বইকথা - রঞ্জন রায়



''পিটার হাণ্টকে, হাঁটতে বলুন : 

কবির যাপনজাত ইস্তেহার''


কবি :                 ভগীরথ দাস 

প্রকাশক :         দি সী বুক এজেন্সী ,কলকাতা 

প্রকাশকাল :     কলকাতা বইমেলা ,জানুয়ারি ,২০২০ 

প্রচ্ছদ শিল্পী :   দেবাশিস সাহা 

বিনিময় :           ১২০ টাকা ।




বিশ্ব সাহিত্যের সেরা পুরস্কার নোবেল। সেটা এবছর (২০১৯) পেয়েছেন অস্ট্রিয়ান লেখক পিটার হাণ্টকে। তাঁর জন্ম ৬ই ডিসেম্বর, ১৯৪২। তিনি ফ্রান্সের কেভিলে'তে (Cheville) বাস করতেন। কবিতা-উপন্যাস-নাটকের পাশাপাশি তিনি অনুবাদ যেমন করেছেন, তেমনি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন। এহেন ব্যক্তিত্বকে উদ্দেশ্য করে কবি ভগীরথ দাস তাঁর কাব্যের নাম দিয়েছেন 'পিটার হাণ্টকে, হাঁটতে বলুন'

 

 

পৃথিবীর দুই ভিন্নপ্রান্তে বসবাস করলেও ,দুজনের মধ্যে শিল্প প্রতিভার বৈষম্য থাকলেও কোনো একটি বিন্দুতে এসে দুই শিল্পীর মধ্যে একটা যোগসূত্র গড়ে ওঠে। আসলে কবিদের যেমন কোনো নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ড হয় না তেমনি তাঁদের ভাষাও অভিন্ন। সে ভাষা তাঁদের শিল্পীসত্তার অনুভবের ভাষা। শুধু তার প্রকাশরূপ আলাদা। সেইসূত্রেই একজন কবি যখন পৃথিবীর ভিন্নপ্রান্তের কোনো কবিকে সম্বোধন করে নিজের কথা বলেন, তখন কবির সেই কথনে যুক্ত হয়ে যায় তাঁর যাপন অভিজ্ঞতার কথা। কবি ভগীরথ দাসের এই কাব্য সেদিক থেকে তাঁর যাপনের ইস্তেহার।

 

 

উত্তরবঙ্গের প্রান্তজেলা কোচবিহারের নটুয়ার পাড়ের কবি ভগীরথ। গত শতাব্দীর নয়ের দশকের গোড়াতেই, বলতে গেলে তারও কিছুটা আগেই কবি পত্রিকা সম্পাদক হিসেবে ভগীরথ দাস বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছেন। কবির সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্যে রঞ্জন রায় সম্পাদিত ভগীরথ দাসের 'নির্বাচিত কবিতা' ( প্রকাশক-সোপান, কলকাতা) বইটি আগ্রহী পাঠকরা পড়ে দেখতে পারেন।

 

 

কবি ভগীরথ দাসকে তাঁর জীবন-জীবিকার তাগিদে বাড়ি থেকে প্রায় প্রতিদিন একশো কিলোমিটারের বেশী পথ অতিক্রম করে অধ্যাপনা করতে যেতে হয় জেলার বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মেঘলিগঞ্জ কলেজে। প্রতিদিন বাসে জার্নির দুর্বিষহ জীবন অভিজ্ঞতা তাঁর সঞ্চয়ের ঝোলাতে পরিপূর্ণ রয়েছে। সেই যাত্রার নিত্যসঙ্গীদের তিনি কাব্যটি উত্সর্গ করে করেছেন -- 

'নিত্য বাসযাত্রা যাদের'

 

 

সকল লোকের মাঝে বসেও কবি আসলে শেষপর্যন্ত 'একা'। ভিড়ে ঠাসা সেই বাসযাত্রার আসা-যাওয়ার অবকাশে বাসের সিটে বসে, কখনো বা যাত্রীদের মাঝে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই মোবাইলে টাইপ করে ফেলতেন তাঁর বিচিত্র ভাবনাকে। সেসব 'আন-কাট' আকারে ফেসবুকের পাতায় পরিবেশনও করে দিতেন প্রায় নিয়মিত। সেই ক্ষণিক অনুভব থেকে উঠে আসা শব্দতুলির বিচিত্র-বিক্ষিপ্ত চিত্রের কোলাজ হয়ে উঠেছে এই কাব্যের কবিতাগুলো।

 

 

কাব্যের শীর্ষনাম কবিতাটিতে কবির যে ভাবনা ফুটে উঠেছে সেটা আবহমান কালের সব কবি-শিল্পীরই শাশ্বত ভাবনার প্রকাশ। নোবেলিস্ট পিটার হাণ্টকে উদ্দেশ্য করে লেখা এই কবিতায় একটা স্বপ্নের দেশের ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন কবি। কবির স্বপ্নের দেশ কেমন হওয়া উচিত, অথচ দেশ কেমন অবস্থায় রয়েছে, সেই ভাবনাকে খণ্ড খণ্ড আকারে প্রকাশ করেছেন। কবিতাটির সূচনায় একজন গণ্ডমূর্খ চাষী দেশের নিয়মতান্ত্রিক প্রধান রাষ্ট্রপতির উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে নিজের তথা দেশের আম-নাগরিকের মনের কথাটি ব্যক্ত করেছে – 

 

'একজন গণ্ডচাষী পোস্টকার্ডে লিখে পাঠালেন রাষ্ট্রপতিকে 

স্যার,

আমাকে একদিনের জন্য 

দেশের প্রধানমন্ত্রী করে দেওয়া যায় না?

দেশটাকে মাতৃভূমি করে তোলবার দায় আছে আমার।'

 

দেশের ভেতরে যে দেশ রয়েছে সেটা মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের রাজনৈতিক নেতাদের, 'মাল্লু' (অসত্ পথে উপার্জিত অর্থ) আছে যাদের সেইসব 'ক্লাসের' নাগরিকদের। সেখানে সাধারণ মেহেনতি মানুষ কৃষক-শ্রমিক-ফেরিওয়ালা-ফুটপাথবাসী এরা সকলেই 'ক্রীতদাস' মাত্র। সে দেশের অবস্থা বর্ণনা করে কবি লিখেছেন,

 

'...টিকিট নেই ট্রেনে প্লেনে বিনোদন-ঘরে নেমত্রণ-টেবিলে 

টুরিষ্ট বাংলোয় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে

পার্লামেন্ট ভবনে যাবার টিকিট পেতে 

পরিচিত পতাকার তলে নিঃশ্বাসযোগ্য জায়গা নেই।

 

অথচ গড়াগড়ি খাচ্ছে 

প্রদর্শনে ব্যাধি-ধর্মে দ্রাবিড়িয়ান অলজ্জ রত্ন খেতাব।'

 

এমন একটি দেশের জন্যে 'পিটার হাণ্টকে এই দৃশ্যে একটু হাঁটবে বলুন প্লিজ।'

 

পরিচিত এই দেশে 'আখের গোছানো লোক' যত, মহাত্মা নেই সেই তুলনায়। কাব্যের প্রথম কবিতা 'আশ্রয়' কবি সেকথাই ব্যক্ত করেছেন,

 

'আজ, এই সময় 

মহাত্মা বর্জিত এই দেশ 

 

কষ্ট দুঃখের কথা সর্বত্র বিছানো 

-সময় সকলেই আশ্রয় খোঁজে।'

 

দেশের অর্থনীতির মূলভিত্তি যে জমি তা আজ জমি মাফিয়াদের কব্জায়। ব্যক্তিগত জীবন অভিজ্ঞতার এক টুকরো যন্ত্রণা ফুটে উঠেছে 'ঘৃণ্য লোকটি' কবিতায়,

 

'নোংরা অশিক্ষিত লোকটি 

জমি কেড়ে নিয়ে অস্তিত্ব কেড়ে খেল 

অবৈধ সন্তানের কাজের বাহার তার 

আমার শ্রম মিথ্যে হয়ে গেল।'

এমন 'অস্তিত্ব' হারা মানুষের যন্ত্রণার সত্যি 'কোন ইতিহাস থাকবে না।'

 

 

মানুষ গড়ার কারিগর কবির শিক্ষক-সত্তা সহজেই বুঝতে পারে শিক্ষার প্রকৃত চালচিত্র। হীরক রাজার দেশে মহারাজ আর তাঁর মন্ত্রী-বিদূষকের কথোপকথনমূলক নাট্য-কবিতা 'অথ বর্ধিত গ্রীষ্ম ছুটি কথা' কবিতায় শিক্ষা ব্যবস্থার বিচ্ছিন্ন ছবি ফুটে উঠেছে,

 

'..অর্থমন্ত্রী : মহারাজ আপনি ধন্য।

বিদূষক : কিন্তু মহারাজ, এতে কী হবে কাজ? বলছিলেম তাই ....

মহারাজ : নাহলে কাজ কী হবে মন্ত্রী?

মন্ত্রী : আজ্ঞে মহারাজ ওদের চাই মগজ ধোলাই।'

 

দেশের বৃহত্তর ক্ষেত্রগুলির পাশাপাশি কবির চোখে দেশের সমাজ মানুষের টুকরো টুকরো জীবনচিত্র, খণ্ড ভূ-খণ্ডের স্থানীয় সম্প্রদায়ের বিভিন্ন লোকাচার থেকে শুরু করে কবির পরিচিত বৃত্তের কবি লেখক জীবনানন্দ-অমিয়ভূষণ-অরুণেশ ঘোষের কথা, নস্টালজিয়ার পথ ধরে এসেছে শৈশবের নানা স্মৃতিকথা। এসেছে অতীত ইতিহাসের নানা অধ্যায়। ব্যক্তিগত 'একা' হয়ে ওঠার টুকরো টুকরো যন্ত্রণার কথাও কোনো কোনো কবিতায় বলেছেন অকপটভাবে। 'জীবন, জীবনানন্দ যদি হোত' কবিতায় জীবনের ভাষ্যকার জীবনানন্দ-এর সঙ্গে অন্তরের যোগ অনুভব করে কবি লিখেছেন,

 

'সুতরাং স্বীকারোক্তি খুলে বসি 

মন খারাপের ভেতর লুকোন জীবনানন্দ 

ভাষ্য আর ভাষা জমে অতিশায়নের পথে 

সময় বলেছে ভাষা শুধুই মাধ্যম 

বাতাসের ভাষা নেই, সে এখন ইন্দ্রিয় সপ্তম 

ছাড়া জীবন নেই, বাতাস মাধ্যম 

 

জীবনানন্দ কেবলই ভাষ্যকার।'

 

কিম্বা 

 

'অরুণেশ' শীর্ষক কবিতার শেষে কবি লিখেছেন,

'আজকে অরুণ গল্প হলো 

রাত জাগে কোন গন্ধ নেশা।

পড়তে শেখো ভাবতে শেখো 

ধর্ম নিজেই নিজের দ্বেষা।'

 

'আলোদির গল্প' কবিতায় পরিচিত বৃত্তের সাধারণ মানুষের কথা যেমন কবি বলেছেন, তেমনি 'সাধনদারা কোথায় যান, আমি জানি' কবিতায় কবি জানিয়েছেন,

 

'এখান থেকে পরতে পরতে কাহিনি 

সাধনদারা কোথায় যান, আমি জানি।'

এসেছে রাজবংশী সম্প্রদায়ের বিভিন্ন লোকাচার, ভাষা-সংস্কৃতি, গিদাল নজরুল, করমপুজোর কথা আর 'মাছ মারেয়া' কবিতায় প্রজন্মের পর প্রজন্মের গল্পকথা তুলে এনেছেন কবি,

 

'চল্লিশ বছর হল আড়তের বাড়ি কলাকাটা 

সুদু দেউরীর চায়ের দোকানে ঝোলানো থাকত 

কাঁচের বোতল অ্যাকোয়ারিয়াম, ছোটো মাছের বাগান 

 

আফাদার হানে মাছের গুদাম 

ভোরবেলা শুরু মাছের ম্যাজিক 

ফেরিওয়ালা রোজ সেখানে কসম খায় 

 

সন্তান লালন চায় অধিকার থেকে 

পিতা জন্ম ঘটে পালক যেখানে না-পিতা 

লালনের পরও সেখানে মারেয়াই থেকে যায়।'

 


অথবা 'ভগ্নদশা' কবিতায় অধ্যাপকের বাড়ি খোঁজার গল্পকথা কবি ব্যক্ত করেছেন,

 

'অধ্যাপক, এই ভগ্নদেশে খুঁজে ফিরছ বাড়ি 

 

তোমার প্রিয় গৃহস্বামী ঘ্রাণ হারিয়ে পথে স্বপ্ন ভাসায় 

শান্ত মনের অঘুম আড়াআড়ি 

অধ্যাপক, ক্ষুধা হারাও তাকিয়ে দেখ রথের যিনি 

মহারথী নিজের মূর্তি গড়ে!....

 

এই ভগ্নদেশের কোথায় তোমার বাড়ি?'

 

এইভাবে টুকরো টুকরো কবিতাগুলি যেন হয়ে উঠেছে কবির প্রতিদিনের যাপনের ইস্তেহার, যার সঙ্গে পাঠক হিসেবে আমরাও একাত্ম হয়ে যাই।

Comments