প্রবন্ধ - বিপ্লব ভট্টাচার্য্য


ইতিহাস উপেক্ষিত এক শিক্ষকঃ- 


পণ্ডিত প্রবর বুনো রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত


কান্তিচন্দ্র রাঢ়ী মহাশয় নবদ্বীপমহিমা পুস্তকের শেষাংশে লেখা হয়েছ রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত নবদ্বীপবাসী ছিলেন না। তিনি ধাত্রীগ্রামের গুরু-বংশীয় অভয়রাম তর্কভুষণের পুত্র ছিলেন। কেউ যদি যখন জিজ্ঞাসা করেন, মহাশয় আপনার নিবাস কোথায়? প্রত্যন্ত গ্রামে বাড়ি হলে, আমরা সেই গ্রামের নাম না বলে, পাশাপাশি কোনো বড়ো গ্রাম বা শহরের নাম বলি। সেই রকমই রামনাথ মহাশয় কোনো কোনো সময় বলতেন তাঁর বাড়ি ধাত্রীগ্রামে। আসলে রামনাথের বাড়ি ছিল ধাত্রীগ্রাম থেকে মাইল দশেক পশ্চিমে সহজপুর গ্রামে। যে গ্রামটি কালনা থানার অন্তর্গত এবং কাঁকুড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্ভুক্ত। এই একই সময় নবদ্বীপে দুইজন রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত ছিলেন। একজন নৈয়ায়িক। অন্য জন স্মার্ত। যিনি স্মার্ত ছিলেন তাকে বলা হত বুনো রামনাথ। আর অন্য জনকে গেঁয়ো রামনাথ।


রামনাথের পিতা অভয়রাম তর্কভূষণ ছিলেন তৎকালীন এক মহাপণ্ডিতের অধিকারী। তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন দক্ষিন চব্বিশ পরগনা জেলার এঁড়দহের রাঘব বংশীয় ঘোষাল পরিবার। পরবর্তীকালে পৌরহিত্যের কারণে এই বংশ ভট্টাচার্য্য উপাধি লাভ করেন। কোনো একসময় এদের বংশধর নবদ্বীপে চলে আসেন। যতদূর জানা যায় এদের শেষ বংশধর অভয়রাম তর্কভূষণ। তিনি অবস্থাপন্ন লোক ছিলেন না। তার দুইবিঘা জমি ছিল। তার দুই পুত্র- রামনাথ ও চন্দ্রনাথ। অনেকে এই রামনাথকেই বুনো রামনাথ বলতেন। তিনি নাকি বনে বনে ঘুরে বেড়াতেন। কিন্তু বর্তমান গবেষকদের ধারনা অন্যরকম। আসলে এই রামনাথের আসল বাড়ি ছিল কালনা থানার অন্তর্গত সহজপুর গ্রামে। যেখানে তার বাড়ির পাশে "বুনো" নামে একটি বৃহৎ পুকুর ছিল। এই পুকুরটি তার ছিল। তিনি স্বয়ং এই পুকুরটির নাম অনুযায়ী নিজেকে বুনো রামনাথ বলে পরিচয় দিতেন। বনের প্রান্তে বাস করার জন্য তাঁর নাম বুনো রামনাথ হয়নি। আজও বুনো নামক পুকুরটি সহজপুরে বিদ্যমান।


বুনো রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত তৎকালীন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সমসাময়িক পণ্ডিত ছিলেন। তার একটা সংস্কৃত টোল ছিল। সেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু শিষ্য শিক্ষালাভের জন্য আসতেন। কিন্তু রামনাথ তাদের কাছ থেকে কোনোরূপ গুরুদক্ষিণা নিতেন না। অথচ সংসারে ছিল নিত্য অভাব। তেঁতুল পাতার ঝোলই ছিল একমাত্র ব্যঞ্জন। তাই দিয়েই তারা সশিষ্য অন্নসেবা করতেন। তবুও তার তার খ্যাতি ছিল সমগ্র দেশ জুড়ে।


রামনাথের এক শিষ্য, পরবর্তী কালে যিনি গোবিন্দ ন্যায়তীর্থ নামে পরিচিত হন। একদিন তিনি গুরুগৃহে অধ্যয়ন করতে এসে পাঠ সম্পূর্ণ করতে পারেননি। বুনো রামনাথ তাকে কোনোরূপ ভৎর্সনা বা শাস্তি প্রদান না করে বলেছিলেন, " তুমি যতক্ষন না পাঠ সম্পূর্ণ করতে পারছো, আমি ততক্ষণ  অন্নজল গ্রহণ করবো না।"


গুরুদেবের এই কথাগুলো শিষ্যের হৃদয়কে বিদ্ধ করেছিল। সে ভাবলো আমার জন্য গুরুদেব সারাদিন অন্নজল গ্রহণ করবেন না? এত বড়ো শাস্তি গুরুদেব তাকে দিতে পারলেন? অতঃপর সেই শিষ্য বাড়ি ফিরে গিয়ে পাঠ সম্পূর্ণ করে, দ্বিপ্রহর শেষে গুরুদেবকে পাঠ সম্পূর্ণ করার প্রমাণ  দিলেন। তারপর বুনো রামনাথ সেই শিষ্যের সাথে নিজগৃহেই একসঙ্গে অন্নজল গ্রহণ করেন। এইভাবেই বিনা বেত্রাঘাত, বিনা শাস্তিপ্রদানের মাধ্যমে তিনি শিষ্যদের অন্তরে প্রকৃত শ্রদ্ধার আসনটি জয় করে নিয়েছিলেন। 


আর একবার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বুনো রামনাথের পাণ্ডিত্যের প্রসংশা ও হত-দরিদ্রতার কথা শুনে ছদ্মবেশে বুনো রামনাথের গৃহে গিয়েছিলেন। রাজার উদ্দেশ্য ছিল বুনো রামনাথকে কিছু নিষ্কর জমি ও অর্থ সাহায্য করা। রামনাথের পাণ্ডিত্যের কথা, তার সাংসারিক জীবনের কথা শুনে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র জানতে চেয়েছিলেন যে, রামনাথের কোনো অভাব আছে কি না?


রামনাথ রাজাকে বলেছিলেন, "আমি তো এ বিষয়ে কিছু জানি না? আপনি বরং আমার স্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করুন। কারণ আমার সংসারের অভাব অনটনের কথা আমার স্ত্রীই জানেন।" 


রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রামনাথের স্ত্রীর কাছে অভাব অনটনের কথা জানতে চাইলে, স্বামী গর্বে গরবিনী রামনাথের স্ত্রী জানিয়েছিলেন, তাদের কোনোই অভাব নেই। তাদের জল খাওয়ার জন্য ঘটি আছে, শোওয়ার জন্য চ্যাটাই আছে, আর তার হাতে শেয়তির শাঁখা-পলা না থাকলেও একগাছি করে লাল সুতো ও সাদা সূতো আছে। যা তার এয়োতির চিহ্ন। ফলে তাদের কোনো অভাবই নেই।


এমনই ছিল রামনাথের পরিবার। চরম দরিদ্রতার মধ্যেও কারোর সাহায্য গ্রহণ করেননি।


রামনাথের স্ত্রী নিত্য অভাবের মধ্যেও ছিলেন উচিত বক্তা। তিনি তাঁর স্বামীর পাণ্ডিত্যে অহংকার না, গর্ব অনুভব করতেন। তাঁর স্বামীর খ্যাতি ছিল ভারতসেরা। সমগ্র নবদ্বীপবাসী রামনাথকে শ্রদ্ধা করতেন। 


একবার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের স্ত্রী অর্থাৎ রাণী'মা পরিচারিকাদের নিয়ে ভাগীরথীর ঘাটে স্নান করছেন। এমন সময় রামনাথের স্ত্রী প্রায় জীর্ণ বস্ত্র পরে মাটির কলসী নিয়ে রাণীকে তোয়াক্কা না করেই স্নান সেরে উঠে আসছিলেন। 


তা দেখে রাণীমা পরিচারিকাদের বলে উঠেছিলেন- "মহারাণীর দেমাক দেখেছিস? একবার ফিরেও চায়না? তবু যদি হাতে শাঁখা-পলা থাকতো? বলি, ঐ সুতো কি হাতে থাকবে? দুদিন পরেই তো ছিঁড়ে যাবে।" 


তৎক্ষনাৎ রামনাথের স্ত্রী ঘুরে দাঁড়িয়ে দুচোখে আগুন জ্বেলে রাণীর চোখে চোখ রেখে বলেছিলেন- "আমার হাতে যতদিন এই লাল সূতো আর সাদা সূতো বাঁধা আছে, জেনো ততদিনই নবদ্বীপের গৌরব আছে। এই সুতো যেদিন ছিঁড়ে যাবে সেদিন সারা নবদ্বীপ অন্ধকার হয়ে যাবে। আমার হাতে লাল সূতো আছে বলেই নবদ্বীপে এখনও আলো আছে।"


বুনো রামনাথ তর্কসিদ্ধান্তের একটা ভিটে নবদ্বীরের বুকে আজও আছে। যেটি নবদ্বীপ পুরাতন সংস্কৃত কলেজ নামে পরিচিত। গত ২০০০ সালের বন্যায় কলেজটির ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক পুরাতন বই লাইব্রেরি সবকিছু গঙ্গার জলের তলায় চলে যায়। বর্তমানে বঙ্গবিভুধ জননীসভা নামে একটি সংস্থা সেটি রক্ষণা-বেক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। ২০১৭ সালে সেখানে রামনাথের একটি কল্পিত মূর্তি উন্মোচন করা হয়।


এখানেই শেষ নয়। বুনো রামনাথ, এমনকি তাঁর পিতা অভয়রাম তর্কালঙ্কার যে বাড়িতে বসবাস জন্মগ্রহণ করেছেন সেই বাড়িটি প্রায় তিনশো বছরের পুরনো মাটির দোতলা। উপর নিচে চারটি ঘর। আজও সহজপুরের মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে। যে বাড়িতে বুনো রামনাথের বংশধররা আজও বাস করেছেন। আমি নিজে সেই বুনো রামনাথের বংশধর হিসেবেই এই বাড়িতেই বাস করছি। 


রামনাথের পুত্র ছিলেন  ভুবনেশ্বর। ভুবনেশ্বরের দুই পুত্র ও এক কন্যা - বড় পুত্র নৃসিংহ প্রসাদ ও কনিষ্ট পুত্র আশুতোষ এবং কন্যা সুরৎ ঠাকরুণ। আশুতোষের দুই কন্যা ছিল- জয়া ও কমলা। অন্যদিকে নৃসিংহ প্রসাদের তিন পুত্র ও এক কন্যা - শ্যামাপদ, শৈলেশ্বর ও কালীশঙ্কর। 


শৈলেশ্বরের চার পুত্র ও তিন কন্যা- ছায়া, গোবিন্দ, থাকো, দেবপ্রিয়, সত্যপ্রিয়, রমাপ্রিয় ও সুমিতা। এদের পরের বংশধরগুলি হল সুমন, সমীক, অন্বেষা। অন্য দিকে কালীশঙ্করের সাত পুত্র এবং তিন কন্যা। দিলীপ, সঞ্জয় ( আমার বাবা), দীপক, অখিল, নিখিল, বিজন, সত্যজিৎ, গীতা, গৌরী ও আইভি। এরা সকলেই জীবিত। এদের মধ্যে তিন ভাই চাকরীর সুত্রে বাইরে আছেন। বাকিরা সহজপুরেই বাস করছে। 


এদের পরের বংশধরগুলি হল বিপ্লব (আমি), অর্ণব, ঋষভ, অঙ্কন, মানসী, শম্পা, চৈতালী, মৌসুমী, ঋতু,  অন্তরা, অঙ্কিতা ও অন্যান্য।


বর্তমানে বুনো রামনাথ তর্কসিদ্ধান্তকে নিয়ে অনেকে হয়তো গবেষণা করে চলেছেন। যেটা আরও অনেক আগে দরকার ছিল। আজ তিনি বাংলা সংস্কৃত কাব্যের উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক হয়েও এক উপেক্ষিত শিক্ষক। তার মতো শিক্ষক বর্তমানে সমাজে বিরল। বুনো রামনাথ তর্কসিদ্ধান্তের বংশধর হিসেবে আমি অত্যন্ত গর্ব অনুভব করি। এই বসতভিটার প্রতিটি ধূলিকণা আমার কাছে অত্যন্ত পবিত্র এবং মহামূল্যবান। আমি নতমস্তকে শতকোটি প্রণাম জানাই সূর্য্যসম দীপ্যমান আমার সেই  পূর্ব পুরুষ শ্রদ্ধেয় বুনো রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত মহাশয়কে।



Comments

  1. খুব ভালো লাগলো! ওনেক কিছু জানতে পারলাম

    ReplyDelete

Post a Comment