বই কথা - রঞ্জন রায়

''একটু আলোর জন্য : গভীরতর অসুখ ও প্রত্যাশীর স্বপ্ন কোলাজ''


'চারিদিকে মৃতদেহের শব --

মাথার উপর শকুনেরা উড়ছে ---

মহানগরী শববাহকের 

শ্মশানযাত্রী ।'

করোনা ভাইরাসের দাপটে বর্তমান বিশ্বমানবের সামনে যে সার্বিক বিপর্যয় নেমে এসেছে, তারই প্রেক্ষাপটে পঙতিগুলিকে কিছুটা বিন্যস্ত করে নিলেই অনায়াসে প্রয়োগ করা যায়। তবে শুধু আজকের অতিমারীর নিরিখেই নয়, যেকোনো দেশ কালের গণ্ডী অতিক্রম করে যে কোনো দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর কবলে বিধস্ত মানবাত্মার বিপন্নতা ফুটে ওঠে পঙতিগুলোর মধ্যদিয়ে। এরই পরিপূরক হিসেবে কবি লিখেছেন,

'পদ্মা-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের 

বিস্তীর্ণ বালুচর ঘিরে 

নিরন্তর মানুষের কান্না 

অরণ্য - অন্ধকারে 

প্রতিধ্বনিত হয়ে ফেরে।'

এ যেন সময়ের যথার্থ তমসুক। উত্তরবঙ্গের প্রান্তবর্তী জেলা কোচবিহারে বসে গত শতকের পাঁচের দশকে কবি অপরাজিতা গোপ্পী তাঁর 'একটু আলোর জন্য' কাব্যের 'চারিদিকে রক্ত ঝরছে' কবিতায় এই পঙতিগুলি লিপিবদ্ধ করেছিলেন। মূলত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত অপরাজিতার অন্তরের অন্তঃস্থলে যে একজন সংবেদনশীল কবিসত্তা লুকোনো ছিল, পঙতিগুলো তাঁর যথাযথ দৃষ্টান্ত। তিনি তাঁর কালের একটা উত্তাল সময়কে চিহ্নিত করতে গিয়ে কলম ধরেছিলেন রাজনীতির পাশাপাশি।

গত শতকের নয়ের দশকের শুরুতে কলেজে পড়তে এসে শহরের বাড়িগুলোর দেওয়ালে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতীকের পাশে অপরাজিতা গোপ্পীর নামটি কখনো উজ্জ্বলভাবে আবার কখনো খসে যাওয়া পলেস্তারার নিচে ধূসর হয়ে যেতে দেখেছি। এর বাইরে মানুষটি সম্পর্কে বিশেষ কোনো ধারণা ছিল না। পরবর্তীকালে উত্তরের সাহিত্য-চর্চার প্রতি আগ্রহী হতেই নামটির সঙ্গে ভিন্নভাবে পরিচয় ঘটে। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারী কবিতাচর্চাও করে গেছেন নীরবে। সেসবের অধিকাংশই বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য।অন্তর্জাল ঘুরে যা কিছু তথ্য পাওয়া যায় তাও মূলত রাজনীতিবিদ অপরাজিতা বিষয়ক।

জেলার রাজ-আমলের মেয়েদের স্কুল সুনীতি একাডেমী স্কুলে পড়ার সময় থেকে অপরাজিতা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ছাত্র বয়সেই তিনি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিনটি পালনের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কবিতা চর্চাও চলেছে নিভৃতে।

ভারতীয় রাজনীতিতে অপরাজিতা ছিলেন প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সারা ভারত ফরোয়ার্ড ব্লক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হয়েছিলেন ২০১৩ সালে। ২০০৭ সালে তিনি ছিলেন ফরোয়ার্ড ব্লক দলের পশ্চিমবঙ্গের সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য।সেইসঙ্গে ২০০০ সালে তিনি ছিলেন রাজ্যের সর্বোচ্চ পার্টি নেত্রী। ছিলেন সর্বভারতীয় অগ্রগামী মহিলা সমিতির চেয়ারম্যান। ১৯৭২ সালে কোচবিহার জেলার উত্তর কেন্দ্রের বিধানসভা নির্বাচনে দাঁড়িয়ে তিনি হেরেছিলেন। পরে অবশ্য ১৯৭৭ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত নির্বাচিত বিধায়ক হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক জীবন আবর্তিত হয়েছে। এরই পাশাপাশি তিনি নিরন্তর কবিতা লিখে গেছেন। যদিও সেসব অযত্ন আর অবহেলার কারণে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। এ বিষয়ে কবি নিজেই বক্ষমান বইটির পরিচায়িকায় 'আমার কথা' শীর্ষক সংক্ষিপ্ত আলোচনায় জানিয়েছেন,

'....আমার রাজনৈতিক জীবনে নানান ঝামেলার মধ্যে কবিতাটা লেখাই যেখানে দুর্ঘটনা, সেখানে সময় করে কবে কোথায় কবিতা লিখেছি এবং সেগুলো আদৌ সাহিত্য উত্তীর্ণ কিনা এসব আমার জানা নেই --জানার চেষ্টাও কোনদিন করি নি।'

কবির খেয়াল যাই হোক না কেন, অনুসন্ধানী পাঠক হিসেবে বইটির প্রকাশক শ্রী স্বপন মুখার্জী বইটির কবিতা গুলো সংকলিত করে প্রকাশের মধ্যদিয়ে একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। প্রকৃত সাহিত্য অনুরাগীরা তথা সময় যে একদিন এই কাব্যকে খুঁজে নেবে সেটা স্বপন বাবু হয়তো ঠিক বুঝেছিলেন।

কবি অপরাজিতার কাব্য চর্চা সম্পর্কে যেটুকু জানা যায়, তা থেকে আমরা দেখি কবির প্রথম কাব্য 'আহত পাখির মতো ডানা ঝাপটায়' বেরিয়েছিল ১৯৭৩ সালে। দ্বিতীয় কাব্য 'অরণ্য গভীরে' প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৮১ সালে। এবং কবি জীবন সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বিষয়ক কবিতা সংকলন 'সুভাষম', বেরিয়েছিল ১৯৮৩ সালে। তাঁর তৃতীয় কাব্য 'একটু আলোর জন্য' বের হয়েছে অনেক পরে। আসলে ততদিনে তিনি রাজনীতিতে পুরোপুরি ডুবে গেছেন।কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর শব্দতুলির আঁচড়ে।

কবির পক্ষে সমাজকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করা দরকার। তাঁর 'কবিতার অস্থির ভিতরে থাকবে ইতিহাস চেতনা আর মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান'। আর তিনি যদি একজন দায়িত্বশীল ও সৎ রাজনীতিবিদ্ হন তাহলে তো সেই সমাজ-সচেতনতা তাঁর কাব্যে অপরিহার্যই হয়ে ওঠে। ফলে তিনি 'সাহিত্যের জন্যে সাহিত্য নয়' 'জীবনের জন্যেই সাহিত্যকে বেছে নেন। তাঁর দর্শনই হয়ে ওঠে নিছক শিল্পসৃষ্টি নয় 'সমাজের প্রয়োজনেই সাহিত্য'।রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে অপরাজিতা তাঁর রাজনীতি আর কবিতার মেলবন্ধন সম্পর্কে নিজেই জানিয়েছেন,

'আমার রাজনৈতিক জীবনে কবিতা লেখা এবং কবিতা আমার দর্পণ।' 

এই দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর কবিতাগুলোর প্রতি ছত্রে ছত্রে প্রতিফলিত হয়েছে।

'পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ' এর কালে যে তমিস্রা ঘনীভূত হয়ে উঠেছিল নিজের পরিচিত পরিসর জুড়ে, কবি অপরাজিতা সেই ঘনায়মান অন্ধকার থেকে উত্তরণের জন্যে একটু আলোর সন্ধান করেছিলেন। কাব্যের প্রথম কবিতা 'প্রজ্বলিত মশাল' এ সেই বোধেরই প্রকাশ। চারদিকে ঘন অন্ধকার পরিবৃত হয়ে আছে।' কারাগারের লৌহদ্বার বারবার দৃষ্টি বিভ্রান্ত'। সেই প্রেক্ষাপটে কবি লেখেন,

'চারিদিকে সমুদ্র কোলাহল 

অবরুদ্ধ চেতনা 

অবচেতনের লৌহ আবেষ্টনী ভেঙে 

প্রত্যাসন্ন মুক্তির আবির্ভাবে 

প্রকল্পিত।....


আলো-হাত বঞ্চিত উত্তরণের পথ 

অন্ধকারে 

দ্বারে দ্বারে হাঁক দিয়ে ফেরে 

প্রত্যাশিত আশার সন্ধানে।'

যন্ত্রণাদগ্ধ সময় যেন কথা বলে উঠেছে কবির একেকটি কবিতায়। সেই যন্ত্রণার সঙ্গে সংবেদনশীল পাঠকও একাত্ম হয়ে যান অনায়াসে। কবি যখন লেখেন,

১. ... 'তাইতো আজ 

পৃথিবীর অতৃপ্ত হৃদয় থেকে বঞ্চিতের 

কান্নার আর্তনাদ ছেয়েছে আকাশ বাতাস --

এখানে কোন জাত নেই --


মুক্তি যন্ত্রণায় দেবতার মন্দির থেকে মসজিদ 

সমগ্র মনুষ্যত্ব আজ ক্রুশবিদ্ধ।

মানবতার পূজারী যিশু রক্তাপ্লুত।'

(চারিদিকে রক্ত ঝরছে)


২. এখানে প্রতি মুহূর্তে 

নিঃস্বার্থ জীবনের ছন্দ 

প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা,

প্রতিনিয়ত নির্মম সংঘাতে হতেছে 

রক্তাপ্লুত।

সভ্যতার বিস্তৃত প্রাঙ্গণে 

ক্রুশ বিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকে 

বিবেকবান মনুষ্যত্ব।'

(সভ্যতার বিস্তৃত প্রাঙ্গণে)


৩. 'নতুন যৌবনদীপ্ত অগ্নিসত্তায় 

প্রেমের সংগীতে উজ্জীবিত যৌবন 

নীলকন্ঠের মত 

নিজ রক্তে বিষ ধারণ করে 

মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে 

রণক্ষেত্রের বিধ্বস্ত 

মনুষ্যত্বে বিকৃত শব। ধ্বংসস্তূপে 

চারিদিকে শুধু লাশ 

লাশের পিরামিড 

ঢেকে দেয় বসন্তের আহ্বান।'

(অগ্নিসত্তা)

এইসব মানবতার লাঞ্ছনাময় অবস্থা একজন সচেতন রাজনীতিবিদ হিসেবেই যেমন কবিকে যন্ত্রণা দিয়েছিল, তেমনি সমাজসচেতন কবিও তাঁর 'বিবেকবান মনুষ্যত্ব' নিয়ে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এবং সেসবের নগ্ন ও বাস্তব চিত্র তুলে এনেছেন।

পৃথিবীর বুকে সভ্যতাদর্পি মানুষ যুগে যুগে তার শাসন কায়েম করার সব রকম প্রয়াস চালিয়েছে।পারমাণবিক শক্তির সাহায্যে 'একদল যুদ্ধবাজ আত্ম অহংকারী দস্যুরা তীক্ষ্ম নখদন্তে ধর্ষিতা ধরিত্রী', চারদিকে নাগিনীর বিষাক্ত নিঃশ্বাস', বারুদের গন্ধে আসন্ন ঝড়ের সংকেতে যখন আকাশ বাতাস মুখরিত, সেইসময় কবি তরুণ প্রজন্মকে আহ্বান জানিয়েছেন 'অগ্নিসত্তা' কবিতার অন্তিমে,

'...বিজ্ঞানের জয়যাত্রা 

আণবিক শক্তির পঙ্কিল আবর্তে 

সভ্যতাকে করে পরিহাস 

তবু আগামী প্রজন্ম 

রণক্ষেত্রের ধ্বংসস্তূপে 

রক্ত গোলাপ হয়ে ফুটে 

উঠতে চায়।'

কিম্বা 'জোয়ার আসবে' কবিতায় কবি স্বপ্ন দেখেন,

'জোয়ার আসবে বলে 

রয়েছি দাঁড়ায়ে সমুদ্র সৈকতে,

মনের মধ্যে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অস্থিরতা 

অদূরে উন্মত্ত ঢেউ আছড়ে পড়ে 

সমুদ্র সৈকতে 

ভরে ওঠে বুক লোনা স্বাদে।....


নীরবে সাগরের জলে 

জোয়ারের প্রস্তুতি চলে 

আগামী সূর্য প্রদক্ষিণের 

প্রতীক্ষায়।'

যাবতীয় অন্যায়ের মূর্ত প্রতীক হিসেবে কবি নেলসন ম্যান্ডেলার স্তব করেছেন 'নেলসন ম্যান্ডেলা' পূর্বতন 'ধ্রুব নক্ষত্র' কবিতায়। আফ্রিকার মুক্তিসূর্য ম্যান্ডেলাকে উদ্দেশ্য করে কবি লিখেছেন,

'অরণ্য গভীরে যেখানে ছেয়েছে আঁধার,

সূর্য পারে না প্রবেশ করতে, 

আঁধারের সেই দুর্জ্ঞেয় রহস্য ভেদে শ্বাপদসংকুল গভীর জঙ্গলে 

সূর্যোদয়ের সংগ্রামে তুমি আজও অটল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

নেলসন ম্যান্ডেলা, তোমার নামের জ্যোতির্ময় 

আকর্ষণে সঙ্ঘবদ্ধ আজ।'

কেবল 'আফ্রিকার আঁধার আকাশে'ই নয় পৃথিবীর সব প্রান্তের অন্ধকার দূর করে' একটি ধ্রুব নক্ষত্র 'রূপে জেগে থাকবে ম্যান্ডেলার মতো প্রতিবাদী সত্তা। সেইসঙ্গে কবি আরেকজন ব্যক্তিত্বের উল্লেখ করেছেন, তিনি হলেন সত্যজিৎ রায়। 'সত্যজিৎ রায়' শীর্ষক কবিতায় কবি লিখেছেন,

'কখনো পথ চলতে চলতে 

অনবধানতায় যদি অস্তিত্ব হয়েছে বিপন্ন,

ঘুন পোকার ক্রমান্বয় দংশনে,

ক্লীবত্বের অন্ধকারে জাতি সত্তা,

হতাশায় নিমজ্জিত ---

তখনই কি এক আশ্চর্য প্রাণ উন্মাদনায় 

রোমাঞ্চিত আবেগে তোমার 

আবির্ভাব।'

সমাজ সচেতন কবি অপরাজিতা এখানেই থেমে থাকেন নি, তিনি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে তথাকথিত ধারা মেনে 'একলব্য' কিম্বা 'রামচন্দ্র' হতে চান নি। প্রসঙ্গত 'একলব্য হতে চাই' কবিতায় কবি লিখেছেন,

'আমরা আজ যে কথা বলি,

আগামীকাল সে কথাই 

অন্য কথা হয়।

এ যুগে কেউ আমরা একলব্য নই।


প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য,

নিজের আঙ্গুল কেটে 

গুরু দক্ষিণা দিতে 

আজ আর আমরা 

কেউ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নই। '

সেইসঙ্গে কবি বলেছেন, 'প্রয়োজন নেই সত্যনিষ্ঠ হবার' তাই তিনি লিখেছেন,

'এই মুহূর্তে পরিত্রাতা সেজে 

পৃথিবীর সামনে দাঁড়িয়ে 

যে কথা বলবো 

কাল সে প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য 

রামের মত পিতৃসত্য পালনে যাবো না।

আমরা আজ আর কেউ রাম হতে চাই না।'

শেষপর্যন্ত কবি সিদ্ধান্তে এসেছেন 'একলব্যের আত্মত্যাগে রামের প্রতিজ্ঞা পালনে আমরা আজ দৃঢ় হতে চাই'। স্বপ্নপ্রত্যাশী কবি 'তৃষিত হৃদয়' কবিতাতেও বলেছেন,

'জানি মহুয়ার মিষ্টি গন্ধ 

বাতাসকে করেছে আহ্বান 

করেছে আকুল 

ব্যথিত হৃদয়ের 

এপারে সময়ের ঢেউ গুণে গুণে 

যখন মন হয় ক্লান্ত 

তখন জানি না 

কোন অজানা উদ্দেশ্য 

দুর্গম পথে চলেছে তোমার অভিযান।'

সংবেদনশীলতা সৃষ্টিশীল মানুষকে, এমনকি একজন রাজনীতিবিদকেও যে 'একা' করে তোলে তা অপরাজিতার কবিতাতেও আমরা প্রত্যক্ষ করি।' অভিশপ্ত আত্মার অবরুদ্ধ কান্না তাঁকে বিহ্বল করে দেয়।' নিঃসঙ্গ একক মন' কবিতায় কবির সেই একাকীত্ব ধরা পড়েছে। কবি লিখেছেন,

'পৃথিবীর সব আলো যদি 

আজ নিভে যায়,

মুছে যায় -- আবীরের রঙ 

দু'চোখের স্বপ্ন হ'তে।

তবু জোনাকির আলোর মতন 

এ মন রইবে জেগে 

নিঃসঙ্গ একক 

বন্ধুহীন পৃথিবীর বুকে।'

কিম্বা কাব্যের শেষকবিতা 'দু'চোখে নামে না ঘুম' কবিতায় কবি লেখেন,

'দু'চোখে নামে না ঘুম।

জ্যোত্স্না রাত --

একান্ত একাকী নিঃসঙ্গ নিঝুম।

এখন অনেক রাত 

সবাই ঘুমিয়ে সব দিকে।

আমি শুধু একা জেগে রই।

নিস্তব্ধ গভীর রাত --

কেউ জেগে নেই 

হৃদয়েরা শুধু জেগে রয় --

জেগে জেগে রাতের আঁধারে শুধু পথ 

খোঁজে।'

কিন্তু একজন প্রকৃত কবির মতো, একজন আলোকবাদী রাজনীতিক হিসেবে কবি অপরাজিতা অন্ধকারেই আবদ্ধ থাকেননি, আলোর বলয়ের খোঁজে বেরিয়েছেন। 'বর্ষার আহ্বান' কবিতায় সেই আশার কথা উচ্চারিত হয়েছে। ব্যক্ত হয়েছে রোমান্টিকতা। তিনি লিখেছেন,

'পৃথিবীর এ দুঃখ --- এ ব্যথা 

হিংসার সহস্র ফণার বিষাক্ত নিঃশ্বাস ,

পারে না স্পর্শ করতে 

ওদের মনকে 

ওরা মর্ত্যের সীমানা ছাড়িয়ে 

সত্যের পেয়েছে সন্ধান;

তাই ওরা দিয়েছে ডানা মেলে 

নিঃসীম আকাশের বুকে।'

একই প্রত্যাশার কথা রূপকের আড়ালে ব্যক্ত হয়েছে 'বঞ্চনার অভিশাপ থেকে ' কবিতাতেও। সেখানে ঈগল পাখির ডানার নিচে নিশ্চিত বিশ্বাসের বার্তা পেয়ে চড়ুই পাখি 'নিঃসীম আকাশের বুকে ডানা দুটি মেলে মুক্তির অনাবিল আনন্দে ভেসে যেতে' চেয়েছে 'দৃঢ় আত্মবিশ্বাসে'। কিম্বা 'অভীষ্ট লক্ষ্য সব' কবিতায় কবি আত্মপ্রত্যয়ের সুরে বলেছেন,

'রক্তিম এ পথ 

আমাদের পাড়ি 

দিতেই হবে।'--

এই আশাবাদ ভাবনার স্বর্ণশিখর স্পর্শ করেছে কাব্যের শীর্ষনাম কবিতায়। 'তিমির বিনাশী' কবির মতোই অপরাজিতা 'প্রেমহীন ভালোবাসাহীন পৃথিবীর বুকে ভালোবাসার গান রচনা করে' যাবার কথা ঘোষণা করেছেন,

'.... কোথাও নীল রঙ নেই,

তেপান্তরের গান নেই,

প্রেম নেই --- ভালোবাসা নেই।

জননী আমার 

তবু আমি ভয়ংকরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে 

নক্ষত্রহীন আকাশে ধ্রুব তারকা 

খুঁজে নিতে চাই।


প্রেমহীন --- ভালোবাসাহীন পৃথিবীর বুকে 

ভালোবাসার গান রচনা ক'রে যেতে চাই।'

এখানেই কবি ভাবনা ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি নির্বিশেষ, এবং খণ্ডকাল থেকে শাশ্বত কালে উত্তীর্ণ হয়েছে।এবং কাব্যের সূচনায় কবি যে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন,' ...সাহিত্য অনুরাগীরা এই লেখাগুলোকে সাহিত্য মর্যাদায় ঠাঁই দেবেন কিনা অনিশ্চিত।' কবির সেই ধারণা অমূলক হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে যে এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।





Comments