গল্প - মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস


অন্ধ স্বপ্নের আলোঘর


আজও ঘড়িতে সাড়ে তিনটে। কেন এত দেরী মেলাতে পারেনা পিয়া। ওদিকে রান্নাঘর সামলে সাফসুতরো করতে করতেই বিকেল পাঁচটা। সুতরাং এদিকে ঝুঁকবেই তো রাত। তবে সবটা সময় বেশ দৌড়েই কাটছে ঘরের ভিতর। বাইরে গিয়ে কোনও দিন চাকরী করেছে মনে হচ্ছেনা। একতলার কেমন ঠান্ডা হয়ে থাকা ঘরটায় ঢুকলে সব তালগোল পাকিয়ে যায় ওর। দুঘরে দুটো মশারীতে দুজন মরার মত ঘুমোচ্ছে। ঘড়িতে দুপুর বারোটা। আজকাল নাকি ঐ রীতি। যেখানে চাও সেখানেই উড়িয়ে দেখ ছাই ঐ একই অমূল রতন মিলবে। পিয়া আজকাল ওদের প্রতিশিক্ষায় কোন রিঅ্যাক্ট করেনা। প্রথম প্রথম তর্ক, early to bed and early to rise এর প্রচুর জ্ঞান বিকিয়েছে। সব ব‍্যানা বনে মুক্তোর মত হারিয়ে গেছে ধূলি হয়ে। এখন ঐ একা হাতে কাজ সারতে মাঝে মাঝে কেমন কাতর যন্ত্রণা হয়। বয়স তো মেঘে মেঘে কম হলোনা! রান্নাঘরে অতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা সবটা স্বাস্থ‍্যকরও না। কিন্তু পরিষেবা পেতে কার না ভাল লাগে! আর পুরুষতন্ত্র কথাটা এত ক্লিশে, মনে করতেও ইচ্ছে করেনা। বাড়ীর মায়েদের সঙ্গে বরাবর এমনকি আজও আধুনিকীকরণ নিয়ে বাইরে যতই গলাবাজি করা হোক, ব‍্যবহার করা হয় 'লাইক আ মেড সারভেন্ট'। সর্বত্র অবশ‍্যই এক চিত্র নয়। যে যত হামবরাই হওনা কেন, বাড়ীতে প্রতিবাদ ট্রতিবাদ করেছ কি মরেছ। আহা! ইগো নামের বস্তুটি নড়বড় করে উঠবে। আরে! এরকমতো তুমি ছিলেনা, এত মুখ নাড়া শিখলে কবে!.... মানে তুমি যত মেনে নেবে, আজ মোচা, কাল কাঁঠাল পরশু আবদেরে লুচি...ততই টেকেন ফর গ্রান্টটেড। আর কিছু পুরুষ, পিয়া প্রায়ই গল্প শোনে দেখেও। ফলাও করে গলা ফোলায়, আমাকে কোন কিছুতে হারাতে পারবেনা। সব পারি আমি। সবটুকু।



তুমি করলে কি করলেনা বয়েই গেছে। অথচ দুদিন আগে মোচা খেয়ে আঙুল চেটেছে যে, ভুলে মেরে দিয়েছে। এগুলো তৈরি হওয়ার দোষ। স্ত্রী বলে নয়, এরা কাউকেই শ্রদ্ধা করতে শেখেনি, তাহলে আর ছেলে মেয়েকে শেখাবে কি!



পিয়ার এই ভোরবেলা মানে রাত শেষটুকু একান্ত নিজস্ব করতে পেরেছে এটুকুই মহা লাভ। লুকিয়ে বই পড়া, ডায়রীতে কিছু লেখার চেষ্টা এসব ঐ আধঘন্টা সময়টুকু নিজস্ব নিয়মে চলুকনা, না হয় ঘুম কম হবে, হয়তো আসতে চাইবেনা চোখ বুজে থাকলেও। না আসুক সুগারের ওষুধতো আছেই, কিন্তু বাতাবী লেবুফুলের গন্ধ আর মনের খাঁ খাঁ ভাবটুকু যদি লিখে রাখতে না পারল তাহলে আর হলোকি! সব শরীর হালকা করে বিছানায় যাও, হোকনা দু তিন ঘন্টার ঘুম, তাতে কি! ঐ কদর্য সংসার থেকে তো দূর অনেকদূর-স্বপ্নের ঘুম।



এইতো গতকাল পাশের বাড়ীর বৌদিকে শ্বাসকষ্ট নিয়ে শহরের বাইরে নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে হল। কি-না হাই সুগার। প্রবল শ্বাসকষ্ট। ছেলেকে নিয়ে মারাত্মক চিন্তা। সে বাইরে পড়ে। এ লকডাউনে আটকে পড়েছে। চাকরী এখনো কেন পাচ্ছেনা এসব নিয়ে নাকি তার নির্ঘুম রাত কাটে। পিয়ার কষ্ট হয়েছে বুকের ভিতর। নিজের মত ভাবনাগুলো যদি শেয়ার করে দিতে পারত, যদি সবাই চাপ ধরা কষ্টগুলো দেদার অন‍্যত্র অন‍্য কাজে কম্মে বিকোত তো এসব বুকের কষ্ট চেপে আসত না।



এই আজই যেমন ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে ঘুরুক। চুল নিয়ে হাতের আঙুলে জট, গিঁঠ, সারাদিনের যা কিছু সব ছাড়িয়ে তোলার চেষ্টা ওর আজীবন। আজও ঐ নিয়ে বসেছিল, লকডাউন যতই হোক, রান্নাখাওয়া প্রাত‍্যহিক ক্রিয়াকর্ম কিই বা বাকি থাকে! পিয়াও সবটুকু কাজ আষ্টেপৃষ্ঠে সেরে যত রাতই হোক, নিজের কাজগুলো সেরে ফেলতে চায়। একান্ত নির্জনতা তবু আসেনা। তার কারণ, বাড়ীর ভিতর এদিক ওদিক ঘুর ঘুর আওয়াজ, রেওয়াজ, তানপুরার ঝাঁঝালো সা পা সা সব মাথার ভেতরটা কেমন গুলিয়ে দিয়ে পাগল পাগল করে দেয়। ঠিক শেষবেলার মাথার কুচকোনো চুলের জটধরা টুকরো গিঁঠের মত। যখনই গিঁঠ ছাড়াতে পারেনা এখন হয়েছে নতুনরকম। কাচি দিয়ে কেটে ফেলে এদিক সেদিক। তেমন বেআক্কেলে গোছের হলেই ইন্দিরা গান্ধী ছাঁট দিয়ে নেবে। এসব হ‍্যাপা আর ভাল লাগেনা। ...তোমার কালো চুলের গন্ধ নিলাম, সম্পূর্ন মন ডুবে গেছে আজ, সেসব বলার মত দিন বা মানুষ এখন নেই। ওসব বেশী থাকতেও নেই। এখন ঐ কাঁপুনি, মাকড়সা বা উল্টোনো আরশোলা দেখলেই কেমন নিজেকে দেখে পিয়া। সঙ্গে সঙ্গে মনের অস্তিবাদী চিন্তাগুলো খাড়া দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে ওকেও সোজা করে দেয়। যেমন বাবা ওকে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়েছে দেখলেই পিঠে আলতো করে কিল দিয়ে সোজা করে দিত। -'ওরে সোজা রাখ শিরদাঁড়া....ঋজু'। কিন্তু বড় দেরী হল। বড় পড়াশুনো কম হল। এ লকডাউনে কত কিই করার ছিল পিয়ার হলোনা। একখানা উপন‍্যাস হতে পারত! ইস্ তাহলে প্রস্থে প্রস্থে রান্না সারবে কে! বাসন ঝকঝকে না করে লিখতে বসবে! হা ঈশ্বর! সে আর হলোনা কোন কালে। কি করে যে আশাপূর্না, মহাশ্বেতা, বানী বসু .....হতে হয় জানা নেই। সংসার ছেড়ে দাও। দু হাতের মুঠোয় শুধু নিজের কথা ভাব, গুটিয়ে আন সবটুকু, তাহলেই বড় হবে পিয়া। আরো বড়। ...ঐ ওরা কি করে সময় পায় ছাদে বেড়াবার, কি করে রাত সাড়ে দশটাতে সব সেরে ঘুমিয়ে পড়ে, কি করে ভোরে ওঠে জেগে! সেসব দিন গেছে চুকে পিয়ার সংসারে সন্ততিদের। শুধু পাশ ফিরে থাকা। প্রতিদিন রুটি গড়া দশটা, এগারোটা। সঙ্গে বিশেষ তরকারী। আসলে তুমিও বড়ই খাদ‍্যরসিক পিয়া।নিজেই তৈরি করেছ হাতে করে যে রুটিন, ভাঙবে কি করে, বল... এখন কথায় কথায় তাই শুনতে হয়, ছোট থেকে তুমি করাওনি। শেখাওনি। এখন ঐ আঙুল তোলা অভিযোগগুলো নিতে পারেনা পিয়া। তবু ভোর হয় তিনটে বাজে, নিজের সঙ্গে কথা বলে, পাখিরা প্রহরে প্রহরে ডাকে, ভোর- কলকাকলীর মধ‍্যেই শুতে যায়।



 দুই


ভোরের স্বপ্নগুলো এত গেড়ে বসে মাথা থেকে অন্তহীন গভীর অন্তর্দাহে। কেমন করে বুঝে উঠতে পারেনা কিছুতেই। খাওয়ার টেবিলে ঐ বারোটার পর চা, সঙ্গে কিছু। সবার স্বপ্নগুলো সেখানে দেরাজ খোলে। আজ বড় ছেলে বলল একটা চিতাবাঘ... কি বিরাট আর ক্ষিপ্র! ছাদের দিকে ‌ঋজুদের আমবন, কাঁঠাল, শিশু গাছের ফাঁক দিয়ে যেন আকাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ভাবো, আমি একটুও ভয় পেলামনা জানো! নিজেকে বাঁচাতে তো হবে। দুহাতে ওর পাঞ্জা চেপে ধরেছি। দেখতে পাচ্ছি কবজি বেয়ে লাল তরল রক্ত গন্ধ। কি করব! চেষ্টা করছি লাথি কষানোর, তীব্র মরিয়া আমি। ওকে সিঁড়ির দরজার দিকে যেতে দেবনা। আমি মরি মরব। আর কাউকে মরতে দেবনা। দরজা খোলা ছাদের। ও দুরন্ত ধারালো দাঁতে মাথাটা এগিয়ে আসছে। আমি শুনছি, ভীষণ শ্বাসের শব্দ। ঠিক তখনই ছাদের কিনারে রাখা লোহার রড কি করে হাতে নিয়েছি। আমি প্রাণপন শক্তিতে মরিয়া হয়ে মাথায় মেরেছি... ওকি পালালো-তীব্র একটা শব্দ। ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম মার হাত থেকে লোহার কড়াইটা পড়ে গেছে। একই সঙ্গে তীব্র হুইসিল দিচ্ছে প্রেসারকুকার। আমি ঘেমে নেয়ে গেছি। ....বাকি তিনজন ডাইনিং এ রুদ্ধশ্বাস গতি।



পিয়া বলতে শুরু করে, কি আশ্চর্য দেখ, স্বপ্নগুলো সবারই কোথায় গিয়ে যেন এক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমারটাও বলছি শোন। তার আগে বলি এত রাত করে ঘুমিয়োনা বাবু, পেটে গ‍্যাস ফর্ম করবে, আর অবসাদ বাড়ী বসে থাকা সব মিলে ভাবনাগুলো দেখেছিস কেমন জড়িয়ে মরিয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে যায়? থম্ ধরে ছিল শ‍্যামল, শ‍্যামলেন্দু। ....চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে, আমি কি দেখলাম বলোতো! ভয়ঙ্কর! বর্ষার জল পড়ে তাগড়াই কদম গাছটা দেখেছিস? ওর ফুলগুলো কেমন নানা গাঢ় রঙের ভীষণ কদাকার দেখতে হয়ে গেছে। মাটি দিয়ে ওদের কাঁটাওযালা শরীর নিয়ে ঘুরছে ফিরছে। কাঁটাগুলো বিঁধে বিঁধে মাটিতে দাগ হয়ে যাচ্ছে। আর দরজার ফাঁক থেকে সকালের আলো বাড়তেই দেখলাম হাসপাতালের নীলচে এ্যাপ্রোণে মাথা মুখ ঢাকা রোগীর দল আমাদের কোলাপসিবল্ গেট টেনে খুলে ফেলেছে। প্রত‍্যেকের হাতে ঐরকম ভাইরাসগুলো বীভৎসভাবে বড় হয়ে উঠেছে, সকলে ভয়ঙ্কর জার্ম বহনকারী। ঢুকে পড়েছে। সকলে আমরা ওদের তাড়াবো কি! লুকিয়ে পড়তে চেষ্টা করছি বাথরুম, কখনো পাশের ঘর, ঘুমন্ত টুবাই, তুই বুবুল, তোর মা সবাইকে খোঁচা দিয়ে মাটিতে পেড়ে ফেলেছে। অল্প আলোয় আমি বাথরুমের তাক থেকে বড় স‍্যানিটাইজারের শিশিটা পেড়ে নিয়েছি। সাহসে ভর করে এগিয়ে যাচ্ছি। আর স্প্রে করার চেষ্টা করছি। ততক্ষণে পিছু হটছে ওরা। আশপাশের বাড়ী থেকে যেন মজা দেখছে, এভাবে তাকিয়ে আছে ওরা। একপাল ভাইরাস বহনকারীদের দেখে দরজায় এবার খিল দিয়েছে। আমি কেঁদে উঠছি হাউ হাউ করে। ...কেনরে! দেখতো আমার টেম্পারেচারটা ...ঘুম ভাঙতে তোর মাকে শুনলাম বলছে,পাশের বাড়ীর মৃন্ময়ীকে, ...অনিলের মাকে এইমাত্র নেওটিয়াতে ভর্তি করা হল। সুগার রাইস করেছিল অসম্ভব। ওষুধের ডোজের হেরফের। ....আর চট করে বাইরে বেরোলাম আমি। দেখছি দিব‍্যি হাওয়ায় দুলছে কদমগাছটা। ফুলগুলো আর ও যেন সোনা রঙ। কয়েকটা নীচে পড়ে আছে।ভারী সুন্দর।...



এই স্বপ্নের গল্পটা শুনতে শুনতে পিয়া কেমন ঘেঁটে উঠেছে তখন। নিজের লোমশ সবুজ বিশাল গাছ হয়ে ওঠার গল্পটা বলবে বলে ওদের বসিয়ে রেখে ব্রেকফাষ্ট তৈরি করল অনেকদিন পর। মানে আজ চারজনেই উঠে পড়েছে। ঘড়িতে বারোটা পার হলে হোক একসঙ্গে খাচ্ছেতো বটে! ....ছোট টুবাইও কখন গুটি গুটি জড়সর নিজের চেয়ারটায় বসেছে গেড়ে।চোখদুটো কেমন অদ্ভুত ভীত দেখাচ্ছেনা! অদ্ভুততো! রান্নাঘর থেকে লক্ষ‍্য রাখে পিয়া। এবার ওর পালা। ডিমটোষ্ট, কলাগুলো ছাড়িয়ে টেবিলে রাখতে রাখতে একবার হাঁক দেয়। ....টুবাই, দাঁত মেজে, মুখ হাত ধুয়ে একবারে বস টেবিলে। ...ও কেমন কুঁকড়ে ছিল, উঠল। দৃষ্টিটা দেখে  মনে হল ও যেন এখানকার নয়। অন‍্য কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। কোনও গভীর বনপথের নির্জনে হাঁটছে ইয়াব্বর ইয়েতির মত। টুবলু আর শ‍্যামল কেমন থম মেরে গেছে মনে হল। 



এবার পিয়া শুরু করে ...আমি কি দেখলাম বলতো? প্রতিদিন প্রায় দশ সাড়ে দশ হয়ে যায় রাতে ওয়ার্ক আউটে। ছাদে গিয়েই আধো অন্ধকারে চারদিকে বাড়ীগুলোর আলোর দিকে তাকাই, হাঁটতে শুরু করি। এক, দুই, তিন... গুনতে গুনতে পঞ্চাশের দিকে এগোই প্রতিদিনই। একে একে অন‍্যান‍্য দূর দূর, কাছের বাড়ীগুলোর আলোর নিভে আসা দেখি। আমি হাঁটতেই থাকি। কখন পঞ্চাশ পুরিয়ে যায়। এতো রোজকার নিয়মই, তারপর পুশ আপ, ফ্রি হ‍্যান্ড কয়েকটা, কয়েকবার লাফানো এসব চলেই। আজ ঘুমের ভিতর সাধ‍্যসাধনা করে ঢুকব কি, শুধুই মনে হচ্ছে চরকি পাক দিচ্ছি, চতুর্দিক গাঢ় অন্ধকার। ঋজুদের বাড়ীর দিকের ঘন উঁচু গাছপালার ভিতর থেকে কার অস্তিত্ত্ব টের পাচ্ছি যেন। ঐ টুবলুর স্বপ্নের গল্পটার মত ই মনে হল কোন বন‍্য জন্তু লাফ দিয়ে নামবে বাড়ীর ছাদে। আমাকে উপেক্ষা করে ঐ সিঁড়ির খোলা দরজা পেয়ে নীচে আধো আলোয় নেমে যাচ্ছে তোদের ঘরের দিকে... এটাকে হায়না মনে হচ্ছে, কিন্তু আমি যেই সাহসে ভর করে হ‍্যাট হ‍্যাট্ করে তেড়ে গেছি নীচে  দেখছি ও নীচের তলায় ঠিক এখানে আমরা যেখানে বসে আছি ...ঢুকে পড়েছে। তোদের ঘুমন্ত শরীরের কাছে ওর নিশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট। আমি চেষ্টা করছি, ধাক্কা দিচ্ছি নীচের দরজা ....কেন যেন সেটা বন্ধ, কি করে ভেতর থেকে বন্ধ হয়ে গেল বলতো ....হায়না কি দরজা আটকে দেওয়ার শক্তি রাখে!! ...আমি তোদের বাঁচাতে পারছিনা। চিৎকার করছি যাতে তোরা সাবধান হতে পারিস। ....না, তোদের সাড়াশব্দ নেই। এমনকি, ঘুম পাতলা শ‍্যামল ও কোন আওয়াজ করছেনা। আমি আশপাশের উল্টোদিকের বাড়ীগুলোর দিকে তাকিয়ে অন্তত দু একটা চেনা মুখ দেখতে চাইছি কিন্তু মরুভূমির নীরবতা। সব ঘুমে কাঠ। ওরা কি সত‍্যিই শুনতে পাচ্ছেনা না কি চুপ করে আছে! ভয়ঙ্কর কিছু মানুষ-দানোকে চিনছি যেন। স্বার্থপর মেকি দন্তযুক্ত কিছু মুখ। সকাল সকাল ঘেমে নেয়ে বিছানায় উঠে বসেছি ....জোরে মোবাইলে এলার্ম বেজে যাচ্ছে। তাড়াহুড়ো করে এ্যালার্ম স্টপ করি। সব আবার স্বাভাবিক চোখে দেখতে থাকি। ...প্রবল শ্বাসকষ্ট বোধ করতেই ব‍্যাগ থেকে অল্প আলোয় ইনহেলারটা খুঁজে বের করে দু-তিনটে পাফ নিয়ে নিই। এবার নিশ্চিন্তি। কিন্তু মাথা থেকে দুশ্চিন্তা যায়না।তাড়াতাড়ি নেমে আসি। দেখি সত‍্যিই নীচের সিঁড়ির দরজা তোরা বন্ধ করে ঘুমিয়েছিস। ....সত‍্যিই দেখ, আমি যদি সত‍্যি জ্ঞান হারাতাম! তোরা জানতে পারতিস? ঐ আশপাশের মানুষগুলোর মতই যদি তোদেরও আচরণ হয় তাহলে মানুষকে আর মানুষ বলব কি করে! ....ছোট ছেলেটা গা ঘেঁষে আছে অনেকক্ষণ। ...এবার ছলছল চোখে তাকায়।



-ভয় করছে মা, তুমি তোমরা সবাই এসব দেখছ কেন? বাড়ীতে কতদিন পর একসঙ্গে সব আছি। কবে যে সব স্বাভাবিক হবে কে জানে! তোমাদের সব স্বপ্নগুলো ভীষণরকম দুশ্চিন্তা থেকে। ...আমি তোমাদের মত বাপু খবর ও শুনছিনা। খবরের কাগজও খুলছিনা। শুধুই অনলাইনে ক্লাস করছি। স্কলারশিপের টাকায় বেশকটা শখের জিনিস অনলাইনে বুক করে দিয়েছি। ...তোমরা ভাবছনা কেন, একমাসেরও কম দরজায় কড়া নাড়ছে পুজো। আমি কিছু দামী মাস্ক ও অনলাইনে অর্ডার করেছি। এবার পুজোয় ঐ মাস্ক পরেই বন্ধুদের সঙ্গে বেরোবো। আমি বিছানায় শুয়ে পড়লেই মাথার ভিতর ঢাকের আওয়াজ পাই। আর দেখি মন্ডপে অঞ্জলি শুরু হয়ে গেছে। আর মা তখনো রেডি হয়নি। আমি দৌড়ে দৌড়ে আসছি বাড়ীর দিকে, মাকে অঞ্জলির খবর দেব। ...শিগ্গির রেডি হও মাম্... নতুন শাড়ীটা পরেছ তো? তাড়াতাড়ি কর। দ্বিতীয় ব‍্যাচ। এখুনি শুরু হবে। এসো মা এসো...



পিয়ার চিন্তার কালো ধোঁয়াগুলো পাক খেতে খেতে নামে। উজ্জ্বল হয় চোখদুটো। ....হ‍্যাঁ বাবুসোনা, তুই এভাবেইতো এবারও আমাকে ডেকে নিয়ে যাবি, নয়তো আমার অঞ্জলিই দেওয়া হবেনা। এমনিই সহজ ভাবনায় মিলে মিশে থাক বাবু, তাহলেই অন্ধসময়, অন্ধ দরজাগুলো খুলে মানুষের পাশে আবার দাঁড়াতে পারব রে! আমরা নি:শ্বাস নিতে ভুলে যাচ্ছি শুধুই...



এক চাপা দীর্ঘশ্বাসে ছবির মত নিজের ছোটবেলার বাড়ীর উঠোনের স্থলপদ্মের গোলাপি রঙ চোখে পড়ে পিয়ার। মার হাতের সাজিতে একরাশ শিউলি। ...পিয়া ডাকতে এসেছে মাকে। পোলাও গন্ধ রান্নাঘরে। ...রান্না ছাড়। এবার নতুন শাড়ি পর। চল অঞ্জলি শুরু হল বলে... আঁচলে টান পড়ে.... মা আর সে পাশাপাশি হেঁটে যায়। সেই ট্রাডিশন চলছেই। শুধু রূপ বদলে গেছে।

Comments