গল্প - কাজী রুনালায়লা খানম


মন্দ মেয়ের উপাখ্যান 


আমি বিজয়া, কুসুমপুর গাঁয়ের সুকুমার জেলের মেয়ে বিজয়া। এই যে আপনারা গ্রামের মহামান্য বিচারকগণ সবাই এসেছেন আমার বিচার করবেন বলে। তা করুন। বিচারে আমার যা সাজা হবে তা আমি মাথা পেতে নেবো। কিন্তু তার আগে যে আমার কথা গুলোও শুনতে হবে আপনাদের! 


পঞ্চায়েতের মিলি দিদি, মহিলা সমিতির চম্পাকাকি ওর স্বামী কমলেশ, প্রধান, হাবুল মাষ্টার, গাঁয়ের গুণী মানুষ কাদের মিঞা সবাই একে একে হাজির হয়েছেন প্রধানের বাড়ির আমগাছ তলায়। চম্পাকাকি মহিলা সমিতির সভাপতি। সে বলছে  "না না এমন নচ্ছার মেয়েকে তো গাঁয়ে থাকতে দেওয়া যায় না! এর দেখাদেখি বাকি মেয়েগুলোও নষ্ট হবে।" পঞ্চায়েতের বর ভোলা সে বলছিলো "এ মেয়ে গাঁয়ের বদনাম! একে মেয়েছেলে দিয়ে পিটিয়ে মাথা ন্যাড়া করে গোটা গ্রাম ঘোরানো  দরকার।" হাবুল মাষ্টার সবাইকে হাত তুলে থামিয়ে আমার বাবার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন "তো সুকুমার! তোমার কিছু বলার আছে? তোমার মেয়ে যে ভুল করেছে তারজন্য ওকে শাস্তি পেতেই হবে। তোমার এ নিয়ে কিছু বলার আছে?" কথার ফাঁকে মিলি বৌদি বললে "ওদের একঘরে করে রাখা হোক।" সভার সবাই সমস্বরে বলে উঠলো" ওর আবার কি বলার আছে? ওর মেয়ে অন্যায় করেছে তার শাস্তি ওদের পেতেই হবে!" হাবুল মাষ্টার খানিক থমকালেন। বাবা তখন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে এককোণায় বসে। মা সকাল থেকে ছোটগিন্নীর পায়ে পড়ে ক্ষমাভিক্ষা করেছে। এবারটির মতো ক্ষমা করো ছোটমা। তুমিই পারবে আমাদের বাঁচাতে।


সভায় তখন তুমুল উত্তেজনা। ছোটমা আমাকে নিয়ে ধীর অথচ দৃঢ় পায়ে এসে দাঁড়ালো। আমার চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো  "বল বিজয়া কেন করলি এ কাজ? নির্ভয়ে বল!" মিলিবৌদির বর তখন ঢোক গিললে। বললে "ও ও আবার কি বলবে?" সবাই জানে ও যা করেছে আর তাছাড়া... হাত তুলে থামিয়ে দেয় ছোটমা। "বল বিজয়া" বলে পাশে দাঁড়ায় আমার।


আমি বিজয়া কুসুমপুর গাঁয়ের সুকুমার জেলের মেয়ে। দশমীর দিনে ভোরবেলা পাড়ার পুজামন্ডপে পুরোহিত যখন দুর্গামন্ত্র পাঠ করছিলেন তখনই নাকি আমার জন্ম হয়। সেইজন্যই  আমার ভক্তিমতী মা আমার নাম রেখেছিলো বিজয়া। সবাই বলে পড়াশোনায় ছোটবেলা থেকেই আমার মাথা নাকি পরিস্কার! একবার পড়লেই সব পড়া মনে থাকে। দিদিমনি বলতো "শোন বিজয়া যতো কষ্টই আসুক জীবনে পড়া ছাড়বি না। একদিন তোকে অনেক বড় হতে হবে। মাথা উঁচু করে বাঁচতে হবে, বুঝলি!" ক্লাস এইট পর্যন্ত ভালোই চলছিলো। সরকারী বই খাতা, মিড ডে মিলের গরম ভাত, ডাল, তরকারী। বাদ সাধলো নাইনে উঠে। মিড ডে মিল টা বন্ধ হয়ে গেলো। টিফিনবেলা পেটের ভেতর হাকুড় পাকুড় করে খিদার রাক্ষস। হেড দিদিমনি বলেছিলো বটে খিদে পেলে দিদিদের কাছে যাবি। কিন্তু মিড ডে মিলের রাঁধুনি দিদিরা খুব রাগ করে রোজ রোজ খেতে গেলে। বলে "তুই এখন নাইনে উঠে গেছিস।তোর এখন খাওয়া নাই।"


অগত্যা সকাল বেলাটা লোকের ঘরে কাজ নিলাম।এভাবেই চলছিলো জানেন। মাথার ওপর চাল নেই, পেটে ভাত নেই, শরীর ঢাকার পোশাক নেই। এই এতো এতো নেই এর মাঝে থাকার মধ্যে শুধু টানটান শিরদাঁড়ার ওপর শক্ত হচ্ছিলো একটা খাঁড়া মাথা। যা আপনাদের চোখে পড়েনি এতোকাল। আপনারা দেখেছেন আমার গায়ের ফর্সা রঙ, উঁচু বুক, পেলব পেট, মসৃণ নিতম্ব! 


এই এতো এতো রক্তচক্ষুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে বুঝে উঠতে পারছিনা কোথা থেকে শুরু করবো। তবু বলতে আমাকে হবেই। সেই কোন ছোটবেলা থেকে  দেখে এসেছি আপনাদের মতো ভদ্র পোশাক পরা বাবুদের স্যাঁতসেঁতে আঙুল, ধারালো দাঁত নখ একটু একটু করে খুবলে খেয়েছে আমাকে। আমার মতো গাঁয়ের আরো অনেক অনেক মেয়েকে। আমি জানি আপনারা আমাকেই দোষ দেবেন। আমার জন্যই নির্ধারিত হবে শাস্তির বিধান। সেই কোন ছোটবেলায় মায়ের সাথে বড়বাবুর বাড়িতে কাজ করতে আসতাম। তখন কতই বা বয়স বারো কী তেরো। শরীরে কেবল উঁকি দিচ্ছিলো যৌবন। একদিন বড়গিন্নিমার ছোটছেলে মাথা টিপে দিতে একা ঘরে  ডেকে নিলো। তারপর আমাকে ইচ্ছেমতো... উহ্ কী ব্যথা! সাতদিন বুকের ব্যথায় থাকতে পারি না। মা কে বলতে গেলে মা উল্টে  আমাকেই শাসিয়ে  দিলো। "চেপে যা! কাউকে যদি বলেছিস! জানিস এসব কথা কাউকে বলতে নেই! কেন গেলি ছোটবাবুর ঘরে একা? জানিস না বাবুদের বাড়ি বাঘের গুহা। ওখান থেকে কেউ আস্ত ফেরেনা!" সেই থেকে আর কোনো বাবুর ঘরে একা ঢুকি না। মহিলা সমিতির সভাপতি চম্পার চোখে চোখ রেখে বললাম  "তোমার মনে আছে কাকি সেদিন সন্ধ্যাবেলা কুয়োতলায় বাসন মাজার সময় কাকাবাবু আমাকে ফেলে কি করেছিলো! তুমিই তো টেনে তুললে কাকাবাবুকে! আমি ভয়ে কাঁদছি দেখে উল্টে আমাকেই স্বামী স্ত্রী মিলে সে কি শাসানি। কাউকে বললে জিভ টেনে ছিঁড়ে দেবে। আমি ভয়ে কাউকে বলতে পারিনি।বললে তোমাদের বাড়ির কাজটা চলে যেতো। কিই বা করতাম বলো বাপটা তখন অসুখে। সংসারে চার চারটা পেট। মায়ের একার রোজগার। চেপে গেলাম।কাজ করি চুপচাপ। বুকের ভেতর বাড়তে থাকে ভয়, আতঙ্ক!"  "আর তোমার মনে আছে কমলেশ কাকা।সেদিন দুপুরবেলা? বাপ তখন নদীতে গেছে মাছ ধরতে। মাছ ধরে বিক্রী করে চাল আনবে তবে হাঁড়ি চ'ড়বে। পাটকাঠির বেড়াদেওয়া ঘরে ভাঙা দরজা ঠেলে তুমি ঘরে ঢুকে আচমকা আমায় পেছন থেকে ...তোমার অমন সাঁড়াশির মতো হাত থেকে কিছুতেই ছাড়াতে পারলাম না নিজেকে। চিৎকার করতে পারলাম না মুখটা চেপে ধরেছিলে জোরে। উহ্ কী ব্যথা। কতোক্ষণ আমাকে ছিঁড়ে খেয়েছিলে মনে নেই। যখন হুঁশ এলো তখন আমার দু পায়ের ফাঁকে রক্তের নদী। যেতে যেতে বলে গেলে চিন্তা করিস না বিজয়া। এই নে ট্যাবলেটটা খেয়ে নে। পেট হবে না।মাঝে মাঝে এমন সময় সুযোগমতো আমি আসবো। আর তোকে এমনি করে আদর করবো। তোর বৌদি পোয়াতি কি না। সুখ দিতে পারে না। তোর শরীরে তো সুখই সুখ। তারপর ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে বললে আর যদি ট্যাঁ ফোঁ করেছিস তোর গোটা গুষ্টিকে কচুকাটা করে ইকতির জলে ভসিয়ে দেবো। বুঝলি?" 


সভায় তখন পিন পতনের শব্দ নেই। আমি কারো দিকে না তাকিয়েও বেশ বলে দিতে পারছি কমলেশ কাকা, চম্পাকাকি, মিলিদিদি, ওর বর সবার মুখ তখন রক্তশূন্য। আর বুকের ভেতর ক্রোধের দাউ দাউ। পারলে আমাকে এ মুহূর্তে ভষ্ম করে দেয়। আর বাকি যারা এতোক্ষণ আমার মুন্ডুপাত করছিলো সবাই মাটির দিকে তাকিয়ে। স্থাণুবৎ।


না আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। মনে মনে ফন্দী আঁটছিলাম বহুদিন থেকেই এরপর যে আসবে তাকে এমন জন্মের শিক্ষা দেবো যে আর কেউ আমার দিকে হাত বাড়ানোর আগে দশবার ভাববে। বুকের ভেতর ভয় আর আতঙ্ক। খেতে পারি না ঘুমাতে পারি না। একদিন মোহরদি ডেকে বললে কি রে কি হয়েছে তোর অমন আমসির মতো মুখ করে থাকিস কেন? পড়াশোনায় মন নেই। সবসময় যেন কী ভাবছিস! কি হয়েছে খুলে বল!" একদিন সব খুলে বললাম মোহরদিকে। মোহরদি আমার স্কুলের দিদিমনি। ও হ্যাঁ এইখানে বলে রাখি আমি লোকের বাড়ি বাসন মেজেও স্কুলের পড়াটা ছাড়িনি। মোহরদি আমার স্কুলের নতুন দিদিমনি। মোহরদি না এলে জানতেই পারতাম না আমার জীবনটাও দামী। শুধু বাবুদের বাড়ি কাজ করে আর যখন তখন ওদের দাঁত নখে ছিঁড়ে যাওয়ার জন্য নয়। দিদি আমায় ক্লাসের বাইরেও একটা জীবন চিনিয়েছিল। পাঠ্য বইএর পড়ার বাইরে একটা অনেক বড় জীবন। আমি দিদির ঘরে গিয়ে একটু একটু করে রবীন্দ্রনাথ পড়েছি। পড়েছি আশাপূর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী, বুদ্ধদেব গুহ। পড়েছি সুনীল গাঙ্গুলি। মোহরদি  আমার বুকের ভেতর জ্বালিয়ে দিয়েছিলো একটা তেজালো আগুন। দুর্গামন্ডপে নিয়ে গিয়ে চিনিয়েছিলো আমার ভেতরে যে অসুরনাশিনী শক্তি আছে তার রূপ! দিদি বলেছিলো এ শরীরটা শুধু তোর বিজয়া। তোর ইচ্ছের বাইরে কেউ ছুঁতে চেষ্টা করলে নিজের ভেতর জাগিয়ে তুলবি অসুরদলনী মা কে। মা দুর্গা দশহাতে দশ অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছিলো তুই একহাতে পারবি না? এই কথাটা মনে রাখবি রবি ঠাকুর বলেছেন "যার ভয়ে ভীত তুমি সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে / যখনি জাগিবে তুমি তখনই সে পলাইবে ধেয়ে" 


হ্যাঁ আমিই। সুবলের লিঙ্গে হাঁসোয়ার কোপটা সেদিন আমিই বসিয়েছিলাম। কি করবো? আমার মাথায় তখন ঝলকে উঠেছিলো আগুন। মা দুর্গা ভর করলো আমার শরীরে, মনে। বিশ্বাস করুন আমি বাধা দিয়েছিলাম সুবলকে বারবার। কেঁদে বলেছিলাম ছেড়ে দে সুবল আমার শরীর খারাপ হয়েছে!" বাবা গিয়েছিলো জাল নিয়ে হলং নদীতে  মাছ ধরতে। মা গিয়েছিলো কুসুমদের বাড়ি সিঁদূর খেলতে। ছোটবোনটা মায়ের সাথে গিয়েছিলো। ভাইটা ভাসান দেখতে। আমি ছিলাম একা। সেই সুযোগে সুবল ঘরে ঢুকেই ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার ওপর। কামড়ে খামচে একসা করে দিলো আমাকে! কোনমতে হাত ছাড়িয়ে বালিশের তলায় হাত ঢোকালাম। সুবল তখন উন্মত্ত! হাঁসোয়া টা হাতে ঠেকতেই কোনকিছু  না ভেবেই বসিয়ে দিলাম কোপ। না গলায় কোপটা দিই নি। আমি তো সুবলকে মেরে ফেলতে চাইনি।চেয়েছিলাম ওর পুরুষাঙ্গটাকেই... আমার কোনো আক্ষেপ নেই জানেন। আমার কোনো  খেদ নেই, লজ্জা নেই, কোনো অনুতাপ নেই এর জন্য। বরং এতোদিনের অপমান, ভয়, আতঙ্ক থেকে আজ আমি আমাকে মুক্তি দিয়েছি। আপনারা মহৎজন। বিচারে আমার কি শাস্তি হবে এ নিয়ে এতোটুকু পরোয়া করি না।


আজ শুধু বলতে চাই "হ্যাঁ মোহরদি আমি পেরেছি। তোমার জ্বালানো আগুনে আমার শোক - তাপ - দুঃখ - ভয় - অপমান সব  কেমন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাঁটি সোনা হয়ে উঠছি একবার এসে দেখে যাও মোহরদি। একবার এসে দেখে যাও।

Comments