প্রবন্ধ - রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

 

জীবনী-সাহিত্য : গদ্যসাহিত্যের বিশেষ শাখা


।। এক।।

জীবনী বা Biography বলতে সাধারণভাবে বোঝায় কোনও ব্যক্তিবিশেষের জীবনবৃত্তান্তকে সুবিন্যস্তভাবে লিপিবদ্ধ করা ও তার চরিত্রের বিশ্লেষণ। আরও বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে জীবনচরিতে ব্যক্তির বহির্জীবনের ঘটনাবলীর বিশ্বাসযোগ্য বিবরণের সঙ্গে তার অন্তর্জীবনের দ্বন্দ্বসমূহের প্রতিফলন থাকবে, সেই সঙ্গে থাকবে তার মানসিকতার বিশ্লেষণ। সার্থক জীবনচরিত লিখতে গেলে ব্যক্তির জীবনকে তার সময় ও যুগের প্রেক্ষিতে স্থাপন করে ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির তথা পারিপাশ্বিকের সম্পর্কও উন্মোচন করতে হয়।  ফ্রাঙ্ক হ্যারিস মনে করেন জীবনচরিত নিছক ব্যক্তিজীবনের ইতিহাসমাত্র নয়। তিনি বলেছেন – “Biography is not only history. It can also be good literature. And in some cases it can even rank with creative literature.” জীবনী-সাহিত্য একদিকে যেমন তথ্যনিষ্ঠ হওয়া প্রয়োজন, তেমনই অন্যদিকে সমগ্র রচনাটির সাহিত্যের রসলোকে উত্তরণ ঘটা প্রয়োজন।

কোনও ব্যক্তিবিশেষের জীবনের যাবতীয় ঘটনা ও বিস্তর তথ্যাদি যোগাড় করলেই তা জীবনচরিত হয় না। এই প্রসঙ্গে প্রখ্যাত জীবনীকার লিটন স্ট্র্যাচি বলেছেন – “A mass of notes and documents is no more a biography than a mountain of eggs on omelette.” জীবনীকারকে এমনভাবে সংগৃহীত তথ্য বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে এবং সাহিত্যরসে জারিত করে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করতে হবে যাতে মানুষটির অন্তর্লোকের বিশ্বাসযোগ্য ছবি ফুটে ওঠে। জীবনীকারের দায়িত্ব হল কোনও ব্যক্তির জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে তার সমগ্র সত্তাকে উদঘাটিত করা। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে তা যেন নিছক ঘটনাবলীর বিবরণে পর্যবসিত না হয়, রচনাকে বর্ণনাশক্তির গুণে সাহিত্যের স্তরে উন্নীত হতে হবে। হেমকেথ পিয়ার্সন বলেছেন – “Biography is the history of lives of individual men – a truthful record of an individual and composed as a work of art. It is the narrative from birth to death, of one man’s life in its outward manifestation and inward working.”

আঁদ্রে ম্যুরোর কথায় প্রকৃত জীবনচরিত হল জীবনের মধ্য দিয়ে একটি মানবাত্মার দুঃসাহসিক অভিযানের আলেখ্য। তাঁর ভাষায় – “Biography is that type of writing which reveals, in narrative form, the outer and inner experience of one personality through another. It is the study and presentment of a human character with its inner conflict of aim and impulse and its outer struggle between circumstance and temperament. In short, it is the faithful portrait of a soul in its adventures through life.” ম্যুরোর এই পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত অর্থবহ। জীবনের নানা ঘটনা ও তথ্যের উপর মানবাত্মার দুঃসাহসিক অভিযানের আলেখ্য নির্মাণ সত্যিই দুরূহ। এটি এমনই এক সৃজনকর্ম যা বিজ্ঞানীসুলভ বিশ্লেষণ ও শৈল্পিক দক্ষতার সার্থক সমন্বয় ব্যতীত প্রায় অসম্ভব। সেই কারণেই লুই মামফোর্ড বলেছেন – “Biography is both a science and an art.” একজন ব্যক্তির জীবনের উপর আলোকপাত করে তার চরিত্রের বিভিন্ন দিকগুলি পাঠকের সামনে তুলে ধরতে গেলে সাহিত্যগুণের সঙ্গে শৈল্পিক দক্ষতা দরকার। জীবনচরিত রচনার কাজটি যে কত কঠিন তা বোঝা যায় প্রখ্যাত জীবনীকার এমিল লুডউইগের কথা থেকে – “To re-create by-gone scenes and figures, to re-animate with movement, proportion and climax the stubborn facts of a man’s or woman’s whole existence, requires a dramatic sense equal if not superior to that of the playwright or a novelist.” এই বক্তব্য অনুযায়ী একজন জীবনীকারকে হতে হবে একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার এবং চিত্রকর;  শুধু জীবনের ঘটনাবলীই নয় তাঁকে জীবনরহস্যকেও উদঘাটিত করতে হবে। বহির্জীবন ও অন্তর্জীবনের সুসমঞ্জস নির্মাণ ও ইতিহাসের শিল্পসম্মত রসায়ন ছাড়া কোনও জীবনচরিতই সার্থক হতে পারে না।

সার্থক জীবনীগ্রন্থের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল –

১. প্রাথমিকভাবে ব্যক্তিজীবনের কথা সতর্কভাবে তথ্যনিষ্ঠার সঙ্গে লিপিবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন।

২. জীবনচরিতে ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে সমকালীন সমাজ ও যুগের ইতিহাসের প্রামাণ্য চিত্র থাকতে হবে।

৩. জীবনচরিত নিছক তথ্য ও ঘটনার কালানুক্রমিক বিবরণ নয়। তাতে কথাসাহিত্যের রস ও উপভোগ্যতা থাকা কাম্য। তা না হলে রচনাটি কেবল তথ্যভারে ভারাক্রান্ত হবে, তাতে সাহিত্যরস থাকবে না।

৪. ব্যক্তির জীবনের ভাষাচিত্র এমনভাবে অঙ্কন করতে হবে যাতে রচনা সুখপাঠ্য হয় ও পাঠকরা তা পাঠ করতে উৎসাহিত হন।

৫. জীবনচরিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রটির সঙ্গে অন্যান্য চরিত্রগুলির সম্পর্ক ও সংঘাত যেন বিশ্বাসযোগ্যভাবে চিত্রিত হয়।

৬. জীবনীগ্রন্থে কোনও নীতি বা আদর্শ প্রচারের তাগিদে যেন চরিত্রচিত্রণ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। মহৎ ব্যক্তির চরিত্রের সৌন্দর্য যেন পাঠককে মুগ্ধ করতে পারে।

ব্যক্তিজীবনের ইতিহাস জীবনচরিতের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। সে কারণে তাকে তো তথ্যনিষ্ঠ হতেই হবে। কিন্তু জীবনীকার তো নিছক তথ্য-সংগ্রাহক বা chronicler নন। তাঁর লেখায় ব্যক্তিত্বের গভীর দেখার অনুশীলনের ছাপ থাকতে হবে। শুধু তাই নয়, একটি চরিত্রে লেখকের নিজস্ব কল্পনায় রক্তমাংসের সজীবতা আরোপ করতে পারাটাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পাঠক যদি সেই জীবনের গভীরে প্রবেশ করে তার সমগ্র সত্তাকে নিজের অনুভবের বলয়ে আনতে না পারেন তাহলে জীবনীকারের কাজ ব্যর্থ হয়েছে বলে ধরতে হয়েছে। কেবলমাত্র ঘটনার সারিবদ্ধ বিন্যাসে জীবনী সার্থক রূপ পায় না। এই বক্তব্যের সমর্থনে সমারসেট মমের মন্তব্য উদ্ধৃত করছি – “A biography which is merely anecdotal is not biography at all. An anecdote is indispensable, but to have any real biographical value, an anecdote must reveal the true nature of the man.”

এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ে ইংরেজি ভাষায় সব থেকে বিখ্যাত জীবনীগ্রন্থ জেমস বসওয়েলের লেখা স্যামুয়েল জনসনের জীবনচরিত ‘The Life of Samuel Johnson’ (১৭৯১) বইটির কথা। দেশ-কাল নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে বসওয়েল যে কাজ করেছেন তা আদর্শ বলে গণ্য হবে। বিশেষ করে তিনি জনসনের জীবনের শেষ কুড়ি বছরের যে ছবি তুলে ধরেছেন তা অবিশ্বাস্য। বসওয়েলের লেখা জীবনচরিতের বৈশিষ্ট্য হল তা একাধারে কাহিনিমূলক এবং তথ্যবহুল। কিন্তু প্রতিটি কাহিনি ও তথ্যাবলীর ভেতর দিয়ে তিনি ব্যক্তি জনসনের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যসমূহ যেভাবে তুলে ধরেছেন তা আমাদের মনে বিস্ময়ের উদ্রেক করে।

বসওয়েল যাঁর জীবনী লিখেছিলেন সেই স্যামুয়েল জনসন আবার ইংরেজ কবিদের জীবনচরিত লিখেছিলেন। তাঁর সেই বিখ্যাত ‘Lives of the Poets’-এ (১৭৭৯-৮১) আব্রাহাম কাউলে, জন ড্রাইডেন, উইলিয়াম কলিনস, টমাস গ্রে প্রভৃতি ৫২ জন ইংরেজ কবির জীবনী অনবদ্য ভাষায় ও ভঙ্গীতে প্রকাশিত হয়েছে। জনসন জীবনচরিতের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন – “The business of the biographer is often to pass slightly over those performances and incidents which produce popular greatness, to lead the thoughts into domestic privacies, and display the minute details of daily life, where exterior appendages are cast aside, and men excel each after only by prudence and virtue.” অর্থাৎ জীবনচরিত যাঁকে নিয়ে লেখা হবে তাঁর জীবনের আনুপূর্বিক পরিচয় জীবনীকারকে পেতে হবে। তার পর তিনি কাহিনি এমনভাবে সাজাবেন যাতে মানুষটির বাইরের ও ভেতরের চেহারাটি পাঠকের মনের পর্দায় সমানভাবে প্রতিভাত হয়। সে কারণেই জীবনচরিত রচনা রসোত্তীর্ণ সাহিত্যসৃষ্টি হয়ে উঠতে পারে।


।। দুই।।

পাশ্চাত্যের প্রাচীনতম জীবনীকারদের মধ্যে অন্যতম হলেন কর্নেলিয়াস নেপোস। ৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর রচনা ‘Excellentium Imperatorum Vitae’ (‘Lives of Outstanding Generals’)। তবে পাশ্চাত্যের প্রাচীন ধ্রুপদী সাহিত্যে যাঁকে জীবনী-সাহিত্যের জনক বলে ধরা যেতে পারে তিনি হলেন প্লুতার্ক। গ্রীক ভাষায় লিখিত তাঁর বিখ্যাত ‘Lives of the Noble Greeks and Romans’-এ (যা ‘Parallel Lives’ নামেও পরিচিত) ছেচল্লিশ জন বরেণ্য গ্রীক ও রোমক পুরুষের জীবনী রয়েছে। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের (আনুমানিক ৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এই কাজটিতে অপরিসীম তথ্যনিষ্ঠা ও সৃজনীশক্তির সাহায্যে তিনি বেশ কয়েকজন মহৎ মানুষের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। প্লুতার্কের জীবনীগ্রন্থ এলিজাবেথীয় ইংল্যণ্ডে সাহিত্যরচনার অন্যতম আকরগ্রন্থ হিসেবে সমাদৃত হয়েছিল। বিশেষত শেক্সপীয়ার তাঁর নাট্যরচনার ক্ষেত্রে প্লুতার্কের কাছে ঋণী ছিলেন। 

অন্ত্য-মধ্যযুগের সব থেকে বিখ্যাত জীবনীগ্রন্থ হল স্যার টমাস ম্যালোরি লিখিত রাজা আর্থার ও তাঁর নাইটদের জীবনী অবলম্বনে রচিত ‘Le Morte d’Arthur’। এরকমই বিখ্যাত আর একটি গ্রন্থ হল জিওর্জিও ভাসারি-র ‘Lives of the Artists’ (১৫৫০)। ইংল্যণ্ডের বিখ্যাত নারী-পুরুষদের জীবনীর একটি সংকলন হল উইলিয়াম ওল্ডিস সম্পাদিত ‘Biographia Britannica’ (১৭৪৭ - ১৭৬৬)। ভিক্টোরীয় যুগের চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিক টমাস কার্লাইল জীবনচরিত লেখক হিসাবে বিশেষভাবে উল্লেখের দাবী রাখেন। তাঁর ‘The Life of John Sterling’ (১৮৫১) এবং ‘Frederick the Great’ (১৮৫৮) দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এর মধ্যে দ্বিতীয় বইটি তাঁর প্রচুর পরিশ্রমের ফসল এবং একটি কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বকে চিহ্নিত করার প্রয়াস। তবে ব্যক্তির চাইতে সমষ্টি এবং সাহিত্যের চাইতে ইতিহাস এখানে বড় হয়ে উঠেছে। 

আধুনিক জীবনী-সাহিত্য রচনায় সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন লিটন স্ট্র্যাচি। তিনি নিরাসক্তভাবে, পক্ষপাতমুক্ত হয়ে নির্মোহ দৃষ্টিতে বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী রচনার ধারার সূচনা করেছিলেন। ১৯১৮ সালে তাঁর ‘Eminent Victorians’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে জীবনী রচনার ধারাই পাল্টে যায়। এতদিন পর্যন্ত ধরে নেওয়া হত জীবনীকার সশ্রদ্ধচিত্তে বিখ্যাত ব্যক্তিদের এমন ভাষা-প্রতিকৃতি নির্মাণ করবেন যা হবে মর্যাদামণ্ডিত ও সমীহ উদ্রেককারী। কিন্তু স্ট্র্যাচির আবির্ভাবে এই ভিক্টোরীয় রক্ষণশীলতা ও অর্ধসত্যের চর্চা ভেঙে যায়। তিনি মনে করতেন জীবনীকার তাঁর বিষয় সম্পর্কে আক্রণাত্মক মেজাজে থাকবেন এবং হঠাৎই জীবনের ফাঁক-ফোকরে আলো ফেলবেন। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে ‘Queen Victoria’ (১৯২১), ‘Books and Characters’ (১৯২২), ‘Portraits in Miniature and Other Essays’ (১৯৩১) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এই গ্রন্থগুলি তাঁকে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ জীবনী-সাহিত্য রচয়িতার স্বীকৃতি দিয়েছে।

বাংলা জীবনী-সাহিত্যের ক্ষেত্রে অনেকে বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণচরিত্র গ্রন্থটিকে আলোচনায় আনতে চান। মধ্যযুগীয় চরিত-সাহিত্যের বিপরীতে তিনি বাংলায় জীবনী রচনাকে নতুন মাত্রা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দেবতা হিসাবে পরিচিত একটি চরিত্রকে বেছে নিয়েছিলেন, তাই একে আধুনিক জীবনী-সাহিত্যের নিদর্শন বলা যায় না। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা ঈশ্বর গুপ্ত ও দীনবন্ধু মিত্রের জীবন-বিষয়ক আলোচনায় জীবনচরিত রচনার পক্ষে মূল্যবান উপাদান থাকলেও তিনি পূর্ণাঙ্গ জীবনচরিত রচনায় আগ্রহী হননি। রবীন্দ্রনাথ যদিও রামমোহন, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর প্রভৃতি খ্যাতনামা ব্যক্তির জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত রচনা দ্বারা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন, কিন্তু তিনিও পূর্ণায়ত জীবনী রচনায় হাত দেননি।

একালের সাহিত্যিকদের মধ্যে জীবনী রচনায় আগ্রহ দেখিয়েছিলেন মোহিতলাল মজুমদার। তাঁর ‘বঙ্কিম বরণ’ ও ‘শ্রীমধুসূদন’ কাহিনিমূলক জীবনকথা নয়, বরং তাতে দুই অসামান্য প্রতিভার ভাবজীবনের আলোচনাই প্রাধান্য পেয়েছে। মোহিতলালের আর একটি জীবনচরিত ‘জয়তু নেতাজী’ অবশ্য সেই পর্যায়ে ওঠেনি, কারণ নেতাজীর ভাবজীবনের সঙ্গে কর্মজীবন এখানে ততটা গুরুত্ব পায়নি। মোহিতলালের পরেই জীবনচরিত রচনায় যাঁর নাম করতে হয় তিনি হলেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। অনেকটা কথাসাহিত্য রচনার আকর্ষণীয় ঢংয়ে তিনি লিখেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জীবনীগ্রন্থ ‘পরম পুরুষ শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ’। পরবর্তীকালে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত আরও যে কয়েকটি জীবনীগ্রন্থ রচনা করেছিলেন সেগুলি হল স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী ‘বীরেশ্বর বিবেকানন্দ’, নেতাজীর জীবনী ‘উদ্যত খড়গ’ এবং নজরুলের জীবনী ‘জ্যৈষ্ঠের ঝড়’। এগুলির পাশাপাশি স্বামী সারদানন্দ প্রণীত ‘শ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ’ গ্রন্থটিকেও জীবনী-সাহিত্য বলেই গণ্য করতে হবে, যদিও তাতে ভক্তিরসের উপাদান অনেক বেশি।

স্বামী বিবেকানন্দের জীবন নিয়ে অচিন্ত্যকুমারের আগেই সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার লিখেছিলেন ‘বিবেকানন্দ চরিত’। বিদ্যাসাগরের জীবন নিয়ে লেখা হয়েছিল দু’টি জীবনীগ্রন্থ – চণ্ডীচরণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ এবং সুবলচন্দ্র মিত্রের ‘বিদ্যাসাগর’। তবে সাহিত্যগুণের বিচারে এগুলিকে ছাপিয়ে গিয়েছে ইন্দ্র মিত্রের লেখা ‘করুণাসাগর বিদ্যাসাগর’। এ ছাড়া বিদ্যাসাগরের জীবন অবলম্বনে লিখেছেন নমিতা চক্রবর্তী এবং সন্তোষকুমার অধিকারী। রাজা রামমোহন রায়ের চরিত্রটিও লেখকদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে এবং তাঁর জীবন নিয়ে অনেকগুলি গ্রন্থ রচিত হয়েছে। নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়’। এছাড়া মণি বাগচি লিখিত ‘রামমোহন’ একটি সুখপাঠ্য রচনা। 

মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক বর্ণময় চরিত্র। তাঁকে নিয়ে প্রথম জীবনীগ্রন্থ লিখেছিলেন যোগীন্দ্রনাথ বসু। এ ছাড়াও মাইকেলকে নিয়ে জীবনীগ্রন্থ লিখেছেন প্রমথনাথ বিশী, শীতাংশু মৈত্র, মণি বাগচি প্রমুখ। পরবর্তীকালে গোলাম মুর্শিদ রচিত ‘আশার ছলনে ভুলি’ মাইকেলের প্রামাণ্য জীবনীগ্রন্থ রূপে স্বীকৃত হয়েছে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম আলোচিত গ্রন্থ প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রচিত রবীন্দ্রনাথের পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ ‘রবীন্দ্রজীবনী’। রবীন্দ্রানুরাগীদের কাছে এটি একটি আকরগ্রন্থ বলে বিবেচিত হয়। রবীন্দ্রনাথের জীবন সংক্রান্ত এই রকমই আরও একটি আকরগ্রন্থ হল প্রশান্তকুমার পালের ‘রবিজীবনী’, যা লেখকের অপরিসীম পরিশ্রমের ফসল।

মধ্যযুগে চৈতন্যদেব ও তাঁর পার্ষদদের নিয়ে অনেকগুলি জীবনীকাব্য রচিত হয়েছিল। এগুলিতে উচ্চস্তরের কাব্যরস থাকলেও এই সব আখ্যানধর্মী কাব্য আসলে মহৎ সন্তজীবনের অলৌকিক মাহাত্ম্যের বর্ণনা, যা মূলত ভক্তিরসাত্মক। চৈতন্যভাগবত, চৈতন্য চরিতামৃত, চৈতন্যমঙ্গল ইত্যাদি নামের জীবনীকাব্যগুলি যতটা প্রশস্তিমূলক ততটা প্রামাণ্য ও ইতিহাসসম্মত নয়। এগুলিকে আধুনিক জীবনী-সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত না করে ‘সন্তজীবনী’ (বা hagiography) বলাই ভাল।


।। তিন।।

জীবনীকার যেমন কোনও ব্যক্তির জীবনকথা অবলম্বনে জীবনচরিত (biography) লেখেন, তেমনই কেউ নিজেই তাঁর জীবনকাহিনি লিখতে পারেন, যাকে বলা হয় আত্মচরিত (autobiography)। স্যামুয়েল জনসন মনে করতেন জীবনচরিত আত্মকৃত হলেই ভাল। তবে অনেক সময় লেখক নিজের কথা লিখতে গিয়ে সংযম হারিয়ে ফেলেন, নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের জীবনবৃত্তান্তকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন না। অন্যদিকে আত্মচরিত লিখতে গিয়ে লেখক যদি বিনয় বা কুন্ঠার বশে তাঁর জীবনের অনেক অভিজ্ঞতাকে আড়ালে রাখেন তাহলেও জীবনবৃত্তান্ত সঠিক হয় না। আত্মচরিতের প্রাচীন উদাহরণ হিসেবে সন্ত অগাস্টাইনের ‘Confessions’-এর নাম করা যায়, যেটির রচনাকাল আনুমানিক ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। 

আধুনিক আত্মচরিত রচনার শুরু অষ্টাদশ শতকের শেষে রচিত ফরাসি দার্শনিক রুশোর ‘Confessions’ দিয়ে। এ ছাড়া কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আত্মচরিত হল বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের ‘Autobiography’, গিবনের ‘Autobiography’, জন স্টুয়ার্ট মিলের ‘Autobiography’, মহাত্মা গান্ধীর ‘My Experiments with Truth’ ইত্যাদি। বাংলায় এ ধরনের রচনার উদাহরণ নবীনচন্দ্র সেনের ‘আমার জীবন’, শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘আত্মচরিত’, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের ‘আমার সাহিত্য জীবন’ ইত্যাদি। কখনো কোনও কবি একটি দীর্ঘ কাব্যের রূপে আত্মচরিত লেখেন, যেমন উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘Prelude’। আবার কবি স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের ‘Biograpia Literaria’ একটি আশ্চর্য আত্মজৈবনিক রচনা। তথ্যভার সরিয়ে রেখে সাহিত্যজীবন ও দার্শনিক উপলব্ধির এ এমন এক বিবরণ, যাতে প্রচলিত আত্মজীবনীর পূর্ণতা পাওয়া যায় না।

আত্মচরিতে উত্তম পুরুষের বয়ানে লেখক নিজেকেই উন্মোচিত করেন। তবে কাজটি মোটেই সহজ নয়। নিজের কৃতিত্বের কথা বিশদে লিখলে তা পাঠকের কাছে পীড়াদায়ক হয়ে উঠতে পারে, আবার নিজের দোষ-ত্রুটির কথা অকপটে স্বীকার করার মানসিকতাও সুলভ নয়। এ ছাড়া নিজের জীবনের অজস্র ঘটনা, নানা চরিত্র ও বিচিত্র অভিজ্ঞতাসমূহের মধ্যে থেকে গ্রহণ-বর্জন করতে গেলে আত্মজীবনীকারের বিবেচনা ও শিল্পজ্ঞান যথাযথ হওয়া দরকার। কেবলমাত্র কালানুক্রমিকভাবে জীবনের সমস্ত ঘটনা লিপিবদ্ধ করে গেলেই আত্মজীবনী সার্থক হয় না। প্রয়োজনে কালিক পারম্পর্য ভেঙে চরিতকথাকে প্রাসঙ্গিক ও আকর্ষণীয় মাত্রা দিতে হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর আত্মস্মৃতিমূলক রচনা ‘জীবনস্মৃতিতে’ বলেছেন – “স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না। কিন্তু যেই আঁকুক সে ছবিই আঁকে। অর্থাৎ যাহা কিছু ঘটিতেছে তাহার অবিকল নকল রাখিবার জন্য সে তুলি হাতে বসিয়া নাই। সে আপনার অভিরুচি অনুসারে কত কি বাদ দেয়, কত কি রাখে। কত বড়কে ছোট করে, ছোটকে বড় করিয় তোলে। সে আগের জিনিসকে পাছে ও পাছের জিনিসকে আগে সাজাইতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। বস্তুত তাহার কাজই ছবি আঁকা, ইতিহাস লেখা নয়।”

জীবনচরিতের আর একটি রূপ দিনপঞ্জী বা কড়চা (Diary)। কখনো কখনো লেখক তাঁর জীবনের নানা ঘটনা দৈনন্দিন পরিক্রমার আকারে লিপিবদ্ধ করেন। এর শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হল স্যামুয়েল পেপিজ-এর ‘Diary’। ১৬৬০ সালের ১লা জানুয়ারী থেকে শুরু করে ১৬৬৯ সালের ৩১ মে পর্যন্ত তিনি এই ডায়েরি লিখেছিলেন। মোট ছ’টি খণ্ডে এই ডায়েরি ম্যাগডালেনের গ্রন্থাগারে রাখা ছিল। কেমব্রিজের জনৈক ছাত্র জন স্মিথ ১৮১৫ সালে এই ডায়েরির পাঠোদ্ধার করে তা প্রকাশের উপযোগী করেন। একান্ত ব্যক্তিগত রচনা হিসাবে এর আকর্ষণ ও সাহিত্যমূল্য উপেক্ষা করার মত নয়। ঠিক এ ধরনের দিনপঞ্জী বাংলা ভাষায় তেমন নেই। তবে এই গোত্রের রচনা হিসাবে চারুচন্দ্র দত্তের ‘পুরনো কথা’, কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের ‘পুরাতন প্রসঙ্গ’, চন্দ্রশেখর বন্দোপাধ্যায়ের ‘গদাধর শর্মা ওরফে জটাধারীর রোজনামচা’, রবীন্দ্রনাথের ‘য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি : খসড়া’ প্রভৃতির নাম করা যায়। 

‘দিনপঞ্জী’ বা ‘কড়চা’ অনেকটা আত্মজীবনীমূলক ও স্বগত আলাপনের ভঙ্গীতে লেখা হয়ে থাকে। রচনায় দিন, মাস, বছরের উল্লেখ থাকে এবং কালানুক্রমিকভাবে প্রতিদিনের ঘটনা বা ও অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ থাকে। ব্যক্তিগত দিনলিপির আকারে রচিত হলেও তাতে সমসাময়িক সমাজ ও পরিবেশের ছাপ পড়ে। খ্যাতিমান মানুষেরা অনেকেই ডায়েরিতে প্রাত্যহিক দিনলিপি বা টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা লিখে রাখেন। কখনো কখনো ডায়েরির সেই খসড়া থেকে আত্মচরিত বা স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ জন্ম নেয়। তবে তেমনটা হতে গেলে ব্যক্তির দিনলিপিকে ভাষা, বর্ণনাশৈলী ও উপস্থাপনার গুণে সুখপাঠ্য হতে হয়। তাতে যথোচিত সাহিত্যগুণ আরোপিত হলে রচনা পাঠকের কাছে আদরণীয় হয়। উদাহরণ হিসাবে নাৎসি বাহিনির হাতে অত্যাচরিত পরিবারের একটি ছোট মেয়ে ‘অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরী’-র কথা বলা যায়।

ডায়েরির প্রায় সমগোত্রীয় লঘুভার পঞ্জীকরণের রীতি হল ‘জার্নাল’। আত্মজৈবনিক রচনায় এ ধরনের রীতির প্রয়োগ লক্ষণীয়। ইংরেজিতে জেমস বসওয়েলের ‘জার্নাল’ ও বাংলায় শঙ্খ ঘোষের ‘জার্নাল’ এ ধরনের আঙ্গিকের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। আর এক ধরনের আত্মজীবনীমূলক রচনা হল ‘স্মৃতিকথা’ বা memoir। এতে লেখক তাঁর জীবন ও অভিজ্ঞতার বিবরণ তুলে ধরেন। লেখকের জীবনের কোনও বিশেষ অভিজ্ঞতাকে বা কোনও বিশেষ ঘটনাকে তুলে ধরতে কখনো দীর্ঘ প্রবন্ধ, কখনো উপন্যাসের বিন্যাসে বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরা হয়। ‘নেপোলিয়নের স্মৃতিকথা’ হল এই শ্রেণীর রচনা। বাংলায় এ ধরনের রচনার নিদর্শন হিসাবে বিদ্যাসাগরের ‘আত্মচরিত’, রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’, ভূপেন গাঙ্গুলীর ‘স্মৃতিকথা’ ইত্যাদির নাম করা যায়। ‘স্মৃতিকথামূলক উপন্যাস’ (memoir novel) সাহিত্যের একটি বিশেষ ধারা রূপে স্বীকৃত। জন ক্লীল্যাণ্ডের ‘Memoirs of a Woman of Pleasure’ (১৭৪৮) এবং উইলিয়াম মেকপীস থ্যাকারের ‘The Memoirs of Barry Lyndon’ এই শ্রেণীর রচনার নিদর্শন।




Comments