গল্প - ফারহা ফাওজিয়া অতসী

দ্বিতীয় অধ্যায়

ছোট্ট পৃথিবী। তাতে একটা ঘর, বিশাল। ঘরে একা আমি। একা নই।আবার একাও।ঘরটায় সবাই দূরে দূরে আছে।দাঁড়িয়ে, বসে। কিন্তু মা আমার কাছে। খুব কাছে। সবাই যেন লুকানো কান্না কাঁদছে।মা কাঁদছে না। আমার দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে আছে। মাকে অসহায় মূর্তির মতো দেখাচ্ছে। ঘরটা আগরবাতির ধোঁয়ায় একাকার। অচেনা ধোঁয়াশার চাদরে মোড়ানো একটা ঘর। ঘরের মাঝে পরে আছে আমার মৃতদেহ।
ব্যাপারটা এমনি হতে পারত। একদম ঠিক সময়ে দড়িটা ছিঁড়ে না গেলে কল্পনাগুলো হয়তো বাস্তব থাকত। অথচ গুগলে সার্চ করেছিল রাফসান। দেখেছিল কোথায়, কিভাবে সিলিং ফ্যানের সাথে রশি বেঁধে গলায় ফাঁস দিতে হয়। কোথাও একটা ভুলের ফলস্বরূপ রাফসান এখন হাসপাতালের বিছানায়। সেই সকাল থেকে এসব ভাবছে রাফসান। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে এসব ভাবা ছাড়া আপাতত আর কাজ নেই। 
“তুমি তো বিরাট এক ঘুম দিয়ে উঠলা রাফসান ভাইয়া। ডাক্তার আংকেলরা এত চেষ্টা করলো তোমাকে ওঠানোর, কিন্তু তুমি তো বেহুঁশ! দেখেছ কি কাণ্ড! এখন তুমি নিজে নিজে ওঠে বসে আছো।” পুচ্চি বলল। পুচ্চি রাফসানদের বাসার বিচ্ছু গোয়েন্দা । বাসার যাবতীয় খবর পাওয়া যায় পুচ্চির থেকে। রাফসান আর ওর মধ্যে বেশ ভাব! পুচ্চি পুরো আবেগ-আপ্লুত হয়ে বসে আছে। রাফসানের বিছানার পাশে।
“আরে কোত্থেকে এক বজ্জাত পিঁপড়া এসে কামড় বসাল আর অমনি লাফ দিয়ে ওঠে বসলাম। দেখ কেমন ফুলে গেছে হাতটা!” রাফসান মৃদু গলায় পুচ্চিকে হুঁশ ফেরা গল্প শোনালো ।
“ওহ আচ্ছা! এই কাহিনী! ডাক্তার আংকেলরা যা পারেননি পিঁপড়া মশাই তা পেরেছেন। তাহলে তো দেখছি, পিঁপড়া মশাইকে এই হাসপাতালে একটা পদ দেয়া যেতে পারে। তাইনা রাফসান ভাইয়া? তুমি কি বলো?”
পুচ্চির কথায় একরাশ হাসি উপহার দিলো রাফসান। হঠাৎ করে মাথা ব্যথা অনুভব করলো রাফসান। মাথা এক হাতে চেপে ধরল।
“রাফসান ভাইয়া, তোমার একটা চিঠি আছে। দেখলে তো, কথার তালে ভুলেই গিয়েছিলাম।“  পুচ্চি হাত বারিয়ে হলুদ একটা কাগজ রাফসানকে দিলো? “কিসের চিঠি! কে দিলো?” “একটা আপু দিয়েছে। আপুটার বাবা এই হাসপাতালেই ভর্তি আছেন। আপুটা তোমার ব্যাপারে জানতে পেরে একটা চিঠি পাঠিয়েছে।” রাফসান কাগজের ভাঁজ খুলে চোখের সামনে মেলে ধরল চিঠিটা। কি সুন্দর হাতের লিখা! মেয়েটাকে খুব গুণী মনে হচ্ছে রাফসানের । রাফসান চিঠিটা পড়তে লাগলো।
-“কই? মরলেন নাতো! আপনার না মরে যাওয়ার কথা ছিল? দিব্যি তো বিছানায় পরে আছেন। মরতে চান? আসেন জানালা দিয়ে একটা ধাক্কা মারি। তেরো তলা থেকে পরে বাঁচবেন বলে মনে হয়না।”
রাফসান পড়া বিরতি দিয়ে পুচ্চির দিকে ভীত দৃষ্টি ফেলল, “কেমন গুন্ডা মেয়েরে বাবা!” পুচ্চি দাঁত কেলিয়ে হেসে গেল। 
রাফসান আবার পড়া শুরু করলো।
“কি ভয় পেয়েছেন? যাক আসল কথায় আসি। দুইদিন আগে আপনার বাবাকে  চিৎকার করতে করতে হাসপাতালে ঢুকতে দেখি। তার দুইহাতে উঠানো আপনার নিস্তেজ দেহ। সেকি হাহাকার! “আমার বাবাটাকে কেউ বাঁচাও! আমার বাবাটাকে কেউ বাঁচাও!” বলতে বলতে এদিক ওদিক যাচ্ছিলেন পাগলের  মত। দিশেহারা। আপনার মা হাসপাতালের গেইট ধরে মাটিতে অজ্ঞান প্রায় বসেছিলেন। যেন তার সব হারিয়ে যাচ্ছে, যেন তার শখের পুতুল কেউ নিয়ে যাচ্ছে। মুহূর্তেই ভারী হয়ে যাচ্ছিলো পরিবেশ। জানেন কি?  আমার বাবা গত এক সপ্তাহ ধরে এই হাসপাতালের আইসিইউতে আছেন। করোনা ইউনিটে। ডাক্তার বলেছেন। তার হাতে আর সময় নেই। অথচ দেখুন, পৃথিবী জুড়ে অক্সিজেন। কিন্তু আমার বাবার জন্য একটুখানি অক্সিজেন নাই।  বাবা ভেবেছিলেন করোনা তার কিছু করতে পারবেন না। সুঠাম দেহ তার! অথচ কিছুদিনেই  করোনা কেমন কাবু করে ফেললো বাবাকে। একা শুয়ে থাকেন বাবা। প্রিয়জন ছাড়া। চাইলেও পারবেনা ছুঁতে আমাদের। চাইলেও আমি বাবার বুকে আর মাথা রাখতে পারব না। বাবাকে শেষ ছোঁয়া দিতে পারব না। বাবা চাইলেও আর আমাদের মাঝে ফিরে আসতে পারবেন না। কেমন এক অজানা বন্ধন ছেড়া সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। আপনার তো পুরো জীবনটা পরে আছে। কেউ বাঁচতে চেয়ে মরে যায় । আর কেউ পুরো সুন্দর একটা জীবনকে বিসর্জন দেয় ক্ষুদ্র কষ্টের কাছে। আপনি চাইলেই ফিরে আসতে পারেন নতুন জীবনে। কথা বাড়াবো না। একটা কথাই বলি- জীবন কিন্তু সবাইকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয়না। ভাল থাকবেন।”
মাথা ব্যথা তীব্র হলো রাফসানের। মাথা চেপে ধরল রাফসান। যেন জগৎভাঙা ব্যথা! সেই যে পরেছিল ফাঁস দিতে গিয়ে, মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লেগেছে বুঝা যাচ্ছে। রাফসান দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরল। এক অজানা ব্যথা ঘিরে ধরেছে রাফসানকে। রাফসান হারিয়ে যায় ব্যথা ভুলে নতুন জীবনে ফিরে যাওয়ার কল্পনায়।
পুচ্চিটা কোত্থেকে দৌড়ে আসলো রাফসানের কাছে। রাফসানের কানের কাছে গিয়ে ফিস ফিসিয়ে বলল, “আপুটা কিন্তু তোমাকে একবার দেখতে এসেছিলো।সাথে দুইটা লাল পিঁপড়া নিয়ে।”

Comments