লুকোচুরি
(সুন্দরবনের ভাষায় সুন্দরবনের গল্প)
রাখাল,
নৌকা ঘোরা শীগগির…
বলেই রাধাখুড়ো তাড়াতাড়ি জল থেকে জালের শেষ প্রান্তটা হিচড়ে নৌকায় তুলে নিল।
আকাশে তখন কালো মেঘের ঘনঘটা। চারিদিক যেন ধীরে গিলে ফেলছে কামটের মতো।
খুড়োর হাঁকে রাখাল চমকে গিয়ে তড়িঘড়ি নৌকার হালটা হাতে নেয়…
কী যেন ভাবতে ভাবতে বলে…
"খুড়ো, আরেট্টু দেরি কুরে গেলি হুতো না? মাছ তো ভালুই পুড়তোলো…"
খুড়ো রাখালের কথাটা কানে শুনলো বটে, কিন্তু তাকিয়ে রইল আকাশের পানে… তারপর বলল, "গতিক ভালো ঠিকতেছে না রে… সেবারো ধনাটাকে রাখে গেলাম এরাম লোভে পুড়ে রে…"
বলতে বলতে খুড়োর গলা ভারি হয়ে উঠলো……
ধনা আসলে ধনঞ্জয় খুড়োর বড় ছেলে। বেশ কয়েক বছর আগে মহল করতে গিয়ে বাঘের মুখে পড়ে প্রান হারায়। সেবার ওরা বাপ-বেটা তিনজন গিয়েছিল মাছ ধরতে।
সুন্দরবনের ঘন জঙ্গলের খাঁড়িতে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। তবে সেখানে মাছের পাশাপাশি ঝুঁকিও আছে তেমন। ঘন জঙ্গলের খাঁড়িগুলিতে ওত পেতে বসে থাকে সুন্দরবনের পাহারাদার দক্ষিন রায়।
সদ্য বিয়েতে প্রচুর খরচের পর সংসার সামলানোর জন্য বাপ-বেটা ঝুঁকির পথেই সেবার পা বাড়িয়েছিল। আসলে সুন্দরবনের মানুষের সাথে এখানকার জলের কুমীর আর জঙ্গলের বাঘের লুকোচুরি খেলা এমনি করে চলতেই থাকে।
সেবার খুড়োদের নৌকা যখন বাড়ির ঘাটে ফেরে… তখন গোটা গ্রাম ভেঙে পড়েছিল নদীর পাড়ে।
ছোট ছেলে পরাণ হাল ধরে কাঠের পুতুলের মতো বসে আছে, আর খুড়োর কোলে আধ-খাওয়া ধনার মুণ্ডুহীন দেহ।
খুড়োর বুকফাটা কান্নায় সন্তান হারানোর যন্ত্রণা নিকড়ে নিকড়ে বেরোচ্ছিল… "ও ধনারে, তোর মাকে আমি কী জবাব দ্যাবো রে…
ও বাপ, তুই একবারডা ওঠ বাপ…
বাবা বুলে ডাক…,
ও ধনা রে…… হা… হা…"
সে ঘটনা রাখালেরও মনে আছে। সদ্য লায়েক হয়েছে রাখাল… তাই কৌতূহল আটকাতে না পেরে বলল… "সেদিন কী হুয়োলো খুড়ো? এট্টুখানি বলবা?"
বলেই রাখাল নৌকার হালে মোচড় দিয়েছে… নৌকা বাঁক নিয়ে জঙ্গলকে পিছনে ফেলে এগোতে শুরু করেছে…
খুড়ো তখনো আকাশের দিকে চেয়ে…… ওদিকে ঘন কালো মেঘের বুক চিরে মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি চলছে…
খুড়োর চোখের জলে চিবুক চিক চিক করে উঠলো… খুড়ো বলতে শুরু করেছে…… "সেবার বোশেখ মাসে ধনাডার বে দেলাম।
পাঁচ জনের সংসার ছ'জোন হুলো… বে তে বেশ খরচ হুয়েলো…
বে-শাদী মিটলি, ধনা বুললো- 'বাবা, চলো নৌকা নে বার কতক জঙ্গলে যাই। আমাগো ধার-দেনা মিটে গেলি আর যাতি হবে না।"
মনডা শুনেই কু গায়্যে উটলো… তবু সংসারে যা অবস্থা, তা ভাবে রায় দেলাম।
দু-তিন বার যাবার পর ধার-দেনা মিটে গেলো।
ধনা বুলল- "বাবা, এবারডা গে, আর যাবো না। এবারে যা হবে বৌডার জন্যি এট্টা গয়না দ্যাবো, ওরে তো বের সময়ও কিচ্চু দিতি পারিনি আমরা।" সত্যিতে বৌডাকে কিচু দিতি পারিনি ভাবে ধনার কথায় সায় দেলাম।
সেদিন মাছ ধরা প্রায় শেষের পতে, হঠাৎ আকাশ ছায়্যে গেলো ঘন কালো মেগে…..
আমি বললাম- "ধনা গতিক ভালো না রে বাপ। চল যা হুয়েচে, তা নে রওনা দেই…"
ধনা বুলল, "বাবা, আরেট্টু থাকে যাই, জালডা সবে দিচি। খানিক্ষন পরেই তুলে নিচ্চি……"
বুলে ওৎ পাতে বুসে রুলো…
হঠাৎ বৃষ্টি নামলো,
চারিদিকে জলে জলাকার……
দুম-দাম বাজ পড়তি লাগলো……
কারো কতা কেউ শুনতি পাচ্চি নে…
ধনা জাল গুটাতি শুরু কুরেছে। এমন সময়……… ওর জালের দড়ি গেলো আটকে…
ও আমার হাতে জালডা ধরিয়ে দে জলে নামে গেলো…… এগুতে এগুতে সামনের গামো গাছের ঝোপের তলায় যেই গেছে, "বাবা গো" বুলে চিল্লে উঠলো…
ঝপাত করে জলে ঝাপিয়ে পুড়ে চকির সামনে দে ধনাডারে তুলে নে যাচ্চে সে……
আমি...আমি... আমি… কিচ্চু করতি পারলাম না রে রাখাল… কিচ্চু করতি পারলাম না… পরাণ লগি নে লাপ দে জঙ্গলে ডুকোলো ওর দাদারে বাঁচাতি……… আমার ধনা আর ফিরলো না……"
বলতে বলতে খুড়োর দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে চলেছে………
হঠাৎ নামা বৃষ্টির জলে আজ একাকার খুড়োর বুকফাটা কান্না,
সদ্য লায়েক হওয়া রাখাল তার গভীরতা কতখানি বুঝেছে, তা জানি না…
কিন্তু আকাশে ততক্ষণে রেফারী লুকোচুরি খেলার বাঁশি দিতে শুরু করেছে… কড়্ কড়্ কড়াৎ……
মানুষের দরবারে আমার সৃষ্টিকে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ|
ReplyDelete