প্রবন্ধ - জ্যোতি পোদ্দার


একান্নবর্তী আড্ডাঘরে সুবীর একান্ন


তখন ডাক পিয়ন পরমাত্মীয়। চলন্ত বাই সাইকেলে তাকে দেখলেই দাঁড়িয়ে যেতাম। এ বুঝি সাইকেল স্টেণ্ড করে থলে থেকে বের করে দেবে কোন হলুদ খাম।প্রায় চিঠি আসে আমার -- কখন বাড়ি থেকে কখন বন্ধুদের কাছ থেকে। সাংগঠনিক কাজ কারবারে যুক্ত থাকার সুবাদে বন্ধু সংখ্যা ঈর্ষনীয়। তেমনি একদিন ফ্যাকাশে হলুদ পোস্টকার্ড একটি চিঠি পেলাম--- প্রেরক সুবীর সরকার।

সাদা করতলের কবিতা বইটি কিনতে গিয়েই সুবীর সরকারকে জানা। শব্দের ভেতর দিয়ে চেনা। তখনও এই তরুন কবিকে সশরীরে দেখিনি। সাদার ভেতর নীলের রেখা দিয়ে সম্ভবত প্রচ্ছদ। মেলায় একজন ' ও এসেছিল' বলে অন্য ক্রেতার দিকে নজর দিল। "সম্ভবত সে এই ঠিকানায় থাকে "বলে জানাল কবিতাপাক্ষিক স্টলের একজন।

সেই "সম্ভবতের 'উপর ভর করেই যে চিঠি লিখেছিলাম তারই উত্তর পেলাম ফ্যাকাশে হলুদ পোস্টকার্ডে। চমকে উঠেছিলাম সেদিন। এর আগে কবি  মানস কুমার চিনির সাথে  চিঠি চালাচালি হতো। সুবীর দ্বিতীয় -- উপরন্ত সম বয়সী; কাজে কাজেই যুক্ততার গতি পেলো অনেকটা। কিন্তু দেখা আর হয়নি। 

মাঝে ৪নং প্লাটফর্মে রেল গাড়ী আটকে রইল বহুদিন। বার বছর। হঠাৎ একদিন ভার্চুয়ালে দেখা। আরে এই তো সেই কবি সুবীর সরকার। সাকিন দেবীবাড়ি। কোচবিহার। ৪ নং প্লাটফর্ম থেকে গাড়ি একার যন্ত্রের গতি পেলো। দেখা মানে ডিজিটাল দেখা। সখা কবির সাথে ভার্চুয়াল দেখা।

সুবীর সীমান্ত পেরিয়েই জানাল কবি মাসুদার বাড়িতে এসেছে। তখনো যেতে পারিনি। সেখান থেকেই পাঠাল ওর নির্বাচিত কবিতা সংগ্রহ। 

হঠাৎ উনিশ সালে তার সাথে তাহার সাথে হইয়া গেলো অ্যাকচুয়াল দেখা। কত বছর পর? বিশ বছর পর। পোস্টকার্ড আর ইনবক্স পেরিয়ে আমার বোনের বাড়ির উঠানে জড়িয়ে ধরে দেখা হলো সুবীরের সাথে। চোখভেজা আনন্দের সাথে।

সেই সুবীর হাফ সেঞ্চুরি করে শততম রানের দিকে যাওয়ার জন্য ক্রিচে দাঁড়িয়ে। আজ সুবীর একান্ন। বন্ধুকে ফুলেল শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন কবি।



দুই

সুবীরের আড্ডাঘরটি বেশ। ছিমছাম পরিপিটি। জানালায় হাফপর্দা। চারদিকে সারি সারি বই দেয়ালে হেলান দেয়া। প্রশশ্ত রাস্তার পাশেই ছোট্ট গেট -- হা করে খোলাই থাকে। লাল দালানের টিনের  জোড়াবাড়ি। ঢুকতেই ডানে আড্ডাঘর। শতরঞ্জি বিছানো। এই তো সেদিন আমিও মেতেছিলাম সারাদিনের আড্ডায়। দুপুরে পম্পার রান্নার ভোজনসহ পূর্ণদৈর্ঘ্যের আড্ডা।

সুবীর আহ্বানও চমৎকার। লোভনীয়। কোন আড্ডারুর ঠিক থাকার উপায় নেই।

"পাপড়ি নীলাদ্রি আর হিমাদ্রী চলে এলো।
ব্যাস।
জমে উঠল আমাদেন আড্ডা।
আমাদের বিনিময়পর্ব।"

এমন যাপন উদযাপনে সুবীরের ঘর একান্নবর্তী আড্ডাঘর। কী নেই সেই মিউজিক স্টুডিয়ে। কবিতা। গল্প। দেশকালের কথা। শ্রীহরির ছবির কথা।বইয়ের মোড়ক উন্মোচন।আর ঝররঝরে জলপ্রপাতের শুশ্রূষার মতো গান -- ভাওয়াইয়া গান। আমার ফিরে আসার দিনে "ও কি ও বন্ধু  কাজল ভোমরা রে কোনদিন আসিবেন বন্ধু কইয়া যাও কইয়া যাওরে" গেয়েছিল দেবশ্রী।

আমার ভেতরে সেদিন ভরে ছিল কান্না আর কান্না।আড্ডাঘরের মায়া ও ম্যাজিকে আমি মুগ্ধ। সেদিন কে না ছিল --- নিলাদ্রী পাপড়ি,দীপায়ন, মীনাক্ষী, নবনীতা উদয়ার্নব পার্থ নিয়োগী মৃগাঙ্ক তাপস সহ আমি আর সুবীর মিলে একান্নবর্তী আড্ডাঘর।

সুবীরের অভিমানও প্রবল অথচ শিশিরের মতো ক্ষনস্থায়ী। ফেবু দেয়ালে লিখছে। "আর আড্ডা নয়। এবার গভীর মনোযোগ দেবো পড়াশোনা ও পান্ডুলিপিতে। আড্ডাঘর বন্ধ। অনেক কিছু থেকে সরিয়ে আনছি  নিজেকে"।

ওমা পরদিনই দেখছি দলবেঁধে সকলে চলছে রাজাভাত খাওয়ায়। আবার সেই ফেবুর ওয়ালে" প্রচুর ভালোবাসা জড়িয়ে রেখেছে আমাকে" লিখছে সুবীর।
আড্ডা আর আলাদা হয় না--- বরং আরো আরো জমে ক্ষীর একান্নবর্তী আড্ডা।


তিন

কবির কথা হবে অথচ কবিতা নিয়ে কোন কথা হবে না তা তো হতে পারে না। সুবীর মায়া ও ম্যাজিকের কবি। এই শব্দ দুটো সুবীরই আকচার ব্যবহার করে। এমন কী সংযোজক অব্যয় ''ও'' ব্যবহার করে নির্মিত বাক্যে এমন এক সমন্বয়ী বা বিরোধা ভাসের দোলাচাল থাকে যা অন্য অনেকের থেকে সুবীরকে আলাদা করে। 

সুবীরের কবিতা আকারে ছোট তবে বার্তায় ঠাসা। এক বাক্যে বার্তা দিতে না দিতেই অন্য বাক্যে অন্য কোন বার্তা। এটি এই সময়ের বৈশিষ্ট্যও বটে। যোগ্য কেউ সুবীরকে নিয়ে লিখবে --- আমি শুধু আমার পর্যবেক্ষন এখানে নোক্তা দিয়ে রাখলাম। 

সংযোজক অব্যয় ব্যবহার করে সুবীরের কয়েকটি বাক্য বরং টপাটপ পড়ে ফেলিঃ

ক। হাই ও ক্লান্তির ভেতর এই আমাদের দেশ দুনিয়া
খ। তাই আত্মহত্যা লিখি।
     লিখি বাজনা ও বিসর্জন
গ। মধু ও মোমের দাবীতে কত মিছিল হয়।
ঘ। হুজুগের ভেতর শুয়ে থাকা শহরে
     ফিরে আসছে গুজব ও হাইফেন
ঙ। ভায়োলিন ও ভায়োলেন্স দিয়ে ভরে উঠা সেমিনার।
চ। ঘুম ও অ্যালার্জির ধারে আমাদের পৃথিবী।
ছ। চারদিকে বন্ধুকবাজ
   চিরকালীন হয়ে উঠতে থাকা
            মাছ ও বেড়াল

এই তো সুবীর। কবি সুবীর সরকার। একান্নতে পা।একান্নবর্তী আড্ডাঘরে সুবীর সরকারের একান্ন বছর। আহা! জীবন। যাপন। উদযাপন।



Comments

  1. মিঠা লাগল না ভাই জ‍্যোতি। ব‍্যক্তিগত গদ‍্য হলেও একটু রসকষ থাকা বাঞ্চনীয়। জন্মদিনের শুভেচ্ছা সুবীরকে। আমিও কতদিন তোমাকে দেখিনি। ইচ্ছে হচ্ছে খুব ছুটে যেতে পারিনা। ব‍্যক্তিগত হয়ে গেল তো।

    ReplyDelete

Post a Comment