গল্প - অনসূয়া সরকার বিশ্বাস


ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ


অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভায় আর হিমেল হাওয়ায় চারদিকটা ভীষণ মনোরম হয়ে উঠছে। ইচ্ছে থাকলেও এক অজানা শঙ্কায় এই সুন্দর নিসর্গের মোহময়তায় আবিষ্ট হতে পারছিনা। শিবজীর মন্দিরে সন্ধ্যা আরতী চলছে। মনে মনে শিবজী কে প্রণাম করে বললাম "হে ঈশ্বর আমায় শক্তি দাও, আমি যেন সব বাঁধা অতিক্রম করে রজত কে সুস্থ করে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি, এ  লড়াইটা  যে আমার একার।" এবার গেস্ট হাউসে ফিরতেই হবে।রজত  কে একা রেখেই  এসেছিলাম "হেলথি হার্ট"  এর  ড: সাক্সেনার ওপিনিয়ন নিতে।

ড: সাক্সেনা আজ বললেন অ্যানজিওপ্লাস্টি  ব্যতীত রজত সুস্থ হবেনা। খানিকটা মানসিক প্রস্তুতি ছিলই। আমাদের একমাত্র সন্তান রনি মুম্বাইতে। এত কম সময়ে  সে আসতে পারবেনা। কিছুদিন আগেই  ছুটি নিয়ে  মউলকে নিয়ে থাইল্যান্ড গিয়েছিলো এখন আর  হাতে ছুটি নেই। তবে  রনির বন্ধু কে বলা আছে, কোনো সমস্যায় সাহায্য করার জন্য। ব্যয় বহুল সার্জারী। এ যাবৎ  যা সঞ্চয় করেছে রজত তাতে অর্থনৈতিক সমস্যা হবেনা। এ.টি.এম, চেক বই সবই এনেছি। আজই অ্যানজিওগ্রাম হয়ে গেছে। বাদ বাকি টেস্ট গুলো কাল করে নেবো। সব ঠিক থাকলে আগামী পরশুই....  


খানিকটা তাড়ায় ছিলাম। অপারেশনটা হয়ে গেছে। ডক্টর সাক্সেনা যথেষ্ট ভরসা দিলেন। গেস্ট হাউস থেকে প্রয়োজনীয় সব জিনিস আনতে হবে। রাতটা তো রোগীর সাথে অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে কাটিয়ে দিয়েছিলাম। ওষুধ গুলো নিয়ে দুপুরেই চলে আসবো। 

মাগো! গেলো কোমর টা! কি দুষ্টু ছেলে রে বাবা! ওষুধ গুলো সব পরে গেলো! আহা বাচ্চাটার লাগেনি তো?

"ও বাবা তোমার ইয়ে... বেটা জাদা চোট তো নেহি আয়ী! তুম ঠিক হো তো? তুমহারা নাম ক্যায়া হ্যা।"

"নো। ইটস ওকে।  আই অ্যাম ভিকি। ভিগনেস।"

ইনকা নাম ভিগ্নেশ। ডক্টর ইল্লোরে কা বেটা! সুপার স্পেশালিটি কা নিউরো ডক্টর। বলে উঠল মাঝ বয়সী হিন্দি ভাষী একজন মহিলা।

(হাই সুগার ধরিয়েছি তাই ব্যাগে সবসময় চকোলেট মজুত রাখি!) 

দুটো ছোট ছোট ক্যান্ডি এগিয়ে বললাম " তুমহারে লিয়ে।"

"থ্যাংক ইউ!"

কি মিষ্টি মুখটা! বড্ড চেনা চেনা লাগছে কেনো! স্মৃতি হাতরে খুঁজতে থাকি, দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরে স্মৃতি নেহাৎ কম নয়। একদম ঋদ্ধির মত!


৩ 

সুদূর অতীত থেকে ভেসে আসে একটা ছোট্ট মুখ।তখন কতই বা বয়স আমার। একুশ কি বাইশ! বাবা অফিসের কাজে খড়গপুর যাবেন! আমি জেদ ধরে বসলাম বিয়ের শাড়ি গড়িয়াহাট থেকেই কিনব। অগত্যা বাবা নলিনাক্ষ সেন আমাকে ভূতপূর্ব সহকর্মী তথা ঘনিষ্ঠজন রমেনবাবুর কাছে দিন পাঁচেক রেখে খড়গপুর গেলেন। যেমন আন্তরিক রমেন জেঠু তেমনি মায়া জেঠিমা। কি প্রাণবন্ত হাসি! আজও চওড়া সিঁদুর পরা সদা হাস্যজ্জ্বল মুখটি স্পষ্ট ভাবে মনে পরে। দুই বৃদ্ধ দম্পতির সঙ্গে ছিল একজন ক্ষুদে সঙ্গী। দশ বছরের ঋদ্ধি, তাদের আদরের দৌহিত্র। শুনেছিলাম ঋদ্ধির মা রানীদি বিবাহ বিচ্ছিন্ন হয়ে, ঋদ্ধির কাস্টডি পেয়েছেন। কেষ্টপুরে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন। 

সাতদিনেই ঋদ্ধি  আমার বড্ড ন্যাওটা হয়ে উঠলো।  কখনো ক্ষীরের পুতুল, নালক লাল কালো, টিনটিন, কখনো প্যাস্টেলের ল্যান্ডস্কেপ, আবার কখনো বা লুডো, দাবা এগুলো নিয়েই ছিল তার একটা  বিশাল জগৎ। ওই জগতে সে একমাত্র প্রবেশাধিকার দিয়েছিল আমাকেই। কিন্তু তবুও, প্রতিদিনের দিম্মার হাতে তৈরী লোভনীয় টিফিন বন্ধুদের বিলিয়ে দেওয়া, ঠ্যাং ভাঙ্গা শালিকের পরিচর্যা করা, হাসিভরা মুখটার পেছনে লুকিয়ে লুকিয়ে অনেক রাতে চাদর মুড়ি দিয়ে চোখের জল ফেলা শিশুটির মনের রাজ্যে তার অপা দি ঢুকতে পারেনি।

ইতিমধ্যেই বাবা রমেন জেঠুর অ্যাপার্টমেন্টের একজনের ল্যান্ড ফোনে জানিয়েছিলেন খড়গপুর থেকে ফেরার পথে আমাদের দেশের বাড়ি শ্যামচকের ইষ্ট দেবতার পুজো সেরে, ক-ঘর জ্ঞাতিকে নিমন্ত্রণ করে তবেই তিনি ফিরবেন। আরো দিন দশেক লাগবে। আমার হাতে বিয়ের বাজার বাবদ কিছু টাকা আগেই দেওয়াছিল, যাতে আমি রানীদির সঙ্গে গিয়ে কিছু কেনাকাটা সারতে পারি। জলপাইগুড়িতে যখন রমেন জেঠুর পোস্টিং ছিল তখন আমি ক্লাস থ্রি তে আর রানী দি গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে। সে সময়কার নাম করা সুন্দরী ও শৌখিন মেয়ে। কলকাতায় আসবো, শাড়ি কিনবো আর রানী দির টিপস নেবনা তাই কখনো হয়?

ঋদ্ধির সাথে যতই হুটিপাটি করি, তখন সদ্য যৌবনে পা দেওয়া আমার মন রং বেরঙের নতুন শাড়ি, আর হাল - ফ্যাশনের প্রসাধনীর আকাঙ্ক্ষায় উন্মুখ হয়েছিল। কারণ আমার সেই স্বপ্নের দিনটায় আমাকে যে সম্রাজ্ঞী হতেই হবে!

কিন্তু ওই পনেরোদিনে আমি রানী দি কে কখনো দেখিনি। এত আন্তরিকতা আদরের মধ্যে কোথাও একটা অদৃশ্য গোপনীয়তা ছিল। ছোট্ট ঋদ্ধি বলতো সে অনেক দিন মাকে দেখেনি। তার বাবার সঙ্গে ও কোনো যোগাযোগ  বহুবছর নেই। কিন্তু তার অপা দি কে সে একটা  বিধি নিষেধের  সূক্ষ্ম প্রাচীর ডিঙিয়ে কোনো একটা গভীর যন্ত্রণা বলে উঠতে পারেনি।আজ ও মনে আছে জেঠুদের অ্যাপার্টমেন্টের ছাদ থেকে সদ্য নেমেছি, হঠাৎ দেখি  ঋদ্ধি ভীষণ জেদ করে কাঁদতে কাঁদতে  জিনিস পত্র ছুঁড়ে  ফেলছে। আর জেঠিমনী ঠাকুরের সামনে স্থির হয়ে বসে কাঁদছেন। রমেন জেঠু পাথরের মত স্থির। আমি বিচলিত হয়ে জানতে চেয়েছিলাম, উনি কঠোর মুখে শুধু বলেছিলেন অপালা "তুমি ওকে একা থাকতে দাও।"  আর আমি কিছু জানতে চাইনি। তবে  রানীদির ঘরের ড্রেসিং টেবিলে নিত্য ব্যবহার্য প্রসাধনীতে ধুলোর পরত  আর এক্সপায়ারি ডেট দেখে বুঝতে অসুবিধে হয়নি তার  বহুদিনের অনুপস্থিতি। 

অবশেষে  এভাবেই আমি আর ঋদ্ধি হই হই করে, খেয়েদেয়ে, জেঠু, জেঠিমা কে নিয়ে ঘুরে ফিরে পনেরো দিনের মেয়াদ ভালোভাবেই কাটিয়ে দিলাম।কিন্তু আমার দূর্ভাগ্য রানীদি এলোনা আর আমাকেও নিজের আনাড়ী চোখের ওপর ভরসা করে যা হোক একটা কিছু গোছের জিনিসপত্র কিনে জলপাইগুড়ি ফিরতে হলো। সেই উত্তর ফাল্গুনী তিথিতে, সবার চোখে সম্রাজ্ঞী হতে পেরেছিলাম কি না জানিনা তবে অধীর আগ্রহে বসে ছিলাম ঋদ্ধি আর রমেন জেঠুর পরিবারের জন্য! কিন্তু তারা কেউ আসেননি। চিঠিতে যোগাযোগ করেও কোনোভাবেই আর কখনো  ওদের খোঁজ পাইনি। পরে যে কয়েকবার কলকাতায় যাবার সুযোগ হয়েছে পরিবেশ, পরিস্থিতি বিচার করে আমার সেই সুপ্ত ইচ্ছেটা সুপ্তই থেকে গেছে। রজত বা আমার রাশ ভারী শস্রুমাতা কাউকেই আর বলে উঠতে পারিনি। ধীরেধীরে সময় আর জীবনের উত্থান পতনের দ্রুততায় আমার জীবনখাতার ওই পনেরো দিনের ছোট্ট অধ্যায়টা পেছাতে পেছাতে কোথায় যেনো হারিয়ে গিয়েছিলো।আজ এই ছোট্ট ভিকি একটা দমকা হাওয়ার মতো হারিয়ে যাওয়া অধ্যায়টা সামনে এনে দিলো।


 ৪

কালই রজত কে ডিসচার্জ করা হয়েছে। আজ  এসেছি ডক্টর সাক্সেনার কাছে একটা মেডিসিনের ডোজ জানতে আর রজত ট্রেন জার্নি করতে পারবে কিনা সেটাও জানা খুব দরকার। সব ঠিক থাকলে  দু একদিনের মধ্যেই তৎকালে গৌহাটি_ব্যাঙ্গালোরে রিজার্ভেশন করবো। সকালের ব্রেকফাস্ট দিয়ে এসেছি রজতকে। ডাল করা আছে। দুপুরে গিয়ে ভাত আর সবজি করবো। এদিকে মাছের চল তেমন নেই। ফেরার পথেই কিছু সবজি বাজার করে নিয়ে যাবো। এখন কতক্ষন বসতে হবে কে জানে! রিসেপনিস্ট মেয়েটি ঈশারায় বললো ফাইল জমা আছে একটু বসতে হবে। লাউঞ্জে চুপ করে বসে আছি। অনেক বাংলাদেশের মানুষ এসেছেন এখানে চিকিৎসা করাতে। আলাদা রাষ্ট্র হলেও ভাষা এক হলে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে সহজেই। আমাদের গেস্ট হাউসে পাশের ঘরে উঠেছে শিরীন। ও এসেছে বাংলাদেশ থেকে। ছোট্ট একবছরের ছেলের হার্টে ফুটো। সার্জারী হয়ে গেছে। মোটামুটি সুস্থ। হেলথি হার্টের পেছনে এদের NT গ্রুপের সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল তথা ক্যান্সার ইনস্টিটিউটটিও খুব জনপ্রিয়। আমি আর শিরীন গল্প করছি হঠাৎ দেখি ভিকি ছুটে বেরিয়ে গেলো কাঁদতে কাঁদতে। ওর পেছন পেছন ছুটছে ওর আয়ামাসী কৌশল্যা। কি হলো কে জানে।


দুপুর গড়িয়ে গেছে। শিরীন এসেছে। গল্প করছে ওর দেশের, সংসারের, ওর খালার, ওর আপ্পুর। ওর আর সাব্বিরের নিকাহর। হঠাৎই বলে উঠলো "অপালা আন্টি সামনেই একটা পার্ক আছে চলনা একটু ঘুরে আসি।" আমি ইতস্তত করছি দেখে সে আমাকে আশ্বস্ত করলো সাব্বির রেহানকে কোলে নিয়ে এসে রজত আংকেলের সঙ্গে গল্প করবে।প্রাণবন্ত উচ্ছল মেয়ে শিরীন। আমার মত দ্বন্দ্ব ওর নেই। ভাবা মাত্রই কাজ। সাব্বিরও ঘুমন্ত রেহান কে নিয়ে হাজির। অগত্যা গেস্টহাউস থেকে বেরিয়ে কয়েক পা এগোতেই একটা সুন্দর পার্ক। শিরীনের মনোভাব বুঝতে পেরেছি। অনেকদিন চাপা টেনশনে ছিল, আজ জেনেছে ওর ছেলে বিপদ মুক্ত তাই মুক্ত পরিবেশে দু একটা সেলফি তুলে আনন্দটা উৎযাপন করতে চায়। আমি একাই হাঁটছি সহসা দেখলাম একটা ছোট্ট বছর দশেকের ছেলে মুখ গোঁজ করে চুপ করে পাথরের মধ্যে বসে আছে। ওর সামনে আসতেই বুঝতে পারলাম যা আশঙ্কা করেছি তাই।আমাকে দেখেই ভিকি ছুটে পালাচ্ছিল আমি ওর হাত ধরে আশ্বস্ত করলাম ওর বাড়িতে জানাবনা।


আমার রুমে ভিকি বসে আছে। তরকা আর রুটি বানিয়েছি। আয়েস করে বসে খাচ্ছে আর রজত আর সাব্বিরের সঙ্গে ইংরেজিতে গল্প করছে। রেহানের সঙ্গে খেলছে। হঠাৎ বেল বাজতেই আমার বুকটা ঢিপ করে উঠলো। দরজা খুলতেই দেখলাম ডক্টর নেত্রবতী ইল্লোরে। পেছনে এক সুপুরুষ ভদ্রলোক। আমাকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে ভিকিকে নিয়ে গেলেন। ভিকির হয়তো অভিমান হয়েছে কিন্তু এ ছাড়া কি বা করার ছিল! রজত কে যখন আমি পার্ক থেকে ফোন করেছি তখনই ও নার্সিংহোমে সাব্বিরকে পাঠিয়ে নেত্রবতী ম্যাডামের পার্সোনাল মোবাইল নম্বর জোগাড় করে আমাকে দেয়। আমি ভিকিকে আমার রুমে এনে ওনাকে ফোনে সবটা জানাই। ক্ক,কয়েক ঘন্টার মধ্যে ছেলেটা মায়ায় জড়িয়ে দিয়ে গেল।


সকালের ব্রেকফাস্ট অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। রজত সামনের পার্কে সাব্বিরের সাথে গিয়ে হেঁটে এসেছে।রনি ফোন করে খবর নিলো ওর পাপার। রনির কলটা ডিসকানেক্ট করার সাথেসাথে স্ক্রিনে ভেসে উঠলো নেত্রবতী ম্যাডামের নম্বর। সব ঠিক আছে তো?

_   " হ্যালো গুডমর্নিং!"

   _ "গুড মর্নিং ম্যাডাম! ভিকি ক্যায়সা হ্যা। সব ঠিক হ্যা তো!"

  _"এভরিথিং ইস ফাইন! প্লিজ "ম্যাডাম" মত বলিয়ে! আপ মেরে পেসেন্ট নেহি হ্যা। টেল মি নেত্রবতী। আপ মুঝসে সিনিয়র হো।"

   _"ইটস ওকে।"

   _ "মিসেস সেনগুপ্তা কাল ভিকি কা বার্থ ডে হ্যা। আপকো আউর মিস্টার সেনগুপ্ত কো অনাহী হোগা!"

   _"নেত্রবতী হামারে তরফ সে উসকো ঢের সারে প্যার দেনা! মগর রজত তো অভি ফিট নেহি হ্যা।"

   _"কুছ নেহি হোগা! হাম কার ভেজ দেঙ্গে, ইস শহর সে থোড়া দুর, হামারা এক ফার্ম হাউস হ্যা। উহা পর হি..ডোন্ট হেশিটেট প্লিজ।"

   _ "ওকে। ম্যা মিস্টার সেনগুপ্তা কে সাথ থোড়া ডিসকাস করকে আপকো ইনফর্ম।"

   _"ওকে, বায়"


বিকেল হয়ে এলো। একটু পরেই ডক্টর এল্লোরের গাড়ী চলে আসবে। তেমন ভালো শাড়ী আনিনি।একটা পিংক শেডের সিল্ক ছিল ওটাই পড়লাম।শিরীন আবার জোর করে ওর পার্ল সেটটা পরিয়ে দিলো। গিফট কি আর দেবো সব ই ভিকির আছে।দুটো বই নিলাম। মার্ক টোওয়াইনের "অ্যাডভেঞ্চারস্ অফ্ টমস সোইয়ার" আর "স্টোরিজ অফ্ ও হেনরী"!

ঝা চকচকে টয়োটা ইটিয়স ছুটে চলেছে আপন গন্তব্যে। ড্রাইভার ছেলেটি চলতি দক্ষিণী সিনেমার ঝিনচ্যাক গান বাজিয়েছে। সদা ব্যস্ত যান মুখর রাস্তা ছাড়িয়ে চলে এসেছি শহরের প্রান্তে। চওড়া মসৃণ রাস্তা। দুপাশে নীল সবুজ বনানী। অনেকটা জায়গা জুড়ে বড়ো বড়ো ফার্ম হাউস। সন্ধ্যে হয়ে এলেও লাল অস্তরাগে আকাশটা আরো সুন্দর লাগছে। হঠাৎ ই রনি ফোন করে বকাবকি করছে। কেনো তার অসুস্থ পাপাকে নিয়ে আমি বেরোলাম। আমার কোনো আক্কেল নেই। যেখানেই যাই সেখানেই অচেনা লোক কে নিয়ে বেশী মাতামাতি করি ইত্যাদি, ইত্যাদি।

প্রকৃতির এই অনাবিল সৌন্দর্য্য আমার মনে যে আবেশ সৃষ্টি করেছিল তার ছন্দপতন ঘটলো অচীরেই।

অবশেষে গাড়ী এসে পৌঁছল তার গন্তব্যে। বেরিয়ে এসে একটু অবাক হলাম কোনো ফার্ম হাউস নয়তো! এতো একটা অরফানেজ। "সৌজন্য অরফানেজ"! তারপাশে "মায়া ওল্ড এজ হোম"। ড্রাইভার ছেলেটি জানালো দুটোই নেত্রবতীর তৈরী।

বেরিয়ে এলেন নেত্রবতী, আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে। পরণে সাদা জমিতে সাদা সুতোয় কাজ করা ঢাকাই জামদানী আর মুক্তোর গয়না। 

এমনিতেই নেত্রবতী বেশ সুন্দরী। লম্বা ছিপছিপে চেহারা, টিকালো নাক, ঘন লম্বা চুল। গায়ের রং অবশ্য একটু চাপা। কিন্তু আজ চোখ ফেরানো যাচ্ছেনা। স্বর্গীয় সৌন্দর্য্য  ফুটে উঠেছে যেনো।অবাক  হলাম দক্ষিণী মহিলা জামদানী পরেছেন!পরক্ষণেই মনে হলো হয়তো কোনো গুনমুগ্ধ পেশেন্টের উপহার। যাইহোক লম্বা লন পেরিয়ে পৌঁছলাম বিশাল হলঘরে। ঘরের একদম মাঝবরাবর একটা গোল টেবিলে জন্মদিনের আয়োজন। একটা রুপোর বাটিতে সাদা পায়েস।একটা রুপোর থালায় কিছু ধান -দুব্বো। আশ্চর্য্য দক্ষিণী পরিবারের আনাচ কানাচ জুড়ে রয়েছে বাঙালী সংস্কার। হলঘরের চেয়ার পাতা। সেখানে আমন্ত্রিত অরফানেজ বাচ্চারা আর ওল্ড এজ হোমের আবাসিকরা। জন্মদিনের উপহার ভিকীকে দিয়ে আপন মনে হলঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। দেয়াল জুড়ে অনেক ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ।একটা মালা জড়ানো ছবি। অনেকটা ভিকির আদল। জন্ম: 1981 আর মৃত্যু: 2017। নেত্রবতী জানালেন তার স্বামী সৌজন্য চক্রবর্তী। বছর দুয়েক আগে কার অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন। মন টা খারাপ লাগলো পাশের ফ্যামিলি ফটোগুলো দেখতে দেখতে চোখটা আটকে গেলো। একী দেখলাম! চিড়িয়াখানার কাছে আমার আর ঋদ্ধির ছবিটা না!উদভ্রান্তের মত ফোটো গুলো খুঁটিয়ে  দেখতে লাগলাম। রমেনজেঠু আর মায়া জেঠিমা ছবি! আর পাশের ছবিটা তো রাণীদির মনে হচ্ছে! এই ছবিটাই তো রানী দির ঘরে ছিল। অবিকল ওটাই। ঋদ্ধির ভালো নাম তো সৌজন্য ছিল। মন আর বাঁধ  মানছেনা। প্রতিনিয়ত যোগসূত্র খুঁজে চলছে।রিচুয়ালস শেষ হতে না হতেই নেত্রবতী কে ডেকে আনলাম। হিন্দীতে বলতে পারছিনা আর। মনের সব আবেগ রুহ ভেঙে বেরিয়ে আসছে  নেত্রবতী ঋদ্ধি আর আমার ছবিটা নিয়ে কান্না দেখে বলতে লাগলো..ও আর সৌজন্য  এন আর এস এ একসঙ্গে পড়ত। তার এম .ডি. একসঙ্গে করেছে। দুজনের সাবজেক্ট নিউরোলজি। সৌজন্যের মা বিয়ে করে লন্ডনে চলে যান। ও দাদু, দিদার কাছে বড়ো হয়েছে। দাদু, দিদার মৃত্যুর পর বোর্ডিং, মেসেই কাটিয়েছে। পরে এফ.আর.সি.এস করার সময় মায়ের কাছে গিয়েছিলো। ফিরে এসে দুজনেই বিয়ে করে আর হেলথী হার্টে জয়েন করে। ওল্ড এজ হোমটা সৌজন্য তৈরি করেছিল। আর ও চলে যাবার পর ওর স্বপ্নের এই অরফানেজ টা তৈরী করেছে নেত্রবতী। সৌজন্য না থাকলেও আজ ও এগুলোর সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত সে। আমি ওদের ফ্যামিলি ফোটোর সামনে হাত বোলাচ্ছিলাম।নেত্রবতী বলে চলে ভাঙ্গা বাংলা আর হিন্দি মিশিয়ে ছত্রিশ বছরের জীবনে যারা সৌজন্যের খুব কাছের কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে যারা দূরে চলে গেছে তাদের টুকরো টুকরো বিচ্ছিন্ন ছবিগুলোকে এডিট করে এক একটা ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ তৈরি করত সে। তাই প্রতিটা একক ছবি জুড়ে জুড়ে সে নির্মাণ করতো তার স্বপ্নের ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ। আঁকড়ে ধরে থাকতো এভাবেই।

কিছু খাবার অবস্থায় আমি আর ছিলাম না। 


আজ আর আমি আমার বশে নেই। রজত কি বুঝছে কে জানে! আর হয়তো এদের সাথে দেখা হবে কি না কে জানে! মনের এক কোণে লুকিয়ে ছিল আমার  সেই ছোট্ট ভাই। দেখা হোক আর না হোক, মনে একটা ভরসা ছিল সে আছে ,জীবন তো খুব ছোট নয় দেখা হয়তো একদিন হবে আজ সে আশা চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেলো।  এ.সি অফ্ করে জানলাটা খুলে দিতে বলেছে রজত। রাস্তার  আলোটুকু ছাড়া আর তেমন আলো নেই। অবশ্য বড়ো বড় গাড়ী যাচ্ছে অনবরত। সেই আলো ঝলকানি দিচ্ছে প্রায়শই। গাড়ীর দু প্রান্তে দুজন বসে আছি। পাশাপাশি থেকেও মাঝে অনেক বছরের দূরত্ব। বিয়ের প্রথম দু একবছরের মোহের পরত সরে গেছে। তারপর দুজন মানুষের মাঝে ঢুকে পড়েছে রজতের মা, বোন, প্রতিদিনের ছোট ছোট পাওয়া, না পাওয়া। রনি এসেছে। রজতের জীবনে তার কলিগ কণা, আমার নতুন চাকরী। একটা সময় দুজনেই ভেবেছি মিথ্যে খেলাঘর ভেঙে বেরিয়ে নিজেদের মত ভাবে বাঁচি। কিন্তু আমাদের মাঝে সেতু ছিল রনি। চেয়েছিলাম ও আনন্দে, হেসে খেলে বাঁচুক। ওর হাসির কাছে আমাদের দুজনের ব্যক্তিগত সুখ তুচ্ছ ছিল। ধীরে ধীরে শাশুড়ী চলে গেছেন। ননদ এর সংসার হয়েছে। কণা নিশ্চয়তা না পেয়ে দমে গেছে। একসঙ্গে বাঁচতে বাঁচতে খড় কুটোর মত আবার আকড়ে ধরেছি। কিন্তু আমরা রনি কে সফল করেছি মাত্র! মূল্যবোধ গুলো বোধ হয় গেঁথে দিতে পারিনি। অথচ ঋদ্ধি, নেত্রবতী 'ব্রোকেন ফ্যামিলির চাইল্ড' হয়ে বুঝেছে শিকড়ের টান, পারিবারিক মূল্যবোধ। তাইতো সর্বহারা মানুষ গুলো কে ঠাঁই খুঁজে দিয়েছে। ভেঙে যাওয়া পরিবারকে ছবির মধ্যে। 

গেঁথেছে। নিঃস্ব মানুষ গুলোকে নিয়ে তৈরী করেছে একটা বৃহত্তর বৃত্ত।

আমার চোখের জল খেয়াল করেছে রজত অনেকক্ষণ। ওর মোবাইল এ বাজছে আমার বড্ড প্রিয়  মোহরদির "দূরে কোথায় দূরে,দূরে"!

আজ অনেক বছর পর বলিরেখা পরা শুকনো হাতে ওর স্পর্শ পেলাম। যেই স্পর্শে এই প্রথম মনে হলো এ হাত হাতে থাকলে হাজার বছর ধরেও দুর্গম পথ অতিক্রম করা যায়। 




Comments

  1. খুব ভালো লাগলো লেখাটি

    ReplyDelete

Post a Comment