গল্প - রম্যাণী গোস্বামী


করুণাধারায় এসো 

আমাদের চম্পার মা এই সেনপাড়াতেই গুণে গুণে সাত-সাতটি বাড়িতে ঠিকা কাজ করে। একে অপরের গা-লাগোয়া পুরনো বাড়িগুলো। বেশির ভাগই একতলা। আবার কোনও কোনওটির দোতলা উঠেছে বেশ পরে। বাড়ির বাসিন্দাদের মধ্যে বাটি চালাচালি চলেছে প্রায় অনাদিকাল ধরে বংশানুক্রমে। তবে লকডাউনের জন্য আপাতত সেটা কঠোরভাবে বন্ধ রাখা আছে। চম্পার মায়ের বাড়ি থেকে সেনপাড়া খুব বেশি দূরে নয়। তরুণ সংঘের খেলার মাঠটা টপকিয়ে যেতে হয় আরও কিছুটা। হনহনিয়ে হেঁটে গেলে দশ থেকে বারো মিনিট। 

চম্পার মায়ের শক্তপোক্ত দোহারা চেহারা। সে খাটতে পারে ভীষণ। পাড়ায় সে ফেমাস দুটি কারণে। প্রথমটি হল এই যে, নিয়মিত কাজে আসে চম্পার মা, খুব দরকার ছাড়া মোটে বাদ দেয় না। যা এখনকার দিনে অত্যন্ত বিরল। আর দ্বিতীয়টি হল এই যে, ধরাবাঁধা কাজের বাইরে টুকিটাকি, যেমন এঁচোড়টা কেটে দেওয়া, একটু নারকেলটা কুরিয়ে দেওয়া, ছাদে বৃষ্টির জল জমেছে, একটু ঝাঁট দিয়ে ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়ে দেওয়া, এরকম বাড়তি দুটো একটা কাজ দিলে সে আর পাঁচটা লোকের মত খ্যাঁকখেঁকিয়ে ওঠে না। সেই কারণে চম্পার মা’কে নিয়ে পাড়ায় বলতে গেলে টাগ অফ ওয়ার চলতে থাকে বৌগুলির মধ্যে। 

এহেন গায়েগতরে দিবারাত্র খেটে জান লড়িয়ে দেওয়া চম্পার মা হতবাক হয়ে পড়ে সুবলা বৌদির কথা শুনে। কী বলছে কী বৌদিটা! ওকে নাকি কোনও বাড়িই কাজে আসতে হবে না সামনের টানা দু’মাস? চুপটি করে বসে থাকতে হবে নিজের ঘরে? তবুও নাকি বেতন মিলবে আপনা আপনি! ব্যাখ্যানটি যত শোনে ততই আশ্চর্য লাগে তার। পোকার মত না জানি কী একটা বেরিয়েছে চারপাশে। মানুষ থেকেই মানুষে ছড়ায় সেটা। এতদিন মুখপোড়া পোকাগুলো অনেক দূরে দূরে ছিল। কিন্তু ছড়াতে ছড়াতে এখন এক্কেবারে ওদের ঘাড়ের কাছে এসে জুটেছে। সেগুলোর হাত থেকে বাঁচতেই নাকি এত কাণ্ড! নিজের চোদ্দ পুরুষে এরকম আশ্চর্য কথা শোনেনি কখনও চম্পার মা। বলও দেখি, মাথামুন্ডু আছে এসব কথার কোনও? সেই ছোট্টবেলা থেকে আজ এতগুলো দিন, তার নিজের কখনও জ্বরজারি হয়েছে বলে তো মনে পড়ে না। সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ সে। একটা হাতির শক্তি ধরে যেন ওর সবলা দেহে। তাহলে কেন খামোখা কাজ ছেড়ে ঘরে বসে থাকবে সে? শুনি?    

কিন্তু সেদিন সাত সাতটি বাড়ি থেকে সাতটি সুরে সেই একই বাণী বর্ষিত হতে থাকে তার উপর – ওরে মূর্খ! লকডাউন করেছে রে সরকার! লকডাউন! এবার চুপটি করে বাড়িতে বসে থাক। কাজে আসবি না খবরদার! 

দাদা ও বৌদিদের তীব্র ধমকের স্রোতে ওর ক্ষীণ প্রতিবাদটুকু থমকে যায়। পারুল বৌদির দেওয়া কাপড়ের মাস্ক নাকের উপরে চাপিয়ে বিরস বদনে সে রওয়ানা দেয় তিস্তার চর অভিমুখে। নিজের ছোট্ট ঘরটির দিকে। পোকাগুলি আকাশ থেকে ঝরে পড়বে নাকি বাতাসে নিঃশ্বাসের সঙ্গে নাকের ভিতর ঢুকবে, কেই বা জানে সে খবর? নদী লাগোয়া বাঁধরাস্তার উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গোধূলির সোনালি রঙের ছোপ লাগা আকাশের দিকে মুখ তুলে ভাল করে তাকিয়েও কোনও পোকামাকড় জাতীয় কিচ্ছু চোখে পড়ে না ওর। ধ্যাত্‌তেরি। যতসব বানানো কথা। ডাহা গুল। চম্পার মায়ের কেবলই মনে হতে থাকে একটা কথা। আচ্ছা? সবাই মিলে একটা ষড়যন্ত্র রচনা করেনি তো ওর সঙ্গে? ওকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার বাহানা নয় তো এসব? কে জানে। 

কিন্তু দিন সাতেক পরে পারিপার্শ্বিকের দিকে ভালমত নজর করে নিজের ভুলটা বুঝতে পারে ও। ‘করুণা’ না কী যেন একটা নামের সেই পোকাটা সত্যিই আছে কিন্তু। তা না হলে কি আর ব্যাটাছেলে মেয়েছেলে সকলে মিলে দিনরাত মুখ-নাক ঢেকে ঘুরে বেড়ায়? লকডাউনের দিনে এতদিনের পরিচিত রাস্তাঘাট বাজারহাট সব এক শ্মশানপুরীর মত শুনশান হয়ে যায়? হঠাত একদিন কয়েকজন ফিটফাট বাবু মোটর বাইকে চেপে এসে চম্পার মায়ের হাতে ধরিয়ে দেয় কড়কড়ে দুটি হাজারের নোট। সঙ্গের বাবুরা হাততালি দেয়, মোবাইলে ফটো উঠায়। কদিন পরেই ফ্রি’তে ঘরে চলে আসে থলি ভর্তি চাল ডাল আটা। ব্যাপার স্যাপার দেখেশুনে একেবারে তাক লেগে যায় ওর।

আহা! করুণাময়ী মায়ের কী দয়া গো!  

(২) 

ক্যালেন্ডারে তিনটে পাতা উলটে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। এবং এরমধ্যেই ভোল পালটে গিয়েছে চম্পার মায়েরও। একদিন নিজে থেকেই গিয়ে সেন পাড়ার বৌদিদের মুখখানাও দেখিয়ে এসেছে। কয়েকটা বাড়ির বৌদি যে এতটা ত্যাঁদড় হতে পারে, সেটা এতদিন জানা ছিল না ওর। শালা! বলে কিনা গত মাসের মাইনে দেবে না! মাইনের কথা তুলতেই চোখ পাকিয়ে সুর টেনে বলে ওঠে বৌদিরা, বাহ রে বাহ! মজা কত! তুই এখন সরকারের খাচ্ছিস, বাড়িতে বসে আরাম করছিস, এদিকে আমাদেরই কিনা সারাদিন ঘরের ঊনকোটি কাজ করতে করতে হাড় মাস কালি কালি হয়ে গেল! আবার বলে মাইনে চাই! ইস, হবে না। যা। ফের যখন কাজে লাগবি তখন পাবি মাইনে। তার আগে নয়।    

সুবলাবৌদি অবশ্য এ দলে পড়ে না। তার কাছেই এসে রাগে গজরায় চম্পার মা। ভিতর বাড়িতে পা দেয়না অবশ্য। উঠোনের শান বাঁধানো মেঝেতে থেবড়ে বসে আক্রোশে দাঁতে দাঁত চেপে গালমন্দ করে সে। এই বৌদির কাজটাই করবে শুধু। হ্যাঁ। আর বাকি বাড়িগুলোর মুখোই হবে না সে। প্রচুর রসদ জুটছে তার এখান ওখান থেকে। রেশনের যোগান নিয়মিত আসছে। খাওয়া-পরার কোনও অভাব নেই। হাঁড়িমুখো আর বেইমান লোকগুলোর বাড়ি বাড়ি লাঠি ঝ্যাঁটা খেয়ে বেগার কেন খাটা শুধুমুধু? তাছাড়া এই তিনমাসে ঘরে শুয়ে-বসে আর ঘুমিয়ে ওর শরীরটায় বেশ একটা ঝিমঝিমে আমেজের নেশা জেগেছে। এই নেশার স্বাদ নতুন। নাহ, কাজ-ফাজ আর করবেই না চম্পার মা। 

সময় গড়ায় নিজের খেয়ালে। সুখী মানুষ এখন চম্পার মা। এইসময় হঠাত একদিন দেখা যায় যে বাইরের জগতের চিত্রটা বদলে যাচ্ছে দ্রুত। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছে ও। টোটো, রিক্সা এইসব এখন বেরচ্ছে দিব্যি। মানুষজনও চলেছে বাজারের থলি হাতে। যদিও নাকমুখ আষ্টেপৃষ্ঠে ঢেকে। কদিন যেতে না যেতেই দুম করে যেমন আবির্ভূত হয়েছিল ঠিক তেমনই ফুসমন্তরে উবে যায় সাহায্যের সেই হাতগুলি। লোকের ভয়ডরও যেন অনেকটা কমে এসেছে। যা আছে কপালে বলে যেন কপাল ঠুকে বেরিয়ে পড়ছে সবাই কাজেকম্মে। পাড়ায় মাস চারেক আগেকার পুরনো ছবিটাই যেন ফিরে এসেছে আবার। নতুন একটা শব্দও ইদানীং ছিটকে আসছে কানে। যাকে বলে আনলকডাউন। এটা আবার কী রে বাবা! খায় নাকি মাথায় দেয়? 

অথচ বেশি করে চোলাই খেয়ে যখন রাস্তায় পড়ে রইল গোপালের দেহটা, একজনও এগিয়ে গেল না ওকে সাহায্য করতে। এমনকি ওর নিজের বউটাও না। মানুর বুড়ি মা ঘরের ভিতরেই মরে কাঠ হয়ে পড়ে রইল তিনটে দিন। কেউ গেল না তাকে সৎকার করতে। বেঁচে থেকে শুধু নয়, মৃত্যুর পরেও যেন অচ্ছুৎ একটা শরীর। মরে গেলে শরীর কাঁধ পায় না, এই ঘটনা কস্মিনকালেও তো দেখেনি সে!   

জানলা দিয়ে ভয়ে ভয়ে বাইরে উঁকিঝুঁকি দেয় চম্পার মা। মোতির মা, কনকবালা সকলেই কেমন কোমর বেঁধে হইহই করতে করতে কাজে যাচ্ছে। হে ভগবান! এত সাহস এরা পাচ্ছে কোথা থেকে? চিঁ চিঁ করে দু একবার সকলকে নিরস্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু পুরোপুরিই ব্যর্থ হয়। কেউ শুনতে রাজি নয় তার কথা। কনকবালা ঘাড় ঘুরিয়ে তার উদ্দেশ্যে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি ফেলে একটা মুখ ঝামটা দেয়, নেকি! জানিস না এখন আনলকডাউন চলছে? বাবু আর বৌদিরাও সবাই যে যার অফিসে যাচ্ছে। ঘরে বসিয়ে বসিয়ে কে খাওয়াবে তোকে শুনি? আ মরণ!   

সেকী! শুনে টুনে মাথায় যেন বজ্রাঘাত হয় ওর। তার মানে পোকাগুলো সবকটা পালিয়েছে? অফিস টফিসও যত সমস্তই খুলে গেছে? তাহলে? সে কী করবে এবার? ফের সেই বাড়ি বাড়ি কাজ ধরা? বছরভর উদয়স্ত খাটুনি? কাঁড়ি কাঁড়ি বাসন মাজা, গাদা গাদা ঘর ঝাড়ামোছা, বালতি বালতি কাপড় কাচা, উফ্‌! ভাবতেই শিউরে ওঠে চম্পার মায়ের শরীর। বিস্ফারিত চোখে নিজের ঘুপচি ঘরের জানলা দিয়ে বাইরেটা ভালভাবে ঠাহর করতে করতে অস্ফুট স্বরে আর্তনাদ করে ওঠে সে। নাহ, কোথাও নেই পোকাগুলো। সব বেবাক ফাঁকা! হাত-পা যেন আর বশে নেই ওর। থরথর করে কাঁপছে গোটা দেহ। ঘামে ভিজে চুপচুপে শরীরে টলতে টলতে কোনওমতে চম্পার মা এসে ভূমিশয্যা নেয়।  

ভাগ্যের একী ষড়যন্ত্র? আচমকাই জীবনে এই প্রথমবার যেন শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছে ওর। কাজে বেরতে হবে ভাবলেই এমন দুর্বল লাগছে যা আগে কখনও লাগে নি। ‘করুণা’ নামের পোকাটা কি তবে সত্যিই এসেছিল? তাকেও ধরেছে? কিন্তু সে টের পায়নি? হয়ত তাই। আসলে হয়ত সত্যিই তার মনের সমস্ত সাহস শুষে নিয়ে তাকে একেবারে ছিবড়ে করে দিয়ে গায়েব হয়ে গেছে পোকাটা। 

হে করুণাময়ী, এলেই যখন, কৃপা করও মা, আর কটা দিন থাকও। এখনই চলে যেও না তুমি। ছেঁড়া চাদরে শুয়ে কাঁপতে কাঁপতে বিড়বিড় করে চলে চম্পার মা।  

আরও অন্তত একটি বছর পরে যেও ... ফিরে এসো মা... হে করুণাময়ী... !   

Comments

  1. চমৎকার হয়েছে 👌

    ReplyDelete
  2. Besh valo hayeche,karunamoyeer kalyan

    ReplyDelete
  3. ভালো লাগছিলো l গল্প হঠাৎ শেষ হলো মনে হয় l অসুস্থ হয়েও অসুখ কে স্বাগত জানালো l একটু কেমন লাগলো l আরও নতুন নতুন লেখা পড়ার ইচ্ছে রইলো l

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনি একদম ঠিক বলেছেন। গল্পের প্রোটাগনিস্টের কর্মভীরুতা এবং কাজে না যাওয়ার অছিলায় মারী'কে আমন্ত্রণ জানানো, এই দুটো ব্যাপারকে এক যোগসূত্রে বাঁধার জন্য হয়ত আরও কিছু শব্দ খরচ করার প্রয়োজন ছিল শেষে। প্রতিক্রিয়াটি জানানোর জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।

      Delete

Post a Comment