গল্প - ঈদারুল ইসলাম

নীলিমা


বহুদিন পর সেই চিরপরিচিত হস্তাক্ষরে লেখা চিঠিটা হাতে পেয়ে আকাশের মনটা আজ ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে! আকাশ ভালোভাবেই জানে যে, হয়তো নীলিমা আকাশের উপর ভীষণ অভিমান করে বসে আছে। অভিমান করাটাই স্বাভাবিক; সত্যিই তো কাউকে কিছু না বলেই হঠাৎই রাতের অন্ধকারে নিজেকে লুকিয়ে নিয়ে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল সে। কিন্তু বিশ্বাস করুন এছাড়া আকাশের আর কিছুই করার ছিল না। নীলিমা তো সবই জানে যে, সেই ছোট্ট বেলায় আপনজন বলতে যাঁদের বোঝায় তাঁদের হারিয়ে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওই ভূপেন মাষ্টারমশাই ই ছিলেন তার পিতা-মাতা; উনি নিজের সন্তানের মত করে আকাশকে আগলে রেখেছিলেন। যেদিন প্রথমবারের মতো দু'জনের চোখে চোখ পড়েছিল সেদিন এক অজানা আনন্দে মেতে উঠেছিল আকাশের মন-প্রাণ, সমস্ত অন্তরাত্মা। দেখতে দেখতে কখন যে একে-অপরকে ভালোবেসে ফেলেছিল তা নিজেরাই বুঝে উঠতে পারে নি! কত দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা তারা ভালোবাসার পাখির মত নিরালায় বসে কাটিয়েছিল; কিছুই ভোলেনি সে! আজও আকাশের স্পষ্ট মনে পড়ে পার্কে একদিন নীলিমা'র কোলে মাথা রেখে এক স্বপ্নিল জগতে দু'জনে হারিয়ে গিয়েছিল অজানা কোনো এক ঢেউয়ের তোড়ে; আর কখন যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছিল দু'জনের কেউই বুঝতে পারে নি! হঠাৎ একটা বাঁশির শব্দে দু'জনের সম্বিত ফিরে আসতেই চোখ মেলে দেখে যে, আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। চারিদিকে শঙ্খধ্বনি এবং দূরে কোথাও থেকে আযানের আওয়াজ ভেসে আসছিল। কত কথা, কত স্মৃতি, কত স্বপ্ন! সবই যেন ছায়ার মত আকাশকে আজও ধাওয়া করে বেড়ায়। আজও তার সবই মনে আছে, কিছুই ভুলে যায় নি সে! 

ভালো নাম্বার নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরে নীলিমা চলে গেল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আর আকাশ স্কলারশিপের টাকায় কোনোমতে ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে পড়া চালিয়ে যায়। সন্ধ্যায় দু-চারটে স্টুডেন্ট পড়িয়ে যা আসত ওতে অনেক কষ্টে হাত খরচের টাকাটা ম্যানেজ হয়ে যেত, বাকিটা দিতেন পিতৃতুল্য সেই ভূপেন মাষ্টারমশাই। তার পর হঠাৎ একদিন আকাশের মাথার উপর থেকে ওই বটবৃক্ষের ছায়াটাও চলে গেল; বিশ্বাস করুন সেদিন আকাশ ভীষণ কেঁদেছিল। বটবৃক্ষের ছায়াটা হারিয়ে অশ্রুধারায় আকাশের বুকের ভিতরটা যেন সিক্ত হয়ে যায়! সহায় সম্বলহীন অবস্থায় একপ্রকার নিরুপায় হয়েই আকাশ তার এই অনিশ্চিত জীবনের সাথে নীলিমা কে জড়িয়ে তার জীবনটাকে নষ্ট করতে চায় নি। নীলিমা বাবা-মায়ের একমাত্র আদুরে মেয়ে, সেই ছোট্ট বেলা থেকেই অনেক সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যদিয়ে বড় হয়েছে। তাই আকাশ তার এই অনিশ্চিত জীবনের সাথে বেঁধে নীলিমার জীবনকে দুর্বিষহ করতে চায়নি! 

ভালো একটা চাকুরীর খোঁজে কাউকে কিছু না বলেই রাতের অন্ধকারেই মফস্বল শহর ছেড়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সে। এদিক সেদিক অনেক ইন্টারভিউ দিতে দিতে যখন সে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত, কয়েকটা টিউশন পড়িয়ে কোনোমতে দিন কাটাচ্ছে, ঠিক এমন সময় একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ভালো জব অফার পায়। গাড়ি-বাংলো সহ ভালো প্যাকেজ ছিল। সব গুছিয়ে নিয়ে নীলিমার কাছে আসছে বলে পলাশকে বিস্তারিত জানিয়ে একটা চিঠি লিখেও ছিল সে; কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে! আকাশ পলাশের কাছে জানতে পায় যে, নীলিমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে! অকস্মাৎ খবরটা পেয়ে যেন পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছিল; এক নিমেষেই সব স্বপ্নগুলো কেমন যেন দুমড়েমুচড়ে ধূলিসাৎ হয়ে যায়! সহসা আকাশের বুকে সেদিন যেন অশ্রুবৃষ্টি নেমে এসে এক চাপা যন্ত্রণায় ফেটে পড়ে। আকাশ বহুবার ভেবেছে যে ছুটে চলে যাবে 'আকাশের নীলিমার' কাছে; কিন্তু নীলিমার বাবা-মায়ের মাথা যাতে সমাজের কাছে নত না হয় সে কথা ভেবে আবারও রাতের অন্ধকারেই পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল সে। চাকুরীটা ছেড়ে দিয়ে কিছুদিন পাগলের মত এদিক সেদিক ঘুরে বেরিয়ে অবশেষে ভূপেন মাষ্টারমশাইয়ের সেই গ্রামের স্কুলেই পড়াতে শুরু করে। মাসে যতটুকু বেতন পেত তার সিংহভাগই নিজের মত অনাথ শিশুদের জন্য খরচ করে ছাত্র পড়িয়ে কোনোরকমে বেঁচে থাকে। 

আকাশ কোথায় কেমন আছে বা আদৌ বেঁচে আছে কিনা তা নীলিমার জানা ছিল না! হঠাৎ করেই একদিন গ্রামের স্কুলের এক পুরোনো বন্ধুর সাথে সাক্ষাতে আকাশের খবর পেয়ে সে কেমন আছে জানতে চেয়ে তার ঠিকানায় একটা চিঠি লিখে পাঠায় নীলিমা। দীর্ঘ একটা যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার পর হঠাৎ করেই নীলিমার লেখা চিঠিটা হাতে পেয়ে সব স্মৃতি যেন পুনর্জীবিত হয়ে ওঠে! কাগজ কলম নিয়ে চিঠির উত্তর দিতে গিয়ে আকাশের সর্ব শরীর ক্রমশঃ ঘামতে শুরু করে; হাত-পা দুর্বল হতে থাকে। অনেক কথা জমা হয়ে আছে নীলিমাকে বলবে বলে; কিন্তু কিভাবে কি হয়েছিল তা নিয়ে বিস্তারিত লিখতে লিখতে হঠাৎ করেই অশ্রুর বাঁধ ভেঙে যায়। চশমার গ্লাস'টাও অশ্রু-বাষ্পে ঝাপসা হয়ে আসে! কিছুতেই আর লিখতে পারছিল না সে; প্রচণ্ড হাত কাঁপতে থাকে। 

অব্যক্ত কথাগুলো আজ না হয় অব্যক্তই থেকে গেল! জীবনের শেষ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ফুসফুসের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে আজ সে শয্যাশায়ী; হয়তো বা তার চলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে! খুব শীঘ্রই বিদায় নেয়ার পালা চলে এসেছে। এই চিঠিটা যতদিনে নীলিমার ঠিকানায় পৌঁছবে ততদিনে হয়তো বা আকাশ আর বেঁচে থাকবে না।

নীলিমার উদ্দেশ্যে লেখা চিঠিতে শেষ প্যারায় সে এটাই লেখে যে-

"পারলে তোমার আকাশকে ক্ষমা করে দিও। বিশ্বাস করো আমি তোমায় ফাঁকি দিই নি,পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারলাম কোথায়? একটু একটু করে নিজেকে শেষ করে দিলাম! এই চিঠিটা যখন তোমার হাতে পৌঁছবে ততদিনে হয়তো বা আমি তারাদের দেশে মিটমিট করে চেয়ে থাকব তোমার আসার অপেক্ষায়। আমার শেষ ইচ্ছে যদি কখনও ক্ষমা করতে পার, তবে আমার সমাধিতে একটিবার চিৎকার করে বোলো- 'ভালোবাসি-ভালোবাসি, ভালোবাসি তোমায় আজও'! আর পারলে সাথে একটা রক্তগোলাপ এনো। আমি ধরে নেব তুমি আমায় ক্ষমা করেছ।

ইতি-

তোমার 'আকাশ'।"




Comments