প্রবন্ধ - রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

 


বিংশ শতকের বাংলা নাটকভাবনা


।।এক।।

শম্ভু মিত্র মনে করতেন নাটক যিনি লেখেন তাঁকে নাটককার বলাই সংগত।  নাটক ও নাট্য শব্দদুটির মধ্যে অর্থগত ফারাক আছে। নাটক বলতে বোঝায় একটি বিশেষ সাহিত্য সংরূপ (ইংরেজিতে drama বা play)। আর নাট্য বলতে বোঝায় সামগ্রিক প্রযোজনা - যা অভিনয়, মঞ্চ, আলো, রূপসজ্জা, সাজ-পোশাক ইত্যাদির সমন্বয়ে তৈরি হয়ে ওঠে। নাটককারদের মোটামুটিভাবে দুটি শ্রেণীতে ফেলা যায়। প্রথম শ্রেণীতে আছেন সেই সব নাটককারেরা, যাঁরা সরাসরি অভিনেতা, নির্দেশক বা মঞ্চকর্মী হিসাবে প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত নন। তাঁরা নাটক লেখেন সাহিত্য হিসাবে। তাঁদের প্রযোজনায় আগ্রহ থাকলেও তা বাইরে থেকে, সরাসরি থিয়েটারের অন্দরমহলে ঢুকে নয়। দ্বিতীয় শ্রেণীতে আছেন যে নাটককারেরা তাঁরা নাটক প্রযোজনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।


উনবিংশ শতাব্দীর আটের দশক থেকে প্রথম শ্রেণীভুক্ত নাটক রচয়িতার সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে এসেছিল। প্রতাপচাঁদ জহুরীর আমলে বাংলায় পেশাদারী থিয়েটার প্রকৃত অর্থে পেশাদার হয়ে ওঠে। তখন অভিনেতা, নাট্যকর্মী ও নাটককারেরা একজন মালিকের অধীনে চাকরি করতে শুরু করে। যৌথ শিল্প হিসাবে নাট্যের কাছে দর্শকদের অন্য রকম দাবী তৈরি হয়েছিল। তাঁরা তো শুধু সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য নাটক দেখতে যাচ্ছিলেন না। তাঁরা রঙ্গালয়ে যেতেন অভিনয় দেখতে, যুৎসই সংলাপ ও গান শুনতে। ফলে একটি নাট্য প্রযোজনায় সাহিত্যের অংশ অনেকটাই পেছনে পরে থাকছিল। এই সময় এমন নাটককারের প্রয়োজন হয়েছিল যিনি সামগ্রিকভাবে একটি জনগোষ্ঠীর মনে কেমনভাবে আবেগ বা চিন্তার জন্ম দেওয়া সম্ভব তা বুঝে নাটক রচনা করতে পারেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র বা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জায়গায় নাটক রচনায় গিরিশচন্দ্র ঘোষের যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার পেছনে রয়েছে দর্শকদের চাহিদা বদলের ইতিহাস।


বাংলার রঙ্গমঞ্চে পেশাদারীত্ব আমদানি হওয়ার কালে নাটককারেরা সকলেই গিরীশচন্দ্র ঘোষ বা অমৃতলাল বসুর মতো সরাসরি নাটক প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তখন নাটক লেখা হত থিয়েটারের স্বার্থে। এর ফলে বাংলা নাটক রচনায় একটা নির্দিষ্ট ছাঁচ চলে এসেছিল। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ থেকে শুরু করে যোগেশচন্দ্র চৌধুরী, শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত পর্যন্ত মোটের উপর এই ছাঁচই অনুসরণ করে গিয়েছেন। চারের দশকে কিন্তু নাটক গড়ে তোলার এই ধাঁচ পাল্টে গেল। তখন শুধু দর্শকদের অভিনয়ে খুশী করে অর্থ উপার্জন করা নাটকের উদ্দেশ্য রইল না। এই প্রজন্মের নাটকের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল দর্শককে বিভিন্ন তথ্য দেওয়া এবং তাঁদের বিভিন্ন দিক থেকে (যেন রাজনৈতিকভাবে) সচেতন করে তোলা। তা ছাড়া গণনাট্য সংঘের একটা প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন শিল্পের মধ্যে সংযোগ তৈরি করা, গ্রামীণ অভিকর শিল্পের সঙ্গে নাগরিক শিল্পের সমন্বয় গড়ে তোলা। এখানেও নাটকের সাহিত্যরূপের পরিবর্তে নাট্যরূপের ওপরেই জোর দেওয়া হয়েছিল। 


বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে শিশিরকুমার ভাদুড়ী নিয়মিত নাটক প্রযোজনা শুরু করেছিলেন। শম্ভু মিত্র বেশ কিছুদিন তাঁর সঙ্গে অভিনয় করেছেন। চারের দশকের শেষ বা পাঁচের দশকের গোড়ায় যাঁরা অন্যরকম থিয়েটার করতে এসেছিলেন তাঁরা শিশিরকুমার সম্বন্ধে গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। ‘চায়ের ধোঁয়া’ গ্রন্থে আধুনিক বাংলা রঙ্গমঞ্চের  বৈশিষ্ট্য আলোচনা প্রসঙ্গে উৎপল দত্ত বলেছিলেন - ‘প্রধান বৈশিষ্ট্য পরিচালকের অভ্যুত্থান। পরিচালকের ক্রমবর্ধমান একনায়কত্ব। আঙ্গিককে সংহত করে সুসামঞ্জস্য করে মঞ্চে উপস্থাপন করেছেন এঁরা। এককালে – এই সেদিন অর্থাৎ শিশিরবাবুর আগে পর্যন্ত পরিচালক বলে কেউ ছিলেনই না; ছিলেন মোশান-মাস্টার, যিনি কোনোমতে কথাগুলো বলিয়ে নিতেন।’ 


শিশিরকুমার চেষ্টা করেছিলেন প্রযোজনার সামগ্রিকতার প্রতি দৃষ্টি দিতে, অভিনয়ে বুদ্ধির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে এবং থিয়েটারের সঙ্গে সমকালীন বুদ্ধিজীবীদের যুক্ত করতে। কিন্তু পেশাদার থিয়েটারের বাণিজ্যিক দাবীর সঙ্গে নিজস্ব শিল্পরুচির সংযোগ তৈরি করতে না পারটাই শিশিরকুমারের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর ফলে তাঁর মধ্যে একটা প্রবল হতাশার ভাব দেখা দেয়। আসল তিনি চল্লিশের কালের চাহিদা ঠিকমতো বুঝতে পারেননি বা নতুন কোনও নাট্যকারকে আবিষ্কার করতে পারেননি যিনি তাঁর অভিনয়ের ধারাকে বহন করে নিয়ে যাবেন।


পেশাদার থিয়েটারে যেখানে অর্থ উপার্জনের বাধ্যবাধকতা ছিল, সেখানে গণনাট্য সংঘ থিয়েটারকে আদর্শ প্রচারের মাধ্যম হিসাবে দেখতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এই থিয়েটার নতুন সময়ের বেদনা ও স্বপ্নকে ধরতে চেয়েছিল। শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, উৎপল দত্ত, অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়েরা ছিলেন গণনাট্য সংঘের সদস্য, যা তাঁদের শিল্পদৃষ্টি তৈরি করতে জরুরী ভূমিকা নিয়েছিল। এখান থেকে তাঁরা পেয়েছিলেন সমকালীন রাজনৈতিক পটভূমির সঙ্গে শিল্পকে মিশিয়ে দেখার ধারনা এবং থিয়েটারকে নাগরিক পটভূমি থেকে মুক্ত করে দেশের বৃহত্তর অংশের আশা-আকাঙ্খার সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার ভাবনা। তবে গণনাট্য সংঘের বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ ছিল একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, যা শিল্পীর স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে। ১৯৪৮ সালের পার্টি কংগ্রেসে বি টি রণদিভের নেতৃত্বে যে শোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ডাক দেওয়া হয় সেটাই ছিল শম্ভু মিত্রদের দলত্যাগের অন্যতম কারণ। তা ছাড়া গণনাট্য সংঘও তার আদর্শ থেকে কিছুটা স্খলিত হয়ে পড়েছিল। 


চল্লিশের দশকের শেষ বা পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় শুরু হয়েছিল নবনাট্য আন্দোলন, যা পরে গ্রুপ থিয়েটার নামে পরিচিত হয়। স্বাধীনতার পরে-পরেই ১৯৪৮ সালে গণনাট্য সংঘ থেকে বেরিয়ে এসে শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, কালী সরকার প্রমুখরা মিলে তৈরি করেছিলেন ‘বহুরূপী’ নাট্যগোষ্ঠী। ১৯৫০ সালে বিজন ভট্টাচার্য তৈরি করেছিলেন ‘ক্যালকাটা থিয়েটার’। ১৯৫২ সাল নাগাদ উৎপল দত্ত ও তাঁর সহযোগীরা গণনাট্য সংঘ ছেড়ে তৈরি করেছিলেন ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’। পরে উৎপল দত্ত তৈরি করেন ‘পিপলস লিটল থিয়েটার’। আসলে তাঁরা চেয়েছিলেন পেশাদার থিয়েটার এবং গণনাট্য সংঘ দুইয়ের থেকেই আলাদা একটা নাট্যধারা তৈরি করতে। 


বাংলা গ্রুপ থিয়েটার শুরু থেকে অনেকটাই ফর্মমনস্ক থাকতে চেয়েছে। এর পাশাপাশি কত বিচিত্র ধরনের নাটক কতরকম রীতিতে প্রয়োগ করা যায় তার পরীক্ষা করতে গিয়ে পরস্পর বিপরীত ভাবের অনুসারী নাটকের প্রযোজনাও কম হয়নি। তবে নাটক নির্বাচনের ক্ষেত্রে শম্ভু মিত্র সমকালীন বিজন ভট্টাচার্য বা উৎপল দত্তের থেকে অনেক বেশি বৈচিত্র্যের খোঁজ করেছেন। বহুরূপী গোড়া থেকেই অভিনয়ে জোর দিতে চেয়েছে। এর সেরা উদাহরণ হল ‘বিভাব’, যেখানে গোটা প্রযোজনাটা শুধু অভিনেতাদের উপর ভর করেই দাঁড়িয়ে থাকে। শম্ভু মিত্রের পেশাদার থিয়েটারের অভিজ্ঞতা ও নিয়মিত আবৃত্তির চর্চার সঙ্গে আরও একটা বিশেষ দিক হল বাংলা শব্দের গূঢ়তম ব্যঞ্জনা সম্পর্কে তীব্র সচেতনতা, যা তিনি অনেকটাই শিশিরকুমারের কাছ থেকে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাটক প্রযোজনার কোনও গ্রহণযোগ্য আদর্শ তখনও তৈরি হয়নি। ‘চার অধ্যায়’, ‘রক্তকরবী’, ‘রাজা’, ‘বিসর্জন’ প্রভৃতি নাটকে বাস্তবের বাধ্যবাধকতাকে পেরিয়ে যাওয়ায় বহুরূপীর অভিনয়রীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছিল। শম্ভু মিত্র যে বাস্তবের বিশালতার অনুরাগী, ধীরে ধীরে সংলাপের গভীরে কবিতার সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগে তা-ও চলে এসেছিল। খালেদ চৌধুরীর মঞ্চভাবনা এবং তাপস সেনের আলোকসম্পাত সে কাজে অনেকটা সহায়ক হয়েছিল। শম্ভু মিত্র ও তাঁর সহকর্মীরা খালেদ চৌধুরী ও তাপস সেনকে সঙ্গে নিয়ে মঞ্চছবির লাইন, রঙ, বিন্যাস, আবহ ইত্যাদির সঙ্গে নাটকের সম্পর্ক তৈরির নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। 


উৎপল দত্তের নাট্যরীতি অন্য সকলের থেকে আলাদা। অতুলনীয় নাট্যপ্রতিভা, অপরিসীম পাণ্ডিত্য ও উদ্ভাবনী শক্তির সাহায্য নাটকের যে কোনও নির্দিষ্ট ব্যাকরণকে তিনি অনায়াসে ছিন্ন-ভিন্ন করে ফেলতে পারতেন। বিষয়ের দিক থেকে তিনি শম্ভু মিত্র বা বিজন ভট্টাচার্যের থেকে অনেক বেশি করে গণনাট্যের অনুসারী, কিন্তু প্রকাশভঙ্গির দিক থেকে মোটেই নয়। তিনি একটি বিশেষ রাজনৈতিক আদর্শকে তীব্রভাবে প্রকাশ করতেন এবং সে কাজে আঙ্গিককে কখনই অবহেলা করতেন না। তাঁর নাটকের চরিত্রদের মধ্যে যে কোনও ধরণের মানবিক আবেগের প্রকাশ খুব বেশি। বহু মানুষকে নিয়ে বিশাল মঞ্চছবি তৈরি করার ব্যাপারে তাঁর অসম্ভব দক্ষতা ছিল। এই বিস্তৃত পরিসরে বহু মানুষ নিয়ে ছবি তৈরির ফলে নাট্যঘটনায় একটা বড় প্রেক্ষিত চলে আসে এবং নাটকটি কিছু চরিত্রের ব্যক্তিগত কাহিনি না থেকে বহু লোকের দৈনন্দিনতাকে যুক্ত করে ফেলে। অন্যদিকে সাধারণ দর্শকও এর ব্যাপকতার কাছে অভিভূত হয়ে পড়েন। শুধু প্রযোজনাকে দৃশ্যময় করে তোলাই নয়, তার মধ্যে তিনি যাবতীয় থিয়েটারি উপাদানও ভরে দিতে চেয়েছেন নাটককার উৎপল দত্ত সংলাপ লেখায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন, আর প্রয়োগশিল্পী উৎপল দত্ত সেই সব সংলাপ ও পটভূমিকা অসাধারণ ক্ষমতায় মঞ্চে উপস্থাপিত করেছেন।


উৎপল দত্তের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল তাঁর থিয়েটারে আগাগোড়া পরিচালকই প্রধান। যে কোনও ধরনের প্রয়োগরীতি অবলম্বন করে তিনি নিজের রাজনৈতিক মতটিকে প্রকাশ করেছেন। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি সমকালীন ঘটনাকে অবলম্বন করে যেমন ‘অঙ্গার’ বা ‘জনতার আফিম’ করেছেন, তেমনই ইতিহাসের যে কোনো পর্বে, দেশে-বিদেশে চলে গিয়েছেন। প্রয়োগশৈলীতেও তিনি দেশি-বিদেশি যে কোনও সূত্র থেকে উপাদান সংগ্রহ করেছেন। ‘সিরাজদ্দৌলা’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘ব্যরিকেড’, ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’ প্রভৃতি নাটকগুলি তার প্রমাণ। তিনি ধ্রুপদী সাহিত্য সাবলীলভাবে প্রযোজনা করেছেন। মাইকেল মধুসূদন ও গিরিশচন্দ্রের নাটকের প্রতি তাঁর আগ্রহ একটু বেশী ছিল। এই দুজনের নাটকের মধ্যে থিয়েটারের সম্ভাবনাকে তিনি সার্থকভাবে ব্যবহার করেছেন, বিশেষ করে গিরিশচন্দ্রের নাটকে তিনি সমকালীন রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে আসতে পেরেছেন। তুলনায় রবীন্দ্রনাথের নাটক তার পরিশিলীত ভাষা ও বিন্যাসে একটু সুদৃঢ়। তবে দৃশ্যায়নে যে অনুপুঙ্খময় প্রত্যক্ষতা উৎপল দত্তের  ধরন, রবীন্দ্র-নাটকেও তার সাধ্যমতো প্রয়োগ করেছেন। কেবলমাত্র প্রসেনিয়াম মঞ্চই উৎপল দত্তের ক্ষেত্র ছিল না, তিনি পথনাটকেও অভিনয় করেছেন। আসলে প্রয়োগের ক্ষেত্র নিয়ে তাঁর কোনও গোঁড়ামি ছিল না, যে কোনও জায়গায় বলার কথাটা বলাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। বাংলা থিয়েটারে উৎপল দত্ত শেষ পর্যন্ত নিঃসঙ্গ থেকে গেছেন, তাঁর যখার্থ অনুসরণকারী কাউকেই পাওয়া যায়নি। 


শম্ভু মিত্র বা উৎপল দত্তের তুলনায় প্রয়োগশিল্পী হিসাবে বিজন ভট্টাচার্য কম আলোচিত। হয়তো নিজের কাজকে প্রচারের আলোয় আসতে না দেওয়াটাই ছিল তাঁর প্রতিবাদ। তাঁর কাজে একটা তীব্র ঝাঁঝ ছিল, ‘নীলদর্পণ’ বা ‘দেবীগর্জন’ প্রভৃতি নাটক তার প্রমাণ। লোকপুরাণ বা লোকনৃত্যকে প্রখর ব্যঞ্জনায় ব্যবহার করার ধরনে তিনি অন্যদের থেকে একেবারে আলাদা। প্রথাগতভাবে নাটকের কোনও ব্যকরণের কথা না বলে তিনি অভিনেতাকে কখনও কালীঘাটে গিয়ে ভিখিরিদের লক্ষ্য করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন, কখনও বা নিহত কৃষকের মাকে দেখতে বলেছেন।


১৯৬০ সালে তৈরি হয়েছিল নান্দীকার। এর প্রাণপুরুষ অজিতেশ বন্দোপাধ্যায় কিন্তু শম্ভু মিত্র বা উৎপল দত্তের মতো অভিনেতাদের কোনও নির্দিষ্ট ঘরানায় বাঁধতে চাননি। অজিতেশের প্রয়োগশৈলীতে বরাবরই এক ধরনের সবলতাজাত পৌরুষের ছাপ ছিল যা কোথাও কোথাও নাট্যমুহূর্ত আলোকিত করে তুলতে পারত। পাশাপাশি যে কোনও ধরনের নতুন প্রকাশভঙ্গী তাঁকে টানত। ফলে তাঁর প্রযোজনা হয়তো একটু বেশি ফর্ম নির্ভরতার দিকে ঝুঁকত এবং যেখানে সুযোগ বেশি সেখানে অভিনয় মূল নাটককে ছাপিয়ে উঠত। এর একটা বড় উদাহরণ হল ব্রেশট্-এর ‘A Threepenny Opera’ অবলম্বনে রচিত নাটক ‘তিন পয়সার পালা’, যেখানে মঞ্চ রূপায়ণ মূল নাটককে চাপা দিয়ে আরও প্রসারিত হয়ে উঠতে চেয়েছে। 

নান্দীকারের পরবর্তী নির্দেশক রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তও নানা প্রয়োগশৈলী বিষয়ে আগ্রহী। তাঁর নেতৃত্বে নান্দীকার কলকাতায় জাতীয় নাট্যমেলার আয়োজন করেছিল যেখানে সারা দেশের নাট্যচর্চার একটা আভাস পাওয়া যায়। এই মেলামেশা ও চিন্তার আদানপ্রদান বাংলার নির্দেশকদের প্রয়োগচিন্তার প্রভাব ফেলেছে। নান্দীকারের কাজে বরাবরই দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল – প্রথমত প্রচলিত নাট্যনির্মাণের ছককে ভেঙে ফেলার চেষ্টা, দ্বিতীয়ত শারীরিক অভিনয় এবং কন্ঠসংগীতের উপর জোর দেওয়ার প্রবণতা।


।।দুই।।

পাঁচের দশকে (বিশেষত স্বাধীনতা উত্তরকালে) দেশের পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে। এই সময়টাকে গোঁড়া বামপন্থী আদর্শবাদ থেকে সরে আসার যুগ বলা যায়। এই সময় বাঙালি দেখেছে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা, দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, নেতাদের প্রতি ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাস, দেশ জুড়ে ব্যাপক দুর্নীতি। এক কথায় একে বলা যেতে পারে বিশ্বাসভঙ্গের কাল বা স্বাধীনতার স্বপ্নভঙ্গ, নাট্যকারদের উপর যার প্রভাব পড়তে বাধ্য। সুতরাং চারের দশকের তুলসী লাহিড়ির বাস্তবতা দিয়ে সময়কে আর ধরা যাচ্ছিল না। শম্ভু মিত্র ‘উলুখাগড়া’ নাটক লিখতে শুরু করেন ১৯৪১ সাল নাগাদ, শেষ করেন ১৯৪৩-এর গোড়ার দিকে, অর্থাৎ ‘নবান্ন’ বা ‘দুখীর ইমান’-এর সমকালে। কিন্তু তুলসী লাহিড়ি বা বিজন ভট্টাচার্যের সরল আশাবাদ দিয়ে এ নাটক শেষ হয় না, বা তাঁদের মতো কোনও ঘটনার বিবরণ দিয়ে নাটককে সত্য করে তোলা হয় না।


বহুরূপীর প্রথম প্রযোজনা বিজন ভট্টাচার্যের নাটক ‘নবান্ন’ অভিনীত হয়েছিল রঙমহল মঞ্চে, ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ তারিখে। এর পর ‘পথিক’, ‘উলুখাগড়া’, ‘ছেঁড়া তার’ ও ‘বিভাব’ নাটকগুলির প্রতিটিরই পটভূমি প্রযোজনার সমকালে বিধৃত। এই পর্যায়ে শম্ভু মিত্রের মধ্যে গভীর আবেগ এবং ব্যঙ্গপ্রবণতার আশ্চর্য সমাহার ঘটেছিল, যার কারণ তাঁর নৈর্বক্তিক দৃষ্টিভঙ্গী। ১৯৫০ সালের শুরুতে তিনি ‘ঘূর্ণি’ নাটকটি লিখতে শুরু করেন। এই নাটকেও আছে এক সর্বগ্রাসী হতাশার ছবি। ‘ঘূর্ণি’-র পিঠোপিঠি রচিত ‘বিভাব’ নাটকেও এক ধরনের নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ আছে। 


পাঁচের দশকে বাংলার নাট্যকারেরা কেবলমাত্র তাৎক্ষণিকে আটকে না থেকে বড় পটে জীবনের তাৎপর্যকে ছোঁয়ার কথা ভেবেছিলেন। আর তার সহায় হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেইরকম ভাবনা থেকেই বোধহয় ‘লিটল্ থিয়েটার গ্রুপ’ পর-পর প্রযোজনা করেছিল ‘অচলায়তন’ (১৯৫৩), ‘কালের যাত্রা’ (১৯৫৫), ‘সূক্ষ্ম বিচার’ (১৯৫৬) এবং ‘তপতী’ (১৯৫৭)। উৎপল দত্ত বা  ‘সূক্ষ্ম বিচার’-এর নির্দেশক রবি ঘোষের দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে শম্ভু মিত্রের প্রচুর অমিল। তা ছাড়া বহুরূপী নাট্যগোষ্ঠীর আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল। তারা চেষ্টা করেছিল ভারতীয় থিয়েটারের একটি আদর্শ রূপ খুঁজে বার করতে এবং তাদের কাজের মধ্যে দিয়ে ইউরোপীয় থিয়েটার অনুপ্রাণিত বাংলা থিয়েটারের প্রচলিত ধারায় তাকে প্রতিস্থাপিত করতে। সেই ভারতীয় আদর্শের রূপ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের মধ্যে। তাই শম্ভু মিত্র নানাভাবে রবীন্দ্র-নাটকের কথা বলতে চেয়েছিলেন।


বহুরূপীর প্রচেষ্টায় রবীন্দ্রনাথ মঞ্চের ভাষায় বার-বার বাঙ্ময় হয়ে উঠেছিলেন। পাঁচের দশকের গোড়ার দিক থেকে বহুরূপী রবীন্দ্র-নাটকের অভিনয় শুরু করেছিল। ১৯৫১ থেকে ১৯৬৪ এই দশ বছরে তারা মোট সাতটি রবীন্দ্র-নাটক মঞ্চস্থ করেছিল। তাদের প্রথম রবীন্দ্র-নাটকের প্রযোজনা ‘চার অধ্যায়’ (১৯৫১)। এর পর শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় বহুরূপী যে সব রবীন্দ্রনাটকের মঞ্চায়ন করে সেগুলি হল ‘রক্তকরবী’ (১৯৫৪), ‘মুক্তধারা’ (১৯৫৯), ‘বিসর্জন’ (১৯৬১) এবং ‘রাজা’ (১৯৬৪)। এই তালিকায় আরও আছে অমর গাঙ্গুলি নির্দেশিত ‘স্বর্গীয় প্রহসন’ (১৯৫৫) এবং তৃপ্তি মিত্র নির্দেশিত ‘ডাকঘর’ (১৯৫৭)। পরবর্তীকালে তৃপ্তি মিত্র প্রযোজনা করেন ‘দুরাশা’ (১৯৭৩) ও ‘ঘরে বাইরে’ (১৯৭৪)। এছাড়া কুমার রায় প্রযোজনা করেছিলেন ‘মালিনী’ (১৯৮৬) ও ‘মুক্তধারা’ (১৯৯৬)। রবীন্দ্র-নাটক উপস্থাপনার যে আদর্শ শম্ভু মিত্র তৈরি করে দিয়েছিলেন, মোটের উপর অন্যরা তাকেই অনুসরণ করেছেন; তার সঙ্গে এমন কোনও স্বকীয়তাপূর্ণ ধরণ মেশাননি যা শম্ভু মিত্রের বিন্যাসের পরিপন্থী।


১৯৫১-য় ‘চার অধ্যায়’ করার পর থেকে শম্ভু মিত্র পর-পর রবীন্দ্রনাথ, সোফোক্লিস বা ইবসেনের নাটক করে গেছেন। এই সব নাটকের মধ্যে দিয়ে পূর্ববর্তী নাটকগুলির তুলনায় অনেক বেশি অপ্রত্যক্ষতায় সমসময়কে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে, যার ফলে সমকালীন সংকট ও তার সূত্র ধরে গড়ে ওঠা শিল্পীর আকুলতা একটা চিরায়ত রূপ পেতে পারে। ষাটের দশক থেকে সারা পৃথিবীতে ব্যক্তিমানুষের সংকট ও বিচ্ছিন্নতাবোধ প্রবল হয়ে উঠেছিল। আধুনিকতার সঙ্গে পরম্পরা বা যুক্তির যে সম্পর্ক একরকম স্বতঃসিদ্ধ ছিল উত্তর আধুনিক যুগে তা ভেঙে যায়, এমন কোনও আদর্শ বা মূল্যবোধে ব্যক্তি বিশ্বাস রাখতে পারছিল না যাতে করে সে সমাজজীবনের সঙ্গে অন্বিত হয়ে থাকতে পারে। বিশেষ করে ছয়ের দশকের শেষ এবং সাতের দশকের গোড়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল সভ্যতার গতি ক্রমশই শৃঙ্খলা থেকে বিশৃঙ্খলার দিকে এবং সেই সার্বিক পতনের মধ্যে ব্যক্তির কোনও ভূমিকা নেই। এই অসহায়তা থেকে ইউরোপে অ্যাবসার্ড নাটকের ধারা শুরু হয়েছিল, যার সঙ্গে ট্র্যাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর সম্পর্ক খুব কাছাকাছি। বাদল সরকার লিখেছিলেন ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ (১৯৬৩), ‘সারারাত্তির’ (১৯৬৩) এবং ‘বাকি ইতিহাস’ (১৯৬৫)। তাঁর ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ ও ‘সারারাত্তির’ বা মোহিত সরকারের প্রথম দিকের নাটকগুলি প্রায়ই কবিতাকে ছুঁয়ে ফেলে। 


অন্যদিকে বুদ্ধদেব বসু এই ধারার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন রামায়ণ-মহাভারতে। ব্যষ্টি আর সমষ্টির দ্বন্দ্ব তাঁর নাটকের প্রধান উপজীব্য। তিনি যে ইয়েটসের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন ‘তপস্বী ও তরঙ্গিনী’ নাটকের সূচনায় ইয়েটস থেকে উদ্ধৃতি বা ‘পার্গেটরি’ নাটকের রূপান্তর থেকে তা বোঝা যায়। কিন্তু নাটক রচনার সময় তাঁর নিজেকে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টায়, প্রাচীন ও ধর্মীয় পটভূমিতে নাটককে উপস্থাপিত করার ধরনে, প্রচলিত রীতি ভেঙে অন্যরকম নাট্যসংলাপ রচনা করার প্রয়াসে স্পষ্টতই এলিয়টের কথা মনে পড়ে। ‘তপস্বী ও তরঙ্গিনী’ লেখার পেছনে এলিয়টের ‘Murder in the Cathedral’ রূপকল্পের আভাস যুগিয়েছিল। এলিয়টের অনুসরণেই তিনি নাটকে কোরাস ব্যবহার করেছেন, পটভূমি ও সংলাপকে আকুতিময় প্রবলতায় নিয়ে গিয়ে এবং প্রতীক, শব্দস্পন্দ ও চরিত্রানুগ ভাষায় সংলাপ রচনা করে নাটকীয়তা তৈরির চেষ্টা করেছেন। এলিয়ট চেয়েছিলেন প্রাচীন ও ধর্মীয় পটভূমির পাশাপাশি সমকালও যেন কাব্যনাটকের বিষয় হয়ে ওঠে। পঞ্চাশের দশকের শেষ ও ষাটের দশকের গোড়ায় বাংলায় যে কাব্যনাট্য রচনার আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার প্রধান রচয়িতারাও  মূলত সমকালকেই নাটকের বিষয় করেছেন। কিন্তু সমকাল নির্ভর কাব্যনাটকে বুদ্ধদেব বসুর আগ্রহ ছিল না, আবার অতিনাটকীয়তাতেও তাঁর রুচি ছিল না। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত তাঁর সবকটি কাব্যনাটকের বিষয় আহরণ করা হয়েছিল মহাভারত থেকে। তাই তাঁর নাটকে পুরাণ ব্যবহারের প্রসঙ্গে মনে আসে ধরমবীর ভারতী-র ‘অন্ধযুগ’ বা শম্ভু মিত্রের ‘চাঁদ বণিকের পালা’ নাটকের কথা।


।। তিন।।

ষাটের দশকের শেষের দিক থেকে শম্ভু মিত্রের নাটক নির্বাচন দেখলে মনে হওয়া স্বাভাবিক চরিত্রায়ণের ক্ষেত্রে তাঁর প্রবণতা ছিল কোনও বিরাট মাপের ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করার দিকে। একই সঙ্গে নাটক নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি ক্রমশ গোষ্ঠীর সংকট থেকে ব্যক্তির সংকটের দিকে যেতে চেয়েছেন। এর কারণ আমাদের সমাজে কোনও যুক্তিনির্ভর, সৎ, সংবেদনশীল শিল্পীকে সমাজের প্রতিরোধে আহত হতেই হবে। এই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে নির্দেশক শম্ভু মিত্র তাঁর শেষ পর্বের প্রযোজনাগুলি করেছেন। প্রথম অধ্যায়ে তিনি সমকালকে গুরুত্ব দিয়েছেন, মধ্য পর্বে তিনি দেশি ও বিদেশি ধ্রুপদী নাটকের দিকে ঝুঁকেছেন, তৃতীয় পর্বে আবার সমকালকে মর্যাদা দিয়েছেন। কিন্তু প্রথম পর্বের নাটকগুলির থেকে তৃতীয় পর্বের ‘বাকি ইতিহাস’ (১৯৬৭), ‘বর্বর বাঁশী’ (১৯৬৯), ‘পাগলা ঘোড়া’ (১৯৭১), ‘চোপ, আদালত চলছে’ (১৯৭১) প্রভৃতির ধাঁচ একেবারে আলাদা। বাদল সরকার, নীতিশ সেন বা বিজয় তেণ্ডুলকরের নাটক প্রযোজনা করতে গিয়ে তিনি গল্প বলার পরিচিত ছককে ভেঙে দিতে চেয়েছেন। এটাও লক্ষ্য করার যে এই নাটকগুলি এক বা একাধিক গল্প বানায়, আর সেই বানানো গল্প ও জীবনের বাস্তবতার মধ্যে সংঘাত তৈরি হয়। নাট্যব্যক্তিত্ব হিসাবে শম্ভু মিত্রের যে পরিচয় পাওয়া গেছে তারই প্রকাশ দেখা যায় ‘চাঁদ বণিকের পালা’-য়। তিনি এই নাটকের মধ্যে নিজের জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা ভরে দিতে চেয়েছেন এবং এই কাজ করতে গিয়ে চাঁদ সদাগরের কাহিনি বেছে নিয়েছেন। তিনি মঙ্গলকাব্যের কাহিনিকে যেভাবে ব্যবহার করেছেন তাতে কাহিনি, চরিত্র বা অনুষঙ্গগুলো প্রতীকের চেহারা পেয়েছে।


শম্ভু মিত্রের প্রযোজনায় নাট্যচিন্তনের যে ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায়, তৃপ্তি মিত্র বা কুমার রায়ের প্রযোজনার ধরণ তার থেকে আলাদা। নাটকের প্রয়োগ সম্ভাবনার বৈচিত্র্য তাঁদের বেশি আকর্ষণ করেছে। বিশেষ করে তৃপ্তি মিত্রের কাছে নাটকের সাহিত্যরূপের গুরুত্ব অধিক, লিখিত রচনাকে প্রযোজনার তাগিদে ভাঙচুর করার প্রবণতা তাঁর একেবারেই ছিল না। ফলে ‘গণ্ডার’-এ খুঁটিনাটিসহ বাস্তবের অনুসারী পটভূমি রেখে দেওয়া হয় বা উপন্যাসের ধর্ম বজায় রেখেই ‘ঘরে-বাইরে’ প্রযোজিত হয়। এমনকী বাদল সরকারের ‘যদি আর একবার’ নাটকেও তৃপ্তি মিত্র ফ্যান্টাসির নিজস্ব মঞ্চরূপ তৈরি করতে পেরেছিলেন। পক্ষান্তরে কুমার রায় সেই সব নাটক বেশি পছন্দ করেন যায় মধ্যে দিয়ে তাঁর প্রয়োগ পরিকল্পনা বাস্তবকে অতিক্রম করতে পারে। নাট্যের বিবিধ প্রয়োগরীতি ব্যবহারের দিকে তাঁর বেশি আগ্রহ - যেমন সংস্কৃত নাটক, ব্রেখটের নাটক, রবীন্দ্রনাথের মালিনী, মনোজ মিত্রের ফ্যান্টাসি আর বাস্তবের বিভ্রম ভাঙা নাটক, প্রশান্ত দেবের বাস্তবের মধ্যে অবাস্তবের আলো ছড়ানো নাটক কিংবা শিশিরকুমার দাশের নাটক। মোটের উপর বলা চলে তিনি সেই সব নাটকের প্রতি আগ্রহী যার লেখার ধাঁচ বাংলা নাটকের প্রচলিত ধরনের থেকে আলাদা।  


প্রথাগত থিয়েটারের বিপরীত প্রান্তে বাংলায় আরও একটি নাট্যপ্রচেষ্টার ধারা নীরবে প্রবাহিত হয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৪ অক্টোবর কলকাতায় বাদল সরকারের শতাব্দী নাট্যগোষ্ঠী প্রথম অঙ্গন মঞ্চে প্রযোজনা করেছিল ‘সাগিনা মাহাতো’। তার সঙ্গেই বাংলা থিয়েটারে একটি অন্যরকম প্রয়োগধারার সূচনা হয়েছিল। সত্তরের পূর্ববর্তীকালে বাদল সরকার অবশ্য কোনওদিনই প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক থিয়েটার করেননি। বরং তিনি বেশ আঁটোসাঁটো ধরনের কমেডি এবং ব্যক্তিমানুষের ভাঙচুরকে প্রকাশ করতেন। সত্তরের শুরু থেকে তিনি যে ধরনের থিয়েটারের চর্চায় এসেছিলেন তার পিছনে গ্রোটোস্কি, ইউজিন বারবা  বা পিটার ব্রুকের অনুপ্রেরণা ছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক বোধ, প্রথাগত থিয়েটারের সীমাবদ্ধতা থেকে জাত অতৃপ্তি  এবং তার থেকে বেরোবার আকাঙ্খা।


বাদল সরকারের শতাব্দী নাট্যগোষ্ঠী ও তার অনুসারী নাট্যদলগুলির চিন্তাভাবনা প্রথাগত থিয়েটারের থেকে পুরোপুরি আলাদা। যে কোনও একটা আলোকিত চত্বর এক্ষেত্রে অভিনয়ের জায়গা হতে পারে, সে একটা বড় ঘর, শহরের রাস্তা বা গ্রামের মাঠ যাই হোক। এখানে দূরত্বহীনতার কারণে অভিনেতারা দর্শকবৃন্দের সঙ্গে মিশে যেতে পারেন, তাঁদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেন। এখানে নাটক প্রযোজনার মধ্যে ব্যক্তিগত আদানপ্রদানের ছোট ছোট টুকরো তৈরি হয়ে উঠতে পারে। এই থিয়েটার হালকা ও নমনীয় হওয়ায় স্বচ্ছন্দে যে কোনও প্রত্যন্ত প্রান্তে চলে যেতে পারে। মঞ্চ, আলো, পোশাক, মেক আপ ইত্যাদি বাদ দেওয়ার ফলে অঙ্গন মঞ্চ / মুক্তমঞ্চের প্রয়োগরীতিতে বেশ কিছু লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য চলে এসেছে। এখানে উপকরণহীন মঞ্চে অনেকটা ভাস্কর্যের ধরন গ্রহণ করা হয়, যাকে চারপাশ থেকে দেখতেই আনন্দ। কন্ঠস্বর অথবা সামান্য টুকিটাকি জিনিস দিয়ে নাটকের আবহ তৈরি করা হয়। শব্দ প্রক্ষেপণের সুবিধা ছাড়া ঘরে বা মাঠে কথা শোনানোর জন্য অভিনয়ে একটু উচ্চকন্ঠ আনতেই হয়। অর্থাৎ সব অসম্পূর্ণতাকে শরীর দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। তাই শরীরকে হতে হবে বাঙ্ময়, তীব্র ও ভারহীন। প্রয়োগকৌশলের এই ধরণটি ক্রমশই আরও বেশি স্বীকৃত হয়ে উঠেছে।


বহুরূপী. এল. টি. জি/পি. এল. টি এবং নান্দীকার – এই তিনটি নাট্যদলকে দীর্ঘদিন যাবৎ প্রথাগত বাংলা নাটকচর্চার প্রধান ধারা হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। এদের বাইরে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগধারা তৈরি করেছিলেন শ্যামল ঘোষ, প্রথমে গন্ধর্ব এবং পরে নক্ষত্র নাট্যগোষ্ঠীতে। তাঁরা ধারাবাহিকভাবে মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের অন্যরকম নাটক প্রযোজনা করে গেছেন। ‘মৃত্যু সংবাদ’, ‘চন্দ্রলোকে অগ্নিকাণ্ড’ বা নভেন্দু সেনের ‘নয়ন কবীরের পালা’য় তিনি বাস্তবের অনুশাসন ভেঙে গূঢ়তম সত্যে পৌঁছাতে চেয়েছেন। প্রসেনিয়াম থিয়েটারের প্রধানদের মধ্যে একমাত্র তিনিই ‘নয়ন কবীরের পালা’য় বাদল সরকারের অঙ্গন মঞ্চের প্রকাশভঙ্গিতে নিজেকে দেখে নিতে চেয়েছেন। 


স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা থিয়েটারে যে দলগুলি অগ্রগামী ছিল তাদের পুরনো বৈভব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অস্তমিত হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশকের বাংলা থিয়েটার অনেক বেশি ফর্মমুখী। এই পর্যায়ে থিয়েটারের নানা ধরনের প্রয়োগভঙ্গী নিয়ে চর্চা করে যাঁরা নাট্যভাবনায় নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে বিভাস চক্রবর্তী, অশোক মুখোপাধ্যায়, নীলকন্ঠ সেনগুপ্ত, রমাপ্রসাদ বণিক, কেয়া চক্রবর্তী, অসিত মুখোপাধ্যায়, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, শাঁওলী মিত্র, মনোজ মিত্র, অরুণ মুখোপাধ্যায় প্রমুখরা অন্যতম। তাঁরা নানা ধরনের নাটক প্রযোজনা করেছেন যার ফলে বিংশ শতাব্দীর শেষে বাংলা নাটক অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে।

Comments