গদ্য - অঞ্জনা দে ভৌমিক

স্নায়ু্যুদ্ধ


শূন্য দুপুরে সামনে কত জিজ্ঞাসা? উৎসাহের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ তখন ঠিকরে পরে। শোনা যায় মিথ্যে আগ্নেয়গিরির গুরু গুরু ধ্বনি। তৃতীয় বিশ্ব স্নায়ুযুদ্ধ।  মৃত্যু উপত্যকায় দাঁড়িয়ে আছে মানুষ।  হয়তো যা হয় তা ভালোর জন্যই হয়।  আজকাল ঘুম ভাঙে পাখির ডাকে। সূর্যের হাসিটাও বেশ প্রাণ খুলে।  কৃষ্ণচুড়া গাছে কোকিল আর বউ কথা কউ পাখিদের বসে থাকতে দেখা যায় একই ডালে। শালিকপাখিদের দৌড়ে এসে ঝগড়া করাটা দেখতেও বেশ মজাই লাগে। বলতে পারো,  আমরা সময়টা কোথায় নষ্ট করেছি? বইয়ে পড়েছি,  আজ যা করতে পারো তা কালকের জন্য ফেলে রেখোনা। কাল আবার চেষ্টা করেছি।  একটি দিনই তো,  কি আর এমন....

কত অবহেলায় কত দিন নষ্ট করেছি। আজ মনে হয়, একটি দিন যে কত ভয়ংকর! ভগ্ন হৃদয়ের সৈনিক আজ আমরা।  দু'হাতে হাঁটুতে ভর করে উঠবার কত চেষ্টা! 

আজ সারা বিশ্বজুড়ে একলা থাকার বার্তা,  দূরত্ব বজায় রাখার বার্তা।  দূরে সরে যেতে যেতে যখন দেয়ালে পিঠ, তখন বিশ্বজুড়ে একই শ্লোগান।  কতটা অসহায়,  তাই না? একলা হতেই তো চেয়েছিলাম...... 

তবে ভুল কোথায়?  কেন এত জিজ্ঞাসা?  এত কেন কষ্ট!  আড্ডা ঘরের ভেতর অক্ষত শরীরের হৃদয়ে ক্ষত বিক্ষত চিহ্ন!  সব থেকেও কিছু নেই।  ভীষণ গরীব,  তাই না?  

মনে পড়ে আজ,  সেই আধখানা গ্রাম শহর আর আধখানা গ্রামের কথা। গোল গোল করে আমরাও দাগ দিতাম। একটা গোল থেকে আর একটা গোল কোটে লাফিয়ে যাওয়া।  কিন্তু দূরত্ব নয়,  আরো আরো কাছে আসা। আমরা মুখে কাপড় বাঁধিনি।  চোখে কাপড় বেঁধে হাতে হাতে ছু্ঁয়ে দেওয়া। দুপাশে প্রতিবেশীদের বাড়ি। এক উঠোন থেকে আর এক উঠোনে কোন প্রাচীরের বালাই ছিল না। কারো বাড়িতে হঠাৎ অতিথি এলে পাশের বাড়ির রান্না দিয়ে অতিথি আপ্যায়নের আন্তরিক ছোঁয়া।  তখন কোন প্রাইভেসি মেইনটেইন করার ভাবনাটাই ছিলনা। মনে পড়ে আমার পাড়ার নদীর কথা। তোর্সার জলে কত আদর মাখা দিন গুলির কথা,  পাড়ার মাঝখান দিয়ে ধুলোভরা পথের কথা।  বেশ তো ছিলাম।  কি সুন্দর কাটতো দিনগুলি। পাড়ার শিব মন্দিরে মায়েদের পুজো দেওয়ার সময় আকন্দ ফুল, ধুতরা ফুল, বেলপাতা কে এনে দেবে?  সেটা কোন সমস্যাই না। আমাদের গ্রামের কালু, ভুলু,  যগাই সবাই একলাফে গাছে উঠে গেল.... 

"কাকিমা..  সব রেডি"

সেদিনের কথা ভেবে ভেবে আমার রাতে ঘুম হয় না। মাঝে মাঝে একটা স্মৃতির ছায়া আমাকে ডাকে। দিঘির জলে বন্ধুদের সাথে সাঁতার কেটে এপার ওপার মাটি ছুঁয়ে আসা। রায় বাড়ি পিসিমার তেঁতুল গাছে ঢিল ছোরা।  আবার পিসিমা তেঁতুল দেবে বলে হাত দেখাতে বলে হাতে আবার লাঠির একটা বাড়ি। সেই দাড়িয়াবান্ধা কোট,  বউছুট খেলার সঙ্গী,  দুটো বেনী ঝুলিয়ে দিঘির জলে পা দুলিয়ে কত মজার মজার গল্প বলা ও শোনা। মামাতো পিসতুতো ভাইবোনেরা সবাই মিলে মারপিট,  ঝগড়া, খুনসুটি লেগেই থাকতো।

দোষি না আমি,  না তুমি। সময় সব বদলে দিয়েছে।  অচেনারা চেনা হয়েছে।  মন্দ কি!

সময়ের সাথে মানুষ একা থাকাটাকেই পছন্দের তালিকায় রেখেছে।  আমি তুমি ও আমাদের একজন নিজের।  তার বাইরে সবাই পর। খারাপ কি!  তবুও সবাই ভালো থাকুক। কিন্তু ভালো কি আছে কেউ? তবে কেন এই একাকিত্ব মানুষের জীবনকে গ্রাস করে নিচ্ছে!

আজ নিরাশ ও নিরস ভাবে আয়নায় নিজের মুখ দেখে নেওয়ার একটা চুড়ান্ত সময়।  আজ আমরা সবাই একা। অন্তীম যাত্রায় একলা চলা।

শরীর নেতিয়ে পড়েছে অবসাদে। আজ সবাইকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছা ,  একটু ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা।  মন বলে একটু ভালোবাসতে। আগের কথা ছেড়েই দিলাম। বিশ্ব  এখন ভাইরাসে আক্রান্ত।  এই ভাইরাস বিদায়ের সাথে আমরা আবার কি পারি, হাতে হাত রাখতে প্রিয়জনের সাথে,  প্রতিবেশীর সাথে?   

সারা পৃথিবী ঘুরছে। পৃথিবী গোল। এটা তো মানুষই আবিস্কার করেছে।

Comments

  1. যে কোনো কীট পতঙ্গের চেয়েও মানুষ অসহায়। বলা ভালো উন্মাদ। নাহলে এমন হয়, কোটি কোটি মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে ক্ষমতা লিপ্সার এই উল্লাস।

    ReplyDelete

Post a Comment