গদ্য - বনশ্রী রায় দাস



কবিতা আমায় লেখে



আকাশের নীল চাদরে ভালোবাসার অনন্ত শুভেচ্ছা নিয়ে মেঘদূত বয়ে আনে মেঘলা দিনের মল্লার কিংবা বিলাবল। রামধনু রঙ এঁকে বেঁকে যেতে চায় হৃদয় কিনার ঘেঁষে অথচ একটি লাজবন্তি বিকেল বসতে চায় পাশাপাশি, তখন ভীষণ তৃষ্ণা অক্ষর, শব্দালঙ্কার, ধ্বনি তরঙ্গ হয়ে গড়িয়ে পড়তে চায় আশ্লেষে আমার মন-পঞ্জিকার পাতায়। কখনো আবার সামাজিক ব্যাধি অসুখের আকার ধারণ করে ভয়ঙ্কর মৃত্যুর আহ্বানে উল্লসিত হয়ে ওঠে বারংবার। কংক্রিটে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে নিজস্ব ভাবনার চৌহদ্বিতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে দুর্বল প্রাণ-পাখিটিকে কাঁপতে থাকি অসহায়। তখন আমি কবিতা লিখি না কবিতা আমাকে লেখে ভেঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে বিষ বের করে আনে দেহ কাঠামোর অতল থেকে। কখন কোন ধরণের কবিতা ঘর করে ঘরের ভেতর সে বিষয়  নির্ভর করে  সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত দৃশ্যানুভতি জারিত বোধবুদ্ধি চিন্তা চেতনার অনুভবের ওপর। আত্মোপলব্ধির বারান্দায় নিবিড় হয়ে ওঠে।

মেঘলা দিনের এপিটাফ, আকাশের নীল চাদরে প্রিয় মুখ ফুটে ওঠে। রাধার নূপুর মিলে যায় মন কেমনের বাঁশি সুরে যমুনা ভাসে ময়ূর বনে।

কখনো আবার আত্মজীবনীর অংশ বিশেষ হয়ে ওঠে লেখনি।


যে সমস্ত দৃশ্যাবলি দেখার সম্মোহনটুকু আঁচল বিছিয়ে রাখে  আব্রহ্ম জানালার শরীর থেকে সন্ন্যাস  মুছে  তারাবৃক্ষ আলো জ্বালাতে চায় ভাবনার রেণু মাখে  প্রজাপতি, হতে চায় আমার অপেক্ষা ভাবনার মুখর জন্মদুয়ার। অর্গল ভাঙে শ্রাবণ অভিমান অবুঝ মেয়ের আদর-ক্যানভাসে ফুটে ওঠে গৃবাতত্ত্ব। হিম শরীর উন্মুখ আগুন-বাসনায়। 

"গভীর বাতাস থেকে শ্বাস টানি ভারি হয়

নষ্ট হতে হতে নিজের প্রতি ভালোবাসা জাগে,

সোহাগে যত্নে তুলে রাখি নাভি কুন্ডুলী

যার ভেতর লুকিয়ে লক্ষ ভ্রূণের সংকেত"।


চারপাশে যখন শূন্যতার সিঁড়ি দীর্ঘ হয় সাপের মুখে পড়ে  নিম্নগামী যাপন স্রোত। তুল্যমূল্য বারান্দা অতিক্রম করে প্রেম প্রত্যাখ্যান বিরহের-আশ্লেষ খাবি খায়, নিতান্তই পরাজিত ঘোড়া ঘাড় ঝুঁকিয়ে মাটির রংচটা ঘাসে মুখ ডুবিয়ে পরিত্রাণের উপায় খোঁজে। লিঙ্গবৈষম্যের দায়ে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই মৃত্যু ঘটেছে, সেই সমস্ত অবাঞ্ছিত ভ্রূণের অবস্থান নির্ণয় করছে অতিকায় অদৃশ্য হাত ভয়ঙ্করভাবে একটি জন্ম মৃত্যুক্ষণ নির্ণয় করছে। উস্কানিমূলক যৌনতার দায় বহন করে নারী। হত্যা কেবল নিজেই নিজের হত্যা দেখি অনভিপ্রেত আগুনে পুড়ে যাই অবিরত। তখন কবিতা কেবল শব্দাক্ষরে সাজানো শরীর নয়। আত্মা হয়ে জড়িয়ে রাখে এই জীবন। এই ক্ষণস্থায়ী আয়ুর সঙ্গে  বসত করে কতটুকু সঞ্চয়ের ঝুলি পূর্ণ করা যায়? তাই সুখ দুঃখের জীবন চর্চার শেকড়ে গ্রোথিত বোধ হয় কবিতার উপাদান তখন কবি জন্ম দিতে পারেন স্বার্থক কবিতা। শিল্প কর্মের মায়া বৃত্তকে ছুঁয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ডানা মেলে। 

বৃষ্টির পরে রোদ উঠলে মনেও ফসল ফলে      

আত্মসমর্পণের পঞ্জিকা পুড়িয়ে ছাই ভস্ম

তার ওপর চারাগাছ পুঁতেছি পছন্দসই।

দিনান্তে তার বাড়বাড়ন্ত প্রশান্তির আদর

দেয় শরীর ও মনে,

যা একটি জীবন পারেনি দিতে।

                            (কবিতা - জয়ের দিগন্ত)


ক্রমাগত খুন হত্যা রহস্য রাহাজানি জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে ভুলের মাশুল গুনে স্নায়ুবিকারে আক্রান্ত সময়। পিন্ডবৎ অস্তিত্ব চেতনার জড়ত্বের দৃষ্টান্ত। তাই কামনা  আগুনে গ্লানি পুড়িয়ে যে অবশিষ্ট ছাই তাতেই বৃক্ষরোপণ করি।  আকুল অন্তরে বাজে জলের অন্তরা। আর একটি বৃক্ষ জীবনের ভূমিকা মানব জীবনে অভিজ্ঞান দান করে। মানুষের জন্য মানুষ নাও থাকতে পারে কিন্তু একটি বৃক্ষ জীবনের সঙ্গে থাকে আমৃত্যু।

"পৃথিবী ক্রমশ ঢুকে পড়ছে গ্লোবাল ভিলেজ 

একা হতে হতে মানুষগুলো 

হোমাপাখি হয়ে ঢুকে পড়ছে জলন্ত নক্ষত্রের 

                                    অগ্নিগহ্বরে"।


স্মার্ট ফোনের গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব কৈশোর হারিয়ে যাচ্ছে সম্পর্ক। বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, প্রেম এসব যেন কৌতূকে তলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। দৃশ্যের খাঁজে খাঁজে স্থির অন্তর্ঘাত, চুক্তি ভিত্তিক জীবন যাপনে অন্তর্জাল।

ঈশান মেঘে সর্বনাশের অসতর্ক মৈথুন, ভবিষ্যত প্রজন্মকে ঠেলে দিচ্ছে ব্ল্যাকহোলের মুখে। সুন্দরের মাধুরী আজ অনিবার্য ধ্বংসের মুখোমুখি।

"একঝাঁক পাখি উড়ে যাওয়ার পর 

ঘাসে শিশিরের শুকনো দাগে

ঠোঁট রেখে জন্মান্তরের সুরে 

সঙ্গমের গান গায় প্রজাপতি।

তোমার হাসির ভেতর ফুটে ওঠে 

আমার অন্তঃসত্ত্বা দিনের সনেট।



হাঁটতে হাঁটতে তুমি ছেলেবেলা হলে

একটি পালকের জন্মদাগ 

মিশে যায় আমার রক্তে।

তোমার জন্য বন্ধু কিংবা পিতার সম্মান

অথবা আমারই গর্ভের সন্তান।

                                (কবিতা - আত্মীয়তা)


হারমোনিয়ামের  বিভিন্ন রিড ভিন্ন ভিন্ন স্বরে বাজে।  মাতাল করে সুর-সমুদ্র। বিভিন্ন মিঢ়ের গমকে চমকালেও তাদের একত্রে সহবাস। জন্মান্তরের সুরে নেচে ওঠে বিশুদ্ধ  সঙ্গম। মধুর সম্পর্ক বন্ধনে আলো ঢেউ  জ্বালিয়ে সারিয়ে তুলতে পারে সম্পর্কের বিপন্নতা। ভাবনার অবসরে অবগাহনের প্রবাহে নারী পুরুষ পরস্পর হাতে হাত মিলিয়ে সৃষ্টি করতে পারে সুন্দরের। ভালোবাসা, দায়বদ্ধতা দিয়ে এই ভয়ানক অসুখের সময় সকল মানুষের  হৃদয়ে কস্তুরী ফুটুক । নদীর অতল ছোঁয়া নির্জন কথার স্রোতে পানসি ভাসাই অভয়নগরে। কবিতাই  একমাত্র ও শেষ বার্তাবাহক,  আমার মনুষ্য  জন্মের কাণ্ডারী।

Comments