গদ্য - দেবশ্রী রায়


"তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম"


বৈশাখ মানেই আর একটি নতুন বছর, যা কিছু পুরনো, যা কিছু জীর্ণ তাকে বিদায় জানিয়ে সাড়ম্বরে নতুনকে বরণ করা। তবে এই বর্ষবরণ ছাড়াও বাঙালীর কাছে বৈশাখ মানে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ। বৈশাখ মাস রবি মাস। যদিও 'বৈশাখে রবীন্দ্রনাথ' প্রাসঙ্গিক নাকি 'রবীন্দ্রনাথের বৈশাখ' নিয়ে আলোচনা প্রাসঙ্গিক একজন বাঙালীর পক্ষে এটা নির্ণয় করা খুব কঠিন। কিন্তু বাঙালী হৃদয়ের এইসব অনুভূতিগুলিকে ছাপিয়ে বিগত বছরের (১৪২৭) বৈশাখ এবং সদ্য পেরিয়ে আসা (১৪২৮) বৈশাখের সঙ্গে জুড়ে গেছে একটি ভয়াবহ নাম "করোনা"। গত বছর ততটা না হলেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়তেই বৈশাখের শুরু থেকেই একের পর এক মৃত্যুর খবর। কত প্রিয়জন, প্রিয় কবি, কত পরিচিত মানুষ চিরতরে ছেড়ে চলে গেলেন আমাদের। এই অসহায় লাগা দিনগুলিতে, চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসা সময়ে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, পঁচিশে বৈশাখ উদযাপন এইসবের থেকেও আমার কাছে 'আমার রবীন্দ্রনাথ' এই অনুভূতিটুকু অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছিল। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বলতে গেলেই অনেকেই বিতর্ক জুড়ে দেন, নানারকম তুলনা চলে আসে, কেউ কেউ আবার এটাকে আঁতেলপনা বা আদিখ্যেতা বলতেও ছাড়েন না। আমি সেসবের থেকে নিজেকে বাইরে রেখে আমার জীবনে, মননে, চিন্তনে রবীন্দ্রনাথ কী, রবীন্দ্রনাথের ভুমিকা কী, তাঁর গুরুত্ব কতখানি সবসময় শুধু সেটুকুই  বোঝার চেষ্টা করে যাই। কারণ, রবীন্দ্রনাথকে ব্যাখা করার কিংবা রবীন্দ্রনাথকে তুলে ধরবার দুঃসাহস বা যোগ্যতা কোনোটাই আমার নেই।


ঠিক কত বছর বয়সে প্রথম রবীন্দ্র কবিতার প্রতি ভালোলাগা শুরু হয় তা সঠিক মনে নেই। তবে খুব ছোটবেলা থেকেই 'হাট',  'সাধ', 'প্রশ্ন', 'হারিয়ে যাওয়া ', 'বীরপুরুষ', এইসব কবিতা আবৃত্তি করে আনন্দ পেতাম। আর পঁচিশে বৈশাখে স্কুল আর ক্লাবের অনুষ্ঠানে যোগদানের ব্যাপারে আমার বয়সি ছেলেমেয়েদের মধ্যে আমারই উৎসাহ সবচেয়ে বেশি থাকত সবসময়। তখন রবীন্দ্রনাথকে ঠাকুর হিসেবেই জানতাম। তাঁর জন্মদিনে তাঁর ছবিতে মালা পরিয়ে, ধূপ জ্বালিয়ে গান, নাচ, আবৃত্তি, নাটক এসব করে তাঁকে পুজো করতে হয় এরকমই কিছু একটা মনে হতো। অর্থাৎ পঁচিশে বৈশাখ মানে একটা উৎসব। 


একটু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে কবি হিসেবে, গল্পকার হিসেবে, গীতিকার হিসেবে জানতে শুরু করি। পাঠ্যপুস্তকের রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও শুরু হয় তাঁকে আলাদা করে নিয়মিত পড়া।  সঞ্চয়িতা' আর 'গীতবিতান' খুব প্রিয় হয়ে উঠতে থাকে কৈশোর পেরোনোর সময় থেকেই। যত দীর্ঘই হোক অনায়াসেই সঞ্চয়িতা থেকে অজস্র কবিতা দু-চার বার পড়লেই ঝরঝরে মুখস্ত হয়ে যেত। যেটা অন্য কোনও কবির কবিতা অত কম পড়ে মুখস্ত হয়নি। আর সেই সময় থেকেই পঁচিশে বৈশাখের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে ধারণা বদলাতে শুরু করে। সেই কারণেই হয়তো স্কুল, কলেজের অনুষ্ঠান ছাড়াও বাড়িতে একা একা আলাদা  নিজের মতো করে পঁচিশে বৈশাখ পালন করতাম। তেমন কিছু নয়, ঐ বাড়িতে রাখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট্ট  ফটোর দুপাশে দুটো জলভর্তি বোতলে বাড়ির বাগান থেকে ডাল সমেত তুলে আনা গন্ধরাজ ফুল সাজিয়ে, কবির ছবিতে বাগান থেকে তুলে আনা বেলিফুলের মালা পরিয়ে, ধূপদানিতে একমুঠো সুগন্ধি ধূপ জ্বালিয়ে, তাঁর ফটোর সামনে গীতবিতান আর সঞ্চয়িতা রেখে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা। কবি রবীন্দ্রনাথ, গল্পকার রবীন্দ্রনাথ, গীতিকার রবীন্দ্রনাথ, প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ, নাট্যকার রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে চেষ্টা করতাম। আর তখনি ফুল আর ধূপের গন্ধ  মিলেমিশে চারপাশে একটা অপূর্ব গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত। চোখ বন্ধ করলে আজও সেই গন্ধটা পাই। তখন শুধু মনে হতো আমার যা কিছু না বলা কথা, যা কিছু প্রশ্ন তার সব উত্তর গীতবিতান আর সঞ্চয়িতাতে কবি লিখে রেখেছেন আগে থেকেই। ঐ বই দুটোর মধ্যেই যেন মুক্তির আকাশ খুঁজে পেতাম।


এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বয়স বেড়েছে, অভিজ্ঞতা বেড়েছে আর রবীন্দ্রসাহিত্যের সঙ্গে এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ধীরে ধীরে। একটা স্বতন্ত্র আদর্শ গড়ে উঠেছে অজান্তেই নিজের ভেতর। ব্যক্তিগত জীবনে শুধু নয় কর্মজীবনে আমার ছাত্রীদের মধ্যে সেই আদর্শ বিলিয়ে দেবার চেষ্টা করি সবসময়। তবুও আজ নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে বলতে পারব না এতগুলো বছর ধরে ঠিক কতটুকু জেনেছি, কতটুকু পড়েছি রবীন্দ্রনাথকে! রবীন্দ্রসাহিত্য এক সমুদ্র। রবীন্দ্রনাথ একটা আকাশ। আর একটা আকাশের সঙ্গে আর একটা আকাশেরই তুলনা হতে পারে, একটা সূর্যের সাথে আর একটা সূর্যের। তাই একজন বাঙালী হিসেবে অহংকার হয় এটা ভেবে যে, আমাদের নিজেদের একটা আকাশ আছে, নিজেদের একটা রবি আছে। যে রবির আলোয় আমরা আলোকিত হই, আর সেই আলো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁকে নিয়ে নতুন করে আলোচনার দরকার হয় না। শুধু পঁচিশে বৈশাখ কিংবা বাইশে শ্রাবণ নয় রবীন্দ্রনাথ প্রতিটি বাঙালীর জীবনেই বোধহয় সবসময় জ্ঞানে- অজ্ঞানে অপরিহার্য হয়ে আছেন। 


আমার নিজের সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক কী, এটা নিয়ে যখনই ভেবেছি, মনে হয়েছে এত ক্ষুদ্র আমি, সত্যি কি তাঁকে এতটুকুও ছুঁতে পেরেছি কোনোদিন! কিন্তু আমার এই প্রশ্নের উত্তরও তিনি  দিয়ে রেখেছেন তাঁর 'উৎসর্গ' কাব্যগ্রন্থের ১২ নম্বর কবিতায়....


'হায়     গগন নহিলে তোমারে ধরিবে কে বা।

ওগো    তপন তোমার স্বপন দেখি যে,                       

            করিতে পারি নে সেবা।'

            শিশির কহিল কাঁদিয়া,

            'তোমারে রাখি যে বাঁধিয়া 

           হে রবি, এমন নাহিকো আমার বল।

           তোমা বিনা তাই ক্ষুদ্র জীবন কেবলি অশ্রুজল।'


আমি যদি সেই শিশিরবিন্দু হই, তাহলে আকাশের রবিকে ছোঁয়ার সাধ্য কই আমার? কিন্তু না, কবি কবিতার পরের ছত্রে আমার মনের সেই দ্বন্দ্ব দূর  করে দিয়ে বলেছেন..


'আমি    বিপুল কিরণে ভুবন করি যে আলো,

তবু        শিশিরটুকুরে ধরা দিতে পারি 

              বাসিতে পারি যে ভালো।'

              শিশিরের বুকে আসিয়া

              কহিল তপন হাসিয়া,

             'ছোট হয়ে আমি রহিব তোমারে ভরি,

              তোমার ক্ষুদ্র জীবন গড়িব 

              হাসির মতন করি।'


হ্যাঁ, ঠিক এরকমই সম্পর্ক আমার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। আকাশের রবি হয়েও এভাবেই তিনি আমার হৃদয়ে নিভৃতে চিরবিদ্যমান।

Comments