হৃদি প্রত্যাশা : অনাবিল প্রেমের কথাকলি
কবি : দীপ্তি রায়
প্রকাশক : কবি মানস, বাংলাদেশ
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারী,২০২০
প্রচ্ছদ শিল্পী : রাহেল রাজিব
বিনিময় : ৫০ টাকা
'ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
অবহেলা ক'রে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
ঘৃণা ক'রে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে;
আমারে সে ভালোবাসিয়াছে,
আসিয়াছে কাছে,
উপেক্ষা সে করেছে আমারে,
ঘৃণা ক'রে চ'লে গেছে -- যখন ডেকেছি বারে-বারে
ভালোবেসে তারে;
তবুও সাধনা ছিলো একদিন -- এই ভালোবাসা।'
(বোধ : জীবনানন্দ দাশ)
নারী-পুরুষের জীবনের চিরন্তন সত্য যে প্রেম,তাতে ভালোবাসা, অবহেলা, উপেক্ষা, ঘৃণার পাশাপাশি শেষপর্যন্ত যা অবশিষ্ট থাকে তা হলো ভালোবাসা।
'তবু এই ভালোবাসা -- ধুলো আর কাদা --'
ভালোবাসার এই চিরন্তন আকুলতা ও বিচ্ছেদ বেদনার কথাকলি উত্তরবঙ্গের বর্তমান সময়ের তরুণ কবি দীপ্তি রায়ের 'হৃদি প্রত্যাশা' (ফেব্রুয়ারী,২০২০) কাব্যখানি।
পুরুষের চোখে নারীকে দেখার অনন্ত প্রেম পাঁচালি যদি জীবনানন্দের ভাবনায় ধরা পড়ে থাকে, তাহলে তার যথার্থ নারী সংস্করণ হলো দীপ্তির এই কাব্যটি।
নারী সম্পর্কে চিরকালের যে প্রবাদ 'মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না' -- তাকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে দিয়ে দীপ্তি তাঁর এই কাব্যে অনায়াসে বড়ো অকপটভাবে তাঁর ভালোবাসা ও ব্যর্থতা এবং শেষপর্যন্ত হৃদয়ের নিরন্তর প্রত্যাশার কথা উচ্চারণ করেছেন। এ উচ্চারণ বড়োই সাবলীল। প্রেমিকের প্রতি আপন প্রেমের অকপট স্বরূপ উন্মোচন করে কবি প্রথম কবিতাতেই বলেছেন,
'একবার ছুঁয়ে দিলেই,
সমুদ্র হয়ে যাই,
তুমি জানো।
নোঙরহীন মাস্তুল,
অচিনপুরের ডাক,
তোমাকে ভোলাতে চাই না।'
(হৃদি প্রত্যাশা)
সেইসঙ্গে তিনি জানান, বুকের ভেতরে একটি মাছরাঙা পুষে রেখেছেন, যাকে তিনি ঘরের একুরিয়ামে কোনোদিন সাজান নি।
কাব্যের উৎসর্গ পত্র থেকেই পাঠক জেনে যায় কোনো এক উজানকে তিনি বইটি উৎসর্গ করেছেন। এ উজান অনায়াসে ব্যক্তি থেকে নির্বিশেষ হয়ে উঠেছেন। উৎসর্গ পত্রে কবি লিখেছেন,
'উজান তোমাকে দিলাম।'
প্রত্যেকের জীবনে কম বেশি ভালোবাসার গল্প আছে। চিরকালীন ফিরে না তাকানোর অভিযোগ আছে। হঠাৎ মন ভালো করার গল্প আছে। নদীর বাঁকের মতো প্রত্যেকের জীবনেই ছোট ছোট বাঁক আছে। সেই বাঁক বেয়েই উঠে আসে উজানরা।'
এই উৎসর্গ পত্রটিই যেন হয়ে উঠেছে চিরন্তন প্রেমের ইস্তেহার। এরপর কাব্যের আরও দুটি কবিতায় এসেছে উজানের কথা। এবং সেখানে তিনি উজানের সঙ্গে নিজের ভালোবাসার স্বরূপকে ব্যক্ত করেছেন অকপটে,
১) 'কোথাও তোমার দিঘি নেই উজান!
সেদিনের সেই নীল কষ্ট বুকে চেপে,
চাঁপাকে ছড়িয়ে দিও আঙিনা জুড়ে,
চাঁপাফুল বড্ড ভালোবাসতো দিঘি।'
(চাঁপাফুল)
২) 'উজান তোমার স্পর্শে,
আস্ত একটা সন্ধ্যা ভেঙে উঠে আসে কালজানি নদী।
তোমার ঘ্রাণে ডুবে,
প্রতিটি সন্ধ্যা কি অমোঘ টানে নেশাতুর করে তোলে।'
(স্পর্শ)
জীবন নদীর ধারায় অনেকটা পথ চলে আসার পরে কবি উজানের দিকে ফিরে তাকিয়েছেন। 'ফিরুক সুখে উজান স্রোতে' মনে পড়েছে প্রেমিকের কথা। একদিন প্রেম ছিল, কিন্তু আজ দুরুত্ব বেড়েছে ক্রমে। কবি লিখেছেন,
'রোজ একটু একটু করে দূরত্ব বাড়ছে...
তোমার আমার অলৌকিক নেশায়।
একদিন আশ্চর্য একটা স্বপ্নঘোর ছিল,
মায়াবী আবেশ ছিল,
প্রাগৈতিহাসিক ডাক ছিল,
পারিজাত ফুলের ঘ্রাণও ছিল।'
(দূরত্ব)
কিংবা,
'ভালোবাসা আজ শব্দহীন।
ভালোবাসা আজ যন্ত্রণার অব্যক্ত কারাগারে বন্দি।
তবুও খুঁজে নিইনি কোনো তৃতীয় আশ্রয়।
বুঝতে পারিনি আর কতটা রঙে রাঙিয়ে দিলে,
সেদিন তুমি আমার হতে।
বুঝতে পারিনি আর কতটা ভালোবাসলে,
তুমি আমার বসন্ত হতে।'
(বাসন্তী রঙ)
শুধু তাই নয়, প্রেমের স্মৃতি দীপ্তিকে নস্টালজিকও করে তুলেছে। পৃথিবীর সব চেনা নদীগুলি 'এখন শুধুই বালি আর বালি'। তিনি বৃথা খুঁজে ফেরেন তৃষ্ণার জল। সেইসঙ্গে তাঁর অনুভবের ফ্রেমে ধরা পড়েছে,' আজ -- দগ্ধ নিদাঘের স্মৃতিটুকু সার। বৃষ্টিকে উদ্দেশ্য করে তাই তিনি নিজেকে পাথরের ভাস্কর্যের তুলনা করেছেন। তিনি ভালোবাসা ভুলে গেছেন। তাঁর তৃষ্ণা নেই আর। 'বেদনার বেনোজলে' আর ভাসাতে চান নি 'স্নিগ্ধ রাত'। যেন আজও তাঁর সমস্ত সত্তা জুড়ে প্রেমিক উজানের নীরব উপস্থিতি। কবি লিখেছেন,
'বৃষ্টি আমাকে আর ভিজিয়ো না,
তোমার ছোঁয়ায়
কতবার গলে গেছি, নদী হয়ে গেছি।
ভুলিনি কিছুই,
তবু আজ আর এসো না,
তোমার না থাকা জুড়ে থাক ভরা অভিমান।'
(বৃষ্টি ছুঁয়ো না)
কিংবা,
'আজও তুমি খরস্রোতা করো
অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে;
আর আমি তখন লিখে যাই
বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা ভেঙে কাহিনির শোকসংবাদ।'
(শোক সংবাদ)
প্রিয়তমের বিচ্ছেদ বেদনা বুকেও নিয়ে কবি ভালোবাসার প্রতি আস্থা হারান না। বরং অনুভব করেন, প্ৰিয় মানুষটিকে না পাবার মধ্যেও 'একটা মাদকতা আছে'। 'বন গোলাপের নিঃসঙ্গ গন্ধ' কবিকে মাতিয়ে রাখে প্রতিটি রাত। তাঁর তখন মনে হয়, 'দুধ- জ্যোৎস্নায় ভেসে থাকা এ পৃথিবী আমার'।শেষপর্যন্ত তিনি ভালোবাসার প্রতি প্রবল প্রত্যয় থেকে অনায়াসেই বলেছেন,
'পাতাঝরা বিকেলে এখনো আমার প্রেম পায়।
ভেবে সুখ পাই,
তুমি ছুঁয়েছিলে যে অতলান্তকে
সেখানে আমিও যে রেখেছিলাম বনগোলাপের বুনো
গন্ধ।'
(বিশ্বাস)
কিংবা,
'রোজ তোমার নামে চিঠি লিখি,
ফেলে আসি নামহীন ডাকবাক্সটায়।
চিন্তা করো না,
এই বর্ষাতেই আমরা বাড়ি ফিরব একসাথে।'
আঘাত পেয়েও তিনি প্রত্যাঘাতের কথা ভাবতে পারেন নি। বরং আঘাতের ক্ষতগুলি সেরে উঠেছে ক্ষমার মধ্যদিয়ে। বারবার রিক্ত হয়েছেন জেনেও 'শরতের শিউলির শুচিতা দিয়ে মুছে দিয়েছি সব গ্লানি'। এতটুকু জীবনে এতো অপচয়, মিথ্যা কষ্টকে ভালোবেসে আত্মহননের কথা ভাবেন নি। বরং আবহমান কালের প্রত্যাশী মানুষের মতো দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন,
'অমাবস্যার ঘন অন্ধকারেও
জ্যোৎস্না ফেরি করি রোজ!
ক্ষমতা রাখি একটা আস্ত নদীকে পুষে রাখার।
দীর্ঘকাল সাঁতার না কেটেও
অসুস্থ রাত ভোরের ম্যাজিক হয়ে যায়
তোমার ঘুমন্ত মুখের ছোঁয়ায়!'
(হৃদি প্রত্যাশা)
কিংবা,
'তার চেয়ে ফিরিয়ে দাও যা কিছু প্রাপ্য আমার
অঞ্জলি পেতে নেই আর একবার
আমাদের প্ৰিয় কথা, প্ৰিয় সুখ।'
(ফিরিয়ে দাও)
এখানেই ভালোবাসা যে 'ধুলো আর কাদা' তাকে কবি আরেকবার প্রতিপন্ন করেছেন।
বিষয়ের চিরন্তনতার সঙ্গে কবিতার আঙ্গিকেও যুক্ত হয়েছে ট্রাডিশনাল রীতির পাশাপাশি কবির নিজস্বতার সুর ব্যঞ্জনা। কবি মূলত গদ্য রীতিতেই স্বচ্ছন্দ। তবে প্রচলিত ছড়ার ছন্দেও তাঁর নৈপুণ্য প্রত্যেক্ষ করা যায় 'বৃষ্টি মাখি' শীর্ষক কবিতায়। কবি লিখেছেন,
'তোমার নামে / বৃষ্টি মেখে, (৪+৪)
বৃষ্টি দেখি / একলা ঘরে। (৪+৪)
মন খারাপের / অথৈ নদী, (৪+৪)
বইছে দেখো / উদাস মনে। (৪+৪)'
অলংকার প্রয়োগেও রয়েছে কবির নিজস্বতা। কয়েকটি দৃষ্টান্ত এরকম :
• অন্ধ ভিখিরির মতো দৃষ্টিহীন চোখে পথ খুঁজে ফিরি
(উপমা)
• তোমাকে ঘিরে থাকা ছোট ছোট ইচ্ছেগুলো
জেলে ডিঙিদের মতো।
(উপমা)
• পাতাঝরা হেমন্ত রেখে গেছে,
পুরোনো ভালোবাসার দাগ।
(সমাসোক্তি)
• আমি এখন পাথরের ভাস্কর্য
(উপমা)
• এখন বুকের ভিতর শান্ত জলে খেলা করে বাঁকা চাঁদ
(সমাসোক্তি)
• দিঘল রাত্রির বুক চিরে তুমি ছিলে, আমার গভীরে
(বিরোধাভাস) ইত্যাদি।
সেইসঙ্গে 'অসুখের মতো আমাদের জলজ জীবন', 'আমার পাখি জীবনের পালক', 'ভালোবাসা আজ শব্দহীন' ইত্যাদি চিত্রকল্পও ব্যবহার করেছেন ভাবনাকে প্রকাশ করতে গিয়ে।
এক কথায় কবির 'হৃদি প্রত্যাশা' হয়ে উঠেছে কবির অনাবিল প্রেমের কথাকলি।
![]() |
কবি দীপ্তি রায় |
Comments
Post a Comment