গল্প - দেবপ্রিয়া সরকার


সুহাসিনী ও শঙ্খচূড়



গাঢ় কমলা রঙের সূর্যটা ঝুপ করে দিগন্তের ওপারে ডুবে গেল কয়েক মিনিট আগে। পশ্চিম আকাশে নতুন নতুন রঙের প্রলেপ পড়ছে একটু পরপর। প্রথমে পুরোটাই ছিল নীল। তারপর গেরুয়া। এখন লালচে গোলাপী। আর কিছুক্ষণ পরেই দিনের অবশিষ্ট আলোকে সম্পূর্ণ মুছে দিয়ে নেমে আসবে সন্ধ্যা। গোধুলির বিষণ্ণ আকাশের দিকে তাকিয়ে জোরে সাইকেলের প্যাডেল চালালাম আমি, সুহাসিনী, ওরফে সুহা।
দু’পাশে সারি সারি গাঢ় সবুজ চা গাছ। একটু দূরে চা পাতার ফ্যাক্টরি। বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসা পাতা চায়ের সুগন্ধ মাতাল করে আমাকে। ডেঙ্গুয়াঝাড় চাবাগানের বুক চিরে চলে যাওয়া সরু ফিতের মতো রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে আমার মন পাড়ি দেয় পাহাড়ের কোল ঘেঁষে থাকা এক জনপদে। চোখের সামনে দিয়ে উড়ে যায় অজস্র রংবেরঙের প্রজাপতি। কানে বাজে নাম না জানা পাখিদের কিচিরমিচির। নির্জন রাতে একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক,  থেকে থেকে কুলি লাইনের আদিবাসী বাজনার দ্রিমিদ্রিমি শব্দের স্মৃতি ব্যাকুল করে আমার মনকে।


নাগরাকাটা চাবাগানের দু'কামরার কোয়ার্টারেই আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা। আমার বাবা হারাধণ মণ্ডল বাগানের গুদামবাবু। মা অনেক সাধ করে আমার নাম রেখেছিল সুহাসিনী। কিন্তু যতদিন এগোতে লাগল তত ম্লান হতে থাকল আমার মুখের হাসি। কানা ছেলের নাম যেমন পদ্মলোচন হলে সে জনগণের কাছে মজার খোরাক হয়ে ওঠে,  তেমনই গোমড়ামুখো মেয়ের নাম সুহাসিনী শুনে অনেকেই খিল্লি করে আড়ালে আবডালে। অথচ এই আমিই নাকি ছোটবেলায় ছিলাম ভীষণ হাসিখুশি, মিশুকে স্বভাবের। মুখ দিয়ে অনবরত ফুটত কথার খৈ। আমার বয়স যখন দশ কী এগারো তখন থেকেই শুরু হল সমস্যাটা। 


বাবা মায়ের মধ্যে প্রায়ই লেগে থাকত খিটিমিটি। বাবার অকারণে মায়ের ওপর চোটপাট, শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে মায়ের দিনভর কাজ করে চলা, গভীর রাতে বাড়ি ফিরে বাবার আরও একপ্রস্থ চ্যাঁচামিচি দেখে দিনদিন কেমন যেন কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম আমি। কোনও কোনও দিন রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে কানে আসত মা-বাবার উত্তেজিত গলার স্বর। শিউলি নামে কোনও এক মহিলাকে নিয়ে লেগেই থাকত ঝামেলা।


তখন অতটা না বুঝলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে পরিস্কার হয়েছে পুরো বিষয়টা। রেশন ডিলার সত্যসাধন মল্লিকের বিধবা মেয়ে শিউলির সঙ্গে আশনাই ছিল বাবার। আর এটাই হয়ে উঠেছিল আমাদের সাংসারিক অশান্তির মূল কারণ। একদিন রাতে মায়ের প্রচন্ড চিৎকারে জেগে উঠি আমি। শোবার ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে দেখি রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের সারা শরীর জুড়ে লেপ্টে আছে দাউদাউ আগুন। মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে কেমন একটা গোঙানির মতো শব্দ। পাশের কোয়ার্টার থেকে ছুটে এসেছিল রবিনকাকা, বিনোদজেঠুরা। বালতির পর বালতি জল ঢেলে নিভিয়েছিল আগুন, নিয়ে গিয়েছিল হাসপাতালে। শুনেছিলাম হাসপাতালে যাওয়ার পর তিন ঘন্টার মতো বেঁচেছিল মা। অস্পষ্ট স্বরে পুলিশকে বলেছিল মা নাকি নিজের ইচ্ছেতেই আগুন দিয়েছে গায়ে, এর জন্যে কেউ দায়ী নয়। হাসপাতাল থেকেই সোজা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল শ্মশানে। মাকে শেষ দেখাটাও দেখতে পারিনি আমি। 


পুলিশ এই কেস খোলার আগেই বন্ধ করে দেয় মায়ের মৃত্যুকালীন জবানবন্দি শুনে। বাবা স্বস্তির শ্বাস ফেলে ছ'মাসের মাথায় বিয়ে করে ঘরে তোলে শিউলিকে। মায়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু হতবাক করে দিয়েছিল আমাকে। শিউলির আগমণে মুছে গেল মুখের বেঁচে থাকা উজ্জ্বলতাটুকুও। উঠতে বসতে সৎমায়ের মুখঝামটা, পাড়া-পড়শিদের ফিসফাস বড্ড কষ্ট দিত আমাকে। 


চাবাগানের প্রতি আমার টান সেই ছোট্টবেলা থেকে। একটু বড় হবার পর মাসিমণির দেওয়া সাইকেল চালিয়ে চলে যেতাম নিজেদের বাগান ছেড়ে আশেপাশের এলাকার বাগানে। নাগরাকাটাকে ঘিরে আছে অনেকগুলো ছোট বড় বাগান। কুর্তি,  জিতি,  হিলা,  নয়াসাইলি,  ভগৎপুর, হোপ ও আরও কয়েকটা চাবাগান থেকে ছেলেমেয়েরা পড়তে আসত আমাদের স্কুলে।  তাদেরই কারও কারও সঙ্গী হয়ে পা বাড়াতাম নতুন নতুন চা বাগিচা দেখতে। বাড়ি ফিরে কপালে অকথ্য বকা, মার জুটলেও সহজে দমবার পাত্রী ছিলামনা আমি। মুখ গোঁজ করে সহ্য করতাম সৎ মা আর অসৎ বাপের লাগাম ছাড়া শাসন। কিন্তু আবার পরদিনই বেরিয়ে পড়তাম নতুন কোনও অভিযানে। 


শান্তিপাড়া বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে আমার সাইকেল বাঁক নিল ডানদিকে। শহরের ব্যস্ত ট্রাফিক পেরিয়ে যখন ঘরে ঢুকলাম, তখন মাসিমণি তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালাচ্ছে। আমাকে দেখেই বলে উঠল, 
-আজও এত দেরি করলি সুহা? কতদিন বারণ করেছি ভর সন্ধে পর্যন্ত বনেবাদারে ঘুরিসনা, তুই উঠতি বয়সের মেয়ে। দিনকাল বড্ড খারাপ। যদি তোর কোনও বিপদ হয় তাহলে তোর বাপকে কী জবাব দেব আমি? অনেক বড় মুখ করে নিয়ে এসেছিলাম তোকে এ’বাড়িতে।
বারান্দার ওপর সাইকেলটা স্ট্যান্ড করে নেমে এলাম মাসিমণির কাছে। তাকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বললাম, 
-আমার কিচ্ছু হবেনা মাসিমণি, তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। আর যদি হয়েও যায় তবুও আমার বাবা কক্ষনও তোমার কাছে কৈফিয়ত চাইতে আসবেনা। বরং জলঢাকা নদীতে ডুব দেবে আপদ বিদায়ের আনন্দে।
শেষের কথাগুলো বলার সময় গলাটা ধরে আসছিল আমার। বাবা আর সৎমায়ের অত্যাচার যখন চরমে উঠেছিল, তখন প্রতিবেশী বিনোদকাকার বউ ফোন করে নাগরাকাটায় ডেকে এনেছিল মাসিমণিকে। মায়েরা দুইবোন। আগে পরে দাদা ভাই কেউ নেই। আমার কষ্ট সহ্য করতে পারেনি মাসিমণি। সঙ্গে করে নিয়ে আসে জলপাইগুড়ি শহরে,  ঠাঁই দেয় নিজের বাড়িতে।  আমার বয়স তখন চোদ্দর কোঠায়। শরীর ও মনের এই পরিবর্তনের সময় আমাকে ছায়ার মতো আগলে রেখেছিল মাসিমণি। বুঝতে দেয়নি মায়ের অভাব।  পেশায় ব্যবসায়ী সুবিমল মেসোমশাই প্রথমটায় সামান্য আপত্তি করলেও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মেনে নেয় সবটা। তার রেডিমেড জামাকাপড়ের দোকানটা একদম দিনবাজারের ভেতরে। আকারে ছোট হলেও পসার মন্দ নয়। নিজের একমাত্র মেয়ে মিতুলের পাশাপাশি আপন করে নিয়েছে আমাকেও।  উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে এখন কলেজে পড়ছি আমি।  দু'চারটে টিউশনি আর শহরের একটা এন জিও তে কাজ করে জোগাড় করে নিই নিজের হাতখরচটুকু। ছোটখাটো প্রয়োজনে মাসিমণির কাছে হাত পাততে বড্ড লজ্জ্বা লাগে আজকাল। 


মাসিমণিদের বাড়িটা বেশ পুরনো।  তার শ্বশুরের বানানো  একতলা ইটের গাঁথনি, ওপরে টিনের চাল। দেওয়ালে সেকেলে চুনকাম করা। লোহার গ্রিল ঘেরা  লম্বা বারান্দার পাশে পরপর কয়েকটা ঘর। একচিলতে উঠোন পেরিয়ে যেতে হয় কুয়োতলা, রান্নাঘর,  স্নানঘরে। বাড়ির পেছনের ফাঁকা জায়গায় মাসিমণি যত্ন করে লাগিয়েছে ফুল, সব্জীর বাগান। ছুটির দিনে আমিও হাত লাগাই মাসিমণির সঙ্গে বাগানের পরিচর্যায়। এন জিওর কাজে আমাকে মাঝেমধ্যেই যেতে হয় গ্রামগঞ্জ, শহর লাগোয়া চাবাগান এলাকায়।  সেখান থেকে নিয়ে আসি চারাগাছ। বারান্দার পাশে প্রথম ঘরটা বৈঠকখানা। তারপর মাসিমণিদের শোবার ঘর। তিন নম্বরটা মিতুলের দখলে। অগত্যা আমার জন্যে বরাদ্দ হয়েছে একদম শেষের ঘরটা। যার এককোণে পাতা রয়েছে ঠাকুরের আসন। আর সকলে আপন করে নিলেও মিতুলের আমার প্রতি শীতল ব্যবহার ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেয় আমি এ’বাড়িতে নিছকই একজন আশ্রিতা। 
হাত মুখ ধুয়ে বারান্দায় পা দিতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এল মিতুল।  হাতে আমারই মোবাইল ফোনটা।  কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, 
-ফোন নিয়ে যাসনি কেন?  আমি কি তোর ফোন রিসিভ করার জন্যে বাড়িতে বসে আছি?
রবিবার ছুটির দিনে এন জিওর কোনও না কোনও অনুষ্ঠান লেগেই থাকে।  আজও দুপুর দুপুর গিয়েছিলাম করলাভ্যালি চাবাগানে। ওখানকার কমিউনিটি হলে সাপে কামড়ানো রুগীদের নিয়ে একটা অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম ছিল। এসেছিলেন সর্প বিশেষজ্ঞ নান্টু দত্ত আর জেলা হাসপাতালের চিকিৎসক ডঃ নীহার হালদার।  তাড়াহুড়োয় ফোনটা বাড়িতেই ফেলে গিয়েছিলাম। আফসোসের স্বরে বললাম, 
-ইস! একদম ভুলে গিয়েছিলাম ফোনটা নিয়ে যেতে। ওখানে গিয়ে দেখলাম ব্যাগে ফোন নেই।  সরি রে। কেউ কি কল করেছিল আমাকে? 
-হুম। একবার নয়, তিন তিনবার! প্রথম দু'বার ইগনোর করলেও তৃতীয়বার রিসিভ করতে বাধ্য হলাম।
ফোনটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে গলার স্বর নরম করল মিতুল। 
-অমূল্য বিশ্বাসের ছেলে হিরণকে তুই চিনলি কীভাবে? 
-হিরণ ? ও তো আমার ক্লাসমেট। আমরা দু’জনেই জিওগ্রাফি অনার্স।  কাল প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসে আমরা একটা ট্রোপোশিট শেয়ার করব তাই হয়তো ফোন করেছিল।
লাজুক স্বরে উত্তর দিলাম আমি। বাঁকা চোখে আমাকে ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত জরিপ করে মিতুল বলল, 
-আমার সঙ্গে হিরণের আলাপ করিয়ে দিতে পারবি তুই? 
-হ্যাঁ, এ আর কী এমন ব্যাপার? কিন্তু কেন বলতো?  হিরণের সঙ্গে কোনও দরকার আছে তোর? 
-উফ্, ইউ আর জাস্ট ইম্পসিবল সুহাদি!  হিরণ এই শহরের মোস্ট এলিজিবল ব্যাচেলর। ওর বাবা উত্তরবঙ্গের নামকরা কন্ট্রাক্টর তারওপর থ্রি স্টার হোটেলের মালিক। কোটিপতি না হলেও লাখপতি তো অবশ্যই।  হিরণের ছ ' ফিট হাইট,  জিম করা সিক্সপ্যাক ফিগার।  এমন একজন হ্যান্ডসাম হাঙ্ককে মিট করার লোভ সামলানো কি সহজ কথা? এবার বল, কবে দেখা হচ্ছে আমাদের? 
মিতুলের মুখের কঠিন ভাব মিলিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। এখন দেখা যাচ্ছে খুশির ঝিলিক।  দাঁত দিয়ে ঠোঁটটা কামড়ালাম একবার। 
-ঠিক আছে আমি হিরণকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে নিচ্ছি কবে কোথায় দেখা করতে পারবে ও।
-প্রোগ্রাম ফিক্স করে আমায় জানিয়ে দিবি, কেমন?
কথাটা বলেই ঘরে ঢুকে গেল মিতুল।  আমি খানিক্ষণ চেয়ে থাকলাম মিতুলের ঘরের দিকে তারপর ডায়াল করলাম হিরণের নম্বরটা।


-ওহ্ এসি টা কি খারাপ নাকি এখানকার?  কী গরম লাগছে, বাপরে! 
-কোথায় রে? এমন কিছু গরম তো নেই! 
-তোর তো ঠান্ডা গরম কোনও সেন্সই ঠিক মতো কাজ করেনা মনে হয়। এদের জ্বালায় আমার মেকআপটাই না খারাপ হয়ে যায়!
মিতুল আমার থেকে পাক্কা দু’বছরের ছোট হলেও কেমন একটা তাচ্ছিল্যের স্বরে কথা বলে সবসময়। ওদের বাড়িতে আমার থাকাটা একেবারেই নাপসন্দ মিতুলের। মাসিমণির আমার প্রতি স্নেহ, ভালবাসা ছোটবেলা থেকেই একটা ঈর্ষার জন্ম দিয়েছে ওর মনে। তাই আমাকে অপদস্ত করার একটা সুযোগও হাতছাড়া করেনা মিতুল। 
খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি আমাদের। দশ মিনিটের মাথায় চলে এসেছিল হিরণ। নীল জিন্স, কালো ভি নেক টিশার্টে দারুণ মানিয়েছে ওকে। চুলগুলোও আজ জেল মাখিয়ে পরিপাটি করে আঁচড়েছে হিরণ। আমি একবার হিরণকে দেখছিলাম আর একবার মিতুলকে। সেও আজ পরেছে ঝলমলে একটা টপ আর ম্যাচিং পালাজো। সঙ্গে মানানসই চোখ, মুখের মেকআপ। মিতুলের গায়ের রঙ বরাবরই ফর্সা। চোখ, নাক তেমন আকর্ষণীয় না হলেও চেহারায় একটা সুইটনেস আছে। উল্টো দিকে আমি শ্যামবর্ণ। নাকও তেমন লম্বা নয়। কিন্তু মা বলত আমার আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে আমার দু’চোখে। আমি যখন হাসি তখন আমার চোখ দুটোও নাকি হাসে। একদিন প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসে হিরণও বলেছিল, “সুহা তোর চোখ দুটো না ভীষণ গভীর। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না”। 
হিরণ বড্ড হাসিখুশি স্বভাবের ছেলে, যে কাউকেই আপন করে নিতে পারে চট করে। মিতুলের সঙ্গেও হিরণের ভাব হতে দেরি হল না। খুব তাড়াতাড়ি ওরা বন্ধু হয়ে গেল একে অপরের। প্রথম প্রথম হিরণের সঙ্গে দেখা করতে গেলে আমাকে সঙ্গে নিত মিতুল। কিন্তু সে পাট চুকে গেল অচিরেই। আজকাল তিস্তার বাঁধে বা রাজবাড়ি পার্কের বেঞ্চে দুজনকে প্রায়ই দেখা যায় পাশাপাশি। মিতুলের হাবভাব বদলে গিয়েছে অনেকটাই। সবসময় কী এক অজানা আনন্দে মজে থাকে যেন। আমার সঙ্গেও আর আগের মতো কঠিন ব্যবহার করে না। সাজ পোশাক সবই পাল্টে গিয়েছে ইদানীং। আমার সহপাঠী মধুজা বলে, প্রেমে পড়লে নাকি মানুষের এমন বদল ঘটে। তবে কি মিতুল আর হিরণ প্রেমে পড়েছে একে অপরের? 
কথাটা ভাবতে ভাবতেই সাইকেল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম রেললাইনের পাশের রাস্তা দিয়ে। ঘোর ভাঙল বুধুয়ার ডাকে। 
-ইস তরফ মেডামজি। উও ঘরমে ঘুসি হ্যায় শালি। 
মাসিমণি বাড়িতে নেই। হলদিবাড়ি গিয়েছে অসুস্থ ননদকে দেখতে। আজ রবিবার, দোকান বন্ধ। তাই মেসোমশাইও গিয়েছে সঙ্গে। ফিরতে ফিরতে সন্ধে হবে। আমি সাইকেলটা উঠোনে স্ট্যান্ড করে দেখলাম সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। সরলা মাসির ছেলের জ্বর। সেও কাজ করে চলে গিয়েছে সকাল সকাল। আমার ডাক শুনে মিতুল ঘর থেকে বেরিয়ে তালা খুলে দিল গেটের। তারপর বিরক্তি মেশানো স্বরে বলল,
-উফ! কী ঝামেলায় পড়েছি! একবার আয় তো আমার ঘরে। 
আমি মিতুলের পেছন পেছন ওর ঘরে ঢুকে দেখি আলমারির পাল্লা হাট করে খোলা। খাটের ওপর ছড়ানো অজস্র জামাকাপড়!  
-এসব কী রে মিতুল? এতো জামাকাপড় দিয়ে কী হবে?
-দেখ না কোন ড্রেসটা আমাকে মানাচ্ছে? 
-কেন? কোথাও যাবি তুই? 
একটা দুষ্টুমির হাসি হেসে মিতুল বলল,
-আজকে বাড়িতে কেউ নেই তাই হিরণকে আসতে বলেছি। এখন আড়াইটে বাজছে। ও চারটে নাগাদ ঢুকে যাবে বলেছে। ঘণ্টা খানেক সময় কাটাবো একসঙ্গে। হি হি হি! তুই কাউকে কিছু বলিস না যেন।  
থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-হিরণ রাজি হল আসতে?
-আসতে চাইছিল না। কিন্তু আমিই জেদ ধরলাম। তাই আর আপত্তি করতে পারেনি।
অনেক বাছাবাছি করে একটা ড্রেস পছন্দ করল মিতুল।
-শোন সুহাদি আমি একটু ঘুমলাম। বিউটি স্লিপ, ইউ নো। ঠিক একঘণ্টা পর আমাকে ডেকে দিস প্লিজ। 
মিতুল শুয়ে পড়ল পাশ বালিশ জড়িয়ে। আমি খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম বারান্দায়। বুকের ভেতর উথাল পাথাল চলছিল আমার। একটা অদ্ভুত অনুভূতি মাথা তুলছিল সাপের ফণার মতো। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম সাইকেলটার সামনে। হ্যান্ডেল থেকে নামিয়ে আনলাম বড় কাপড়ের ঝোলাটা। 

সাইকেলের চাকা দুটো এগিয়ে যাচ্ছে ঝোপ ঝাড় মাড়িয়ে। মোহিতনগর পেরিয়ে গাছগাছালি ঘেরা জায়গা দিয়ে চলেছি আমি। সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। একটা অন্যরকম আনন্দ, পরিতৃপ্তি ঘিরে রেখেছে আমাকে। আমার কাঁধের ওপর থেকে অনেককাল ধরে বয়ে চলা একটা বোঝা যেন নেমে গিয়েছে। হালকা লাগছে ভীষণ। সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম একবার। কত পাখি ডানা মিলে উড়ে যাচ্ছে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। হাত দুটোকে দুপাশে ছড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলাম আমি। অনেক নির্ভার লাগছে আজকে। আচমকা বেজে উঠল স্লিং ব্যাগে রাখা ফোনটা। ওপাশে হিরণের গলা।
-তুই কোথায় সুহা?
-এই তো একটা কাজে এসেছি মোহিতনগরে। 
-শিগগির বাড়ি ফিরে আয়। মিতুল আমাকে আসতে বলেছিল তোদের বাড়িতে। আমি এসে ফোন করলাম কয়েকবার। কিন্তু মিতুল রিসিভ করেনি। সন্দেহ হওয়ায় বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম। দেখি দরজা খোলা। মিতুল শুয়ে আছে খাটের ওপর। সারা শরীর নীল হয়ে রয়েছে ওর। হাত-পা বরফের মতো ঠাণ্ডা। আমার খুব নার্ভাস লাগছে সুহা। ডাক্তার ডাকতে হবে। তুই তাড়াতাড়ি আয়। মিতুলের মা বাবাকেও খবরটা দে এক্ষুনি।
কাঁপা কাঁপা গলায় কথাগুলো বলেই ফোনটা কেটে দিল হিরণ। ইস! আফসোস হচ্ছে খুব। যদি হিরণ আমার সামনে থাকত তাহলে দেখতে পেত ওর এই দুঃখ, ছটফটানি কতটা আনন্দ দিচ্ছে আমাকে। আমার ফুটিফাটা জীবনে এক পশলা বৃষ্টির মতো এসেছে হিরণ। ওর সঙ্গে কাটানো প্রত্যেকটা পল-অণুপল আমার কাছে দামি। ওর বলা কথার অনুরণনকে সঙ্গী করে কেটে যায় আমার অবসর। শুধু হিরণের কথা ভেবে ভেবেই পেরিয়ে যায় অজস্র নির্ঘুম রাত, তন্দ্রামাখা ভোর। স্ম া 
ফোনটা ব্যাগে রেখে সাইকেলের হ্যান্ডেল থেকে ঝোলাটা নামালাম আমি। গিঁঠ বাঁধা মুখ খুলে বের করলাম চ্যাপ্টা আকারের ঝুড়িটা। ঘাসের ওপর ওটা রেখে ঢাকাটা সরিয়ে দিলাম সাবধানে। ওই তো শুয়ে আছে কুণ্ডলী পাকিয়ে। একদম শান্ত। নিরুত্তাপ। কে বলবে এই নিরীহ প্রাণীটার শরীরে ভরা আছে এতো বিষ! এক ছোবলেই খেল খতম! 
সাপ ধরা আমার অনেকদিনের শখ। সেই নাগরাকাটায় থাকতে গিরিধারিকাকাকে দেখে শিখেছিলাম সাপকে বাগে আনার কৌশল। তারপর বেশ কয়েকবার চা বাগানের পথে বিষাক্ত সাপ ধরেছি আমি। যে এন জি ওতে কাজ করি সেখানেও আমার কারবার সাপ এবং সাপে কামড়ানো রুগীদের নিয়ে। আজ সকালে এই শঙ্খচূড়টাকে পেয়েছি রেলের পরিত্যক্ত স্টাফ কোয়ার্টারে। ওটাকে জঙ্গলে ছাড়ার আগে বাড়িতে গিয়েছিলাম দুপুরের খাওয়া সারতে। আর তখনই ফাঁকা বাড়িতে ঝুড়ির থেকে বের করলাম কুণ্ডলী পাকানো সাপটাকে। চুপচাপ রেখে এলাম ঘুমন্ত মিতুলের খাটের ওপর। বেশিক্ষণ সময় লাগেনি। নিউরোটক্সিক শঙ্খচূড়ের বিষ মুহূর্তে থামিয়ে দেয় প্রাণের স্পন্দন। বেচারা মিতুল! জানতেও পারলনা কীভাবে ভেঙে গেল হিরণের সঙ্গে ওর মিলনের স্বপ্ন, সারাজীবনের মতো।    


জায়গাটা একদম নির্জন। আশেপাশে লোকজন কেউ নেই। থাকলে দেখত বহুদিন পর আবার কেমন প্রাণ খুলে হাসছে সুহাসিনী আর আগল খোলা ঝুড়ি থেকে একটু একটু করে বেরিয়ে আসছে কালচে রঙের বিষধর এক শঙ্খচূড়।

Comments

Post a Comment