ভ্রমণ - দেবপ্রিয়া সরকার


ডাউকিতে ডে আউট


ট্র্যাভেল অ্যান্ড লিভিং চ্যানেলে স্কটল্যান্ডের অপূর্ব দৃশ্যপট দেখতে দেখতে আচমকাই মাথায় এসেছিল ভাবনাটা। তারপর কেটে গিয়েছে বেশ কয়েকমাস। আমার মনের নিভৃত কোণে সকলের অগোচরে সেই ভাবনাটা ক্রমশ একটু একটু করে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে পরিণত হয়েছে জোরালো ইচ্ছেতে। এতদিন কাউকে কিছু না বললেও পুজোর ছুটিতে অসমে বেড়াতে গিয়েই ঝুলি থেকে বেরিয়ে এল বেড়ালটা। পাশ্চাত্যে না হয় নাই বা গেলাম, তাই বলে কি প্রাচ্যের স্কটল্যান্ডটা একবার দেখে আসতে পারি না? 


অসমের ধুবড়ি জেলায় বাড়ি পিসিমণিদের। সবুজ পাহাড়, আঁকাবাঁকা নদীর কাছে ছোট্ট একটা জনপদ। তারওপর আছে ব্রহ্মপুত্রের টাটকা মাছ, ফ্রেস সবজি। নিরিবিলিতে ছুটি কাটানোর মোক্ষম আয়জন। কোজাগরী পূর্ণিমার দু’দিন পরে সপরিবারে চেপে বসলাম অসমগামী কামরূপ এক্সপ্রেসে। পিসিমণির বাড়ির চায়ের আড্ডায় খোলস ছাড়ল আমার সেই গোপন বাসনা। শিলং যাওয়ার প্রস্তাব পেশ করতেই মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেল আড্ডার মেজাজ। আমাকে অবাক করে সকলেই রাজি হয়ে গেল শিলং যেতে। ভেবেছিলাম শিলং আর চেরাপুঞ্জি ঘুরেই ফিরে আসব পিসিমণির ডেরায়। কিন্তু পিসতুতো বোন মৌটুসি বলল, “ধুস, চেরাপুঞ্জি তো কমন স্পট, তোমরা বরং ডাউকি যাও”। পরদিন নেট ঘেঁটে বের করে ফেললাম ডাউকির হাল হকিকত।  


গুয়াহাটি বাস টার্মিনাসে নেমে লাঞ্চ করলাম প্রথমে, তারপর সিটি অটোতে চেপে পৌঁছলাম খানাপাড়া স্ট্যান্ড। এখান থেকেই গাড়ি পাওয়া যায় শিলঙয়ের। একটা  সুইফট ডিজায়ার রিজার্ভ করে পাড়ি জমালাম শিলঙয়ের উদ্দেশে। মনোরম প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে চলে এলাম আমাদের গন্তব্যের কাছাকাছি। জল থৈ থৈ উমিয়াম লেক আর মেঘের ওড়না জড়ানো ঘোলাটে পাহাড় আমাদের অভ্যর্থনা জানাল মেঘের দেশ, মেঘালয়ে। 


‘শেষের কবিতা’র শিলঙে সেদিন আকাশ ছিল মেঘলা। ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছিল অবিরত। বাতাসে হালকা হিমেল ভাব। হোটেলের ঘরে চেক ইন করে চুমুক দিলাম ধোঁয়া ওঠা দার্জিলিং চায়ে। মনে হচ্ছিল জীবনের সকল চাওয়া পাওয়া বোধহয় ফুরিয়ে গেল এখানে এসে। কিন্তু ভুল ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি। আমার চাওয়া সীমিত হলেও প্রকৃতির ঝুলিতে আমাকে দেওয়ার জন্য যে অফুরন্ত ভাণ্ডার রয়েছে তার হদিস পেলাম অচিরেই।

শিলং ঢোকার মুখে সুদৃশ্য উমিয়াম লেক।


প্ল্যান মোতাবেক পরদিন সক্কাল সক্কাল ড্রাইভার বিকেন ডেকা গাড়ি নিয়ে হাজির হল। তড়িঘড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। প্রথম স্টপেজ এলিফ্যান্ট ফলস। নয়নাভিরাম জলপ্রপাতের সৌন্দর্য উপভোগ করে কিছুক্ষণ সময় কাটালাম লাগোয়া চা বাগানে। আগের দিন আকাশে মেঘ থাকলেও  সেদিন ঝলমলে রোদ্দুরে ভরে ছিল চারপাশ। মেঘ ছেঁড়া রোদ গায়ে মেখে আবার উঠে বসলাম গাড়িতে। এবার ডেসটিনেশন ডাউকি। 

ডাউকির পথে ভিউ পয়েন্ট থেকে দেখা
শিলং পাহাড়ের দৃশ্য

প্রায় আড়াই ঘণ্টার সফর শেষে এসে পৌঁছলাম এক স্বচ্ছ জলের নদীর ধারে। ড্রাইভার বিকেন জানাল এই নদীর নাম উমঙ্গোট আর লাগোয়া ছোট্ট শহরটাই হল আমাদের আজকের গন্তব্য ডাউকি। এবড়োখেবড়ো পাহাড়ি ধাপ পেরিয়া নেমে এলাম নদীর কাছে। ঘাটে সারি সারি নৌকো বাঁধা রয়েছে। ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে লাইফ জ্যাকেট। বোটওয়ালার সঙ্গে দামদর পাকা করে শুরু হল আমাদের নৌকাবিহার।

উমঙ্গোট নদীর তীরে নৌকার সারি

নদীর জল কাঁচের মতো স্বচ্ছ, দু’পাশে উঁচু উঁচু সবুজ পাহাড়। চোখে পড়ছে নদীগর্ভে ছড়িয়ে থাকা শ্যাওলা আর ছোটবড় পাথরের টুকরো। ট্যুরিস্ট বোঝাই নৌকা চলেছে একের পর এক। এক জায়গায় নদীর মাঝ বরাবর মোটা আড়াআড়ি একখানা দড়ি ঝুলছে। আমাদের মাঝি ভাই জানালেন, নদীর ওপাশটা বাংলাদেশ। দড়িটাই বর্ডার লাইন। ওদিকেও নজরে এল বহু মানুষের ভিড়। 


জয়ন্তিয়া পাহাড়ের ধার ঘেঁষে ভেসে বেড়ালাম বেশ কিছুক্ষণ। স্থানীয় খাসি সম্প্রদায়ের বাচ্চারা হুটোপাটি করছিল জলে। নগর জীবনের ডামাডোলের আড়ালে প্রকৃতির এই অতুলনীয় রূপে মুগ্ধ হয়ে কেটে গেল অনেকটা সময়। নৌকা ভ্রমণ শেষ করে আবার সওয়ার হলাম চার চাকায়। ইংরেজ আমলে তৈরি বড়সড় একখানা লোহার ব্রিজ পেরিয়ে পৌঁছলাম বাঁদিক থেকে ডানদিকের পাহাড়ে। ওই পাহাড়ের কোলেই গড়ে উঠেছে ডাউকি নামের ছোট্ট জনপদ। ঘড়িতে তখন দুপুর দুটো। একটা চলনসই হোটেল জোগাড় করে খেয়ে ফেললাম ডিমের ডালনা দিয়ে মোটা চালের গরম গরম ভাত। খিদের পেটে তখন ওটাই অমৃত। 

দুই পাহাড়ের সংযোগকারী ইংরেজ আমলে তৈরি
লোহার ব্রিজ

ড্রাইভার সাহেব বললেন ডাউকির একদিকটা ভারত, অপরদিক বাংলাদেশ। দু’দেশের মানুষের অবাধ মেলেমেশা। নেই কোনও সীমানা প্রাচীর, কাঁটাতার। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাবছিলাম যদি এভাবেই সকল সীমানা প্রাচীর গুঁড়িয়ে দেওয়া যেত তবে কেমন হত আমাদের পৃথিবীটা? বিকেন তাড়া দিচ্ছিল তাই আবার গাড়িতে উঠে এগিয়ে গেলাম ভারত বাংলাদেশ বর্ডার চৌকির দিকে। সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে মাল বোঝাই ট্রাক। বাংলাদেশের সিলেটের সঙ্গে জমি ভাগাভাগি করেছে ডাউকি। তাই এপথ দিয়ে চলে আন্তর্জাতিক ব্যবসা বানিজ্য। কিন্তু এই বর্ডার অঞ্চল আর পাঁচটা সীমানা প্রদেশের থেকে অনেকটাই স্বতন্ত্র। নেই নিরাপত্তার তেমন কড়াকড়ি, সীমান্তরক্ষীবাহিনীর চোখরাঙানি। 

ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী দ্বার

সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। গাড়ির চালক বিকেন ভাঙা হিন্দিতে শোনাচ্ছে মেঘালয়ের সামাজিক রীতিনীতি, ব্যবসা-বানিজ্য, পর্যটন আর চেরি ব্লোজম ফেস্টিভ্যালের গল্প। ডাউকি থেকে ফেরার পথ ধরেছি আমরা। উমঙ্গোট নদীকে বাঁহাতে রেখে একটু একটু করে এগিয়ে চলেছি নতুন গন্তব্যের দিকে।


কীভাবে যাবেনঃ- গুয়াহাটি স্টেশন, এয়ারপোর্ট বা বাস টার্মিনাসে নেমে প্রথমে যেতে হবে মেঘালয়ের রাজধানী শিলং। ডাউকি সেখান থেকে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। শিলং থেকে মেঘালয় ট্যুরিজমের বাসে বা প্রাইভেট গাড়িতে অনায়াসেই পৌঁছে যাওয়া যায় ডাউকি। রাতে থাকার মতো তেমন কোনও হোটেল বা হোম স্টে এখনও গড়ে ওঠেনি ডাউকিতে। তবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকেই টেন্ট বানিয়ে রাত কাটায় নদী পাহাড়ের সান্নিধ্যে।

চিত্র - লেখক

Comments