অনুগল্প - মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী


যৌথযাপন 


----ঘুমোলে নাকি?

---উঁ ---না, ঘুমাই নি, বল।

---বলছি সর্ব শরীরে কেমন ব্যথা, জ্বর-জ্বর ভাব, ভয় করে বুঝলে! কি এক অজানা রোগ এসেছে , বাঁচি কি মরি কে জানে!

---শীত শেষ হয়ে গরম পড়তে শুরু করলে তোমার এমন জ্বর হয়, পঞ্চাশ বচ্ছর ধরে দেখচি, এর মধ্যে মরার কতাটা আসে কোত্থেকে?

----না, বয়সটা তো নেহাৎ কম হল না, মরারই তো বয়স। ক’দিন থেকে একটা কথা তোমাকে বলবো বলবো ভাবছি। এ কথাটা তোমাকে না বলে মরে গেলে অন্যায় হবে।

---কী কতা?

---কথাটা ওই লতু মানে লতাকে নিয়ে। একটা সময়ে ওর সঙ্গে আমার খানিক ভাব-ভালোবাসা হয়েছিল, যখন আমি কুচবিহার সদরে একা থাকতুম। সেটা তোমার জানা নেই , বিমল জানতো। তারপর হঠাৎ করে একদিন বিমল নিরুদ্দেশ হয়ে গেল! আর পরদিন লতা গহিনবিলে ডুবে মরলো ------, এ ঘটনাটায় নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়।


----কি গো ঘুমোলে? অ বুড়ি!

----না, ঘুমাই নি। তা এ কতাটা যখন তুমি বললে তখন আমারও কিছু গোপন কতা প্রকাশ করতে হয়। বিমল ঠাকুরপোকে আমিই লতাকে নে পালিয়ে যেতে উসকে দিয়েছিলুম। জমানো টাকা দিয়েছিলুম, বাবার দেওয়া সাতনরি হারটা দিয়েছিলুম। ঠাকুরপোর তো তিনকুলে কেউ ছিল না, সে বলেছিল লতাকে নে সে নেপালে পালিয়ে যাবে। তকন তুমি তো প্রেমে বেদিশে, তাই আমার মাতাটা খুব ঠাণ্ডা রাখতে হয়েছিল। নবু তকন ছয় বছরের, বুবু দুই। এই ছেলেগুলো কলঙ্ক মাতায় নে বড় হবে, সেটা আমি চাই নি। সংসার করতে যকন নেমেচি, তকন সেটাকে সামলেও নিতে হবে তো, হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদলে তো চলবে না! অভিমান হয়েছিল, দুঃখ হয়েছিল, তবু বুকে পাথর বেঁধে, মুখে কুলুপ এঁটে থেকেচি। এসব কথা কইলেই ফুলে-ফেঁপে ওঠে! তাছাড়া কলঙ্কের কতা বাতাসের আগে দৌড়ায়! আরো একটা কতা, গহিন বিলে যে লাশটা পাওয়া গেছিল, সেটা কার তা কিন্তু প্রমাণ হয় নি! আমি হলপ করে বলতে পারি সেটা লতার নয়।


------কি ঘুমালে ? অ বুড়ো !

----না, ঘুমোই নি। আজ আমার বুক থেকে একটা পাষাণ ভার নেমে গেল মনে হচ্ছে। ভালো লাগছে।

---কথায় কথায় রাত যে গড়িয়ে গেল, পুবের আকাশ ফরসা হচ্চে! আর শুয়ে থেকোনা বুড়ো। আদা দিয়ে এক কাপ চা করে আনি, একগাল মুড়ি দিয়ে চা খাও। একটুক গরম জল খাও। রাতে তো কিচুই খাও নি!

---তুমিও চা নিয়ে বসবে তো? নাকি রান্নাঘরে ছুটবে?

----না না, আজ আমার ছুটি । দেকচো না, ইস্কুলগুনো সব বন্ধ করে দিয়েচে! বউমা বাড়ি থাকবে, ঘুম থেকে উঠে সব সামলাবে। উঠুক যকন খুশি!

---তা ও ভালো! ওই দুষ্টু ভাইরাসটার জন্য তুমিও খানিক ছুটি পেলে আর আমিও তোমার সাথে একটু কথা কইতে পেলুম! মরণ তো এসেই গেছে, আর ডরাই না, তখন একটা কথার কথা বলছিলুম, কথা শুরুর আগের কথা! কখনোই তো তোমাকে পাই না, শুধু ব্যস্তই থাকো সংসারের কাজে!

---বুড়োর কতা শোনো! মরণ!

Comments