গল্প - পত্রলেখা নাথ



নীল নয়নার পায়ে পায়ে



আজ ভোররাত থেকেই আকাশটা গুম মেরে আছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি মাথায় করে যমুনা আর শ্যাম আধঘণ্টা হেঁটে স্টেশানে এসেছে। যমুনার বয়স বছর চোদ্দ। শ্যামের বয়স ওর থেকে একটু বেশি, এই সবে হাফ প্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্ট ধরেছে। শ্যামের পিঠে কাপড়ের ঝোলা, তাতে একটা খাঁচাবন্দি টিয়াপাখি যেটা মাঝে মাঝে ক্যাঁক ক্যাঁক করে ডাকছে, গলায় ঝোলানো একটা ছোট ঢোল, কোমরে গামছা বাঁধা রয়েছে।


যমুনার পরনে লম্বা ফ্রক , পায়ে ঘুঙ্গুর, চুল দুটো দুদিকে বেনী করা, গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ, রোদে পুড়ে খানিকটা ট্যান হয়ে গেছে। তবে যমুনার চেহারার মধ্যে সবচেয়ে যেটা চোখে পড়ে, সেটা ওর নীলাভ চোখ। যেন কত যুগের রহস্য লুকিয়ে আছে সে দুচোখে। শ্যাম মাঝে মাঝে ওর চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে থাকে, বলে ‘জানিস যমুনা, আমার মনে হয় তুই কোনও দূরদেশের রাজকন্যে, না হলে তোর চোখদুটো ওমন নীল কেন!’ যমুনাও দেখেছে ওর চোখ দুটোর রঙ আর পাঁচটা ছেলেমেয়েদের থেকে একেবারে আলাদা।


কু-উ শব্দ করে গেদে স্টেশানে ট্রেন ঢোকে। অফিস যাত্রীদের ভিড় না থাকলেও ফুলওয়ালি, সবজি মাসিদের ভিড় রয়েছে প্ল্যাটফর্মে। ভেন্ডারে ছানা আর ওষুধ ওয়ালাদের ভিড়। শ্যাম আর যমুনা গেদে লোকালের পেছনের লেডিসে উঠে পড়ে। প্রতিদিন যাতায়াতে সবার সংগে বেশ পরিচয় হয়ে গেছে ওদের। যমুনা ও শ্যাম ট্রেনে উঠতেই ফুলওয়ালি মাসিরা ওদের জায়গা দেয়। এক মাসি বলে, ‘যমুনা আজকে কিন্তু আমার মেয়ের কপালটা একটু দেখে দিতে হবে।’ যমুনা মুচকি হাসি হাসে। তারপর চিরাচরিত ঢঙ্গে ট্রেনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে লম্বা ফ্রকটাকে দুহাতের দুটো আঙ্গুল দিয়ে একটু তুলে দুপায়ের কৌশলে ঘুঙ্গুরগুলো নাচিয়ে ঝন ঝন করে অদ্ভুত শব্দ করে। শ্যাম যমুনার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে ঝোলা থেকে খাঁচা বন্দি টিয়া পাখিটাকে রাখে। তারপর গলায় ঝোলানো ঢোলটাকে বাঁ পায়ের হাটুর তলায় চেপে দুহাতের জোড়ে দমাদম বাজাতে আরম্ভ করে। ঘুংগুর আর ঢোলের শব্দে টিয়া পাখিটা ক্যা ক্যা করে ডেকে ওঠে। ঢোলের ছন্দে যমুনা প্রথমে তার কোমর দোলায়। তারপর গোল করে ঘুরতে ঘুরতে সাপের মতো যমুনার শরীর দুলে ওঠে। যমুনা আঁকিয়ে বাঁকিয়ে ঘুরিয়ে অদ্ভুত সুন্দরভাবে শ্যামের ঢোলের তালে তালে নাচতে থাকে। তার পরনের লম্বা ফ্রক যমুনার নাচের দোলায় দোল খায়। নাচ শেষ হলে ট্রেনের কামরার সবাই একসঙ্গে হাততালি দিয়ে ওঠে। খাঁচা বন্দি টিয়া পাখিটাও আনন্দে খাঁচার মধ্যে গোল গোল করে ঘুরতে ঘুরতে ডেকে ওঠে। যমুনা টিয়া পাখির খাঁচাটাকে হাতে নিয়ে ট্রেনে বসে থাকা যাত্রীদের কাছে এগিয়ে যায় আর বলে, ‘বাবুরা মায়েরা, বোনেরা দিদিরা, দাদারা ভাইয়েরা, নিজের কপালের কথা জানতে হলে জেনে নিন, এ পাখির নাচ গঙ্গারাম, যা বলে সব মিলে যায়। বিয়ের খবর, রোজগারের হদিশ, ফিন কেমন যাবে যা জানতে চাইবেন সব বলে দেবে। জেনে নিন, নিজের ভাগ্য যাচিয়ে নিন।’ ট্রেনে বসে থাকা অনেকেই উঠে এসে পাখিটাকে ভাল করে দেখে। এক মাসি খাঁচার কাছে এসে বলে, ‘ও গংগারামবাবু, আমার মেয়ের বিয়ে ভালো জায়গায় হবে তো।’ পাখিটা একবার মাসির দিকে তাকায় তারপর মাথাটা সামনের দিকে দুবার নাড়ায়। ওমনি সবাই হাততালি দিয়ে ওঠে। মাসি দশ টাকা যমুনার হাতে গুঁজে দেয়। ফুলওয়ালি মাসিদের কেউ কেউ তাদের খাবার থেকে যমুনাকে মুড়ি মুড়কি খাওয়ায়। 


প্রতিদিন এভাবেই যমুনাদের দিন শুরু হয়। গেদে লোকাল ধরে ভোরবেলা ওরা চলে আসে শহরতলীর কাছে। তারপর কখনো নৈহাটি, কখনো বারাকপুর বা কখনো সোদপুরে নেমে ট্রেন চেঞ্জ করে করে অন্য নানা ট্রেনে উঠে নাচ দেখায়, গংগারাম তার ভবিষ্যৎবাণী করে।


পর্ব-২

আজ স্টেশনে পৌঁছাতে বেশ দেরি হয়ে গেছে শ্যামদের। যমুনা ঘর থেকে আজ লাল মসজিদের মোড়ে আসতে প্রায় প্য়তাল্লিশ মিনিট দেরি করেছে। মাথাভাংগা নদীর ধারে লাল মসজিদের দক্ষিণপ্রান্তে যমুনাদের ঘর আর শ্যাম থাকে পুব পাড়ায়। স্টেশানে আসতে লাল মসজিদের মোড়ে দুজনে দেখা করে তারপর ওখান থেকে একসংগে স্টেশানে আসে। যমুনা আসতে আজ আচ্ছা করে দুটো কথা শুনিয়ে দিয়েছে শ্যাম। এমনিতেই সাজতে গুজতে বেশ সময় লাগে যমুনার। সে জন্য প্রতিদিনই পাঁচ দশ মিনিট হেরফের হয়। কিন্তু আজ প্রায় ঘণ্টাখানেক দেরি। ৬টা ২৫এর ট্রেনটা মিস করলে আবার একঘন্টা স্টেশনে বসে থাকতে হবে।


লাল মসজিদকে পেছনে ফেলে একাই  হাঁটতে শুরু করে যমুনা পেছনে শ্যাম। রাগে গজ গজ করছে যমুনা শ্যামের মুখেও বিরক্তি। শুধু পাখিটার কোন বিরক্তি নেই, সে দিব্য শ্যামের ঝোলায় বসে  ডেকে চলেছে। দুজনে স্টেশনে ঢুকতেই ট্রেনের অ্যানাউন্সমেন্ট হয়। যমুনা শ্যামের দিকে কটমট করে তাকায়। শ্যাম যমুনার হাতটা ধরে বলে, ‘এই রাগ করেছিস। এই নে একটা বিস্কুট খা’ বলে যমুনার মুখে একটা বিস্কুটের টুকরো ঢূকিয়ে দেয়। যমুনা মুখটা ঘুরিয়ে নেয় বলে, ‘তুমিতো শুনলেইনা কেন দেরি হল।’ এরইমধ্যে স্টেশনে ট্রেন ঢোকে। যমুনা-শ্যাম ট্রেনে উঠে পড়ে। অন্যান্য দিন ট্রেনে উঠে নাচার জন্য প্রস্তুতি নেয় যমুনা। আজ যমুনা কেমন আনমনা হয়ে জানলার ধারে বসে দূরে তাকিয়ে থাকে। শ্যাম ঝোলা থেকে প্রথমে পাখিটাকে বার করে তারপর ঢোলটা গলা থেকে নামিয়ে যমুনার পাশে গিয়ে বসে, নিজের হাতের যমুনার মুখে পড়া চুলগুলো সরিয়ে বলে, ‘বল কি হয়েছে তোর যমুনা?’ যমুনা শ্যামের দুটো হাত ধরে বলে, ‘শ্যাম দা,আমায় অনেক দূরে নিয়ে যাবে?’ শ্যাম বলে, ‘সেটা কোথায় রে যমুনা!’ যমুনা জানলা দিয়ে আবার বাইরের দিকে তাকায় তারপর বলে, ‘জায়গাটা কোথায় জানিনা কিন্তু আমি আজ স্বপ্নে দেখলাম সেই জায়গাটাকে। হলুদ রঙের সোনার বালি দিয়ে তৈরী সে দেশ। আকাশ জুড়ে মিশে গেছে সেই সোনার দেশের সঙ্গে। ছোট তাঁবু খাটানো রয়েছে সেখানে। তাতে কত মানুষ কেউ রান্না করছে, কেউ বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছে? আমি একটা উটের পিঠে বসে আছি। আর জানো তো চারিদিকে কিলবিল করছে সাপ।’ শ্যাম হা করে তাকিয়ে আছে যমুনার দিকে। যমুনা তার চোখগুলো বড় বড় করে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে বলছে তার স্বপ্ন কাহিনী। শ্যাম হঠাৎই বলে ওঠে, ‘যমুনা তোর এই স্বপ্নে আমি নেই?’ যমুনা কথা বলতে বলতে হঠাৎ চুপ করে যায়। তারপর সরলভাবে বলে, ‘না তোমাকে তো দেখলাম না সেই দেশে।’


যমুনা আবারও বলে চলে জান শ্যাম দা, ‘জায়গাটা বড় সুন্দর, বড় আপনার মনে হয়। কত মানুষ একসঙ্গে রয়েছে। আমার বয়সী কত ছেলেমেয়ে ঘাগরা পরে বেনী দুলিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচছে। চারিদিকে বালির পাহাড়। আমাকে ওখানে নিয়ে চলোনা শ্যাম দা। ওই বালির দেশে।’ ‘এই জায়গাটা তো চিনি না যমুনা।’ শ্যাম বলে ওঠে। ‘কিন্তু আমি চিনি শ্যামদা। আমার মনে হয় আমি বহুবার ঐদেশে গেছি। ওটাই আমার দেশ।’ চোখের পলক পড়ে না যমুনার। নীলার মতো মণিটাকে ঘুরিয়ে যমুনা বলে চলে। অগত্যা শ্যাম বলে, ‘ঠিক আছে তবে রফিক চাচাকেই জিজ্ঞাসা করব কীভাবে যাওয়া যায় ওই দেশে।’ কথাটা মুখে বললেও মনটা খারাপ হয়ে যায় শ্যামের। আজ যমুনা কেমন যেন এক অন্য জগতের মানুষ হয়ে গেছে। একের পর এক স্টেশন এগিয়ে চলে। সোদপুর স্টেশন আসার ঠিক আগে যমুনা বায়না করতে থাকে সোদপুরে নামবে। গতকাল বাড়ি ফেরার সময় ট্রেনের জানালা দিয়ে শ্যামই যমুনাকে দেখিয়েছিল। সোদপুর থেকে খড়দা যাবার পথে একটা মাঠে সার্কাস বসেছে। যমুনা আজ সেই সার্কাসের মাঠে একবার যেতে চায়। শ্যাম যমুনাকে বলে, ‘আরে বোকা এই সাতসকালে সার্কাস হয়না।’ কিন্তু যমুনা জেদ করে। অগত্যা সোদপুর স্টেশনে যমুনা কে নিয়ে নেমে পড়ে।


পর্ব-৩

স্টেশানে নেমে বাম দিকের বাস রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে খেলার মাঠে বসেছে সার্কাস। মাঠের একপাশে বিশাল তাঁবু খাটানো। তাঁবুর চারদিক অস্থায়ী গ্রিল দিয়ে ঘেরা। সামনে বিশাল একটা গেট। যমুনা গেটের সাইট দিয়ে উঁকি মেরে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করে। মাঝে মাঝে বামন জোকারদের দেখতে পায়। যমুনা তাদের পোশাক হাঁটাচলা দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ে। শ্যাম যমুনার হাতটা ধরে ওখান থেকে ওকে নিয়ে যেতে চায়। যমুনাকে বলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করার মত সময় ওদের হাতে নেই। যমুনা তবু দাঁড়িয়ে থাকে। শ্যামের যে কৌতূহল নেই তা নয়। কিন্তু কাউকে কিছু না জিজ্ঞাসা করে এরকমভাবে কোনো জায়গায় ঢোকা যে অনুচিত সেটা শ্যাম বোঝে। তারওপর এটা তো আর ওদের গ্রাম নয়, যে শ্যামকে সবাই চিনবে। শ্যামের শক্ত হাতটা এক ঝটকায় ছাড়িয়ে দৌড়ে সার্কাসে গেটের ভেতর ঢুকে যায় যমুনা। শ্যামও আর কিছু না ভেবে যমুনার পেছন পেছন ঢুকে পড়ে। ভেতরে ছোট বড় অনেক তাঁবু খাটানো। একদিকে পাইপ দিয়ে হাতি ও তার বাচ্চাদের স্নান করানো হচ্ছে। অন্যদিকে একজন অনেকগুলো লোমওয়ালা কুকুরকে লাঠির ইশারায় একবার ওঠাচ্ছে একবার বসাচ্ছে।আরেকদিক থেকে ভেসে আসছে নানাধরনের পাখির ডাক। ওই তাবুগুলোর একদম পেছন দিকে বিশাল কড়াইয়ে রান্না হচ্ছে। এ যেন এক আলাদা পৃথিবী। যমুনা দৌড়ে একবার হাতির সামনে যায় তারপর নিমেষে ওখান থেকে অন্যদিকে চলে যায়। শ্যামের যমুনাকে দেখে মনে হয়, এই জায়গাটা যেন যমুনার বহুদিনের চেনা। শ্যাম কিছু বুঝে ওঠার আগেই যমুনা চোখের আড়াল হয়। শ্যাম ডাকে, ‘যমুনা চলে আয়, আমাদের ঘরে ফিরতে হবে।’ কিন্তু যমুনার কোনো হদিশ মেলে না। সকাল গড়িয়ে দুপুর নামে। শ্যাম যমুনাকে না পেয়ে সার্কাস গেটের একপাশে বসে পড়ে। সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। খিদে ক্লান্তিতে চোখ জুড়ে আসে শ্যামের। এতক্ষণ কী করছে মেয়েটা। চিন্তায় কি করবে বুঝতে পারে না। দুপুরের ঠাঠা রোদ হালকা হতে শুরু করেছে। চোখ লেগে গেছিল শ্যামের। হঠাৎ চোখ খুলতে  মনে হয় সূর্যের পড়ন্ত আলো গায়ে মেখে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে যমুনা। যমুনাকে দেখতে পাওয়া মাত্র মুহুর্ত দেরি না করে শ্যাম একরকম জোর করেই স্টেশানে নিয়ে আসে। তারপর গেদে ফিরে আসে।


যমুনা দের ঘর  মাথাভাঙ্গা নদীর তীরে। যমুনার বাবা রফিক মিয়া একসময় নৌকা চালাতো। এখন আর শরীর বয় না। ঘরে বসেই বেতের ঝুড়ি, ঠোঙা তৈরি করে যেটুকু পয়সা আসে আর যমুনা রোজগার করে আনা টাকা দিয়ে দুটো পেট কোনমতে চলে যায়। আজ শহর থেকে ফিরে যমুনা অনেকক্ষণ গুম মেরে  ঘরে বসে থাকে। উচ্ছল ছটফটে মেয়েটা হঠাৎ এরকম চুপচাপ হয়ে গেল কেন? রফিক এসে মেয়ের পাশে বশে বলে, ‘কি হয়েছে বেটি? শ্যামের  সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে?’ 
যমুনা দুহাতে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আব্বা আমি সার্কাসে খেলা দেখাবো। ওখানে কত পশুপাখি, কত রকমের লোক, তারা কি সুন্দর খেলা দেখায়। কখনো এদেশে, কখনো অন্য দেশে ঘুরে বেড়ায়। আমি ওদের সঙ্গে যাবো আব্বা।’ রফিক মিয়া দুই হাতে যমুনাকে বুকে টেনে নেয় বলে, ‘তুই চলে গেলে আমায় কে দেখবে যমুনা? তুই ছাড়া আমার কে আছে বেটি!’ যমুনা চুপ করে যায়।


বছর দশেক আগে এক ভোররাতে মাথাভাঙ্গার ধার থেকে যমুনাকে কুড়িয়ে পেয়েছিল রফিক মিয়া। সেদিনকার কথা মনে পড়লে আজও যেন বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। ভোররাতে নৌকা লাগাতে গিয়ে একটা বাচ্চার কান্নার শব্দে রীতিমত ভয় পেয়েছিল সেদিন। কোথাও কিছু নেই চারিদিক সুনসান তার মধ্যে একটা কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। টর্চ হাতে অনেক খোঁজাখুঁজি করে ঘাটের পাশে একটা গাছের তলায় বাচ্চাটাকে দেখতে পেয়েছিল মিয়াঁ। ফুটফুটে বছর দুয়েকের মেয়ে ফ্রক পরা সোনালী চুল, মাথার দুপাশে ঝুটি করা ফর্সা গায়ের রঙ কপালে টিপ হাতে চুড়ি পায়ে ঘুঙুর। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে অনেকটা সময় ওর আত্মীয়দের খোঁজাখুঁজি করেছিল রফিক কিন্তু কাউকে পায়নি। সেই থেকে মেয়েটা রয়ে গেছে রফিকের কাছে রফিক মিয়ার একাকিত্বের জীবনে বাঁচার রসদ ।  যমুনা কে? কোথা থেকে এসেছে? রাতারাতি রফিক মিয়া এক মেয়ের বাপ হলো কি করে এসব নিয়ে গ্রামে বহু কথা হয়েছে, থানা পুলিশও হয়েছে। অবশেষে থানা থেকেই জানিয়েছে রাজস্থান থেকে বেশকিছু জিপসি মেয়েকে বাংলাদেশে পাচার করতে যাওয়ার সময় এই বাচ্চাটাকে অতিরিক্ত বোঝা ভেবে ফেলে  দিয়ে গেছে। এর মা-বাবার কোন হদিস নেই, অতএব রফিক মিয়া চাইলে একে নিজের কাছে রাখতে পারে। তবে তার জন্য কিছু আইনি সই সাবুত করতে হয়েছিল রফিক মিয়া কে। রফিক মিয়ার শূন্য জীবন এই মেয়েটিই  একমাত্র আশ্রয়। তাই আর দেরী করেনি রফিক। থানায় গিয়ে উকিলের সামনে আইনি কাজকর্ম মিটিয়েছিল। সেই সময়ে উকিলবাবু রফিককে বলেছিলেন, ‘ মিয়া এ মেয়ে তো  কোথাও থাকার জন্য আসেনি। এ তোমায় যাদু টোনা করে ভুলিয়ে ভালিয়ে তোমার সব নিয়ে সরে পড়বে। জিপসি মেয়েরা কি সাংঘাতিক  হয় জানো!’ রফিক মিয়া তখন  শুধু হেসেছিল। দু বছরের বাচ্চা কি সাংঘাতিক হবে! আজ অনেকদিন পর সেসব কথাই মনে পড়ছে রফিকের। 


থানার দারোগাবাবুর কাছ থেকে রফিক তখনই জানতে পেরেছিল জিপসিদের জীবনের নানা কাহিনি। শুনেছিল, জিপসিদের জীবন পরিযায়ী পাখিদের মতো। তাদের বাসস্থানও জীবনযাত্রার সংগে চলমান। সারা পৃথিবীতে প্রায় দেড়কোটি জিপসি বসবাস করে। তার মধ্যে সত্তর শতাংশ ইউরোপে থাকলেও ভারতের রাজস্থানেও তাদের অস্তিত্ব রয়েছে। তাদের নিজস্ব কিছু আচার, সংস্কৃতি আছে যা তারা নিজেদের সমাজের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। এই রহস্যময়তা জিপসিদের বিশ্ববাসীর কাছে রোমান্টিক করে তুলেছে। রফিক মিয়াঁ সেদিন অবাক হয়ে শুনেছিল জিপসিদের জীবনের এই সব অদ্ভুত নিয়ম।এরা মুলত অনেকে মিলে গোষ্ঠীতে থাকে, যাকে বলে ‘কুমপানিয়া’। প্রত্যেকটি বড় গোষ্ঠী চালাবার জন্য একজন নেতাকে তারা সারাজীবনের জন্য নির্বাচন করে যাকে তারা ‘ভয়ভোডে’ বলে অপরদিকে একজন বয়স্কা মহিলাকে নির্বাচিত করা হয় যাকে বলা হয় ‘ফুড়ি দাই’। তিনি ওই গোষ্ঠীর নারী ও শিশুদের যাবতীয় সমস্যা, সুখ সুবিধা দেখাশোনা করে। এমনকী গোষ্ঠীর মধ্যে কোনো ঝগড়া অশান্তি হলেও ওই গোষ্ঠীর নেতা নেত্রীকেই জানাতে হয়। তারা তাদের কোনো সমস্যার কথা পুলিশকে জানায় না। রফিক সেদিন দারোগাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আচ্ছা বাবু, আমি যে মুসলমান, এই মেয়েটির কোনো ধর্মের তা তো জানিনা।’ দারোগা হেসে বলেছিলেন, ‘আরে ধর্ম দিয়ে কী হবে!পরম ধর্ম তুই ওর বাপ ও তোর মেয়ে। বাপ মেয়ের মধ্যে আবার ধর্ম কী?আর তাছাড়া এই জিপসিদের মধ্যে কেউ খ্রিষ্টান, কেউ মুসলমান হয়েই থাকে। আসলে যখন তারা যেখানে গেছে সেই স্থানের ধর্মকে গ্রহণ করেছে। তবে বিভিন্ন ধর্ম অনুসারী হলেও তারা মানে সব ধর্ম ঈশ্বরেরই সৃষ্টি, সব ধর্মের মানুষই ঈশ্বরের কাছে প্রিয়।তাই দেখা যায় একটি গোষ্ঠির মধ্যে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ থাকলেও তাদের মধ্যে কখনোও দাংগা হয় না। সেদিনকার সব কথাই ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে উঠছে রফিক মিয়াঁর।   


পর্ব-৪

শ্যাম আজ অনেকক্ষণ অবধি লাল মসজিদের মোড়ে যমুনার জন্য অপেক্ষা করেছে কিন্তু যমুনা আসেনি। গতকাল থেকেই যমুনাকে যেন খুব অন্যরকম লাগছে শ্যামের। সে যেন এক অন্য জগতে হারিয়ে আছে। শ্যাম আর দেরি না করে দক্ষিণপাড়া যমুনার বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।  কি জানি মেয়েটার অসুখ-বিসুখ করল না তো। চিন্তা হয়। দক্ষিণ পাড়ার দরগার পাশের গলিতে রফিক মিয়াঁর বাড়ি। এ সময় চাচাজানের ঘরেই থাকার কথা। ভাবতে ভাবতে শ্যাম পৌঁছে যায় যমুনাদের ঘরে। বার চারেক দরজার কড়া নাড়বার পর দরজা খোলে রফিক চাচা। শীর্ণ শরীর নিয়ে কুঁজো হয়ে কোনোমতে আসে দরজার সামনে। চাচাকে দেখতেই শ্যাম বলে, ‘ চাচা যমুনা কোথায়?’ রফিক একটু অবাক হয়েই তাকায় শ্যামের দিকে । তারপর বলে, ‘ ও  তো কোন ভোরেই বেরিয়ে গেছে রে। কেন তোর সংগে যায়নি যমুনা?’ রফিকের কাছেও এটা একটু আশ্চর্যের। শ্যাম ছাড়া আজ অবধি কোনোদিন শহর পথে পা দেয়নি যমুনা। তবে কী কোনো খারাপ সংগে পড়লো? কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে রফিকের।  শ্যাম আর কোনো কথা না বলে ঘরে ফিরে আসে। আজ এই প্রথমবার যমুনা শ্যামকে ছেড়ে শ্যামকে কিছু না জানিয়ে কোথাও গেছে। কিন্তু শ্যাম ছাড়া যমুনার নাচের সঙ্গে ঢোল বাজাবে কে?


সন্ধ্যার পর থেকে আজ শ্যাম গেদে স্টেশনে বসে থেকেছে। কেন যমুনা আজ এরকম করলো একথা সে জানতে চায়। রাত আটটা পাঁচ এর গেদে লোকাল স্টেশনে ঢোকে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকে শ্যাম।  ভিড় কমলে অনেকের মাঝে ঝকমকে পোশাক পরা মাথায় জরির ফেট্টি বাধা একটা মেয়েকে দেখতে পায় শ্যাম। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে, এই কী ওর যমুনা। শ্যামকে দেখে যমুনা এগিয়ে আসে বলে, ‘কি তুমি এখানে যে?’ শ্যাম যমুনার হাতটা ধরে, বলে ‘তুই আজ কোথায় গিয়েছিলি? সারাদিন আমি তোর জন্য চিন্তা করছি। তোর কি একবারও মনে হয়নি আমার কথা?’ যমুনা  একটা হালকা হাসি হাসে। তারপর বলে, ‘জান শ্যাম দা আমি আজ সার্কাসে খেলা দেখালাম। একটা বিশাল চাকার ওপর দিয়ে আমি তরতর করে হেঁটে গেলাম, সবাই কত তালি দিল। আমার নাচ দেখল, এই দেখো এই পোশাকটা ওরাই দিয়েছে।’ কথা বলতে বলতে যমুনা হেঁটে চলে, পেছনে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শ্যাম।


পর্ব-৫

কাল সারা রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি শ্যাম। ছোটবেলা থেকে যে যমুনাকে চিনে এসেছে শ্যাম এ কি সেই? এ জীবনে তো এতদিন শ্যামই ছিল যমুনার ধ্যান, ওকে ছাড়া কোথাও যেতো না। শ্যামকে কখনো কোনো কথা লুকোতো না। দুদিনে মেয়েটার এতো পরিবর্তন হয়ে গেল। সারা রাত বিছানায় শুয়ে ছটফট করেছে তারপর ভোরবেলা উঠে সময় মত লাল মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছে যমুনার জন্য। কিন্তু আজও যমুনা সময়মতো আসেনি। মনটা কেমন করে ওঠে শ্যামের। মুহূর্ত দেরি না করে সোজা স্টেশনে চলে আসে তারপরে উঠে বসে গেদে লোকালে।ট্রেন এগিয়ে চলে। শ্যামের দুচোখ খুঁজে চলে যমুনাকে। কোথায় যেতে পারে ভাবতেই প্রথমেই শ্যামের মনে আসে সার্কাসের কথা। ট্রেন বারাকপুর  স্টেশন ছাড়তেই সচেতন হয় শ্যাম। তারপর সোদপুর স্টেশনে নেমে পড়ে রুদ্ধশ্বাস দৌড়াতে থাকে সার্কাসের মাঠের দিকে। হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে দাঁড়ায় সার্কাসের মাঠের সামনে। চার-পাঁচটা গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। সার্কাসের তাঁবু খোলা। সামনের একটা গাড়িতে জন্তু-জানোয়ার ঠাসা। অন্য একটা গাড়িতে তাগাড় জিনিসপত্র। শ্যাম প্রত্যেকটা গাড়িতে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করে কিন্তু যমুনাকে কোথাও দেখতে পায়না। একটা একটা করে গাড়ি সার্কাস মাঠ ছাড়ে। শ্যাম আর কিছু না ভেবে যমুনার নাম ধরে চিৎকার করতে থাকে। গাড়ির শব্দে শ্যামের গলা ভালোভাবে শোনা যায় না। প্রাণপণে চিৎকার করে শ্যাম। এক এক করে শ্যামের  সামনে দিয়ে গাড়িগুলো বেরিয়ে যেতে থাকে। হঠাৎ শ্যামের মনে হয় একটা গাড়ির জানালা দিয়ে  যমুনার মতো কেউ শ্যামকে হাত নাড়ছে। শ্যাম একটু এগিয়ে যায়। দেখে ঠিক যমুনাই তো। শ্যাম আর কিছু না ভেবে এগিয়ে যায়, চিৎকার করে বলে যমুনা, ‘দাঁড়া দাঁড়া, একবারটি আমার কথা শোন যমুনা। গাড়ি থামে না।শ্যাম গাড়ির পিছনে দৌড়াতে থাকে। আর চিৎকার করে বলে, ‘যমুনা, আমার কথা শোন, আমি যে তোকে বড্ড ভালোবাসি, তোকে ছাড়া আমি কি নিয়ে থাকব? আমি যে একা হয়ে যাব যমুনা। সেই ছোটবেলা থেকে আমরা একসঙ্গে পথ চলেছি। গাড়িটা থামাতে বল যমুনা আমি যে আর দৌড়াতে পারছিনা।’ 


গাড়ি থামেনা। যমুনাও ধীরে দূরে চলে যেতে থাকে। শ্যামের সব কথা যমুনা শুনতে পায় কিনা জানেনা শ্যাম। শুধু  চলন্ত গাড়ি থেকে যমুনার হালকা কন্ঠস্বর ভেসে আসে।, ‘ভালো থেকো গো শ্যাম দা। আবার কোনদিন এখানে সার্কাস দেখাতে আসলে তোমার সঙ্গে দেখা হবে।’ গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে যমুনার কন্ঠস্বরও মিলিয়ে যায় রাস্তার বাঁকে।


Comments

Post a Comment