নিশিকান্তর প্রেম পর্ব
বাঁকা চাঁদ, বাঁকা হাসি
শূর্পণখা আমি তোমায় ভালোবাসি
এই দুলাইন কবি নিশিকান্তর জীবনে লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে দিল ।শুধু লিখলেই হতো তোমায় ভালোবাসি। কিন্তু শূর্পণখা। এই নামটা প্রতিবেশীরা বলতেই পারে কিন্তু তাবলে নিশিকান্ত !
এখানে শূর্পণখা কিন্তু রামায়ণে রাবনের বোন শূর্পণখা নয়। এ হোল পাড়ার টেঁপী। গায়ের রঙ একটু চাঁপা। চোখগুলো পটল চেরা। কিন্তু ওই নাক। ছোটবেলায় আঁশবটির উপর পরে গেছিল। সে যাত্রা রক্ষা পেলেও নাকের উপর পাঁচখানা সেলাই পড়েছিল। পরে সেই দাগ আর যায় নি। সারা পাড়া আড়ালে আবডালে বলে গতজন্মে লক্ষন ওর নাক কেটে ছিল। সেই দাগটা রয়ে গেছে। তাই চোরাগোপ্তা এই নামটা - শূর্পণখা। কিন্তু সামনে কে বলবে কার বাপের মাথায় কটা পটল গজিয়েছে? টেঁপি মুখের জোরে শূর্পণখা কেন পুতনাকেও ছাড়িয়ে যায়।
শূর্পণখার তিন দাদা। পাড়ার লোকরা তাদেরও নাম দিয়েছে - দুর্যোধন, রাবন, দুঃশাসন আর শূর্পণখার বাবা সাক্ষাৎ কংশ। যাকে বলে, সব ভিলেন যদি এক সিনেমায় থাকে মানে এক বাড়িতে থাকে কি অবস্থাটা হয়! তাই ও বাড়িতে কোন কাজের লোক টেকে না। কদিন পর হাত পা ভেঙে চলে আসে। শুধু এক বুড়ি কাজের মাসি থাকে। সেই মনে হয় সব থেকে পুরনো। লোকে বলে মন্দাদরি।ভিলেন ফ্যামিলির সন্তানরা সব মা হারা। গৃহলক্ষ্মী নাকি খুব অমায়িক ছিলেন, একদম দেবী। শূর্পণখার জন্মের পর পর টিকিট কেটে স্বর্গরাজ্যে ফিরে গেছেন।
কিন্তু কবি নিশিকান্ত এই ভিলেন পরিবারের
শূর্পণখার প্রেমেই হাবুডুবু খাবে কে জানত? স্বয়ং নিশিকান্তই জানত না। কদিন আগেও কালুর কথায় পাড়ার ছোরাদের শূর্পণখার নামে ছড়া বেঁধে দিয়েছে –
নাক কাটা শূর্পণখা
তোর গজিয়েছে পাখা?
তোর মুড়িয়ে দেবো মাথা
কদিন পাড়ার ছেলেগুলো সেই নিয়ে বেজায় সুর তুলেছে। তার আগের ঘটনা, ভালোবেসে কালু এক খানা গোলাপ আর ক্যাডবেরি দিয়েছিল সুন্দর হলুদ রঙের বাক্সে পুরে। একদিন পর কালুকে একটা লাল রঙের বাক্স দিল শূর্পণখা। লাল রঙ যে বিপদ সংকেত তা কালু ভুলে গেল। এক মুখ হাসি আর যাবার সময় হাত নেড়ে টাটা করে ছিল। তাতে কালুর কালো গাল একটু চিকচিক করল। কালু ধরে নিয়েছে তার জন্যও বুঝি কিছু উপহার আছে, উপহার না থাকুক একটা চিঠি অন্তত।
উপহার চিঠি দুটোই ছিল। বাক্সটা খুব লজ্জার সঙ্গে খুলল কালু – কিন্তু একি! তার সারা গায়ে আরশোলা? একবাক্স আরশোলা? কালু তো বাক্স ফেলে পাশের পানা পুকুরে ঝাঁপ দিল। বেচারা সাঁতার জানে না। কয়েক ঢোক জল খেয়ে যখন হাঁকপাঁক করছে তখন কোথা থেকে শূর্পণখার দুর্যোধন দাদা এসে ঘেটি ধরে তুলল। মাথার মধ্যে দুটো কিলও দিল – সাঁতার জানে না প্রেম করার শখ! জানিস তো পাড়ায় আমাদের ফ্যামিলিকে কি বলে? কালু কাচুমাচু মুখ করে বলল – ভিলেন ফ্যামিলি।
- আর যদি দেখেছি আমার বোনের আশেপাশে তাহলে সোজা লঙ্কায় পাঠাবো।
কালুর তখন রাবন দাদার মুখটা মনে পড়ে, সে হাত ভাঙার জন্য কুখ্যাত।
দুর্যোধন দাদা চলে যাবার পরে কালুর চোখ পড়ে বাক্সে একটা চিঠিও আছে।
“ কালু তোর নামে একটা কুকুর পুষবো ভেবেছি। আমি কুকুর খুব ভালোবাসি”। কালু দুদিন পেটের অসুখে বিছানা নিয়েছিল। এই দুদিন পিছন দিয়ে শুধু পানা পুকুরের জল বেড়িয়েছে।
দুদিন পর শূর্পণখার বাড়ি থেকে সত্যি কুকুরের আওয়াজ আসে। আর খবর নিয়ে জেনেছে কুকুরটাকে কালু বলেই ডাকে। কালু গাঁদাল পাতার ঝোল খেতে খেতে গড়গড় করতে থাকে।
বন্ধু নিশিকান্তকে দিয়ে ছড়া বানিয়ে, বন্ধুদের দিয়ে বলা করিয়ে কদিন মনের ঝাল মিটিয়েছে। কিন্তু সে তো লুকিয়ে চুড়িয়ে। বন্ধুরা কেউ সামনে এসে সাহস দেখায়নি।কে আর হাত পা ভাঙতে চায় !
পাড়ার বটতলায় ভজহরির চায়ের দোকানে সন্ধ্যেবেলায় সব ছেলেরা বসে আড্ডা দেয়। নাড়ু বলল – নিশিদা সেবারের ছড়াটা ঠিক কেমন কেমন। জমল না। শূর্পণখাকে ঠিক জব্দ করা গেল না।
নিশিকান্ত মুখ ভেটকে বলল – ইস, এতোই যখন অপছন্দ তখন নিজে বানা। সবাই রে রে করে উঠল – নিশিদার ছড়া স্বয়ং ভিক্টোরিয়ার নাতি শুনে বাহবা দিয়েছে। নিশিদা বলো সেই গল্পটা। খগেন মাথা চুলকে বলে – কত নম্বর নাতি?
নিশিকান্ত আমতা আমতা করে বলে সে কি আর আমি খোঁজ রেখেছি। কিন্তু সাহেব বলল – তার জ্ঞাতির কোন এক ঠাকুমা ছিলেন রানি ভিক্টোরিয়া।
খগেন সন্দিগ্ধ চখে বলে – তা তাকে তুমি খুঁজে পেলে কোথায়?
নিশিকান্ত ভাবে বলবে কি বলবে না। তারপর বলেই ফেলে – ওই চোলাই মদের দোকানে। প্রায় রবিবার এক লালমুখো সাহেব আসে।
খগেন হায় হুতাশ করে – আহারে ভিক্টোরিয়ার নাতির এমন দশা। শেষে বিলিতি ছেড়ে চোলাই!
- তা নিশি কি কবিতা শোনালে?
নিশিকান্ত গলা খাকড়ি দিয়ে ওঠে – আকাশের গায়ে চাঁদ আঁকে আলপনা
তুমি আমার মনোরমা
তুমি কি কেবলি কল্পনা ?
আমাকে ছেড়ে কখনো যেওনা।
ইস ছ্যাঃ ছ্যাঃ, এ কেমন কবিতা? মিল হলেই বুঝি কবিতা? মনোরমা কোথা থেকে উঠে এলো? খগেন দাঁত খুঁচাতে খুঁচাতে বলে।
নিশিকান্ত বিরক্ত হয় – আহা মনোরমা বিয়ের পিঁড়ি থেকে উঠে আসে নি তো। সে বিয়ে করে ড্যাংড্যাং করে শ্বশুর বাড়ি চলে গেছে। তাই তো সাহেব দুঃখী হয়ে মদ খাচ্ছে। আমায় নামটা বলাতেই সঙ্গে সঙ্গে কবিতা বানিয়ে দিলাম। পাঁচশ টাকা উপহার দিয়েছে। নিশিকান্ত নোটটা দেখায়।
খগেন চেঁচিয়ে ওঠে – ওরে শালা, এতো নোট বন্দীর আগের টাকা। এখন এর দাম নেই। যা বিড়ি বানিয়ে ফুঁকে আয়।
ঠিক তাই তো। নিশিকান্ত আগে দেখেনি। সবাই তাকে এভাবেই ঠকিয়ে যায়।
সেই সময় সেখান দিয়ে যাচ্ছিল আমাদের শূর্পণখা। কবিতা শুনে নিশিকান্তর কাছে এসে বলল – বাহ বেশ কবিতাটা। আপনি সবার নামে বুঝি কবিতা করতে পারেন? নিশিকান্তর শুষ্ক ছাতিটা কিছু ফুলে উঠল – হ্যাঁ তা পারি। নাড়ুটা এতো বদমাইশ বলল – এই তো কিছুদিন আগে .........। নিশিকান্ত তার আগেই নাড়ুর পিছনে একটা মোক্ষম চিমটি কেটেছে। তাতে নাড়ুর পাইলসের ব্যথাটা চাগাড় দিয়ে উঠল আবার।
নাক কাটা শূর্পণখাও তো একটা মেয়ে ছিল। সে যতই রাক্ষস বংশের হোক। আর এই শূর্পণখা যতই ভিলেন ফ্যামিলির হোক। তার আসল নাম টেঁপি। কিন্তু টেঁপির নিশ্চই একটা ভালো নাম আছে। নিশিকান্ত লাজুক লাজুক দৃষ্টি নিয়ে বলল – তোমার নামেও কবিতা করবো? টেঁপি মাথা নাড়ায় লাজুক হেসে বলে – আমার ভালো নাম শুচিস্মিতা। নিশিকান্ত এর আগে কখনও টেঁপিকে এতো কাছ থেকে দেখেনি। মুখের মধ্যে বালিকা সুলভ হাসি। লোকেরা কেন আগেই ওর নাকের দিকে চোখ যায়। হাসিটাও বড় সুন্দর। কবির ভাব এসেছে, নিশিকান্তর মুখ দিয়ে এ কোন শব্দ বেড়িয়ে এলো–
তুমি কি হবে আমার মিতা ?
ওগো সুন্দরী শুচিস্মিতা
না, আশে পাশে কেউ নেই। সবাই পালিয়েছে। নিশিকান্ত একলা বসে আছে। সামনে শূর্পণখা। ভয়ে নিশিকান্তর পেট গুড়গুড় করছে। ভেবে নিয়েছে সেই বুঝি শূর্পণখা – তাই চেঁচিয়ে উঠল – এই আমার নাক কেটে দিও না। ভুল হয়ে গেছে। আর বলব না।
কিন্তু ততক্ষনে স্বয়ং শূর্পণখা হাহা করে হেসে উঠেছে – আপনি বড্ড ভিতু কবি তো। মিতা মানে তো বন্ধু। তা বন্ধু না হওয়ার কি আছে? কাল স্কুলের মাঠে এলে দেখা হবে।
- ছুটির পর আসব।
খেলার মাঠে নিশিকান্ত দাঁড়িয়ে। - ওমা কংস, রাবন, দুঃশাসন, দুর্যোধন আর তলোয়ার হাতে সূর্পণখা ছুটে আসছে। নিশিকান্ত দৌড়ে ওদের সঙ্গে পারলো না। সব কটা মিলে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলেছে। শূর্পণখা নিশিকান্তর নাকটা কেটে নিয়েছে। ইস নাক ছাড়া কেমন লাগবে নিশিকান্তকে! সবাই খুব হাসছে আর ঘুরে ঘুরে ছড়া কাটছে –
ওরে নাক কাটা নিশিকান্ত
করব তোকে সর্বস্বান্ত।
- নিশি, ওরে নিশি ওঠ। গোঙাচ্ছিস কেন? কলেজ যাবি না?
নিশি ভ্যাবলার মতো মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে – ইস কি বাজে স্বপ্ন। তাও আবার ভোর বেলায় দেখল? মা ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়?
- সবাই তো তাই বলে। কেন কি স্বপ্ন দেখেছিস?
নিশিকান্ত আর বলতে পারে না, বলে – মনে পড়ছে না।
কলেজ ফেরতা নিশিকান্তি ভয়ে ভয়ে মাঠে দাঁড়িয়ে থাকে। ক্লাস টুয়েলভের ছুটি হয়েছে। এবার নিশ্চই আসবে শূর্পণখা। যত বার ভাবে শুচিস্মিতা কিন্তু মনে হচ্ছে জিভটা তার সঙ্গে শত্রুতা করে মাঝ পথেই শুলে চড়াবে। তাই সে কোন সম্মধন করবে না চুপ করে থাকবে।
শূর্পণখা হেলে দুলে নীল শাড়িতে এগিয়ে আসছে, সঙ্গে দুটো চেলি। নিশিকান্ত বিড়বিড় করে বলে আমার এই লিকলিকে শরীর দেখেও বডিগারড আনতে হয়?
মাঠের পাশে রোজ একটা ফুচকাওয়ালা আর আইসক্রিমওয়ালা বসে। সেদিকে হাত দেখিয়ে শূর্পণখা বলল – খুব খেতে ইচ্ছে করছে। নিশিকান্তর পকেটে পঞ্চাশ টাকা। কিন্তু সেটা বাবার দেওয়া, আটা আনতে দিয়েছে। দুই চেলি এখন হাসাহাসি করছে আর কি গুজগুজ করছে – না আজ আর কিছু খাওয়া হবে না।
প্রেস্টিজ নেই পুরুষ মানুষের! নিশিকান্ত কুই কুই করে বলল – চলো খাবে? কি নির্লজ্জ মেয়েগুলো। তিনজনে মিলে পঞ্চাশ টাকার ফুচকা খেয়ে ফেলল। না এরকম বন্ধু খুব বিপদ জনক। কিন্তু শূর্পণখা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নিশিকান্তর পকেটে কিছু গুজে দিল। নিশি ভেবে ছিল বুঝি প্রেম পত্র। বাবার হাতে মার খেলে নয় বলবে সে টাকা হারিয়ে ফেলেছে। মারের ব্যথা প্রেম পত্রের আনন্দে একটু লাঘব হবে। কিন্তু এ তো পঞ্চাশ টাকা। নিশির মনটা একটু নরম হল – শূর্পণখার মনটা খুব একটা খারাপ নয়! গরিবের বিপদ বুঝেছে।
এরকম ভাবে মাঠে, পাড়ার লাইব্রেরীত, শনিবার করে মন্দিরে প্রায় দেখা হতে লাগলো। পুজোর প্রসাদ, গল্পের বই বদল হতে লাগলো। শেষে মোবাইলের নম্বর পর্যন্ত একে অপরকে দিল।
নিশির নতুন মোবাইলে মেসেজ এলো সিনেমা দেখতে যাবে? এমন মেসেজ পেয়ে কার কলেজে মন টেকে? তাই পরের ক্লাস বাং করে পৌঁছে গেল – সিনেমা হলে।
কিন্তু সেখানে যে শূর্পণখার রাবন দাদার মুখমুখি পরে যাবে এটা কে জানত? আর রাবণেরও যে গার্ল ফ্রেন্ড নিয়ে এই খানেই আস্তে হবে! সে যুগে সিনেমা হল থাকলে মনে হয় সিতাকে অশোকবনে না গিয়ে সোজা সিনেমাই দেখাতো। নিশিকান্ত ভেবেছিল সিনেমার নাম অনুসারে, অন্ধকারে তার যদি একটা হাম্পি জোটে কিন্তু জোটে কটা চড় থাপ্পর আর ঢিসুম। গতবছর এই খানেই ঢিসুম সিনেমাটা দেখে গেছিল । আজ আরেকবার সাক্ষাৎ অনুভব করল।
ঠিক এর পর থেকে নিশিকান্ত অনুভব করে সে শূর্পণখাকে কতটা ভালো বেসে ফেলেছে। কারন শূর্পণখা তারপর থেকে গৃহ বন্দিনি। তার আর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। তাই হোয়াটসাপে একদম ঝিমনো রাতে নিশির মন জেগে ওঠে। একদম ডিরেক্ট প্রেম নিবেদন –
বাঁকা চাঁদ, বাঁকা হাসি
শূর্পণখা, আমি তোমায় ভালবাসি।
শূর্পণখা! নিশি হাত কামড়ায়। কিন্তু ততক্ষনে মেসেজ পৌঁছে, মেসেজ দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু কোন উত্তর নেই। নিশি অনেক কিছু লিখে ফেলেছে – সরি। ক্ষমা প্রার্থনা। কিন্তু হায় নিশিকান্তর বিরহ দেখল না, কেবল কবিতা দেখল। নিশিকান্ত নিজের গালেই চড় কষায় – আজ থেকে না কোন ছড়া না কবিতা।
পরের দিন নিশি অনেক্ষন স্কুলের পাশের মাঠে দাঁড়ালো, দুই চেলিকে দেখলেও শূর্পণখার দেখা নেই। এমন বেশ কয়েকদিন গেল, শেষে তিন সপ্তাহ পর তার দেখা পেল। কছে গিয়ে কথা বলতেই নিশির নাকের উপর সজোরে একটা কিছু উড়ে এলো। তারপর ধারাসায়ি। শূর্পণখা তার সঙ্গে বক্সিং খেলছে! - কেমন দিলাম নাক ফাটিয়ে? আত্মরক্ষার জন্য শিখছি। সত্যি নিশির নাক দিয়ে রক্ত বেরচ্ছে। কিন্তু নিশি তো কিছু করেনি তাকে।
শূর্পণখা এগিয়ে এসে হাত বাড়াল – উঠে পরো। আমি একালের শূর্পণখা নিজের আত্মরক্ষা নিজে করতে পারি।
নিশি লজ্জিত ভাবে বলল – ভুল হয়ে গেছে। স্লিপ অফ ফিঙ্গার।
শূর্পণখা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে –এই শব্দটা শুনিনি তো! স্লিপ অফ টাং শুনেছি।
নিশি উত্তেজিত হয়ে বলে – আরে সে তো ভুল করে কিছু বলে ফেললে। আমার আঙ্গুলগুলো ভুল করে লিখে ফেলেছে। আঙ্গুল ইংলিশ ফিঙ্গার জানো না?আর আমি লিখতে গেছিলাম শুচিস্মিতা। শূর্পণখা এবার রেগে গিয়ে বলে – না আমি শূর্পণখাই।
নিশির দিকে হাত তুলে বলে – তুমি আবার নিজেকে লক্ষন ভেবে নিও না। তুমি হলে একজন ফ্লপ কবি। যে শুধু বিচ্ছিরি কবিতা লেখে।
এমন দুঃখ জীবনে পায়নি নিশি। এর আগে দুবার কেলানি খেয়েছে ওর দাদার কাছে। কিন্তু তাতে গায়ে পায়ের ব্যথা ছিল। কিন্তু শূর্পণখা মনে আর নাকে দুটোতেই ব্যথা দিল! নাক দিয়ে এখনও রক্ত গড়াচ্ছে ।স্বপ্নটা কি সত্যি হল? স্বপ্নে নাকটা কেটে নিয়েছিল। আর এখন নাক ভেঙে দিয়েছে। নিশি এখন নিশ্চিত – আগের জন্মে নির্ঘাত রাক্ষস কুলেই জন্ম হয়েছিল শুচিস্মিতার।শুচিস্মিতা নয় শূর্পণখা।
একবছর ধরে নিশিকান্ত দেবদাস হয়ে ঘুরে বেরাল। কিন্তু কোন কবিতা লিখল না। শেষে বাবার পিটানির ভয়ে পড়াশুনোয় মন দিল। শূর্পণখাও ততদিনে স্কুল পাশ করে নিশির কলেজেই ভর্তি হয়েছে। নিশি অবশ্য এ বছর ওই টেনে টুনে উঠেছে। মানে ট্রাপিজে ঝুলতে ঝুলতে একদম নীচে পড়ে যাচ্ছিল কিন্তু বন্ধুরা মিলে টেনে তুলে দিয়েছে।
শূর্পণখা কিন্তু কলেজে এসেই সবার মন জয় করে নিয়েছে। আহা এমন মেয়ে হয় না। জুনিয়ার, সিনিয়ার সবার প্রিয় হয়ে উঠেছে। কলেজের অনুষ্ঠানে গান গাইছ , নাটক করছে। এই গুনগুলো তো নিশির জানা ছিল না। অবশ্য জানল কতটুকু আর তার আগেই নাক ভেঙে দিল।
এর মধ্যে সূর্পণখা কলেজের ইউনিয়নেও নাম লিখিয়েছে। কলেজ ইলেকশনেও কাজ করছে। কিন্তু সে খবর সবাই তো ভালো মতো নেয় না। বন্ধ ক্লাস ঘর থেকে নিশি শুনল। বিরোধী পার্টির কিছু ছেলের কথা। আজ রাতেই নাকি শূর্পণখার উপর হামলা হবে। নিশি জানত সূর্পণখা রাত করে টিউশন থেকে ফেরে। ছেলেগুলোও খবর রেখেছে। কিন্তু সারা কলেজ ঘুরে শূর্পণখার দেখা পেল না। আগের ফোন নম্বরটাও পাল্টে গেছে। কিন্তু ঘরে গিয়ে খবর দেওয়ার সাহস হল না। ভিলেন ফ্যামিলির মুখটা মনে পড়ল। অগত্যা তার ঠনঠনে সাইকেল নিয়ে রাতে অন্ধকার গলির মোরে দাঁড়িয়ে রইল। সেখান দিয়েই রোজ শূর্পণখা ফেরে। মশার কামড়ে পা ফুলে গেছে। কিন্তু তবু দাঁড়িয়ে রইল। প্রায় এক ঘণ্টা পর শূর্পণখাকে দেখতে পেল। আর পিছনে সেই ছেলেগুলোকে। চারটে ছেলে শূর্পণখাকে পিছন করে ধরে ফেলেছে। ছেলেগুলোর মুখগুলো সব কাপড় দিয়ে বাঁধা। নিশি আর দাঁড়াতে পারল না। হুড়মুড় করে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু নিশির গায়ে অতো জোর কোথায়। সে বেচারা নিজেই কটা কিল, ঘুসি খেল। কিন্তু একি দেখছে সামনে – শূর্পণখা চারটেকেই কি পেটান পিটচ্ছে। মেরে একদম মুখ ভেঙে দিয়েছে। ছেলেগুলো পোঁ পা করে দৌড়। নিশির চোয়াল বেয়ে রক্ত পড়ছে। তবু হেসে বলল – তুমি মাইরি হেব্বি দিলে ওদের। শূর্পণখার এক মুখ হাসি – কেন তোমার মনে নেই তোমার নাক ভেঙ্গে ছিলাম। নিশি নিজের নাকটার উপর হাত বোলাল – খুব লেগেছিল। – কিন্তু নিশি তুমি এই সময়ে এখানে কেন?
আমতা আমতা করে নিশি সবটা খুলে বলে।
শূর্পণখার কি হাসি – তুমি আমাকে বাঁচাতে এসেছিলে? নিশি বোকার মতো চুপ করে থাকে। তার তো আর ভিলেন ফ্যামিলির মতো গায়ে শক্তি নেই।
শূর্পণখা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলে এই এখনি নেট অন করছি আমার ফেসবুকে লাইভ করব। আর তুমি হবে হিরো। আমায় বাঁচিয়েছ গুণ্ডার হাত থেকে ।আমার ভিলেন ফ্যামিলিও খুশি হয়ে যাবে।
নিশি শূর্পণখার হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নেয় – আমি হিরো হতে চাই না। টুকলি করে পাশ করতে পারি, কিন্তু জীবনে মিথ্যে বলে হিরো হতে পারব না। আমি তোমায় বাঁচালাম কোথায়? তুমি আমাকে বাঁচালে। আমি আসলে হেরো, হিরো নই।
শূর্পণখা এতক্ষন চুপ করে কথাগুলো শুনছিল।আজকে নিশি হেরে শূর্পণখার হিরো হয়ে গেছ , তা ওর চোখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে।
নিশি একটু অবাক হয়ে বলে – আচ্ছা তোমার ভিলেন ফ্যামিলিকে খুশি করে আমার কি লাভ?
এবার শূর্পণখার চোখে জল টল টল করছে। সামলাতে না পেরে সোজা নিশির শার্ট ভিজিয়ে দিল। নিশি এই অতর্কিত আক্রমণের জন্য তৈরি ছিল না। কিন্তু আজ সত্যি তার নিজেকে হিরো মনে হচ্ছে।
অন্ধকারে নিশির সাইকেলের ক্রিং ক্রিং আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সাইকেলে একা নিশি নয় সঙ্গে শূর্পণখা। ওদের কথাগুলো এখনও শোনা যাচ্ছে। না কথা নয় কবিতা ।
অন্ধকারে আমি নই একা
সঙ্গে আছে আমার মিতা
সে কেবল আমার শুচিস্মিতা ।
![]() |
চিত্র - শ্রীহরি |
বাঃ, দারুন জমিয়ে লিখেছো। শূর্পনখা কে ভালবেসে ফেললাম।
ReplyDelete