মুক্ত গদ্য - মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস

 


অয়মারম্ভ, শুভায় ভবতু


নববর্ষ মানে মার হাতের কুচি দেওয়া লালচে কিংবা গোলাপি ফ্রক। কখনো ঘটি হাত, নয়তো ফ্রিল দেওয়া কুচি কুচি। এত আনন্দ সকাল। এক প্রস্থ ছোট ছোট কার্ড গতকাল সারা দুপুর সারাটি সন্ধে রঙ দিয়ে এঁকে তৈরি করেছি। বাবার দেখিয়ে দেওয়া ছবির রঙ, চাইনিজ ইংকের অদ্ভুত মিশেল। বড় আর্ট পেপার ভাঁজ করে কেটে নিয়ে কার্ড বানানো। সকাল সাড়ে ন'টা বাজতে না বাজতেই সব বন্ধুদের জুটে যাওয়া। নতুন জামার গন্ধ তখন এপাশে ওপাশে। 'গাছে গাছে ফুল ফুটেছে, নববর্ষের ডাক উঠেছে...' এসব পদ‍্যকথা আমার কার্ডে চলবেনা। সেখানে, ভাই রিনি, শুভনববর্ষ।প্রীতি নিও। ...নাম। সেইতো পুরোনো গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে আসা। আসতে শুরু করা ঋজু কলম। দৃষ্টি বদলের ইতিহাস আর চলন। অন‍্য পথ খুঁজে নেওয়ার সাধনা। সে শুরু হয়ে যেত জানুয়ারি মাস থেকেই। ২৩শে জানুয়ারির ভোরে প্রভাতফেরীর অদ্ভুত আয়োজন থেকে। পাড়া জুড়ে সেই বন্ধন বড় নষ্টালজিক করে তোলে। কখনো মনেই আসেনি এপাড়া ছেড়ে অন‍্য কোনখানে অন‍্যদেশে যেতে হবে কোনদিন। আবার বলি আমার কাব‍্যভাষায়... "আমাদের কোন ভৌগোলিক সীমা নেই/কোনো নদী নেই/কোনো মানুষ নেই/নিজস্ব কিছু ছিলনা কোন ও দিন..." জলের আকৃতির সেই ঘোরাফেরা সর্বত্র ই মানিয়ে নেওয়া অভ‍্যেস, এইতো তৈরি হওয়া। নববর্ষের উৎসব আয়োজন চলত প্রায় পনেরদিন কি একমাস ধরে। কখনো নাটক 'রত্নাবলী', কখনো 'মুকুট', কখনো গানের সঙ্গে নাচ।পাড়ার ছেলেরা আলাদা নাটকে মন দিত। সেটা আমাদের বাড়ীতেই রিহার্সাল চলত।  আর পাশের বাড়ীর ডলি পিসির কাছে মেয়েদের রিহার্সাল পুরোদমে। আর নববর্ষের দিন? এবাড়ী ওবাড়ীর খাট চৌকি তক্তপোষের পাশাপাশি হাতধরাধরিতে নাট‍্যমঞ্চ একনম্বর। আর সব বাড়ীর মা, জেঠিমা, কাকীমায়ের শাড়ীতে উইংস, পর্দা। কোথায় লাগে ডেকোরেটর্স! সেসব শব্দ ই শুনিনি তখন। কারণ পাড়ার পুজোর জৌলুষ ও ফুটিয়ে তুলত পাড়ার বড় ছেলেরাই। 


নববর্ষের সকাল মানে স্কুল ছুটি। পুজোর প্রসাদ। আর নতুন জামার গন্ধ। একটু বড় হতে বন্ধন কেটে মন কেমনের পর্ব। পাড়ার ছেলেদের মধ‍্যে অভি খুব সুন্দর ছবি আঁকত। ওকে উৎসাহ দিতেন সবচেয়ে বেশী আমার বাবা। আঁকার বাঁধানো খাতা বাবা উপহার দিতেন আমার বন্ধুদের মধ‍্যে দু তিনজনকে। আমার সঙ্গে সঙ্গে অভিও একখানা সুন্দর বড় খাতা একবাক্স রঙ তুলি উপহার নিয়ে দারুন আনন্দ পেত মনে মনে। আর অপূর্ব সব কার্ড এঁকে প্রত‍্যেক নববর্ষে আমার একখানা উপহার বাঁধা। সে কার্ড দিত একটু লুকিয়ে। গোপন রাখতে চাইত। ওর লজ্জা মাখা সে মুখ এখনো মনে পড়ে। সে কার্ড আমি কিন্তু প্রথমেই বাবাকে দেখাতাম, তারপর মাকে ডেকে দেখাতেন বাবা। মার চোখে খুশী দেখিনি এসময়। কেমন রাগী চোখে দশ এগারো বছরের মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। ভাবতাম 'এ কিই অপরাধ!!' সে যাক্। আমিও সকলকে কার্ড বিলিয়ে মাংস ভাতের গন্ধে সারা দুপুর কাটিয়ে ঘুরে ঘুরে মঞ্চের কাছাকাছি থেকে দাদাদের ফাই ফরমাশ খাটতাম। ঘরে চালানো রবীন্দ্রসংগীতে মন ভরে যেত, গুণ গুণ করতাম। আর সন্ধে থেকে সাজগোজ, গান বাজনা-নাটক। আহা! মধুর নববর্ষ তখন।


বাংলা ভাষা সাহিত‍্য নিয়ে পড়তে পড়তে, চর্চা করতে করতে কখন মজ্জাগত হয়ে গেছে আদি অন্ত! তাই "এখন কি নববর্ষ গুরুত্ব হারিয়েছে! না কি রূপ বদল করেছে!" এসব প্রশ্নে অবাক হ ই। আসলে দেখার দৃষ্টি, ভাবনা বদলে যায়। যুগের পর যুগ এ বদল লক্ষ‍্য করি। গতিময়তাই আধুনিকতার বিশেষত্ব। সে অতীত সময়ের হাওয়ায় ভাসতে চায়না। কিন্তু একজন বাঙালীর কাছে বাংলা ভাষার গুরুত্ব উপযোগিতা কতখানি তা উপলব্ধির সময় এসেছে। নববর্ষ পয়লা বৈশাখ তাই আজো উৎসব। নতুন আলোর সূচনা। নতুন দিনের সূচনার দিনটি আসুন আমরা সকলেই টিভির বানিয়ে তোলা উৎসবে থমকে যাওয়া দর্শক না হয়ে নিজেরা বাংলা ভাষার জন‍্য অন্তত একদিন ওপারের বাংলাদেশের মত পরম শ্রদ্ধায় উচ্চারণ করি "বাংলার মাটি বাংলার জল..." "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি"। সকলের আগে সকালের আলোয় আসুন স্নান করি ভোরের সূর্যালোতে। একসাথে উচ্চারণ করি সুরে, "নব আনন্দে জাগ, আজি/নব রবিকিরণে..." আনুষ্ঠানিকতায় অনেকে বিশ্বাসী নন। কিন্তু বলি কি, এ অনুষ্ঠান ও জড়িয়ে আছে বাংলাকে ভালবেসে কাছে টেনে নেওয়ার নিবিড়তায়। এ অত‍্যন্ত জরুরী যুগ থেকে যুগান্তরে কালপর্বে অতীত বর্তমানকে মিলিয়ে দেওয়া  আর ভবিষ‍্যতের দিকে হাত বাড়ানোর মোক্ষম বাতাবরণ তৈরিতে। রবীন্দ্র পূজা'ইত‍্যাদি নানা বাক‍্যবাণ অনেকে ব‍্যবহার করেন, করতেই পারেন। আমি বলি, সে আয়োজন, চর্চার বড় দরকার আজ। যে যেভাবে নিন ক্ষতি নেই। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এই বার্তা পৌঁছক নতুন বাংলা বছ‍র মানেকি! তাকে বরণ করতে হবে কেন, নিজের ভাষা, মায়ের ভাষা ভাল না বাসলে, প্রতিষ্ঠা না দিলে আমরা যে প্রতারক নিজের কাছেই। অন‍্যকে আত্মস্থ করার মানসিকতাও জাগবেনা। নিজের তুচ্ছতা নিয়ে হাহাকার শুরু করলে দেখব একদিন নিজেই বিকিয়ে বসে আছি অন‍্য ভাষার কাছে, অন‍্য দেশের কাছে। নতুন বাংলা বছ‍র নিয়ে আর একটু সজাগ সচেতনতা আমরা সকলেই আশা ক‍রি। নতুন দৃঢ় বলিষ্ঠ এক ভবিষ‍্যতের দিকে তাকিয়ে আছি নববর্ষের প্রথম সকাল দেখব বলে...

Comments