গদ্য - সুবীর সরকার


ও জীবন রে...

তখন মধ্য নদীর চর থেকে ইসমাইল শেখের জোড়া মহিষের চকিত ডাক উঠে আসে। নদীর জলে গা ডোবানো সেই জোড়া মহিষের ডাক কিভাবে মিশে যেতে যেতে একসময় গাছপালা, ঝাড়ঝোপেই ডুবে যায়।তখন ইসমাইল শেখের চোখে কি এক দূরাগত স্মৃতিহীনতা! এভাবেই স্মৃতি থেকে বেরিয়ে মানুষকে বারবার স্মৃতিতেই ফিরে যেতে হয়। তাকে স্মৃতিময় হয়ে উঠতে হয়। প্রেক্ষিত জুড়ে নদী,জলরাশি,নদীর চর,অগুনতি হাঁস, চৈত্রের ধুলো আর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই জোড়া মহিষ। ইসমাইল শেখের অন্যমনস্কতায় পুরোন এক দেশকাল প্রবেশ করতে থাকে। আর এই প্রবেশ ও প্রস্থানের মাঝখানে গানের ধুয়ো ওড়ে_

"আজি বাথানে না যান

ও মোর মৈশাল রে"

ইসমাইল হেঁটে যেতে থাকেন রসুনখেতের পাশের  আলের ওপর দিয়ে। তাকে রাস্তা চেনাতে থাকে সেই জোড়া মহিষ। মস্ত এক কালখন্ড রচিত হয় এভাবে আর দৃশ্যের পর দৃশ্যে ঘন ঘন হোচট খেতে থাকে ইসমাইল শেখের  জোড়া মহিষ।

২।

"হলদি রে হলদি

হলদিবাড়ির হলদি"

সেই কবে মেখলিগঞ্জে তিস্তার চর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে চরবসতি থেকে এক প্রাচীন মানুষের কণ্ঠ থেকে এই গানের সুর উঠে আসছিল।আর সেই সুর

ঘুরে ঘুরে চর, বসতি আর নদী তিস্তায় বুঝি ডুবে যাচ্ছিল। এত বছর পেরিয়ে আবার সেই কালখন্ডে ফিরে যেতে চায় জীবন।

আর আমি দেখি মস্ত সেই দেওয়ানগঞ্জের হাট।ভরা হাটের উজানে একা একা হেঁটে যাচ্ছেন ফকির, মিসকিন আর গা_গঞ্জের মানুষেরা।

আমি হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর ভেতর খুঁজতে থাকি ঘোড়া জোতদার,ধনী বাড়ি আর পদুমোহন বরাইকের কাঠের খড়ম।

হেলাপাকরি থেকে ভান্ডানি যাবার রাস্তায় সেই উদাসীন জোড়া মহিষের পিঠে বাচ্চা মৈশাল আর সেই মৈশাল একা একাই গেয়ে উঠেছিল বিরহের গান।

জীবনে এভাবেই কত কত গল্প জমে ওঠে।

আমি দেখে ফেলি রাখালকাকুর মাকে, আপনমনে যিনি শোলোক বলছেন_

"শামুক খাজারে আমার বাড়ি আয়

রকম রকম শামুক দিমু

হলদি দিমু গায়"

রিয়ালিজম এভাবেই গড়িয়ে যাওয়া ব্যাটারির মতন কখন কিভাবে একটা ম্যাজিক নিয়ে আসে বুঝি আমাদের জীবনে!

৩।

একটা ব্যপ্ত পৃথিবী থেকে গান ভেসে আসে_

"কালা বাইগোন ধওলা রে 

সাধু বাইগোনের গোড়ায় কাঁটা"

তখন লোকদেবতার থানে বাদ্য বাজে।বাজনা বাজে। কাদোপন্থে অনন্ত গাড়িয়াল।

জোতদারবাড়ির খোলানে বসে আমি দেখি শত শত বছর আগেকার এক দেশকাল নুতন পৃথিবীতে ফিরে আসছে।

ছোট পাখি। হাঁসের বহর।

ফেলে আসা কাঠের খড়ম।

আসিরুদ্দিন পাইকারের পালাগানের আসর।

রংপুরের গান শুনি। গোয়ালপাড়ার গান শুনি।

হাতিমাহুত আর মৈশালের গান শুনি।

বিভোর হই। চোখে জল আসে।

লোকসঙ্গীত আমার শিক্ষক। আমাকে জীবন চেনায়। আমাকে যাপনের গন্ধে ডুবিয়ে মারে।

বালাবাড়ির ওপর দিয়ে ভেসে আসে গান_

"আজি ছাড়িয়া না যান

ও মোর বাচ্চা মৈশাল রে"


 ছবি - লেখক

Comments

  1. খুব ভালো লাগলো স্যার 🙏

    ReplyDelete

Post a Comment