গল্প - অ্যাঞ্জেলিকা ভট্টাচার্য


ধস     


ঘুড়িটা এখনও দেখা যাচ্ছে আকাশে। সূর্য, ধীরেনের দিকে তাকিয়ে বলল – আরো উপরে উড়বে  না?  
ধীরেনের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠেছে – উড়বে  না কেন? এই দেখ বলে  আরও সুতো ছাড়তে লাগলো। ঘুড়িটা বাতাসে গা ভাসিয়ে উপরে উঠতে লাগলো। এবার ঘুড়িটা মেঘের রাজ্যে কোথায় যে চলে গেল!  আর তাকে দেখা গেল না।
সূর্য অবাক হয়ে বলল – এত উপরে! হারিয়ে গিয়েছে  মনে হয়!
- না না। সুতো গোটাতে শুরু করলেই আবার চলে আসবে। ধীরেন খুব মনোযোগ সহকারে লাটাই গোটাচ্ছে আর আকাশের দিকে তাকাচ্ছে।  
কিন্তু ঘুরি এলো না। একটা অন্য ঘুরি হুট  করে এসে ধীরেনের ঘুড়ি ভোকাট্টা করে চলে গেল। ধীরেন রেগে গিয়ে বলল – এই সূর্য তোর জন্য হল। ভালো করে সুতোতে মাঞ্জা দিতে পারে না। আর কথা বলবি না।
সূর্যর একটু রাগই হল। ভাতের মাড়, কাঁচগুড়ো দিয়ে সুতোতে তো সেই মাঞ্জা দেয়। হাত কেটে যায় প্রতিবার।
ব্যাস দুদিন দুই বন্ধুতে কথা নেই। 

কিছুক্ষনের জন্য ধীরেন আর সূর্যর বয়েস পঞ্চান্ন  বছর পিছিয়ে গিয়েছিল। ধীরেনের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে – মনে হয় যেন এই সেদিনের কথা। সারা দুপুর ঘুড়ি উড়িয়ে বেড়াতাম। এবার তো বিশ্বকর্মা পুজো চলে  গেল। ছোট নাতিটা একটা ঘুড়ি ওড়াল না। হোটেলে যে আর কদিন থাকতে হবে কে জানে? 
সূর্য এতক্ষন গুম মেরে বসে ছিল – ধীরেন,  আত্মীয়র বাড়ি থাকতে ভাললাগে না। কেমন একটা অস্বস্তি হয়। মেট্রোর কাজ যে কবে শেষ হবে? বাড়ির যা ক্ষতি হয়েছে তা সারাতে এখন দেরী আছে।  

ধীরেনের অবস্থা আরও শোচনীয়। - আমাদের দুশো বছরের পুরন বাড়ি। কেমন ঝুরঝুর করে  ধসে গেল! আমার নব্বই বছরের মা ভেবেছিল যে বাড়িতে পালকি করে বউ হয়ে এসেছে। সেই বাড়ি থেকেই শেষ যাত্রায় বেরবে। রোজ জিজ্ঞেস করে “বাড়ি ফিরব কবে?” 

সূর্য দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে – মেট্রোর উন্নতি হবে। মানুষ কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে যাবে। ধীরেন তখন কী কেউ আমাদের কথা মনে রাখবে? তোর কি মনে হয় এটা আমাদের আত্মত্যাগ নয়? নিজের বাড়ি বিনা প্রতিবাদে ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। 
সত্তর বছরের ধীরেনের মাথায় বেশি চুল নেই। টাকের উপর হাত বুলিয়ে বলল – আত্মত্যা! বাড়ি না ছেড়ে উপায় ছিল? পোস্তায় ব্রিজ চাপা পরে যে মানুষগুলো মারা গিয়েছিল তাদের আমরা দিনে কবার মনে করি রে? এটাও জলভাত কেস সবাই ভুলে যাবে। ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো জিন্দাবাদ। একটা বিড়ি দে। মায়ের ব্লাড রিপোর্ট গুলো নিতে যেতে হবে। শরীরটা  ভালো  না মায়ের।

সূর্যের মাথা ভর্তি পাকা চুল। কপালে ভাঁজ পড়েছে। মুখে মলিন হাসি – ভালো থাকবে কী করে? আগে মাসিমাকে এই বয়েসেও দেখেছি একতলা দোতলা ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যে দিতে। বড় ঘর, সিঁড়ি সারা দিন পায়ে পায়ে ঘুরে  ক্লান্ত হতেন না। 
ধীরেনের চোখের কোনায় জল চিকচিক করে উঠেছে – হ্যাঁ এখন হোটেলের রুমে দমবন্ধ হয়ে আসছে। বলছে – খোকা বাড়ি নিয়ে চল আমায়।  দুই ছেলে বলছে বাবা বাড়ির মায়া ত্যাগ করো। চলো কোথাও ফ্ল্যাট কিনে নি। কিন্তু জীবনের এতগুলো বছর যে বাড়িতে কাটালাম। আজ এই বয়েসে দু কামড়ার ফ্ল্যাটে কী বাঁচতে পারবো? মেট্রো থেকে বলেছে যদিও বাড়ি করে দেবে। 
সূর্য হাসল – কনক্রিটের একটা বাড়ি করতে পারে কিন্তু বাড়ির ইটে যে স্মৃতি, ইতিহাস ছিল! সেগুলো তো ধুয়ে মুছে সাফ  করে দিয়েছে।
দুই বন্ধু উঠে পড়ল বেঞ্চ ছেড়ে। রাস্তার উপর জগার  চায়ের দোকান এখন ভরসা। আগে দুবেলা এই দোকানে  দেখা হত।  সকালে বাজারে মাছ নিয়ে দুজনে দড়াদড়ি করত। তাদের এখন সপ্তাহে দুদিন কি তিনদিন দেখা হয় জগার  দোকানে। এই পাড়ার আরও কত মানুষ ঘর ছাড়া! পুজোর সময় আর জমিয়ে আড্ডা দেওয়া হবে না। দুই বন্ধু আলোচনা করতে করতে পা বাড়াল।  

নব্বই বছরের সুরবালা খাটে এলিয়ে শুয়ে আছে। আজকাল আর টিভি দেখতে ভাললাগে না তার। আগে সব সিরিয়াল তার মুখস্ত ছিল। কোন বউ শাশুড়িকে ধোঁকা দিল, কোন শাশুড়ি বউকে জব্দ করল, এগুলো দেখতে দেখতে দিন কেটে যেত। এখন টিভির দিকে ফিরেও তাকাতে ইচ্ছে করে  না। চোখের মধ্যে ভাসে বাড়ির চাতাল, খিড়কি, লাল পাথরের বৈঠকখানা। থেকে থেকে খালি দীর্ঘনিঃশ্বাস পরে। 
বড় নাতির মেয়ে সুমি সুরবালার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল – থাম্মি তোমার ফেভারিট সিরিয়াল। বউটা মরেনি। আবার বেঁচে উঠেছে। 
সুরবালা সেদিকে মুখ না ঘুড়িয়ে বলল – সবাই বেঁচে থাকুক। সবাই ভালো থাকুক। কথাগুলো বলে চোখ বন্ধ করলেন।  
সুমি  অন্য সময় হলে থাম্মিকে জড়িয়ে আদর করে কিন্তু এখন কি  ভেবে হোটেলের রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। 

বড় পরিবার। সুরবালার দুই ছেলে, দুই বউমা,  দুই নাতি, নাতবৌ তাদের ছেলে মেয়ে। সবাই হোটেলের আলাদা আলাদা রুমে আছে। সুরবালা,  বড়নাতির মেয়ে সুমির  সঙ্গেই থাকে।

কদিন ধরে সুরবালার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। খালি চোখের সামনে পাক খাচ্ছে পুরনো স্মৃতি।স্বামী বেঁচে থাকতে কোনোদিন কোথাও ঘুরতে যাননি। স্বামী বলতেন এই বাড়ি আমার কেদার, বদ্রি্‌, পুরী্‌, কাশী।  ঘরকুনো মানুষটা পুজোর সময় চৌধুরীদের ঠাকুর দালানে গিয়ে বসত। শুনেছে এবার নাকি চৌধুরীদের পুজো নাও হতে পারে।  তাদের বাড়িতেও ফাটল ধরেছে। তারাও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে এই বউবাজারেরই  আশেপাশে কোন হোটেলে থাকছে।

হোটেলের পাশেই একটা বেশ বড় গাছ। বট নয় , কিন্তু কী গাছ সুরবালা বুঝতে পারে না। একটা পায়রা গাছের শুকনো ডাল, পাতা মুখে নিয়ে হোটেলের ছাদের দিকে বার বার উড়ে যাচ্ছে আবার আসছে। মনে হয় বাসা বানাচ্ছে। পাখিরা সাধারনত তার সন্তান আসন্ন হলেই বাসা বানিয়ে ফেলে। খুব মন দিয়ে সুরবালা দেখতে থাকে। দরজায় টোকা পড়ল। দুজন মনবিদ এসেছেন। মনের খবর নিতে। তাদের নাকি ডিউটি। 
সুরবালাকে বিভিন্ন  প্রশ্ন  উত্তরের পরে আশ্বস্ত করল – আপনি ঠিক নিজের বাড়িতে ফিরে যাবেন।
আজকাল সব কিছুতেই মাথা নাড়ে সুরবালা।

রাতে খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছে। শুয়ে ঘুম আসে না। বারবার উঠে বাথরুম যেতে ভাললাগে না। নিজের মনেই অনেক কথা ভাবতে থাকে। কালকে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। রক্তে নাকি চিনির পরিমান অত্যধিক বেড়ে গিয়েছে ।প্রেসার ওঠানামা করছে। রক্ত পরীক্ষার সব রিপোর্ট  খোকা যদিও জানায় নি।
পাশে সুমি মোবাইল নিয়ে খুট খুট করছে। সুরবালা সেদিকে তাকিয়ে বললেন  – সুমি, সনতদের বাড়ির নিচে যে গিরির সোনার দোকান ছিল। ওদের কি হল? ওরা দোকান পেয়েছে? রাম বাবুর মুদির দোকান, বিপিন ঘোষের ফুলের দোকান, সব কোথায় গেল? শর্মারা ফটিকদের একতলায় ভাড়া থাকতো, ওরাই বা কোথায় গেল ? 
সুমি আগের মতই মোবাইলে ব্যস্ত – থাম্মি অতো তো কারোর কথা জানিনা। তবে আশেপাশেই আছে নিশ্চয়ই। আজ  সকালে কলেজ যাওয়ার সময় দেখলাম বিপিনবিহারী স্ট্রিটে পথ অবরোধ করেছে। সোনার দোকানের মালিক, কর্মচারী আরও কিছু ছোট ব্যবসায়ী। আসার সময় অবশ্য দেখিনি আর, তখন মনে হয়  অবরোধ উঠে গিয়েছে।
কথা বলতে বলতে হাই তুলছে সুমি।  লাইট অফ করে বলল – থাম্মি ঘুমিয়ে পরো। আমাকে সকালে ডেকে দিও পড়া আছে।

 দূরে রাতের শেষ ট্রামের ঘটাং ঘটাং শব্দ শোনা যাচ্ছে ।চারিধার একটু শান্ত হয়ে এসেছে। জানলা দিয়ে আকাশের তারা দেখা যাচ্ছে। খুব কাছে শিউলি ফুটেছে কারোর বাড়িতে। খুব সুন্দর গন্ধ আসছে। মনটা কেমন পুজো পুজো হয়ে উঠেছে সুরবালার। মাঝে মাঝে বহু পুরনো স্মৃতি, চোখের সামনে যেন ঝিলিক দিয়ে ওঠে। 
দুর্গা পুজোর ঠিক আগে আগে খুরতোত ননদের ছেলের অন্নপ্রাশনে বীরভূমের সাঁইথিয়া গিয়েছিলে। ময়ূরাক্ষীর তীরে কাশের বনে ছোটদের মতো লুকোচুরি খেলেছিল। বাগানে শিউলি কুড়িয়েছিল। গ্রামের আটচালাতে মূর্তি গড়া দেখেছিল। ছেলেমেয়েরা তখন ছোটছোট। ওরাও খুব মজা পেয়েছিল। ময়ূরাক্ষীর জলে সাঁতার কেটেছিল, বান মাছ ধরেছিল। রাতে সেই মাছ রান্না  করেছিল।বাড়ির পাশেই ছিল একটা বড় ছাতিম গাছ। সন্ধ্যে হতেই তার গন্ধে চারিদিক মম করত। ফেরার সময় ননদ একগোছা কাশফুল সঙ্গে দিয়েছিল।

পুজো সেবার বউবাজারের  বাড়িতেই কেটেছিল। কিন্তু ছাতিমের গন্ধটা নাকে লেগেছিল। মনে হচ্ছিল বাড়ির ঠিক পাশেই বুঝি ছাতিমের গাছ আছে। আজ পর্যন্ত কোন পুজোই বাড়ির বাইরে কাটায় নি সুরবালা। এই প্রথম, আসলে বারিটাই তো আর নেই। আসার সময় স্বামীর ছবিটাও সঙ্গে নিয়ে এসেছে। তিনি কুড়ি বছর হল নেই। মরবার পর আত্মা বলে যদি কিছু থাকে তাহলে ওই বাড়ির ভগ্নস্তূপেই ওনার আত্মা রয়ে গিয়েছে। এটাই বিশ্বাস করে সুরবালা।

কত সাল মনে নেই! সরযূবালা আর জহর গাঙ্গুলির  অভিনয় মুগ্ধ হয়ে দেখেছিল। স্বামী, দেওরের  সঙ্গে সেই প্রথম মিনার্ভায় থিয়েটার দেখা। মনে আছে নাটকের নাম ছিল “কালো টাকা”। ছোট দেওর ব্রজ  আরও কিছু নাটকের বই এনে দিয়েছিল।  কলেজের লাইব্রেরি থেকে নভেল এনে দিয়েছিল। কত গল্প, আলোচনা বেশ ভাললাগত সুরবালার। কিন্তু একান্নবর্তী পরিবারে এসব শোভা   পায় না । শাশুড়ি হাবে ভাবে বুজিয়েছিল - এই বাড়ির সম্মান আছে। অন্দরমহলই  বৌদের জগৎ। বৌদি হয়ে ছোট দেওরের মাথা খেওনা। 
একদিন ব্রজকে  বলেই দিল সে যেন আর তার ঘরে আসে না। কিছুদিনের মধ্যে কলেজ শেষ করে ব্রজ  অনেক দূরে চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিল। আর ফেরেনি। পরে কর্মস্থল থেকে এক্সিডেন্টের  সংবাদ পেয়েছিল।
ব্রজর কাছ থেকে জন্মদিনে একটা নাটকের বই উপহার পেয়েছিল সুরবালা। সেটাই শেষ পাওয়া। মনে মনে ভাবত ভাজ্ঞিস লুকিয়ে পড়াশুনোটা শিখেছিলাম একটু। তাই এত ভালো ভালো  বই পড়তে পারি। ব্রজ, মন্মথ রায়ের “খনা” বইটা দিয়ে বলেছিল – বৌদি মুখস্ত করে রেখো আমি ধরব কিন্তু! 

ব্রজ আর কোনোদিন মুখস্থ ধরার সুযোগ পায়নি। কিন্তু এতবার করে পড়েছিল “খনা”,  সুরবালার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। কতদিন নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল বইটা। আজও হয়ত বাড়ির  ধংস্তু স্তুপের মধ্যে বইয়ের ছেঁড়া খোঁড়া পাতা পাওয়া যাবে। 
“না, না, কি মনে করবেন তাঁরা।  ন, না, তুমি ভুলে যাচ্ছ তিলক তোমাদের সে রাজকন্যা মরে গেছে। আজ আমি সংসারের বধূ। অমন ভাবে আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আমায় লজ্জা দিও না। তুমি বরং ......। ”সুরবালা ঢোক গিললেন। গলা শুকিয়ে আসছে। আবার বলতে শুরু করলেন -  “আসছে সমগ্র  সিংহল ......আমার বাবা? না, না এসব কী? এ কী অন্যায়? আমি বধূ, আমার  স্বামী ...” 
সুমি ঘুমের মধ্যে চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠে বসেছে – কী হল থাম্মি? কী  বিড়বিড় করে বলছ? ঘুমিয়ে পরো।  

সুরবালার আজ নিজেকে সত্যি খনা মনে হচ্ছে। বুকের মধ্যে তীব্র ব্যথা উঠেছে। অস্ফুটে শুধু বললেন – “সিংহলে আর না গেলেও চলবে মিহির”। আর কোন শব্দ পাওয়া গেল না।

Comments