বইকথা - জয় দাস



প্রান্তিক উত্তরবঙ্গের এক মাতব্বর-বৃত্তান্ত গাঁথা


যে গল্প ইতিহাসে থাকে না, সে গল্প থাকে মানুষের মুখে, সে গল্প কখনও গান হয়ে ঘুরে বেড়ায় দোতারার সুরে, কখনও বা নদী হয়ে কিৎসা বলে হাটবাজারে। এ সব মানুষেরাই উত্তরের প্রাণ, তাঁদের প্রতিদিনের জীবন-যাপনে জড়িয়ে আছে মাটির ঘ্রাণ। বদলে যাওয়া সেইসব জীবন যাপনের গল্পগুলিকে, হারানো সময়ের নদী ও গানগুলিকে নিয়ে এক যাদুবাস্তবতার আখ্যান তৈরি করেন উত্তরের সাহিত্যিক সুবীর সরকার। আখ্যান জুড়ে থেকে যায় মোহ, মুহূর্ত ও মিথ। মানুষের সাথে জুড়ে যায় উত্তরের মাটি, গান, জীবিকা, অভিমান সব। ‘গুহাগাত্রে ঝরণার ছবি’র মত আমাদের প্রত্যেকের মনে জুড়ে থাকে ফেলে আসা দিনগুলি, বয়স বাড়ে যত একা হই তত, তবু মন কৌটায় জোনাকি অতীত পুষি, মনখারাপে মেটায় যে ক্ষত। সুবীরদার কাহিনি শুরু হয় সেই মানসাই আর সুটুঙ্গা নদীর পাশে, নদীর জলে ভিজতে থাকে শৈশব আর মুহূর্ত। সবাই মিলে থাকার যৌথজীবনের স্মৃতি। বাদ যায় না লণ্ঠন ও পিতামহের খড়মও। ‘বড়াইকবাড়ি’ উত্তরের কোনো স্থান নয় শুধু, উত্তরের সুন্দরের মোহে, মানুষের সরলতায় আটকে যায় কোনো ভিন দেশী, বলে সে ইতিহাস। ডানকান সাহেবের ইতিহাস। উত্তরের মানুষের সাথে, তাঁদের জীবন সংস্কৃতির সাথে মিশে যায় তার ঘোড়া আর বন্দুক, হারিয়ে যায় ডানকান সাহেবের কাছ থেকে কিন্তু এগুলি মিথ হয়ে গল্প বলে আজও উত্তরের গানে, হাট-মানুষের গল্পে আর ডানকান সাহেবের কবরের পাশে। ‘উপসংহারের বদলে’ সেই কাহিনি শুরু করেন আমাদের এই গল্প কথক। ‘এপিটাফে’র শুরু হয় ‘নদীর ভিতর নদী শুয়ে থাকে।’(পৃ-১৫) সময়ের বিছানায় নদী স্বপ্ন দেখে, নদী গর্ভে লুকিয়ে থাকে কালচক্র। নদীর কথক হয় ‘হেরম্ব বর্মন’, সেই হাট-মানুষ, যে হাটে হাটে ঘুরে নদীর গর্ভে হারিয়ে যাওয়া কালচক্রের গল্প বলে আমাদের। ‘উৎসবগাথা’ শুরু হয় নতুন শিশুর জন্মের সাথে রাজবংশী মেয়েদের দলবদ্ধ নাচের স্মৃতিতে। জন্ম মিথকে অমর করে, প্রজন্ম প্রজন্ম চলতে এই কথকতা। ‘বাবুলাল বাঁশফোড়’ যে গাছের পাখি শিকার করত গাছের আঠা দিয়ে। জীবন জীবিকা বদলে গেছে ঠিকই তবু সুবীরদার- ‘বাঁশেরসাঁকোথেকে দীর্ঘতম সুড়ংগপথ-সমস্তটাই আমার কবিতা জীবন।’ এই ‘নদীয়া হোলা’ নদীর জলে সুর মিশে থাকে মাটির জীবনের- ‘ঢেঁকিশালে পোষা বিড়াল। গলায় ঘণ্টা বাঁধা। আমি রাজবংশী সম্পন্ন কৃষকদের ডারি ঘর বা বৈঠকখানা ঘরে বসে দোতারার আওয়াজ শুনি।’(পৃ-১৯) এই নদীর ধারেই এক জন্মান্ধ কবি ভালুক মিঞা, যিনি ভাওয়াইয়ার সুরে বলে যান এখানকার ইতিহাস, হোমারের মত। খুচরো পয়সার মত ছড়িয়ে পরে তাঁর যাপন, মুহূর্ত হয়ে প্রতি পয়সায় থাকে তাঁর আনন্দ আর গল্পেরা। সামান্য বাদ্যযন্ত্রে তিনি অসামান্য হয়ে ওঠেন। নাম চায়নি কখনো, চেয়েছেন আনন্দের সাথে বলতে এই নদী আখ্যান। কবি সুবীর সরকার তাঁর সাথে পরিচয় করান আমাদের। এখানেই তিনি অসমান্য হয়ে ওঠেন আমাদের কাছে। উত্তর জুড়ে থাকে জোতদার আর মাতব্বররা। ইয়াসীন মাতব্বর কিংবা ধনকান্ত জোতদারেরা। তাঁদের জীবন জুড়ে থাকে এই ইতিহাস আর মুহূর্তরা। ‘মাতব্বরবৃত্তান্ত’ ছুঁয়ে থাকে সেই ইতিহাস। ‘মাতব্বর হাঁটা শুরু করে জোতদারটারির জঙ্গলের দিকে। জঙ্গল অতিক্রম করে তাকে দ্রুত পৌছাতে হবে একুশ ঘোড়ার ধনকান্ত জোতদারের বাড়ির খোলানে।’(পৃ-২১) সেই চলার পথে গল্প ও জীবন গাঁথা সঙ্গে চলে তাঁর। চা বাগানের গল্প, শালবাগানে বাঘ বেরানোর গল্প, ভাই ইয়াসিনউদ্দিনের বাইসনের গুঁতোর গল্প, বুধুরামের গল্প, কান্দাকান্দি মেলার গল্প। এই চলার পথের গল্পে মিশে যায় ‘মাতব্বর’ এই মাটির সাথে, তাঁর জোতদারি জীবনকে বাদ দিয়ে। ‘গাথাশোলক’ গাঁথায় আটকে থাকে শোকের ব্যথারা। মকবুল বয়াতির দোতারার বোলে তা আরও মিশে যায় আমাদের সাথে। আসে উত্তরের গিদাল নজরুল ইসলামের গান, জোতদারের তেভাগার গল্প প্রভৃতি। নদীর বয়স বাড়ে না, বাড়েনা গানের সুরের ‘নদীকে উপাস্য ভেবে আমাদের উওরবাংলায় গান বাঁধা হয়।’(পৃ-২৭) মদ্যপান রূপক মাত্র আসলে নদী ও জ্যোৎস্নার মাদকতা ছেয়ে থাকে সেইসব লোকেদের স্মৃতিচারণে আর সুবীরদার কলমে। সেই মাটির লোকেরা ‘তারা’ হয়ে ওঠে, অতীত মাদকতার আকাশে। ‘বাওকুমটা বাতাস যেমন’ প্রত্যেকের মনে জুড়ে আছে এক দীর্ঘশ্বাস আর মনকেমনের বাতাস। যৌথ জীবন থেকে একাকীত্বের পথে উত্তরণ, আসলে একা করে আমাদের। ‘জীবনেরই বন্দনাগান।’ গানও চলে যৌথতার সাথে যেখানে পালাগানের মাষ্টার টরেয়া বর্মনের কথা আছে আছে স্মৃতিপটে নাচতে থাকা বুধেশ্বরী বুড়ির কথা। মুন্সি করিম যে নদীর ধারে থাকে আছে ধল্লা নদীর কথা। ‘… নৌকো ও মাঝির সম্পর্কের মতোন দোতরা ও গীদালের সখ্যতার মতোন জীবন সংকোচনপ্রসারনের ধন্ধধোঁয়ায় ফাঁকা ফসলহীন শীতমাঠ মেমে এসেও নির্জনতা খুঁজতে গিয়ে চিরকালীন বিষাদ নিয়ে জেগে উঠতে থাকে শোক ও শ্লোকবাহিত।’(পৃ-৩১)। ‘জোতদারটাড়ি’ তে চাচামিঞার গল্পে জুড়ে থাকে মিসকিন কবিরাজের কথা। আসে গানের কথা, নাচের দলের কথা, নদীর কথা আসে বাঘের কথা, সাহস আর ব্যথার কথা ‘চাচামিঞা তার বৃত্তকে সম্প্রসারিত করে তুলতে থাকে প্রসারনের গতিপ্রকৃতি খণ্ড-বিখণ্ড জুড়ে জুড়ে অনবদ্য এক জীবনযাপনের তালপাকানো আদিমতায় নিঃশঙ্ক ফিরে আসতে থাকে।’(পৃ-৩৭) খেলপাথারের ঢোল বাদক বসন্ত মালি, বাইদর হাতিরা, গদাধরের বুকে পানসিরা, মাহুতের হাতির ফাঁদ আমাদের অন্যতম জীবিকা, সুউচ্চ টংঘর সবকিছু জুড়ে থাকে জোতদারটাড়ি, শুধু শাসক ও শোষণের কথা বলে না, বলে আমাদের যৌথজীবনের বর্ণময় জীবন জীবিকা গানের কথা যাদের সাথে জুড়ে থাকে আমাদের জীবননদীরা। উত্তরের জীবনে ‘মাহুত বন্ধু রে’ শুধু গান মাত্র নয়, জীবিকা আর জীবনের মুহূর্ত যাপনের গান ব্যথা। যা রাধার মত আমাদের প্রত্যেক মাহুত বন্ধু বাথান বন্ধুর স্ত্রীরা বহন করে তোলে। রাজবাড়ি জুড়ে থাকে লালটিয়া, ‘প্রান্তবাসীর ঝুলি’কে পরিচয় করান আমাদের নীহার বুড়ুয়া। সেখানে আছে যেমন বসন্ত মালি, সুধীর রায়, সীতানন্দ বুড়ার গানের দল আছে তেমন লালজি রাজা আর রাজকুমারী যে সঞ্চয় করতে শুরু করে ঝুলিকে। আছে বাঘ শিকারের গাঁথা, আছে হাতি ক্যাম্প, আছে গাড়িয়াল ও মইশাল বন্ধুর গান ও কথা। করিতুল্লা বয়াতির কথা, শরৎসুন্দরী, জলঘুভরার কথা, প্রতাপ সিং, জং বাহাদুরের কথা, রতিকান্ত দেওয়ানি, আবদুল জব্বার, গঙ্গাধরের কথা আসে গিয়াসুদ্দিন, ভলুলাল শিকার ও জন্তুদের আর্তনাদ আসে বলরাম ঢোলীর কথা, পাথারবারি, বিয়াওবাড়ি, মৌরীবালা, নান্দুনি বুড়ির কথা। এইসব ‘চ্যাংড়া বন্ধুর’ গাঁথা নীহার থেকে পুনমে হয় সঞ্চারিত। ‘হিজড়াপুরাণে’ আমরা দেখি উত্তরবাংলায় সেইসব ‘বৃহণ্ণলা’দের কথা। আদ্যনাথ ধনীর বাড়ির টিয়াসুন্দরী, হরসুন্দরীর গাঁথা, জীবন জীবিকা বদলে গেছে তাঁদের। তবু স্মৃতিকথায় তাঁদের মনে আছে জন্ম মৃত্যুর বৃত্তান্ত। ‘শোক ও শ্লোকের কুয়াশার আড়ালে হিজড়েরা বুঝি মনে করিয়ে দেয়- ‘জীবন মৃত্যুশাসিত। দিনে দিনে খসিয়া পড়িবে রঙ্গিলা দালানের মাটি!’’ (পৃ-৬২)


গদ্যকার সুবীর সরকার এভাবেই জিইয়ে রাখে আমাদের উত্তরের মাটি, গান, জীবিকা ও মানুষদের। পরিচয় করান আমাদের ইতিহাসে উপেক্ষিত মানুষদের সাথে। যারা হয়ে ওঠেন উত্তরের ‘মাতব্বর’ মন জমিনে এদের জুড়ে থাকে উত্তরের মাটি আর মানুষ। পাকা রাস্তায় শূন্যতায় এরা গল্প বলে কাঁচা রাস্তার লোকসংগীতের আর নদীর। আমার মনে হয় এখানেই সুবীরদা অনবদ্য আর সৎ সাহিত্যিক। উত্তরের প্রাণভোমরাকে যিনি নিজের প্রাণে পুষে রাখেন আর লেখনির দ্বারা ছড়িয়ে দেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। আসুন আমরা স্মৃতির মাদুর বিছিয়ে লণ্ঠনের আলোতে, জোনাকিদের সাথে ‘মাতব্বর-বৃত্তান্তের’ কথকতা শুনি, সূত্রধর সুবীর সরকারের কলমে।



‘মাতব্বর-বৃত্তান্ত’
সুবীর সরকার
গাঙচিল
প্রথম প্রকাশ : ডিসেম্বর ২০১৮
প্রচ্ছদ- বিপুল গুহ
মূল্য- ২০০ টাকা


Comments