গদ্য - মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস


শীতের গল্পে সপ্তপদী



মাঘ মাস আর বিয়ে এদুটি শব্দে কি মিল কি মিল!ভাবা যায়না। শীতের থরহরি কম্পে ঐ 'বিয়ে' নামক পদার্থ হজম করা নারীকূল থুরি মনুষ‍্যকূলের কাছে এক চ‍্যালেঞ্জের মত। অজস্র কোটি কোটি বিবাহ এ প‍্যানডেমিক কাল পরবর্তীতে এক্কেবারে মুখিয়ে ছিল। আত্মীয় অনাত্মীয় দুকূল সামলাতে গিয়ে সত‍্যিই নাস্তানাবুদ। তা কোনোটায় গেছি কোনোটায় পারিনি। কি করব! মানুষতো আর দশপ্রহরণধারিনীর মত বিভিন্নরূপে বিভিন্নত্র যাতায়াত বা যোগদানের অলৌকিক ক্ষমতা রাখেনা! তবু যেটুকু পারা গেল যাওয়া হল। ...কিন্তু একিরে বাবা! এই মাঘের শীতে বাঘ কাঁপছে আর 'বিউটি পার্লার' থেকে সদ‍্য ফেরা তরুনীকূল কেঠো কেঠো মাথার চুল (এখন সাবলীল ঢেউ খেলানো পছন্দ তালিকায় নেই), নকল চোখের পাতায় অচেনা সাদাটে মুখে একেবারে আয়রন উওম‍্যান হয়ে দু বাহু উদ্বাহু হয়ে জরিদার আঁচলে (সেসব আঁচল এখন শাড়ীর হয়না) উন্মুক্ত পাখির মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। অবশ‍্য সকলকে ভীষণ চেনা হলেও অচেনা। কাউকে দিনের বেলা যেমন দেখেছিলাম রাতেরবেলা চিনতে পারছিনা। তবে মন বলছে, যাকে এসব বলতে যাব সেই বলবে, 'এটা তোমার সমস‍্যা...', ঠিক তাই। আমিও ভাবতে শুরু করেছি এ 'আমি' অন‍্য গ্রহ থেকে এই ঠকঠকে শীতে এসে জুটেছি উৎসব বাড়ীতে। অবশ‍্য একটু পর ই দুরন্ত আলোয় উৎসব পরিবেশ এমন গরম হয়ে উঠেছে যে বোকাটে আমার মত যে ক'জন সোয়েটার পরেছি খুলে ফেলতে হল। তাতে আমাদের নিজস্ব নবীশ হাতের সাজসজ্জার দফা রফা। তা যাক। উৎসব বাড়ি ফেরৎ কুয়াশা ঘেরা পথে আমাদের সোয়েটার বেশ কাজে এসেছে আর মনে মনে গর্বিত হয়েছি। যাকগে, এসব দেখলে একটু পিছিয়ে যাওয়া সময়ের কেবল বিয়ে নামের দুটো দিনের কথা মনে হয়। কিন্তু সেগুলো মনে না করাই ভাল। এখন প্রাদেশিক বা প্রতিবেশী রাজ‍্যের কৃষ্টি সংস্কৃতি ধরে রাখতে অথবা টিভি সিরিয়ালের দীর্ঘদিন ধরে বিবাহের আয়োজন দেখে দেখে বিয়ের ও ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী পেরিয়েও চলছে, চলবে মানে'ক্রমশ। তারমধ‍্যে কয়েকটির নাম আমি জানতে পেরেছি ঐ উঁকি ঝুঁকি দিয়ে। হলুদকোটাতো ছিল ই। কিন্তু রকম বদলে গেছে সিরিয়ালের দৌলতে। তারপর 'সংগীত' (উচ্চারণ বানানের মত নয়, হিন্দী ঘেঁষা হতে হবে)। নইলে ব‍্যাকডেটেড। মেহেন্দী, তত্ত্বসাজানো, আশীর্বাদের ধরণ সব বদলেছে। আরো জাঁকজমকের আরো খানিকটা নিয়মের আধিক‍্যে জর্জরিত (না মাখো মাখো) যাইহোক, এ কুয়াশাঘেরা সকাল কিংবা দুপুর...রাতের দিকে হিমেল হাওয়ার সঙ্গে তাল রেখে বড় মনে পড়ছে বার্ষিক পরীক্ষা শেষে ডিসেম্বরের কয়েকদিন। উঠোনে আগুন জ্বেলে আগুন পোহানো, গনগনে উনুনে ফুলে ওঠা রুটির সঙ্গে খেজুর গুড়ের নরম স্বাদ...যৌথ বাড়ীর রীতিকথা, লোহার কড়ার আগুন উসকে দেওয়া আর ঐ যজ্ঞ আগুনকে সাক্ষী রেখে দিদিদের একে একে সপ্তপদী পার করা। রঙীণ ওড়নার আড়ালে ওদের লালচে আভার মুখে করুণ ছটা আর চন্দন। সেসব কবে চুকে গেছে। যৌথ বাড়ীর সবচেয়ে বড় তিনজন দিদি হারিয়েছে এই শীতেই তাদের পথ চলার সঙ্গীকে। গত জন্মের স্বপ্নের মত ওরা মন দিয়েছে নিরামিশ হবিষ‍্যিতে। অথচ হিমোগ্লোবিন কমতে কমতে সিঁদুরের মতই উবে যাচ্ছে ওদের ধমনীর লাল রঙ। আসলে আমরা আধুনিক ন ই।  আধুনিকতার বড়াই করি। অনেক শব্দ উচ্চারণ করি যা নিজেরা ভাবিনা বা বিশ্বাস করিনা। ...পরবর্তী প্রজন্মের তরুনী তরুনের মুখে চোখে লেগে থাকে বহু প্রাচীন বিবাহ রীতি পালনের লোভ। বুকের ইচ্ছে। দু একজন যারা ব‍্যতিক্রম হাতে গুনে বের করতে হয়। আর তাদের সমাজ দেখে বিস্মিত দৃষ্টিতে। ওরা এক একজন উল্লেখযোগ‍্য নাম তখন। ...'ওরে জানিস, ওদেরনা ভাদ্রমাসে বিয়ে হল। ভাদ্রেতো বিয়ে হয়না, নারে?' আবার শুনি... "ওরে ওরাতো নিবন্ধীকরণের (কার্ডে লেখা ছিল তাই বাংলা উচ্চারণ) বিয়ে করছে।" -মানে? -ঐ রেজিষ্ট্রী শুধু। -তাই? তাহলে আবার নিমন্ত্রণ কেনরে? -কেন?সব ব‍্যবস্থাই আছে। দারুন ব‍্যবস্থা সব। শুধু ওরা ঐ নিয়ম টিয়ম করছেনা। ওদের মা বাবার ইচ্ছে নয়‌-ও! কেনরে বাবা! জীবনেতো একবার ই বিয়ে, তা একদিনে বা কয়েকদিনের রাজা গজা রানী সাজার শখ কার না হয় বল্! ....এই হল গিয়ে শিক্ষিত মানুষজনের সংলাপ। 


আবার সত্তর নয়, আশী নব্বুই এর দশকে বিয়ে হয়ে যাওয়া দুই প্রৌঢ়ার ক্তি, ...বাবা! দেখেছিস কত আয়োজন! ...ইস্ আমাদের সময় এসব কিছুই ছিলনা। এত সাজগোজ, আলো। আমাদের কেমন ম্রিয়মান সব। এখনকার কালে জন্মালে বেশ হত।বল্? সাজগোজ বিবাহ বাসর সব আলাদারকম। ...সত‍্যিই হিংসে হয় ওদের দেখে। ...মাঘ ই হোক বা বৈশাখ 'বিবাহ' মানেই একদিনের স্বপ্ন দেখা রাজা রানী। অজস্র বাজি পটকার নিমেষে পুড়ে যাওয়ার গল্প। আর তারপর? এই জাঁকজমকের ফল প্রচুর আর্থিক বিনষ্টী, এসবের ফল একবছর পুরো হবেতো? না কি সপ্তপদীর আলতারঙ না শুকোতেই শুকিয়ে যাবে ভালবাসার অগাধ সমুদ্র! ...না, এসব কথা সবার জন‍্য নয়। যারা এ শীতেও মেরুদন্ড সোজা রেখে হেঁটে যান আরও কোন মানুষের দিকে...মানুষ মুখ আর শীত কুয়াশা পাশাপাশি রাস্তায় কিভাবে নষ্ট করে মানুষ জন্ম!কিভাবে পাখির বাসা থেকে ডিম ভেঙে পাখি মুখে পালিয়ে যায় রাতের নি:শব্দ নেউল। ...এ শীতে পথ কুকুরের জন‍্য বাড়ীর চৌহদ্দিতে ঘর বানিয়ে দেয় আজো যারা আরো কিছু প্রাণ পৃথিবীতে আসবে বলে, ঠিক তাদের জন‍্য কুয়াশার গল্প লিখি আমি। সেখানে অঝোর ঠান্ডায় মদনমোহন ঠাকুর বাড়ীর নহবত বেজে ওঠে কারো বাড়ীর তোরণে। সে বাড়ীর মেয়ে নিবন্ধীকরণের বিয়ে সেরে পা বাড়ায় অন‍্য শহরের শীত আর নদী নিজের করে নেবে বলে।

Comments

Post a Comment