গল্প - নন্দিতা বর্মন

ভদকা

            ব্রিজটার দু ধারে কিছূদুর পর পর রাতবাতি দাঁড়িয়ে। আমার এক হাত দূরে বিজু। রনিতার মাস তুতো ভাই। কালী পুজো চলে গিয়েছে। উত্তরের বাতাসে এখন শীতের  কামড়  আমার পাশেই  বিজুর বাইক  দাঁড় কড়ানো। উলেন কুরতির  উপরে শুধু  একটা পশ্মিনা শাল আমার গায়ে জড়ানো। এখন  বেশ ঠান্ডা লাগছে।

         "কি রে তোর হলো?  সিগারেটটা  কি এবারে  ফেলবি? এভাবে রাতের বেলা দাঁড়িয়ে থাকতে আর ভালো  লাগছে না।"              

        "ধুর রাত কোথায়? এতো সবে সন্ধ্যে অবশ্য তোর তো এটা মধ্য রাত। আচ্ছা তোরা ন টায় খেয়ে দশটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়িস না?"

        "কেন এতে অসুবিধের কি আছে?"

        "না না আসুবিধের কি গ্রামে তো সবাই  তারা তাড়ি শুয়ে পরে। গ্রাম আর শহরের এতোটুকু ফারাক তো হবেই!"

       "সে তুই যতই গ্রাম তুলে কথা শোনা এবার আমি ফিরব।"

        এভাবে কথা বলা আমার পছন্দ নয় অন্য সময় হলে আমি আর কথাই বলতাম না। আজ কেন জানি রাগ হল না। বরঞ্চ কালো জিন্সের উপরে হলুদ পুলোভার পরা মানুষ টাকে বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছি। বিজুর নাক সামান্য বাকা যে কারনে অন্য  সময় ওকে দেখতে আমার বিশ্রী লাগতো। এখন সেরকম লাগছে না।    

         এই যে সিগারেট টানতে টানতে আমার দিকে চেয়ে হাসছে-আমার ভালো লাগছে। কেমন একটা ঘোর লাগা চোখে বিজুকে দেখছি। রাস্তার আলোতে কুয়াশার চাদর জড়ানো, সবকিছু ঝাপসা দেখাচ্ছে বিজুকেও।

           সিগারেট ফেলে দিয়ে দুহাত ঘষতে ঘষতে বিজু ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে একটু চেচিয়ে বলল - "জাকিয়ে ঠান্ডা পড়েছে না রে?"

           প্রতুত্তরে চেচিয়ে বলি "এবার ফিরব তো না কি?"

           "আরে এ তুই তো হেব্বি খচে আছিস। কুল ডাউন ইয়ার। আর তোর কেস কি বলতো তখন থেকে এক্কেবারে চুপচাপ!"

           "ধুর কিসসু না। তুই যাকে বিয়ে করবি সেই মেয়েটার নাম কি?"

           "তমা ব্যানার্জি।"

           "স্মার্ট নেম। আর যার সাথে সাত বছরের প্রেম তার নাম?"

            রঞ্জিতা-শালী বহুত হারামখোর।

            "এই এটা কি হচ্ছে! তুই ওকে গালি দিচ্ছিস কেন? ওকে বিয়ে না করে করছিস তো অন্য জনকে তাহলে?"

            ও তুই বুঝবি না।

           ফোন বাজতেই দেখি রনিতার কল "তোদের খুব বাড় বেড়েছে না! এত রাতে তোরা এখন বাইরে! ফিরবি টিরবি তো নাকি?"

            "এক্ষুনি ফিরছি" ফোন কেটেই বিজুকে তাড়া দিলাম। বাইকে আর এক চক্কর কেটে আমরা রনিতার বাড়ির সামনে এসে দাড়ালাম।

            "তোকে একটা থাপ্পড় মারব। রাতের বেলায় একটা ছেলের সাথে বেড়িয়ে ওনার ফেরার নামই নেই!" মেয়েটার রণরংগিনি মুরতি দেখে আমরা দুজনেই হতভম্ব!" পীযুষ ফোন করেছিলো। তোকে না পেয়ে আমাকে ফোন করেছিল বললাম টায়ারড ঘুমিয়ে ছিস।"

           ওহ এতক্ষনে ব্যাপার বুঝলাম। "কে জানে আবার ফোন করবে! গুডনাইট জানিয়েই তো তোদের সাথে বসলাম।"

           ও কে গুডনাইট। মেহুল কাল আসব আজ আসি বলেই কি যে হল কাছে এসে বিদেশী স্টাইলে একটু গাল স্পর্শ করে গেল।

           একটা তীব্র বিরক্তিতে মনটা বিষিয়ে গেল। গালটা ঘষতে ঘষতে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। বেরিয়ে বিছানায় যাওয়ার সময় শুনি রনিতা গজ গজ করছে "অমনি শুতে চললি খাবি না?"

           মানীর মান ভাংগাতে বলতেই হয় "না বন্ধু আজ আর খাব না তুমি অলরেডি অনেক খাইয়ে দিয়েছ।"

       পরিশ্রান্ত শরীরে বিছানায় ডুবে যাওয়ার সাথে সাথে ঘুমে চোখ জড়িয়ে যাচ্ছিল, এই চেতন অচেতন এর আবেশে কিছুক্ষন আগে বিজুর বলা কথাগুলো হাল্কা মেঘের মত ভেসে এল। বলছিল "কোমর জড়িয়ে বস ।" আরও বলছিল "তুই কি জানিস তুই দেখতে ভীষণ কিউট! আর ঠোঁট  চেপে যখন হাসিস এত সুন্দর লাগে দেখতে!" ছেলেটার বোধহয় মাথাই খারাপ হয়েছিল কিংবা অন্য কিছু। এই অন্য কিছুটা আর মাথায় এল না তার আগেই ঘুম এল।

        ঘুম ভাংগতেই চোখে পড়ল সাড়ে ন টা বাজে। ঘুমাচ্ছি দেখে রনিতা আমায় ডাকেনি। ন টার বাস টা আর ধরা হল না।

         বিছানা থেকে নামতেই ঘরের কোণায় ভদকার বতোল টা চোখে পড়ল। উইথ আ্যকিউট লাইম, কাঁচা লংকার কুচি,কুচো মাছ ভাজা, খাসির তেলের বড়া সহযোগে এখানেই তো কাল আমাদের আড্ডা বসেছিল। কুশল দা বাইরে ওকে ছাড়াই রণিতা কাল বিজুর আইবুড়ো ভাত এর আয়োজন করেছিল এইভাবে। নাকি আমি আছি সেটাও একটা কারণ। আসলে রনিতা এই পেগ বানানোর ক্যাপা আমাকে না দেখিয়ে পারছিল না। আমি এসবে অভ্যস্ত নই। কালই হাতেখড়ি, আমি পেটরোগা বাংগালী। রনিতার মত স্মার্ট নই!তাই এই স্বাদ আর একবার নেওয়ার ইচ্ছেও নেই।

         বিজুর আইবুড়ো নাম ঘোচাতে কুঁচো মাছ ভাজা, তেলের বড়ার সাথে এক পেগ আমিও খেয়েছিলাম। আর তাতেই যত বিপত্তি। যে বিজুকে এর আগে দেখে সচেতন ভাবে এড়িয়ে  গেছি তার সাথেই রাত এগারটায় বাইকে চেপে ঘুরে বেড়ালাম!

             খনিকের ভাললাগার আবেশ মনকে তন্ময় করে রাখল! বাথরুম থেকেই বিজুর গলা আর বাইক দুটোর আওয়াজ পেলাম। বাইরে বেরিয়ে দেখি চা খাচ্ছে। আমাকে দেখেই ভুরু নাচাল "বেশ ঘুম দিলি! সকালেই কি বরের ঝাড় খেয়েছিস? "

            "কেন? ঝাড় খেতে হবে কেন?"

            "ওহ তাহলে আদর খেয়েও মুখখানাকে অমন বাংলার পাঁচ করে রেখেছ কেন সোনা?"

             বিজুর এই গায়ে পড়া ভাব তা অসহ্য লাগছিল। রনিতা চা এনে বাঁচাল। "শোন একবারে দুপুরে ভাত খেয়ে বেরোস এখন আর হুরোহুরির দরকার নেই।"

             "না রে বেরতে হবে আজ সন্ধেবেলায় বাড়িতে একজন আসবেন দেখা করা জরুরি। এগারটার বাসটা ধরলে সন্ধের মুখে  পোউছতে পারব।"

             "দ্যাখ তোর ব্যাপার।" রনিতা শেষ  চেষ্টা  করে দ্যাখে "বলছিলাম কি দুপুরে বেরলে আর একবার আমার সাথে মার্কেট ঘুরে যেতে পারতিস।"

             "না রে এবার যাই পরের বারে হবে।"

             বিজু বলে উঠল "কখন বেরবি?  আমি অপেক্ষা করব?"

             "না না" আমি আঁতকে উঠি "তোর অপেক্ষা করার দরকার নে। আমি চলে যাব।"

             নিষ্প্রভ বিজুর সামনে থেকে চা এর কাপ উঠিয়ে গুন গুন করতে করতে রনিতার ঘর লাগোয়া বারান্দায় চলে যাই। আহ আকাশটা কত গভীর নীল। খোলা যায়গায় এসে বুজলাম ভদকা না হলে বিজুর সাথে কথা বলা যায় না।

Comments