ভূমিকম্পের পর
সত্তরের দশক। সকাল সাড়ে সাতটায় আকাশবানী থেকে খবর প্রচার হল। থমথমে গলার পরিচিত স্বর বলে উঠল নেই "দেবব্রত বিশ্বাস" চলে গেলেন। উঠোনে ঘুরতে থাকা শিশু কন্যা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল। প্রাণে তুফান তুলেছিল বোধ। আত্মীয়ের বিয়োগ ব্যথার বোধ। সমস্ত বাড়ীটা ম্রিয়মান। একই অনুভূতি কতবার হয়েছে! একে একে আশ্রয় হারিয়েছি। যেমন বাবা মা, ঐ একই অনুভূতি বুকের নীচে রক্তধারায়। চলে গেলেন সুচিত্রা মিত্র। তখন লুকিয়ে কাঁদার বয়স। তবুও এ জল মুছিয়ে দিয়েছে বাবা মানুষটা।আর ঠিকানা বদলে যাওয়ার পর তিস্তার পাড়ের প্রিয় মানুষদের যেমন হারিয়েছি, তেমনি হারিয়েছি আবার বজ্রপাতের মত কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেই বাল্যকাল থেকে জড়িয়ে আছি যাঁদের নিয়ে, বেঁচে আছি যাঁদের বোধে একাত্ম হয়ে তেমনি আর একজন এইতো সেদিন চলে গেলেন পূর্বা দাম। চোখের জল বাঁধ মানেনি।সেদিনের সে ছোট্ট শিশুর মতই কেঁদেছি পনের ই নভেম্বর, ২০২০। চলে গেলেন সেই এক রক্ত অনুভবের মানুষ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, যাঁকে শিশুবেলা থেকে এক ই ভাবে মঞ্চে বাবার মত ভেবেছি, দূর থেকে একলব্য ভাবনায় গুরু বলে মেনেছি। অপূর্ব কবিতার পংক্তি আমাদের শাশ্বত এক বোধের কাছে দাঁড় করিয়ে দেয়। কোচবিহারে স্কুলের শেষধাপে ওনার "নামজীবন" নাটক দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। সামনের দিকের রোয়ে বসে। এত অপূর্ব অভিনয় এবং আনুষঙ্গিক মঞ্চসজ্জা থেকে শুরু করে সবটুকু সে বয়সেই মনে হয়েছিল অসাধারণ। তারপর কখন চলচ্চিত্রের হাত ধরে তাঁর ব্যক্তিত্ব শুধু একক ভাবে নয়, সার্বিক মানবিক বোধে রাজ্য ছাড়িয়ে দেশ, দেশ ছেড়ে বহির্বিশ্বের মানুষ করে তুলেছিল তাঁকে। বাঙালী হিসেবে গর্বে বুক ভরে যায় যখন রাজস্থানের বিভিন্ন জায়গা যেমন জয়শলমীরে গিয়েও শুনেছি সত্যজিত রায়, সৌমিত্র চ্যাটার্জি এঁদের সকলের কথা। সোনারকেল্লা দেখতে মানুষ ভীড় করে কেন সে ইতিহাস ও সেখানকার মানুষ অকপটে জানায়। এই দেশ ছেড়ে আন্তর্জাতিক স্তরের এই মানুষেরা কখন যে আত্মার আত্মীয় হয়ে যান আমরা বুঝিনা। তার জন্য ব্যক্তিগত সান্নিধ্যের ও তেমন দরকার হয়না। ঠিক এই জন্য ই তো রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ আমাদের পাশে থাকেন সর্বদা। এক শোক মিটতে না মিটতেই প্রিয় প্রবাসী কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের মৃত্যু সংবাদ এল কাল। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ থেকেও এঁরা কিন্তু ধারাবাহিক ভাবে কাজ করে গেছেন। স্বপ্ন কে ফুরিয়ে যেতে দেননি। ২০২০র করোনা কালেও সৌমিত্রের মত মানুষ তাঁর কর্মযজ্ঞে টানা থেকে গেছেন। অত্যন্ত সাবধানতা নিয়েও আক্রান্ত হয়েছেন। করোনাকে দূরেও সরিয়ে দিতে পেরেছেন, কিন্তু মষ্তিষ্কের সংক্রমণ তাঁকে নিয়ে গেল নিষ্ঠুরের মত। এই এক একটি মহীরুহের পতন আমাদের নি:স্ব করে দিচ্ছে। শূন্যতা সহ্য করার শক্তি আমাদের প্রতিদিন অর্জন করতে হচ্ছে অন্তরের সদর্থক শক্তি দিয়ে। প্রতিটি ধ্বংসের পর নতুন সৃষ্টির মত। বলতে হচ্ছে, ঈশ্বর, নতুন করে তোলো। মহামারী, অতিমারীর স্তর পেরিয়ে সেই আশ্রয়স্থল একে একে হারিয়েও আমরা নতুন শপথের দিনে যেন এগিয়ে যেতে পারি, নতুন দীপালোকে ভরিয়ে দিতে যেন পারি নতুন প্রজন্মকে। আকাশের অসংখ্য তারার মালায় অদৃশ্য থেকে তাঁরা আমাদের আশীর্বাদ পাঠাবেন নিয়ত।
সুন্দর স্মৃতিমেদুর গদ্য।
ReplyDelete