কুয়াশা, শিশির আর ঘাসের উপর তিনি ছড়িয়ে দিতে থাকেন অদ্ভূত এক স্মার্টনেস
প্রসঙ্গ: সুবোধ সরকারের দুটি বই
সুবোধ সরকার। বাংলা কবিতায় একটা নিজস্ব নাম। সুবোধের কাব্যভাষা আর কথার চলাচল ঘিরে একটা সতেজতা খেলা করে। খুব সরাসরি কথা বলেন তিনি।
আমাদের বাংলা কবিতায় কুয়াশা, শিশির আর ঘাসের উপর তিনি ছড়িয়ে দিতে থাকেন অদ্ভূত এক স্মার্টনেস।
এখানেই সুবোধ সরকারের সিগনেচার।
সুবোধ দার দুটি বই জড়িয়ে বসে আছি।
‘যা উপনিষদ, তাই কোরান’ এবং ‘বৈশাখী ও বব ডিলান’।
প্রথমটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৬-এ। আর দ্বিতীয়টি ২০১৮-তে।
নুতন করে আবার পড়ে ফেলতে হলো বইদুটি আমাকে।
সুবোধ সরকারের চেতনার পরতে পরতে দেশ, কাল ও সময়। তার সমাজ ও রাজনৈতিক চিন্তাচেতনায় খুব প্রখর হয়ে থাকে মানুষের আবহমানের যাপন।
খুব তীব্র তার কথনভঙ্গি।
‘যা উপনিষদ, তাই কোরান’- এ সুবোধ সরকার বলেন, বলতেই থাকেন-
এখন বছরে তিনবার ধান হয় বলে
একজন ভিখিরি,একজন পাগলের খাবার
কেড়ে নেবার আগে দুবার ভাবে’
কিংবা-
‘যেসব মেয়ে হারিয়ে যায়,তাদের শাড়ির রং
কেন হলুদ হয় জানেন?
তারা ধানক্ষেত হয়ে ফিরে আসে হেমন্তের আগে।‘
কি তীক্ষ্ণ দেখবার চোখ!শব্দের কি ম্যাজিক বিছিয়ে কবিতার জোতজমি সাজাতে পারেন কবি সুবোধ সরকার।
সুবোধ বলেন আর আমরা শুনি-
‘সোনা পাব বলে ,মাটি তুলে দেখি হিরে
রাজা ও ভিখিরি একইভাবে আসে ফিরে’।
অথবা-
‘একদিন পুলিশের ভয়ে
আমিও পলিয়ে বেরিয়েছি।
খাবার জোটেনি
জঙ্গলে জঙ্গলে আমরা দিন কাটাতাম
তবু সেটা ছিল স্বপ্নের দিন
চা-বাগানের দিন,কয়লাখনির
কবিতার দিন’
সুবোধ সরকার প্রবলরকম বিশ্বজনীন। তিনি আর্ন্তজাইতিক। তার মগ্নতার তরঙ্গে খেলে বেড়ায় আবহমান এক ভুবনবিশ্ব।
কথকঠাকুরের ঢঙে তিনি বলে চলেন-
‘পালিয়ে এসো, হে ব্যালেরিনা
একদিকে আমি বলতে পারি
একদিকে যে পারি না।
ভলগা থেকে গঙ্গা, তুমি বিরাট চর।‘
গোটা বই জুড়ে তীব্র এক মায়া। ঘোর। দ্রোহ, সময় ও প্রেম ছুঁয়ে ছুঁয়ে কিরকম নুতন এক পাঠক হয়ে ফেরা।
সুবোধ সরকারের কবিতা পাঠ আসলে উপভোগ্য এক জার্নির মত।
‘যা উপনিষদ, তাই কোরান’ থেকে যখন আমি ‘বৈশাখী ও বব ডিলান’- এ ঝুঁকে পড়ি তখন আমার এক তীব্র শিহরণ হয়।
এই বইতে সুবোধ লিখছেন-
‘আমাকে কেনা যায় না, আমাকে বিক্রি করা যায় না
আমি বৈশাখী।আমি খরা ও বন্যার মাঝখানে থাকা একটা হরিণাভি’।
কিভাবে পাঠককে আবিষ্ট করে দেন তিনি!
এই তারুণ্য, শব্দের মায়া হয়ে ওঠা পাঠককে ছিলার মত টানটান ও অস্থির করে দেয়!
এখানেই কবি সুবোধের জিত। জিতে যাওয়া।
সুবোধ একদা বলেছিলেন- ‘আজকের কথা আমি আজকেই লিখবো।‘
আর সেই কাজটা তিনি করেই চলেছেন সমস্ত ভ্রুকুটি ও ভান উপেক্ষা করে।
কাকদ্বীপ থেকে কালিফোর্নিয়া, গরম ভাত থেকে মণিপুরের মা সব চলে আসে তার কবিতায়।
কি অসম্ভব তারুণ্য নিয়ে কবি লেখেন-
‘বাবা আমাকে একটা জাহাজের ডেকে দাঁড়
করিয়ে রেখে চলে গেছেন, বলে গেছেন, ’আমি না ফেরা পর্যন্ত নড়বি না। কেউ ডাকলেও যাবি না’।ডাকছে তো অনেকে, অনেক রঙের শত্রু। কী করব বাবা?’
ভালোবাসা, বিরহ,ডিপ্রেশন, খিদে আর পবিত্র রাগ মিশিয়ে তছনছ করে দিতে চান তিনি আমাদের বাংলা কবিতা।
আর বলেন-
‘ভালবাসার উলটোদিকেই অসুখ শুয়ে থাকে’।
তাই-
‘যে দেশ তার লেখকার কবিকে খুন করে
সে দেশ অনিবার্য ভাবে না খেতে পেয়ে মরে’।
কবি সুবোধ সরকার খুব সরাসরি কথা বলেন।কেননা তিনি খুব সরাসরি দেখেন। তার বই নিয়ে মাইল মাইল শব্দ লেখাই যায়। কিন্তু না, আমি চাই পাঠক সুবোধ কে পাঠ করুন। আর নুতন হয়ে উঠুন।
আর পোয়েট্রি ও এন্টি পোয়েট্রির মাঝখানে আমরা দেখি অবিরাম বব ডিলান বাজছেন-
‘আমেরিকার ঝুলপি ধরে
মারছে টান বব ডিলান
গালেয়ামার গালে তোমার
মারছে চড় বব ডিলান’।
Comments
Post a Comment