গদ্য - মনোনীতা চক্রবর্তী


ছায়া


'তার উপরে সদর কোঠা ওই লালন ভেবে কয়...' বরং এভাবেই শুরুটা করি। প্রতিটা শুরুর শুরুটাই আসলে আসল কথা; একবার অন্তত চেষ্টাটা তো করি! লালন সাঁই ভাবলেন কত-কী এই সদর কোঠা থেকে উড়ানের কথা। মিলনের কথা। অপেক্ষার কথা। পনিটেল করা সময়ের ভিতর কে যেন কানের ঘরে বলে যায়, "সাঁই আমার কখন খেলে কোন খেলা..." কখনও লিখেছিলাম হারমোনিয়ামের রিড হয়ে উঠছে আমার সবক'টা অস্থিসন্ধি... মহুয়া'দি সেদিন উত্তরার জন্য রবি ঠাকুরকে নিয়ে আমার ভাবনা বলবার কথা বলেছিলেন। আমি ফোনের এপার থেকে বললাম যে সবেতেই তিনিই পরম আশ্রয়। নতুন করে তো আমার রবিন ঠাকুরকে নিয়ে  (রবিন ঠাকুর' আমি ভালোবেসে বলি) কিছু বলার নেই; "আছে দুঃখ আছে মৃত্যু..." কোথায় তিনি নেই! আসলে এত কথা বলার কারণ হল যে আমি লিখেছিলাম, হারমোনিয়ামের রিড হয়ে উঠছে সবক'টা অস্থিসন্ধি... এই শেষ চৈত্রে যখন বৈশাখকে বরণ করবো বা করার কথা, বা এভাবেও যদি বলি বৈশাখ মানে তো রবীন্দ্রনাথ;  ঠিক তখন  অস্থিসন্ধি অস্থির; বড়ো বেদনার মতো বেজেই চলেছে কেবল! ওই যে আজ দুপুরে ঘোড়সওয়ার-এর নীহার দাদা যখন ফোনে বললেন যে এখন নয় তো আর কখন শব্দ আসবে...আমি বললাম, 'দেখছি'। আমি কী-করে বোঝাই বলো তো ওই কমলা রঙের পাখিটা আমাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে! এভাবে কেউ ছেড়ে যায়, বলো তো? মা গোসাঁই গো, গতবছরের প্রায় এরকম সময়েই রেওয়াজ সিরিজের ৫ নম্বরে লিখেছিলাম জল খুনের বিশদ, মনে পড়ে তোমার? লিখেছিলাম, জল খুন হবার পর সে জানতে পারলো যে খুনি হতেও যোগ্যতা লাগে। অযোগ্য খুনির হাতে অন্তত জলের নিহত হবার কোনো ইতিহাস নেই। জল-খুন হয়ে গেছে বহুকাল হল; মন-খুন  কখন, কেমন করে কোন কাপালিক এসে করে যায়; কিছু বোঝার আগেই খুন হওয়া জলের রক্তে মন ভেসে যায়। ট্রেন আসতে তখনও কিছু সময় বাকি; কমলা রঙের পাখিটা একবার বলছে, 'রাজামণি' আবার কখনও বলছে, 'কী চাই?' দুপুরে ঘুম। দুপুরে স্বপ্ন। রাতের ঘুমের বদলে ঘাম ঝরে। চশমা বদল করতে গিয়ে চোখ উলটে দিয়েছে কত সম্পর্ক! মধ্যদুপুর আর মধ্যরাতের দূরত্বের ভিতর এক শান্ত স্থিরচিত্র। হৃদয়, হিরে, হিমশীতল যা-কিছু কুচিকুচি স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে উপসংহার সাজাচ্ছে। চারপাশে শোকের চেয়ে ভারী হয়ে উঠছে আচার-বিচারের কিলবিল করা বাস্তু সাপ। আমি শ্বাস নিতে পারছি না, কমলা পাখি! আমরা চারজন কেউই শ্বাস নিতে পারছি না!  শরীর জুড়ে গুপ্তচর। যেন গুপ্তধন! সে-রাতে শিলাবৃষ্টি। সে-রাতে গান, "নৈনা মোরে তরস গই...'। অনুশ্রীর সাথে দীর্ঘ কথা। পরের দিন বাবার ছবিতে দই-মিষ্টি আর পায়েস দেবার দিন; পাপাইয়ের ছবির জন্মদিন। ওই যে লিখেছিলাম যে শোকও সাবালক হয় একদিন। সাবালক হতে না-হতেই ওই কমলা রঙের পাখিটা সব্বাইকে ফাঁকি দিয়ে কোথায় যে উড়ে গেল! ফেরেনি। কেউ ফেরে না। আমার লালন সাঁইকে মনে পড়ে ভীষণ -ভীষণ! কী অদ্ভুত একটা জিনিস লক্ষ করলাম যে আমার বাবার নাম 'কমল' আর শাশুড়ি মায়ের নাম 'কমলা'... 'আসা যাওয়ার পথের ধারে...' কেবল শিলাবৃষ্টি আর ঝাপসা দৃষ্টি... গান ভেঙে-ভেঙে আসে। প্রতিটি ফুরিয়ে  যাওয়াই আসলে  শুরু হওয়ার কথা বলে...আলগোছে মায়া ঢেকে রাখি বুকের নীচের আয়না  মহলে, খুব গোপনে...

আমার সর্বাঙ্গে  ঐশ্বরিক ধুলো 
প্রাক- বৈশাখের প্রথম ঝড়ে 
আমাকে খুঁজছি ছায়াপথে...
নির্বিকার বাতাস বিলি কেটে 
এগিয়ে চলছে সন্ধানী ডানা ...
আঙুলের  অনন্ত মুদ্রা 
পাঁচ রঙা বৈভব ...

বহুবছর আগেরই লেখা। সন্ধানী ডানা আর অনন্ত মুদ্রার লক্ষ্য অলক্ষ্যে আজও...ছায়া হারালে আরও দীর্ঘ হয় প্রহর। মায়ার বার্ধক্য আসে...

''কপালের ফের নইলে কী আর
পাখিটির এমন ব্যবহার।
খাঁচা ভেঙ্গে পাখি আমার,
খাঁচা ভেঙ্গে পাখি আমার কোনখানে পালায়...''

ও পাখি, আমার কমলা পাখি, যদি পারিস অন্য রঙের পাখি হয়েই নয় ফিরে আসিস...ফিরলে কিন্তু আর কোনোদিনও পালাবি না কিন্তু এই বলে দিলাম; নইলে সাত জন্মের আড়ি-আড়ি-আড়ি... কথা দে, ফিরবি তো?

Comments