গল্প - ব্রততী সেন দাস


ফুলির মা


স্টাডিতে ঢুকে অনন্যা বিরক্ত হল। সারা ঘরটার কী অবস্থা!অমিতাভ রাত জেগে কাজ করে আর বিপুল সিগারেট খায়। তার অবশিষ্টাংশ আশট্রে উপছে মেঝেতেই পড়ে আছে। অনন্যা ফুলির মাকে ডেকে বলল- মাসি, তুমি এই ঘরটা আগে ঝাঁট দাও তো!

ফুলির মা ঝাঁট দিতে দিতে বলল- দাদাবাবু খুব সিগারেট খায় না?

- হুঁ

- শুনেছি সিগারেট খাওয়া খারাপ?

- ঠিকই শুনেছ, অনন্যা বইয়ের তাক গোছাতে গোছাতে বলল। ফুলির মা অনেকদিনের লোক, কাজকর্ম খুব  ভাল, কামাই নেই। শুধু একটাই দোষ খুব বকবক করে। হাত আর মুখ দুইই চলে সমানে। অফিসের দিনে অনন্যা ওর বকবকানিতে কান দেয় না। আজ ছুটি, রিলাক্সিং মুডে তাই ফুলির মায়ের কথা কিছু কানে ঢুকছে।

- ফুলির বাবা আমাকেও খুব বকত।

- কেন?

- ওই যে বিড়ি খেতাম।

- তুমি বিড়ি খেতে!

- হ, কী করব, অব্যেস হয়ে গেছিল বৌদি। ঘরটা ঝাঁট ময়লাগুলো জড়ো করে বলল- ফুলির বাবাও বড় রাগ করত গো। নিজে তো বিড়ি তামাক ছুঁতো না পর্যন্ত। বলত বিড়ি খাস না,মুখে বড় গন্ধ হয়, বলে ফুলির মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফিক করে একটু হাসল। বছর পঞ্চাশের দোহারা চেহারা, মাথায় কাঁচা পাকা চুলের একটা বড়ি- খোঁপা। অর্ধেক দাঁত নেই, গালে ভেঙে গেছে কিন্তু চোখ দুটো সুন্দর। এক সময় এই চোখ যে মায়াঞ্জন ছড়াত বোঝাই যায়।

- তার পর তুমি বিড়ি ছেড়েছিলে?

- নাহ্! সে কি ছাড়া যায়

এ নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি, মারপিটও হয়েছে বউদিমণি।লুকিয়ে চুরিয়ে তাও খেতাম। ফুলির বাবা ঠিক ধরে ফেলত,কতা বলতো না গো। বলত খাস না বৌ,বুকের দোষ হবে।

- ঠিক কথা। দেখোনা, দাদাবাবুর কত কষ্ট, শ্বাসের কষ্টে মরে যায় তবু সিগারেট ছাড়ে না।

- তাপ্পর আমি ছাড়লুম  ফুলির বাবা মারা গেলে পর, এখন আর ছুঁই না গো।

এর পর খানিক্ষন চুপ করে থেকে কাজ সেরে ফুলির মা চলে গেল।


- বৌদি, আলমারিতে সাজানো ওগুলো কি মদের বোতল?

উফ, আবার শুরু হল। ফুলির মায়ের অত জিজ্ঞাসা কেন?

- হ্যাঁ

- দাদাবাবু খায়, না? 

- মাঝে মাঝে.... এগুলো সব বন্ধুদের দেওয়া, ওরা এলে খায়।

- আমিও মাঝে মদ্দে খাই

- তুমি মদও খাও!! মাসি তুমি কী গো! অনন্যা মনে মনে খুব হাসল। ফুলির মা ওর শাশুড়ির আমলে লোক, শাশুড়ি ঠাকরুণের পছন্দ আছে বলতে হবে!

- আমার জামাই খুব ভাল গো শুধু একটাই দোষ মদ খায়, হপ্তায় চারদিন। মদ খেয়ে নেশা করে, মেয়ে খুব রেগে যায়। দুজনের খুব ঝগড়াঝাঁটি হয়, আমি মেয়েকে একবার বলেছিলুম চলে আয়। মেয়েও চলে এসেছিল বৌদিমণি।

- তারপর?

- তারপর আবার কী, জামাই এসে কান্নাকাটি, হাতে- পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে তারপর শান্তি!

- এখন আর জামাই খায় না?

- খায়,তবে অল্প। আর আমার বাড়ি এলে আমাকেও একটু দেয় গ্লাসে করে। ফুলির মায়ের চোখে হাসির ঝিলিক।

- আমার জামাই খুব ভাল ছেলে!

- বাঃ! মাসি, যেই তোমায় গেলালো তোমার জামাই ভাল হয়ে গেল! তাজ্জব তো!

- নাহ্! আমি বলেচি মেয়ের গায়ে হাত তোলা যাবে না বাপু! আর মারে না।

- হুঁ,বুঝলুম।


সেদিন ফুলির মা ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই অনন্যা চেপে ধরল- মাসি, সেদিন তোমায় দেখলাম।

ফুলির মা জবাব দিল- কোথায়?

- আমি রিক্সা করে যাচ্ছিলাম, দেখলাম তুমি একটা দাওয়ায় বসে বিড়ি খাচ্ছো। তাই না? তবে যে বললে তুমি ফুলির বাবা চলে যেতে ছেড়ে দিয়েছো?

ফুলির মা কোন জবাব না দিয়ে সেদিনের মত মুখ বুজে কাজ সেরে চলে গেল।

রাতে অনন্যা অমিতাভকে সব কথা বলে দুজনে মিলে খুব হাসতে লাগল।

অমিতাভ গম্ভীরসুরে  বলল-আহা! তুমি এসব বুঝবে না। মাসি হল গে আমার দলের লোক, উচ্চমার্গের দার্শনিক... সুখে আবিষ্ট,না- সুখেও আবিষ্ট!




Comments