নিবন্ধ - পার্থ সারথি চক্রবর্তী


কোচবিহারের গোসানীমারি এক ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনস্থল

      

কোচবিহার জেলার গোসানীমারি অঞ্চল শুধু ঐতিহাসিক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, পুরাকীর্তি ও প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। দিনহাটা শহর থেকে আনুমানিক দশ কিমি দূরে এই অঞ্চল। পুরনো কামরূপ বা কামতা রাজধানীর চিহ্ন সমৃদ্ধ এই গোসানীমারি। এখানের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে সর্বপেক্ষা প্রথমেই আমরা আলোচনা করব কামতাপুর দুর্গ নিয়ে। পালবংশের রাজা গোপাল,ধর্মপাল কামরূপে রাজত্ব করেছিলেন। পরবর্তীকালে  বিজয় সেন কামরূপের রাজাকে পরাজিত করেন। তারও পরে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত যায়। স্টেপলটন বলেন শাসকদের দুর্বলতার সুযোগে এই অঞ্চলে খেন বংশীয় রাজাদের রাজত্বকালের অবসানে  অরাজকতা শুরু হয়। খীয়ানের 'খেন' রাজারা কামতাপুরে আগেই  তাদের  রাজধানী স্থাপন করেন। নীলধ্বজ, চক্রধ্বজ ও নীলাম্বর তাদের রাজত্বকালে অনেকগুলো দুর্গ নির্মাণ করান। মনে করা হয়, তাদের নির্মিত এক  বিশালাকার দুর্গই আজকের কামতাপুর দুর্গ হিসেবে পরিচিত। এই দুর্গ  কামতা রাজ্যকে সুরক্ষা দিত। দুর্গের ভিতর অবস্থিত রাজপাট। যার উচ্চতা ৬০ ফুট আর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ প্রায় ৩০০ ফুটের বেশী। এটি বর্তমানে গোসানীমারি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্ভুক্ত খলিসা গোসানীমারি মৌজাস্হিত। দুর্গের কেন্দ্রে অবস্থিত ছিল রাজপ্রাসাদ। এর একটা অংশ রাজপাট নামে অভিহিত। এর পূর্বে ধরলা নদী থাকায় কিছু জায়গা প্রাচীরবিহীন। পশ্চিম দিকে একটু দূর দিয়ে বইছে সিঙ্গিমারি নদী। পাঁচিলের ভিতরে ও বাইরে গভীর পরিখা ছিল। কামতেশ্বরীর মন্দির এই রাজপাটের এক অনন্য নিদর্শন। দুর্গের সাতটি প্রবেশদ্বার ছিল, যার ছয়টির নিদর্শন আজো বিদ্যমান-শিলদুয়ার, বাঘদুয়ার, সন্ন্যাসীদুয়ার, জয়দুয়ার, নিমাইদুয়ার ও হোকদুয়ার। এগুলোর মধ্যে প্রথমটি পাথরের। বাঘদুয়ারে বাঘের ছবি অঙ্কিত আছে। নিমাইদুয়ার নাকি এই অঞ্চলে চৈতন্যদেবের আগমনের পথ। তবে গোসানীমঙল পুঁথিতে অন্যরকম নাম ও অবস্থানের দুয়ারের কথা বলা হয়েছে। দুর্গের ভিতর কয়েকটি তালুকের উল্লেখ রয়েছে। ভিতরে টাঁকশাল, ভুলাকাভুলকি, পেটলা ইত্যাদি স্থান ছিল। শীতলাবাসে বড় পাথরের তৈরি স্নানপাত্র পাওয়া যায়। এটি স্থানীয় ভাষায় 'শিলখুড়ি' নামে পরিচিত। এখানে অনেক ধাতু ও পাথরে খোদাই করা মূর্তি ও অবয়ব পাওয়া যায়। রূপার মুদ্রা, কামান ইত্যাদিও পাওয়া গিয়েছে। এখন অবশ্য রাজপাটের কাছে কোন দুয়ার দেখা যায় না। প্রাচীরের পাশের পরিখাটিতে সর্বদা জল রাখার জন্য জলাধার ব্যবহার হত যা 'জল উবার' নামে পরিচিত। বাঘদুয়ার থেকে আরেকটি রাস্তা রাজপাট অবধি বিস্তৃত ছিল । এখানে একটি দিঘি রয়েছে যার নাম 'ভোলানাথের দিঘি'। এর সিঁড়ির ধাপগুলো পাথরের তৈরি। এর কাছে বেলেপাথরের একটি মূর্তি পাওয়া গেছে। একে স্থানীয়রা 'সুবচনী দেবী' রূপে পূজো করতেন বলে সন্ধান মেলে। ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় এটি বীণাবাদন রত এক নারীমূর্তি। আরো কিছু স্থাপত্য  যেমন থাম, তোরণ, নারীমূর্তি পাওয়া যায়। এছাড়া রাজপাটের ঢিবির কাছে স্নানঘর, ছোট প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের খোঁজ মেলে। খেন রাজাদের পরে কোচ রাজা বিশ্বসিংহ ১৫১০ সালে কামতেশ্বর উপাধি নেন। তিনি দুর্গ ও রাজপাটের সংস্কার করেছিলেন ব'লে শোনা যায়।


পরবর্তীতে  Archaeological Survey of India  রাজপ্রাসাদের রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব নেয়। কিছু মূর্তি, পাথর, ধাতব পদার্থ লোপাট হয়ে যায় বলে অনুমান। ASI ১৯৯৮ সালে অজানা সংস্কৃতিকে জানতে ও ইতিহাস উদ্ধার করতে খননকার্য শুরু করে। খনন শুরু করা হয় ঢিবির বিভিন্ন অংশজুড়ে পর্যায়ক্রমে। এর আগে আনুমানিক ১৮০৮ সাল নাগাদ ড. বুকানন হ্যামিলটন মানচিত্র সহ রাজপাট ঢিবির একটি বিবরণ দিয়েছিলেন। দেখা যায় ঢিবির এক কোণে একটি ঘেরাওয়ের মাটির দেওয়াল ছিল, যা প্রায় পুরোটাই ভেঙে পড়েছে। সেই সঙ্গে কয়েকটি ইটের দেওয়ালও পাওয়া যায়। খননে খেন রাজাদের সময়কার পাথরের একটি আকৃতি, ইটের তৈরি দুটি গোল কূপ, দীর্ঘ দেওয়াল, একটি মাটির বাড়ির ধ্বংসাবশেষ সহ বহু কিছু উঠে আসে। দুর্গের প্রাচীর পাল ও সেন যুগের নিদর্শন বহন করে চলেছে। একটি বড় পুকুরের সন্ধান পাওয়া গেছে। পুকুরের দুটি স্নানঘাট বর্তমান-একটি পূর্ব দিকে ও অপরটি পশ্চিমে। পুকুরের পাড়ে ইটের প্রাচীর রয়েছে। এই অঞ্চলে লাল, ধূসর, কালো রঙের মাটির তৈরী জিনিসের সন্ধান পাওয়া গেছে।


যেসব জিনিস পাওয়া যায়, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল-

১|  মাটির হাড়ি, কলসী।
২|  মাটির বাটি, থালা, জলপাত্র।
৩|  ধাতব পানপাত্র।
৪|  কারুকার্য খচিত পাত্র(মাটির ও ধাতব)
৫|  বড় গোলাকার খোল ইত্যাদি।
৬|  পাথরের পুরুষ ও নারী মূর্তি।
৭|  টেরাকোটা শিল্পের নিদর্শন (যদিও এগুলোর উৎপত্তিস্থান নিশ্চিত করা যায়নি)।
৮|  মা মনসা দেবীর মূর্তি।
৯|  গিয়াসউদ্দিন আজম খাঁর নামাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা।
১০|  মৃত পশু ও পক্ষীর হাড় ইত্যাদি।


রাজপাট ঢিবির উপরে বহুদিন পর্যন্ত অনেক পাথরের মূর্তি দেখতে পাওয়া যেত। অনুমান করা হয়, কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এই নগরী ধ্বংস হয়। রাজপাট ঢিবি এককথায় সেই ধ্বংসাবশেষের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। এই অঞ্চলের অদূরেই আছে কামতেশ্বরী মন্দির। দেবী কামতেশ্বরী খেন রাজাদের উপাস্য দেবী ছিলেন। পঞ্চদশ শতকে নীলধ্বজ মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন ব'লে অনুমান করা হয়। আবার এটাও কথিত আছে যে নীলধ্বজ কামতেশ্বর উপাধি নেন এবং মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু নিশ্চিত করে বলার মতো প্রমাণ হাতে পাওয়া যায়নি। নীলাম্বরের পরাজয়ে কামতা রাজত্ব শেষ হয়। পরবর্তী কোচ রাজারা কোচবিহারে রাজধানী স্থানান্তর করেন। ফলে এই নগরী অন্ধকারে হারিয়ে যেতে বসে। রক্ষনাবেক্ষনের অভাব ও হয়ত কোন বহিরাগত শত্রুর আক্রমণ, সব মিলে ধ্বংস হয়ে যায় মন্দিরটিও। ১৮০৮ এ প্রত্নতত্ত্ববিদ হ্যামিলটন আদি মন্দিরটির চিহ্ন পেয়েছিলেন। পরে রাজা প্রাণনারায়ণ (সম্ভবতঃ) বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করান। মন্দিরের চারধারে প্রাচীর। এর দুটি তোরণ, একটি পশ্চিমের প্রাচীর (প্রধান তোরণ) আর অপরটি উত্তরের প্রাচীর। তোরণের উপরে নহবতখানায় বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজত। পাথরের তৈরি তোরণে অলঙ্করণ করা ছিল। চারটি দ্বিতলবিশিষ্ট মিনার গম্বুজাকার। দক্ষিণ-পূর্ব মিনারে অধিষ্ঠিত ছিল শিবলিঙ্গ ও বিষ্ণুমূর্তি। উত্তর-পূর্ব কোণের মন্দিরে শিব ও ভৈরবীমূর্তি। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে তারকেশ্বর শিব আর উত্তর-পশ্চিম দিকের মন্দিরটি বন্ধ। দেবীর মূল  মন্দিরের সামনে আছে হোমমন্ডপ, ভোগমন্ডপ ও ধ্যানাগার। মূল মন্দিরের সামনে তিনটি মন্ডপ অবস্থিত। রাজা প্রাণনারায়ণ নিত্য পূজো ও রক্ষনাবেক্ষনের জন্য প্রচুর ধনসম্পত্তি দান করে যান। মূল মন্দিরটি ইন্দো-স্যারাসেনিক শৈলিতে নির্মিত। মন্দিরের চূড়ায় অঙ্কিত পদ্ম, কলম ও ত্রিশূল। গর্ভগৃহে পূর্বে রূপোর কৌটোয় রাখা একটি কবচ পূজো করা হত। এছাড়া শিবলিঙ্গ, ব্রহ্মা, নারায়ণ শিলা পূজিত হয়। ব্রোঞ্জের ও কষ্টি পাথরের সূর্যমূর্তি, অষ্টধাতুর গোপাল দণ্ডায়মান। তাছাড়া মন্দিরের দেওয়ালে বিষ্ণুমূর্তি, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গজলক্ষ্মীর মূর্তি অঙ্কিত আছে। দেবী কামতেশ্বরী সম্ভবত মা ভবানী। তবে তা গোসানী কি করে হল, তা বোঝা মুশকিল। মন্দিরের কাছে একটি পুরনো বটগাছ আছে। আজো দেবত্র ট্রাস্টের মাধ্যমে যথাযথ যত্ন নেওয়া হয় এই মন্দিরের।


সবমিলিয়ে পুরাতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকে গোসানীমারির এই অঞ্চল অতীব সমৃদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ।

রাজপাট ১


রাজপাট ২




রাজপাটের পথ


খননে প্রাপ্ত কিছু জিনিস
(ছবি- ইন্টারনেট থেকে লেখক দ্বারা সংগৃহীত)


প্রধান তোরণ ১


প্রধান তোরণ ২


মন্দিরের পথ


দেবী কামতেশ্বরী


কামতেশ্বরী মন্দির ১


কামতেশ্বরী মন্দির ২


সূত্র-
১| কোচবিহারের ইতিহাস- খাঁ  চৌধুরী আমানতুল্ল্যা।
২|  প্রাচীন কোচবিহারের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত- স্বপন কুমার রায়।
৩| উত্তর প্রসঙ্গ জার্নাল।

(ছবি - লেখক)

Comments

Post a Comment