রম্যরচনা - সুনৃতা মাইতি


কলা কেলেঙ্কারি  এবং নিউটনের তৃতীয়  গতিসূত্র 



বাজার করা বরাবরই আমার বিশেষ প্রিয় বিষয়। ভজ বাজারুর মতই বাজার নিয়ে আমার আদিখ্যেতার শেষ নেই। তা এহেন প্রিয় বাজার নিয়েই ঘটল বিভ্রাট। আহা! খোদ সরস্বতী পুজোর বাজার করতে গিয়ে। বাজার করবার মতই সরস্বতীপুজোও  আমার কাছে খুবই প্রিয় একটি নির্ঘণ্ট। সেটা অবশ্য ছোটবেলা থেকেই। একে তো এসময় বাতাসে মিশে থাকে প্রেম প্রেম সুবাস; তার ওপর আবার বসন্তের নির্লজ্জ হাতছানি চারিদিকে। বাঙালির ভ্যালেনটাইন বলে কতা! না গো দিদি দুঃখের কথা কি বলব... পরকীয়া প্রেম-টেমের সুযোগ আমাদের জোটে না। তার ওপর ওই একটু বুকের পাটারও অভাব আছে কিনা। এ বিষয়ে পাড়ার  গুগলজেঠু পুলীনবাবুকে জিগ্যেস করলেই তিনি শৃগাল ও দ্রাক্ষার উদাহরণ সহ এমন হাইপোথিসিস নির্মাণ করবেন যে অতি বড় সমাজবিজ্ঞানীও হুব্বা হয়ে যাবেন। তবে ওই  পরকীয়-প্রেম চর্চাতেই মোক্ষলাভ আমাদের। দুগ্ধ স্হলে ঘোল আর কি!  আমরা মানে গণপতি আবাসনের মহিলা গ্রুপ। আপাততঃ জয়া কাকিমা ও বুলবুলদির হাতেই গ্রুপের হাতে আবাসনের শাসনভার অলিখিত ভাবে ন্যস্ত। আমরা আড়ালে বলি জুলবুল (জয়া+বুলবুল) সরকার। ভারী কঠোর এবং নিয়মপরস্ত সরকার। তা জুলবুল সরকার গেলবারের সরস্বতী পুজোর বাজারের দায়িত্ব দিলেন এই অধম, তস্য প্রিয় বন্ধু অর্পিতা এবং গুরুজন  নীলাকাকিমাকে। গুরুজন হলে কি হবে নীলা কাকিমা ভারী সুরসিকা। পুজোর আগের দিন মৌরি চিবোতে চিবোতে এবং জগৎ সংসারের নানা রকম বৈধ-অবৈধ ঘটনার আলোচনা করতে করতে তিনজনে মিলে আমরা বাজারে রওনা দিলাম। কিন্তু  আমাদের অর্পিতার সমস্যা হল যে তার মাথায় কিছু ঢুকলে সে কোনওভাবেই সেটা ভোলে না। কেনই বা যে বাজারে রওনা হবার সময় বি ব্লক এর পিউ  অর্পিতার কানে পই পই করে বলে দিয়েছিল ...

"দাঁড়ানো সরস্বতী মোটে এনো না। দাঁড়ানো সরস্বতী একছুটে পালিয়ে যায়। সরস্বতী পালিয়ে গেলে ওই ছোট অপোগন্ডগুলোর  কি হবে বুঝতেই পারছ!" 

সেই থেকে বাজারে আসা ইস্তক অর্পিতা ঠিক বসাও নয়, অতিমাত্রায় থেবড়ে বসা সরস্বতী মূর্তি খোঁজায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এমন এক মূর্তি হবে যাতে  মা সরস্বতী সহজে  পালাতে  না পারেন।  অর্পিতা- আকাঙ্ক্ষিত সেই শেকড় সম্ভবা সরস্বতী মূরতি খুঁজতে খুঁজতে আমাদের ঘর্মাক্ত দশা। এদিকে চারিদিকে চরম ভিড়। করোনা তখনও মার্কেটে আসেনি। তাই ভক্ত মানুষজনের ঢল  নেমেছে চারিপাশে। অর্পিতার বিশাল বপু সেই ভিড়ের মাঝে আমাদের জন্য চলার জায়গা করে দিচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন চলমান চীনের প্রাচীর। নীলাকাকিমা তারই মধ্যে দশকর্মা টু দশকর্মা ঘুরে উদ্দণ্ড চেহারার যবের শীষের আপ্রাণ খোঁজ করে চলেছে। ন্যাতানো বস্তু তার কোনওভাবেই পছন্দ নয়।  সেটা যবের শিষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অতএব বাজারে অকাল অষ্টমীর ভিড় ঠেলে এইসব কাস্টমাইসড পছন্দের খু্ঁতখুতুনি সামলে সামনের দিকে এগোতেই দেখি একটি সবজির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রচনা। রচনা আমার পুরোনো পাড়ার বন্ধু। এখনও যোগাযোগ আছে ভালোই। এমনিতে সে ভারী ভালো মেয়ে। পরোপকারে তার জুড়ি নেই। তা দোষের মধ্যে তার একটি পরকীয়া ইন্টুসিন্টু আছে। তা একে গুণ ভাবলে গুণ, দোষ ভাবলে দোষ। পোস্টমডার্নিসমের ভাষায় দোষ-গুণ লাইস ইন দ্য আইস অব দ্য বিহোল্ডার! আপনের ইন্টুসিন্টুর ভাগ্য সুমসৃণ হলে  পরকীয়া অতি সুমধুর মনে হবে। ভাগ্য বিড়ম্বিত হলে জঘণ্য সামাজিক অপরাধ! আর সবার ভাগ্য কি সমান হয়! সৃষ্টিকর্তা স্বয়ংই  সোস্যাল ইনইকুয়ালিটির প্রবর্তক।

তা রচনাকে দেখে দাঁত কেলিয়ে এবং তার হিতাহিতের খানিক খবর নিয়ে সামনে এগুলাম এক কাঁদি কলা কিনব বলে। এদিকে তো পেটের ভেতর প্রবল আইঢাই করছে। আসলে রচনার পরকীয়া কীর্তির হাতে গরম খবর নানা খবর অর্পিতা এবং নীলা কাকিমাকে  সে মুহূর্তে না জানালেই নয়। বাজারের মধ্যিখানের ফলের দোকানে  দাঁড়িয়ে বিষয়টি বেশ রসিয়ে বর্ণনা করছি; হঠাৎ নীলা কাকিমা হাতে চাপ দিলেন। আমার তখন "আজকে আমায় থামায় কে" কিংবা "গুফন কথাটি রবে না গুফনে" দশা।  স্রোতের মতো আগল ভেঙে বেরিয়ে আসছে  কথারা। বিরক্ত মুখে নীলাকাকিমার হাত ছাড়াতেই দেখি অর্পিতার বিশাল বপুর পেছনে ফলের দোকানের ঠিক পাশটি ঘেঁষে আমার দিকে ড্যাবডেবে চোখ মেলে দাঁড়িয়ে আছে রচনা। সব শুনে ফেল্ল নাকি! যাচ্চলে কাকা! এ আবার এখানে কি করে এল! রচনার মুখের ভাবটি তখন ....!! অবর্ণনীয় বলতে পারেন। নীলাকাকিমা এবং অর্পিতা কি করা উচিৎ বুঝতে না পেরে বাজারের ছাউনি ভেদ করে উপরের অসীম আকাশে বিবিধ মহাজাগতিক  বিষয়বস্তু  খোঁজার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সেই মূহুর্তে  নিউটনের গতিসূত্রের প্রতিক্রিয়ার সম্ভাব্য আঁক কষতে কষতে প্রাণ হাতে করে আমরা বিনা বাক্যব্যয়ে একযোগে বাজার থেকে হুড়মুড় করে কোনরকমে বেড়িয়ে এলাম এবং  ভয়ানক আত্মগ্লানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়লাম। আত্মগ্লানির বাড়াবাড়ি হলেই আমি প্রচুর পরিমাণে স্বগতোক্তি করে থাকি। এই যেমন ...

"অত্যন্ত বাজে স্বভাব হয়ে গেছে আমার... ধৈর্য্য বলে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই ...বাড়িতে গিয়ে চা খেতে খেতে কি এই আলোচনা করা যেত না! যেত। বিলক্ষণ যেত। আমারই কেবল তাড়াহুড়ো! ক্লাস নাইনে ফিজিক্স স্যার কত করে বলেছিলেন... ওরে... স্হান - কাল - পাত্রের সূত্রটা আঁক কষে কষে মুখস্থ কর .... তখন আমি সে কথা শুনলে তো! সিলেবাসের বাইরের সব পড়াতেই বেশি উৎসাহ তখন। ওই জন্যই তো এই জীবনে আর সায়েন্স পড়া হলোনা। সরস্বতীও  মিটিমিটি হাসলেন! আর  অংকতে তো অট্টহাস্য! ফলে বাংলার নলেজ সোসাইটিতে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়েই জীবন কেটে গেল!" 


তা যা হোক পরদিন যথা সময়ে পুজো আরম্ভ হলো এবং  আমাদের সদানন্দ ঠাকুর মশাই দুলে দুলে মন্তর পড়তে আরম্ভ করলেন। সদানন্দ ঠাকুরমশাই এর মতে এ "পিথিবি" নাকি ধীরে ধীরে উচ্ছন্নে যাচ্ছে। তার মুখ্য কারণ মহিলারা ঘরের কাজ শিকেয় তুলেছে। রুটি বানাতেও তাদের অনীহা। সেটিও কিনে খায়। কি অনাচার!  পুজোর মাঝে মাঝে এইসব সদানন্দীয় টীকাভাষ্য শোনাটা নিতান্তই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। ফেমিনিষ্ট অর্পিতা দাঁত কিড়িমিড়ি করতে করতে এইসব বক্তব্য নির্বিবাদে হজম করছিল। আমরা সদুবাবুর কথার কস্মিনকালেও কোনও উত্তর দিইনা পাছে পুজোর ব্যাঘাত ঘটে। তাছাড়া সরস্বতী পুজোর মত এত গুরুত্বপূর্ণ  পুজোর মন্তরে যেমন তেমন কিছু  বিপাক ঘটে গেলে দুর্দশায় পড়বে ওই পুর্ব উল্লিখিত ছোট অপোগন্ডগুলোই। পুরুত মশাই এর ঘন্টাধ্বনির মাঝেই হঠাৎ শুনি জুলবুল সরকারের প্রবল তর্জন-গর্জন।  বুলবুলদি বাঘিনীর মত রোর করছেন....

"কলার কাঁদি কই!"

অবশেষে বোঝা গেল গতকালের পরিস্থিতির চাপে পয়সা দিয়েও কলা বাজারের ফলের দোকানেই ফেলে চলে এসেছি। ওমাগো! টুরু সূত্র!  নিউটনের তৃতীয় সূত্র তো অভ্রান্ত হে!  জয়া কাকিমার মাথা ঠাণ্ডা। তিনি সদুঠাকুরকে ভুজুং ভাজুং দিয়ে অতি সত্বরই কলার শাস্ত্র - অনুমোদিত বিকল্প খুঁজে বের করলেন। কলা- কেলেঙ্কারি ঠেকনা দিয়ে তখনকার মত  সামাল দেওয়া গেল বটে কিন্তু জুলবুল সরকারের দণ্ড থেকে বাঁচা মুশকিল। 


জুলবুল সরকার সেদিনই ফরমান জারি করল যে আমার এই আতাক্যালানে আচরণের  শাস্তিস্বরূপ  "রচনা" এবং তার যাবতীয় কীর্তিকলাপ সকলকে বিস্তারিতভাবে শোনাতে অতি সত্বরই  একদিন আমার বাড়িতে তাদের সকলকে টি পার্টি দিতে হবে। আর হ্যাঁ ... চা এর সঙ্গে চাই নানাপ্রকার সুস্বাদু "টাও"।

Comments

Post a Comment