গল্প - কেকা দাস


ঠিকানা


যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে..... আলার্মে সেট করা রিং টোনে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। রাত তিনটে বাজে, এখনি যদি না তৈরি হই, বেলা হয়ে যাবে। আমি চাইনা আমি যখন বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি কেউ যেন দেখে... আমি অদিতি, অদিতি রায়। নিজের পরিশ্রমের করা বাড়ি থেকেই আজ আমি চলে যাবো...


কত স্মৃতি চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, মনে হচ্ছে সব স...ব নিয়ে যাই। ধুর মায়া করলে আর চলবে না..। 


বাবা যখন চলে গেলেন আমার আঠেরো বছর বয়স। মাত্র তিনঘন্টার মধ্যে আমি মা আর তিনভাইয়ের অভিভাবক হয়ে পড়লাম।ভাইগুলো তখন বড্ড ছোট, বড়জন বারো, মেজো দশ আর ছোট্টটা সাত।


বিপদের দিনে আত্মীয়স্বজনকে ভীষণ চেনা যায়, আমরাও চিনলাম।বাবার জমানো সামান্য টাকা আর মাথার উপরে  ঘরের ছাদ এই নিয়েই শুরু হোলো আমার লড়াই। কাজের খোঁজে যে যা কাজ দিয়েছে সব স...ব করেছি। একটু একটু করে পরিচিতি বেড়েছে, পাড়ার এক দাদার চেষ্টায় একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ পেয়েই নাইট কলেজে ভর্তি হয়েছি। সকাল বেলায় ভাইদের পড়িয়ে,অফিস করে, কলেজ করে ফিরতাম তখন খাবারের ইচ্ছা থাকতো না, ভাবতাম কখন বিছানায় গিয়ে ঘুমোবো।


সত্যি বলতে তিনভাই পড়াশুনোয় খুব ভালো ছিলো ফলে শত অসুবিধাতেও আমি পড়া বন্ধ করতে দেইনি। ওরা কলেজে উঠলো, এক একজন করে চাকরিও পেয়ে গেলো আর আমার বিয়ের বয়স যে  কবে পেরিয়ে গেলো বুঝতেও পারলাম না।


ভাইদের চাকরি পাবার পরে আত্মীয় সমাগম বাড়তে লাগলো আর আমি বিয়ে না করায় তাদের আফসোস শুরু হলো। শুরু হলো তাদের নিকট আত্মীয়দের সাথে ভাইদের বিয়ের সমন্ধ করার। ভাইরা চাকরি পাবার আগেই আমি বাড়িতে হাত দিয়েছিলাম, নিচে দু ঘর বাড়িয়ে ছাদ ঢালাই করে, দোতলায় হাত দিয়েছিলাম। সকালে মায়ের হাতে হাতে কাজ করে সাড়ে আটটায় বেড়িয়ে পড়তাম। বড় ভাইয়ের বিয়ে নিজে দেখে দিলাম, বউটা ভালো কিন্তু সকালে ওঠে সেই আটটায় ফলে আমার কাজের কোন সুরাহা হলো না। ছোট দুটি তিন বছরের ব্যবধানে পর পর বিয়ে করলো নিজেরা দেখেই। বিয়ে করলো সংসারে লোক বাড়লো কিন্তু টাকা বাড়লো না। আমার পুরো মায়না আগে যেমন পুরোটাই সংসারে দিতাম তেমনি এখনো দিতে হয়, না কুলালে ভাইরা এটা সেটা কিনে এনে জোরাতাপ্পি দেয়। অফিসের পিএফের টাকা তুলে দোতলা সম্পূর্ন হোলো। লোক বেড়েছে ঘরের খুব দরকার।


ভাইদের ছেলেমেয়েগুলো ভারী মিষ্টি, ছুটির দিনগুলো খালি পিসি পিসি করে। তিন ভাইয়ের প্রত্যেকের দুটি করে ছেলে আর একটি করে মেয়ে। মা সব নাতি নাতনি দেখে যেতে পেরেছিলেন। সেদিন হঠাৎ ছোটভাই এসে বললো দিদি তোর ঘরটা খুব বড়, তুই একা মানুষ, এত বড় ঘর দিয়ে কি করবি!  তাই ভাবছি ঐদিকের কোনের ঘর টা তুই নিলে আমরা একটু হাত পা ছড়িয়ে থাকতে পারি। যখন নতুন ঘর হচ্ছিলো তখন কিন্তু কেউ বলেনি দিদি আর মা নতুন ঘরে থাকবে.. বাবার সময়ে করা ঘরেই আমি আর মা থাকতাম।


দুবছর হোলো অবসর নিয়েছি, পেনশন নেই, জমানো টাকা বাড়ির পিছনে পুরো খরচ করেছি। বুঝলাম, ওদের আমাকে আর প্রয়োজন নেই। ভাইকে  বললাম দাঁড়া একটু ভাবি।


অফিস যেতে হয়না বলে সকাল থেকে রান্নাঘরেই ব্যাস্ত থাকতে হয়।বৌরা তরকারি কাটতে গিয়ে  গল্পেরচ্ছলে প্রায় বলে এই যুগে একজনকে বসিয়ে খাওয়ানোটা কি ঝকমারি। ওদের এরকম কথায় বিস্ময় প্রকাশ করতেও ভুলে যাই! মেয়েগুলো বড় হয়েছে ,তাদেরও ঠেস মারা কথা বড্ড মনে লাগে। মাঝে মাঝে মনে মনে নিজেকে ঠাস করে মারি আর বলি হলো তো সংসার করা.... আমার ভাইয়েরা, আমার সংসার.... আশ মিটেছে তো!


এলার্মের শব্দে উঠে সারাবাড়ি চোরের মত ঘুরে এলাম। বড্ড মায়া চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে... সেদিন ভাগ্যিস সেই দাদার সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিলো, যে আমায় চাকরি দিয়েছিলো, হয়তো মনে মনে আমায় ভালোবাসতো... বুঝেও না বোঝার ভান করতাম যে... দাদারও বয়স হয়েছে, আমি সব খুলে বলতে বললে  অদিতি সব টাকা খরচ করে ভুল করেছো, সংসারে তোমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। পারবে এখনো কোন দায়িত্ব নিতে? আমার ছেলে রাজা  আমাদের দেশ গ্রামে এক আবাসিক স্কুল করেছে দুঃস্থ ছেলে মেয়েদের নিয়ে, তাদের মায়ের মত যত্ন করতে পারবে? রাজা খুঁজছে এক বিশ্বস্ত, পিছুটান নেই এমন মহিলা, যদি পারো তাহলে সাত তারিখ সকাল ছটায় এসো।রাজা তোমায় সেখানে নিয়ে যাবে, দেখো পারো কিনা নতুন ছেলে, মেয়েদের নিয়ে নতুন ভাবে বাঁচতে... আজ সেই সাত তারিখ, আমি চলেছি নতুন জীবনের, নতুন ঠিকানার খোজে.... আপনারা আমায় আশীর্বাদ করবেন, ওই দুঃস্থ বাচ্চাদের যেনো আমি ভালো মা হতে পারি।

Comments