল দক্ষ প্রশিক্ষক। তাদের সাহায্য ছাড়া এগোনো সম্ভব ছিল না। আর এদের সবার ওপরে ছিল ইউরোপিয়ান ম্যানেজার এবং প্ল্যান্টার। একদা জনমানবহীন ডুয়ার্স বদলাতে শুরু করেছিল সেই তখন থেকেই। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ মিলে ডুয়ার্সে মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে উঠলেও, সঙ্গত কারণেই ইউরোপিয়ানরা নিজেদের আলাদা করেছিল। বিভিন্ন জায়গায় তাদের নিজস্ব ক্লাব, খেলাধুলা, আমোদপ্রমোদের আলাদা ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হয়।


কিন্তু  প্রতিকূল আবহাওয়া, অস্বাস্থ্যকর এলাকা, হিংস্র প্রাণী, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর ইত্যাদি সব মিলে ডুয়ার্স সেই সময় ছিল যথেষ্ট প্রাণঘাতী। তাই চা-বাগান প্রতিষ্ঠার দিন থেকে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে এখানে প্রাণ হারানো ইউরোপিয়ানদের সংখ্যা কম নয়। মালবাজারের কাছে রাঙামাটি চা-বাগানের চাইবাসা ডিভিশনের পরিত্যক্ত সমাধিস্থান সেই নিদর্শন বহন করে চলেছে আজও। একটি বিরাট অঞ্চলের ইউরোপিয়ানদের সমাধিস্থল ছিল এটি। যদিও এই সমাধির ঠিক কবে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তা জানা যায় না, কিন্তু এই অঞ্চল তো বটেই তিস্তা থেকে সংকোশ অবধি ডুয়ার্সের বিস্তীর্ন এলাকায় এত প্রাচীন সমাধিস্থল আর দেখা যায় না।  



এখানে রয়েছে  ১৮৮০ সালে মৃত রোডেরিক ম্যাকলিডের সমাধি। এখনও অবধি যে সব স্মৃতিসৌধের গায়ে উৎকীর্ণ করা লেখা পড়া যায়, তাদের মধ্যে এটিই সবচেয়ে প্রাচীন।  পূর্বে উল্লেখিত জন উইলিয়াম থমসন, চা-বাগানের সূত্রেই, ডামডিমে আসেন। কিন্তু ডুয়ার্সের পরিবেশ তাঁর সহ্য হয় নি। ১৮৮৯ সালে তাঁর মৃত্যু হলে তাঁকে এখানে সমাধিস্থ করা হয় পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে। ১৮৯৫ সালে, ২৪ বছর বয়সে, উইলিয়াম কসের মৃত্যু হলে তাঁর সমাধির ওপর শ্বেতপাথরের ফলকে আবেগময় কবিতা লেখে তাঁর প্রিয়জন অচেনা কোনও কবি। বাগরাকোট চা-বাগানের টি প্ল্যান্টার উইলিয়াম ভ্যালেন্টাইন শিয়ারার ১৯১৮ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে মারা গেলে, ভাই ও বোন, পিটার কালটার ও আবার্ডিন, স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করেন তাঁর সমাধিতে। এই সমাধিস্থলে রাঙামাটি চা-নবাগানের তদানীন্তন ম্যানেজার ডব্লিউ ডি কাউল ১৯১৯ সালে তাঁর পত্নী, মরিয়াম ইডাকে সমাধিস্থ করেন। মরিয়াম মারা যান ৪৯ বছর ১১ মাস বয়সে।  সমাধির ওপরে কাউল সাহেব  তৈরি করেন শ্বেত পাথরের অনিন্দ্যসুন্দর এক পরী, যার চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে অদ্ভুত বিষাদ। বর্তমানে সেই পরীর ডানা দুটি অক্ষত থাকলেও, হাত দুটি ভেঙে গেছে। ফলকে উৎকীর্ণ লেখাটিও কষ্ট করে পড়তে হয়। কিন্তু একশ বছর পেরিয়েও  শ্বেতপরী বলে চলেছে এক অমরপ্রেমের কথা। আবার, অন্য অনেকের মতো, ১৯২৩ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে, কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে সমাধিস্থ হন ফ্রেডেরিক চার্লস জর্ডান। তাঁর কর্মস্থল ছিল সাতখাইয়া চা-বাগান। লিস রিভার চা-বাগানের জন অ্যান্ডার্সন পার্থ দম্পতি ১৯৩৪ সালে তাঁদের ২৭ বছর বয়স্ক সন্তান জেমসের জন্য যখন সমাধিটি  তৈরি করেন, তখন তাঁদের মানসিক অবস্থাটিও সহজে বোঝা যায় সমাধির ওপর লেখা পড়ে। হয়ত একইরকম মানসিক অবস্থা নিয়ে, মিনগ্লাস চা-বাগানের মালিক জন রাইট তাঁর সন্তান জর্জকে সমাধিস্থ করেন। মৃত্যুর সময় জর্জের বয়স ছিল মাত্র আটাশ বছর। রাঙামাটি চা-বাগানের  জন জেমস লিথাল লোগান ৫১ বছর বয়সে মারা যান। ১৯৪৭ সালে তিনি এখানে  সমাধিস্থ হন। বড়দিঘি চা-বাগানের সুইনটন থমাস আগাসি সম্ভবত সমাধিস্থ হওয়া শেষ ব্যক্তি। তাঁর মৃত্যু হয় ৪৭ বছর বয়সে  ১৯৬৮ সালে। রয়েছে আরও বেশ কিছু  সমাধি যেগুলির পরিচয় জানা যায় না। তবে এঁরাও যে চা-বাগানকে কেন্দ্র করে কোনও না কোনও সময় ডুয়ার্সে পা রেখেছিলেন, সেকথা স্পষ্ট বোঝা যায়।এঁরা  সকলেই  শুয়ে রয়েছেন  হিমালয়ের পাদদেশে দুটি-পাতা একটি কুঁড়ির চা-বাগানের সবুজ বিস্তারের মাঝে এই বিরাট সমাধিস্থলে। 


একদা টাটার অধীনে থাকা চা-বাগানটির মালিকানায় এখন আমালগামেট। দুর্ভাগ্য, সমাধিস্থলটি সংরক্ষণের কোনও প্রচেষ্টাই নেই। ফলে, ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে এটি। রাতে তো বটেই, দিনেরবেলাতেও মাঝে মাঝে বসে নেশার আসর। চা-বাগানের কর্মী দিলবাহাদুর থাপা কয়েকবছর আগে সঙ্গী-সহ সমাধিস্থলের দেখাশোনা করলেও সমাধিস্থল আজ প্রহরীবিহীন। এক সময়ে প্রচুর ঔষধি বৃক্ষ সমাধিস্থলের বিরাট সম্পদ ছিল। কিন্তু বদল তো সর্বত্র। সবুজ চা-বাগানের পাশে ভাঙা প্রাচীরে ঘেরা সমাধিস্থলটি দেখে মন সত্যি খারাপ হয়। ডুয়ার্সের অতীত ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সমাধিস্থলটির সঠিক সংরক্ষণ না হলে ইতিহাসের একটি অনবদ্য অধ্যায় মুছে যাবে অচিরেই। বদলে যাওয়া ডুয়ার্সে এই বদল আদৌ কাম্য নয়!

চিত্র : লেখক

Comments