গল্প - অনিন্দিতা গোস্বামী

কাকতালীয় 


শুধু ইন্টিরিয়র ডেকরেশনেই পড়ল দশ লাখ টাকা। মনের মতো ঝকঝকে তক্‌তকে নতুন ফ্ল্যাটে সদ্য উঠে এসেছে সুলগ্না। কিন্তু এত সুখের মধ্যেও খচ্‌ খচ্‌ করে বিঁধছে অশান্তির কাঁটা। সে কোন কথাই কাউকে বলছে না বটে কিন্তু নিজে সে কোন ও কাজেই ঠিকমত মন দিতে পারছে না। শব্দটা আবার হল, টক্‌, টক্‌। কান খাড়া করে রইল সে, শব্দটা কোথা থেকে আসছে বোঝার জন্য কিন্তু নিস্তব্ধ চরাচরে শব্দটা যেন তরঙ্গ তুলে হারিয়ে গেল। সে বালিসের তলা হাতড়িয়ে মোবাইল ফোনটা নিয়ে সময় দেখল, রাত দুটো। মাথার কাছের টিপয় থেকে জলের বোতল নিয়ে জল খেল ঢক্‌ ঢক্‌। দুভুরুর মাঝখানে গভীর হলো চিন্তার ভাঁজ। কিন্তু দ্বিতীয় বার আর সে শুনতে পেল না শব্দটা। বালিশে মুখ গুঁজে থাকতে থাকতে কখন আবার সে ঘুমিয়ে পড়ল।

সকাল বেলা ব্রাস করতে করতে সে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে চারিদিকের দেওয়াল গুলো খুঁজতে লাগল। রাত্রিবেলা কোথাও মিস্ত্রি কাজ করছিল কি? কোথাও কেউ পেরেক টেরেক পুঁতেছে কি? কিন্তু কোথাও কিছু দেখা গেল না। অধিকাংশ ফ্ল্যাটেরই দরজা বন্ধ। যারা এসেছেন তাদেরও, যারা আসে নি, তাদেরও। সে যখন আঁতি পাতি করে এদিক ওদিক খুঁজছে তখন যেন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে সুগত। বলল, কি খুঁজছ সকাল সকাল? স্কুলে যাবে না?

সুলগ্না বলল, যাব তো, কিন্তু পরশু তোমাকে বলেছিলাম না কেমন একটা টক্‌ টক্‌ আওয়াজের কথা, কাল রাতে সেটা আবার হয়েছে জানো।

সুগত বল, ভূতে করেছে ভূতে। রাত দুপুরে তো মানুষে তোমার জন্য পেরেক পুতবে না।

সুলগ্না কাঁচুমাচু করে বলল, না গো বিশ্বাস করো আমি সত্যি শুনেছি।

সুগত বিরিক্ত ভাবে বলল, হুম্‌ বুঝেছি, বুঝেছি। এ বাড়িতে এসে থেকে তোমার মাথাটাই গেছে। যাও যাও জলদি তৈরী হও। এরপরে আর ট্রেন পাবে না। কোথাও কিছু নেই, শুধু শুধু এই এক ঢঙ শুরু হয়েছে তোমার। 

হুম্‌ যাই। বলে সুলগ্না ঘরে চলে এলো। চা খেতে খেতেই মাইক্রোওভেনে গরম করতে ঢুকিয়ে দিল নিজের খাবার টুকু। তারপর প্রায় ছুটেই ঢুকে গেল স্নান করতে। সত্যিই সকাল বেলা শ্বাস ফেলার সময় থাকেনা সুলগ্নার। সকাল আটটার ট্রেন ধরে তাকে যেতে হয় সুদূর মফঃস্বলে, তাই সে সময় ভূত ভবিষ্যৎ ভাবা সত্যিই অবান্তর।

সে স্নান সেরে বেরলেই ঢুকে পরে মলিনা দি। সংসারের ব্যাটনটা মলিনাদির হাতে ধরিয়ে দিয়ে সুলগ্না বেরিয়ে পড়ে স্কুলের উদ্দ্যেশ্যে। স্কুলেও সুলগ্নাকে ভালোবাসে অনেকেই। সে খুব জমিয়ে রাখে স্টাফ রুম। নানা রকম গল্প বলে সে বেশ রসিয়ে রসিয়ে, কিন্তু কদিন ধরে সে চুপ চাপ। ব্যাপারটা খেয়াল করেছে অনেকেই। দু একজন বলেওছে কি হয়েছে গো সুলগ্নাদি। কিন্তু সে কোন উত্তর দেয় নি। এড়িয়ে গিয়েছে। এত শখ করে কেনা ফ্ল্যাট, কদিন আগেই সে মিষ্টি খাইয়েছে সবাইকে, সেই ফ্ল্যাট সম্পর্কে এমন বিরূপ কথা কি বলা যায় কাউকে। তাছাড়া তাকে বিশ্বাস করবেই বা কে। বাড়ির লোকরাই বিশ্বাস করছে না। সে যেই একটা করে অদ্ভূদ জিনিসের কথা বলছে ওমনি হেসে উঠছে সুগত। বলছে এটাতো এই জন্য হয়েছে। এমন কি দুদিনের পুচকি মেয়ে তিন্নি, সেও তাকে আমল দিচ্ছে না। মুখে হাত চাপা দিয়ে খুক্‌ খুক্‌ করে হাসছে। সেদিন পোডিয়ামে ঘুরবার সময় তার কেবলই মনে হচ্ছিল তার আশে পাশে কেউ ঘুরছে, মুহূর্তে একটা ছায়াও সরে যেতে দেখেছিল সে কিন্তু তিন্নি বলল মা তুমি তোমার ছায়াই দেখেছ। চারদিক থেকে আলো জ্বলছিল তো। প্রথম প্রথম সে-ও ভাবছিল হবেও বা হয়ত তারই দেখার ভুল। কিন্তু ক্রমে ক্রমেই যেন রহস্য ঘনীভূত হয়ে উঠছিল। সেদিন স্কুলে হঠাৎ মলিনাদির ফোন, এ কী ভূতুরে ফ্ল্যাট কিনলা বল তো। কল দিয়া জল পড়তে পড়তে হঠাৎ বন্ধ হয়া যায়। ভয় পাইছি ভয় পাইছি বললে পরেই আবার জল পড়তে শুরু করে। শুনে সুলগ্না বলল, আঃ মলিনা দি তোমার না সব তাতেই বাড়াবাড়ি। এখনো তো সব ফ্ল্যাটে লোকজন আসেনি, নতুন নতুন এসেছি আমরা সেইজন্য হয়ত জলের ফ্লো-টা ঠিক ঠাক হয়নি এখানে।

মলিনা দি বলল, হ, তোমরাতো ওই সব কইবাই তবে আজ মণিরে স্নান করানোর সময় দেহি গরম জল পড়তে পড়তে হঠাৎ করে ঠান্ডা জল পড়তিছে। 

তা সে তো হতেই পারে। সুলগ্না ভাসা ভাসা  গলায় উত্তর দিল। অন্য সময় হলে হয়ত হেসে উড়িয়ে দিত কিন্তু এখন যেন তার মনের জোরটাই হারিয়ে গিয়েছে। মলিনাদি তখনও যেন কি সব বলে যাচ্ছিল কিন্তু সবকথা ঠিক মত সুলগ্নার কানে যাচ্ছিল না। মলিনা দি বলছিল হ তুমিও যেমন, আমি কি তোমার বাড়িতেই প্রথম গিজার দেখছি নাকি। একবার ঠান্ডা একবার গরম আবার ঠান্ডা এরম কোন গিজারে হয় শুনি? এইরম চললে কিন্তু আমি আর কাজ করুম না কয়ে দিলাম। আমার ভয় করতিসে, এই সব ভূতুরে বাড়িতে আমি নাই।

সুলগ্না বলল, বেশ, বেশ, কানেকশনের কোন গন্ডোগোল হয়েছে হয়ত আমি বাড়ি গিয়ে দেখছি।

ফোনটা ছেড়ে দিয়ে থম মেরে বসেছিল সুলগ্না। সহকর্মীরা সকলে ছেঁকে ধরল, কি হয়েছে গো সুলগ্নাদি খুলে বল। কি বলবে সুলগ্না, যে ফ্ল্যাট কেনার জন্য কদিন আগে সবাইকে মিষ্টি খাইয়েছে সেই ফ্ল্যাট হন্টেড্‌। তাই কি বলা যায় না বলতে ইচ্ছে করে! সে বলল কদিন আগে আমার এক বন্ধু ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে মারা গেছে তাই মনটা ভালো লাগছে না। কথাটা খানিকটা সত্যিও। বেশ কিছুদিন আগে তার এক বন্ধু মারা গেছিল কিন্তু যোগাযোগহীনতা সে গ্লানী কবেই মুছে দিয়েছিল তার মন থেকে। সবাই সান্ত্বনা দিল তাকে। বলল, কাটিয়ে ওঠো সুলগ্না দি। বেরিয়ে এসো। তুমি বুঝতে পারছ না তুমি বড্ড মন মরা হয়ে গিয়েছ কদিন ধরে। মাথা ঝাঁকালো সুলগ্না। ঠিক। মনে মনে ভাবলোও বেরিয়ে আসতে হবেই তাকে। ভূত বলে কি সত্যিই কিছু হয়? তার বিজ্ঞান মনষ্ক মনভাব কোথায় চলে গেল হটাৎ করে! সে তো কোনদিন এসব বিশ্বাসই করেনি সেভাবে! পরক্ষণেই তার মনে হলো ঘটনাগুলো যে সত্যিই ঘটছে! সে যে স্পষ্ট শুনছে একটা আর্তনাদ। হ্যাঁ সে কাউকে বলেনি টক্‌ টক্‌ শব্দই শুধু নয় সে যেন একটা আর্তনাদও শুনেছে দু একবার সেই সঙ্গে। কোনটা যে সত্যি আর কোনটা যে তার মনের ভুল সে যেন নিজেই গুলিয়ে ফেলছে একসঙ্গে। না না এসব সে এক্কেবারে কাটিয়ে ফেলবে মন থেকে, একপ্রকার প্রতিজ্ঞা করেই সেদিন স্কুল থেকে বেরিয়েছিল সে ব্যাগ কাঁধে, কিন্তু ফ্ল্যাটের সামনে অটো থেকে নামতেই ঘটল বিপত্তি।

লনের ওপর একটা পাতার ঘূর্ণি উঠছে পাকিয়ে, কি সুন্দর। ব্যাগ থেকে সেল ফোনটা বার করে ছবি তুলতে গিয়ে সে দেখল তার মোবাইল ফোনটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, ফের বুকটা ধ্বক্‌ করে উঠল, তার ফোন তো কখনো বন্ধ হয় না। ব্যাটারী ব্যাকআপও তার যথেষ্ট ভালো। হুট্‌হাট চার্জও চলে যায় না! আনমনে এসে সে লিফ্‌ট-এ ঢুকল। কিন্তু তিন তলার মাঝামাঝি এসে লিফ্‌টা গেল দাঁড়িয়ে। কী আশ্চর্য, এই নিয়ে তিন দিন। সে অস্থির হয়ে বোতাম টিপতে লাগল, যদি চালু হয়, কিন্তু লিফ্‌টা নট নরন চরন। তারপর সে সব গুলো বোতামই টিপতে লাগল একে একে। শেষে লিফটা চলতে শুরু করল এবং সবকটা ফ্লোরেই একবার করে দরজা খুলতে আর বন্ধ হতে লাগল। তারপর সেভেন্থ ফ্লোরের কাছে দরজা খুলতেই সে প্রায় লাফিয়ে বেরিয়ে এলো লিফট থেকে তারপর ঘনঘন কলিং বেল বাজাতে লাগল ফ্ল্যাটের। মলিনাদি দরজা খুলেই জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে দিদি, শরীর খারাপ? সে মৃদু ভাবে ঘাড় ঝাঁকালো, না, একটু জল দাও তো, বলে সে সোফার ওপর বসে পড়ল ধপ্‌ করে। অন্য সময় হলে হয়ত সে সবিস্তারে গল্প শুরু করত মলিনাদির সঙ্গে কিন্তু এখন তার ইচ্ছে করল না। কারন মলিনাদি এমনিতেই যা প্যানিক করছে এই গল্প বললে হয়তো কাল  থেকে আর কাজেই এলো না। আর মলিনাদি না আসা মানে তার স্কুলও বন্ধ। অতএব ভিতরে তার যাই হোক আপাতত মুখ বন্ধ করে রাখাই শ্রেয়।

সেদিন রাতে আরো জোরালো হলো আর্তনাদ। কে যেন গলা টিপে ধরছে কার। আঁ আঁ আঁ আঁ। চোখ কচলে বিছানার ওপর উঠে বসল সুলগ্না। স্বপ্ন দেখছে না তো সে। না, ওই তো আবার। একটা হিম স্রোত নেমে গেল তার শিরদাঁড়া দিয়ে। সে উঠে তিন্নির ঘরে গেল, ভয় টয় পায়নি তো মেয়েটা! না মেয়ে তার অকাতরে ঘুমুচ্ছে। এবার সে পায়ে পায়ে সুগতর ঘরে গেল, মৃদু ধাক্কা দিয়ে ডাকল, এই শুনছ? আবার ওই আর্তনাদটা শুনলাম।

পাশ ফিরে শুতে শুতে সুগত বলল, কি নাক? নাক ডাকছে আমার?

সুলগ্না বিরক্ত হয়ে বলল, ওফ্‌ নাক নয় নাক নয় নাদ আর্তনাদ।

- আর্তনাদ! কে করল? আমি? না না আমি কোন আর্তনাদ করিনি। রাত দুপুরে কি শুরু করলে বলত। একা ঘরে শুতে পার না তো শুতে যাও কেন! বলে সুগত এক পাশে সরে গিয়ে বলল নাও এখানে শুয়ে পর।


চিত্রনাট্যে এই সময় একটি খুব রোম্যান্টিক দৃশ্যের অবতারণা করা যেত। সুগত ঘুম ঘোরে হাত দিয়ে সুলগ্নাকে টেনে নিতে পারত উম্‌ম্‌ করে নাক দিয়ে ঘষে দিতে পারত বুকের মধ্যে, চিত্রনাট্য আরো প্রসারিত হতে পারত কিন্তু জীবন সবসময় চিত্রনাট্য অনুসারী হয় না। কখনো সে চিত্রনাট্যকে ছাপিয়ে যায় কখনো চিত্রনাট্যকে অতিরঞ্জন প্রমান করে হয় সে সাদামাটা। আপাতত দ্বিতীয়টাই ঘটল। খাটের এক পাশে গুটি শুটি মেরে শুয়ে পড়ল সুলগ্না কিন্তু তার ঘুম এলো না। সে তাকিয়ে রইল ড্যাবড্যাব করে আর সুগতর নাসিকা গর্জন শুনতে লাগল এক নাগারে। তবু তার মনে হল, যাক্‌ বাবা নাসিকা গর্জন অনেক ভালো ঐ আর্তনাদের চেয়ে।

কিন্তু কাউকে যে সে বোঝাতেই পারছে না ঘটনাটা সত্যি ঘটছে। অবিশাস্য ঘটনা সহজে কাউকে বোঝানো যায় না। বরং যে বলতে যায় সমাজ তাকেই পাগোল ঠাওরায়। স্বীকার মানেই স্বীকৃতি। তাই সকালে উঠেই সুগত বলল তোমায় একটা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব ভাবছি। তিন্নি বলল, হ্যাঁ মা বাবা বলছিল তোমার নাকি মাথায় গন্ডোগোল হয়ে গেছে ডাক্তার দেখাতে হবে! যাও না ডাক্তারের কাছে। আনমনে সুলগ্না বলল  প্রয়োজন হলে যেতে হবে তবে আর কদিন সময় দরকার আমার। বুঝে নেওয়া দরকার সত্যিই আমার ভুল কিনা।

সুগত বেশ জোরের সঙ্গে বলল, অবশ্যই মনের ভুল। তোমার এরকম মনে হচ্ছে, কই আমারা তো কিছু শুনতে পাচ্ছি না।

সুলগ্না বলল, কি করে শুনবে? রাতে তো তোমরা ভোঁস ভোঁস করে ঘুমাও। আমার ঘুম আসে না তাই আমি শুনতে পাই।

সুগত এক্সপার্ট ওপিনিয়ন দিল, কাজ করতো কাজ কর। দেখবে কাজ কম্ম করলেই রাতে ঘুম আসবে আর ওসব কিছু শুনতে পাবে না। কিছু না বলে চুপ করে গেল সুলগ্না, কি বলবে, এসব কথার কোন উত্তর হয় না।

তিথিটা ভালো। অনেক ফ্ল্যাটেরই সেদিন গৃহপ্রবেশ। দোল উপলক্ষে তাদেরও দুদিন ছুটি। বেশ কয়েকজন প্রসাদ টসাদও দিয়ে গেছে প্লেটে করে। চারদিকে বেশ হৈ চৈ। অতি উৎসাহে কেউ কেউ যেন সাউন্ড বক্সে গান চালিয়ে দিয়েছে জোরে জোরে। ফাঁকা দেওয়ালে ধাক্কা লেগে তা যেন গম গম করছে। আটটা নাগাত সে নিজের ঘরে তিন্নিকে অংক করাতে বসল। আর ঠিক তক্ষুনি সেই আর্তনাদ, আঁ আঁ। তিন্নির গায়ে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সুলগ্না বলল, এই শুনলি? শুনলি?

চোখ বড়ো বড়ো করে তিন্নি বলল, হ্যাঁ মা সত্যি! শুনলাম।

খপ্‌ করে তিন্নির হাতটা ধরে সুলগ্না বলল, চল আজ একটা হেস্ত নেস্ত করেই ছাড়ব। কোথা থেকে আসছে এই শব্দ তা আজ বার করবই করবো

তিন্নি হাতটা ছাড়াতে চেয়ে কাঁদতে লাগল, আঁ মা আমাকে ছেড়ে দাও, আমার ভয় লাগছে।

সুলগ্না বলল, ভয় কি আমি আছি তো, তাছাড়া আজ সন্ধ্যে রাত, এখনো ফ্লোরে, পোডিয়ামে অনেকেই আছে হয়ত। চল না, আমি শার্লক হোমস্‌ আর তুই বেশ মি ওয়াটসন।

তিন্নি বলল, মা রহস্য গল্প?

- হুম্‌ রে। বলে সে দরজা টেনে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সুগত তখন গেছে বন্ধুর বাড়ি আড্ডা দিতে, সে এসবে কিছু জানতেই পারল না। মা মেয়ে বেরিয়ে পড়ল অভিজানে। এদিক ওদিক এ ফ্লোর ও ফ্লোর, পোডিয়াম কোথাওই কিন্তু আর শুনতে পাচ্ছিল না শব্দটা। এবার সে কেয়ার টেকারের ঘরের সামনে গিয়ে বলল কথাটা। সে বলল কই চলুন দেখি তো। আর্তনাদ? সে আবার কি বলছেন! বলে সে উঠে এলো তাদের ঘরের সামনে তারপর বলল, কোথা থেকে শব্দটা পান বলুন তো?

সুলগ্না বলল, ঠিক বুঝতে পারি না, কেমন যেন ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ছড়িয়ে যায় চারিদিকে।

কেয়ার টেকার আঙুল দিয়ে সুলগ্নার পাশের ফ্ল্যাটটা দেখিয়ে বলল ওই খান থেকে শব্দটা আসে না তো?

সুলগ্না বলল, কি করে আসবে? ওটা তো বন্ধ। 

উ হুঁ হুঁ বলে মাথা ঝাঁকালো কেয়ার টেকার বিশু, বলল, ঐ ফ্ল্যাটের ভদ্রমহিলা তো দু সপ্তাহ হলো এখানে এসে আছেন। কেমন যেন অদ্ভূত ভদ্রমহিলা। মিটারের কানেকশনও নেন নি, আলোও জ্বালেন না। দরজা খুলে বেরনওনা কখনো।

চোখ বড় বড় করে সুলগ্না বলল, পাশের ঘরে ভদ্রমহিলা আছেন? বুঝতে পারিনি তো এতদিন। তিন্নি বুড়ো আঙ্গুলটা নীচের দিকে করে বলল টায় টায় ফিস্‌, মা তোমার গোয়েন্দা হওয়া হলো না।

তাদের কথা বার্তায় উল্টো দিকের দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে শম্পা। বলল, কি হয়েছে গো সুলগ্না দি? 

সুলগ্না সংক্ষেপে দু একটা কথা বলে বলল তুমি টের পেয়েছিলে যে ভদ্রমহিলা এখানে আছে? শম্পা বলল নাহ্‌। চল তো ধাক্কা দিয়ে দেখি, এখন যা দিনকাল পড়েছে কে যে কখন কোথায় ঢুকে থাকবে বলা যায় না।


দরজায় কলিং বেল নেই, সুলগ্না ভয়ে ভয়ে দরজা ধাক্কা দিল। বেশ কিছুক্ষণ ধাক্কানোর পর দুম্‌ করে খুলে গেল দরজা। সুলগ্না দেখল বেশ সুবেশ এক ভদ্রমহিলা হাতে একটা দরজার ডাসা নিয়ে উদ্দত ভঙ্গিতে বলল, কে, কি চাই এখানে? 

সুলগ্না বলল, না না কিছু চাই না। আমরা পাশের ফ্ল্যাটেই থাকি। আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এলাম।

ভদ্রমহিলা লাঠি নামিয়ে রেখে দরজা ধরে দাঁড়ালেন বললেন, হুম্‌ আলাপ! বেশ! বলুন।

সুলগ্না বলল, আলো জ্বালেন নি? 

ভদ্রমহিলা বললেন, আমার ঘরে তো আলো নেই। আমার আলো ভালো লাগে না। তাছাড়া সন্ধ্যে থেকে আমার কোন কাজও নেই, আলো কি হবে? শুধু অপচয়।

মাথা ঝাঁকালো সুলগ্না, তা ঠিক। রাতে খান না?

- হ্যাঁ খাই। খিদে পেলে খাই। মুড়ি বিস্‌কুট সব হাতের কাছেই থাকে আমার।

- রান্না করেন না ?

- না, আমার তো গ্যাস নেই। কেউ সুযোগ পেলেই যদি আগুন ধরিয়ে মেরে ফেলে আমায় তখন। চারিদিকে শত্রু আমার। আমার ভাই, ভাই বউ সুযোগ পেলেই লোক ঢুকিয়ে দেয় আমার ঘরে। লোকগুলো কি মারে আমায়। আমায় পেরে ফেলে পেটের ওপর চেপে বসে পেটায়। বুকে টুকে হাত দেয় না অবশ্য শুধু মারে আর আমি চিৎকার করি। এখানেও আসে মাঝে মাঝে।

কেয়ার টেকার বিশু বলল, এবার যাই দিদি। আশা করি আপনার ভয় কেটেছে। আমি সব ঘটনাই ম্যানেজার বাবুকে জানিয়ে রাখব।


সুলগ্না বুঝে গেছে ভদ্রমহিলা বদ্ধ উন্মাদ। ভূতের ভয় কেটেছে বটে তবে এক অজানা ভয় যেন তাকে চেপে ধরেছে। সে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ বিশু তুমি এসো। তারপর ফ্যাঁস্‌ ফ্যাঁসে গলায় ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞাসা করল আগে আপনি কোথায় থাকতেন?

ভদ্রমহিলা বলল, আসামে। ওখানে ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস পড়াতাম। কিন্তু একা মানুষ হলে যা হয়, ওখানেও সবাই আমার পিছনে লেগে গেল। আমার পেনশনের কাগজ পত্র সব ওরা আটকে দিয়েছে। টাকা পয়সা কিচ্ছু দেয় নি। আমাকে আবার যেতে হবে, এর মধ্যেই আমি যাব আবার ওখানে।

শম্পা এতক্ষন হতবাক হয়ে সব শুনছিল। এবার বলল, আপনার নাম কি?

ভদ্রমহিলা বললেন, ব্রততী রায়। বি আর। বি আর ম্যাডাম বলতে পারেন আমায়।

সুলগ্না বলল, ঠিক আছে ম্যাডাম আমরা আজ যাই। সাবধানে থাকবেন।

ঘাড় ঝাকালেন ব্রততী, সেই, বলা যায় না কখন কি হয়, বলে দুম করে মুখের ওপরেই দরজা বন্ধ করে দিলেন তিনি।

ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এলো। ভয় কেটে যেতেই সব শব্দ টব্দ গুলোও স্বাভাবিক মনে হতে লাগল সুলগ্নার কাছে। দু একবার টেরিয়ে টেরিয়ে ফ্ল্যাটটার দিকে তাকানো ছাড়া কেউ আর ঘটনাটা আমল দিল না সে ভাবে। কেয়ার টেকার খবর দিল ভদ্রমহিলা আবার কোথায় চলে গেছে। শম্পা একদিন বলল, সুলগ্না দি চল আমরা দুটো পরিবার মিলে এবার আসাম থেকে বেড়িয়ে আসি আর ভদ্রমহিলার একটু তত্বতালাশ ও করে আসি। আমার কেবলই যেন মনে হয় জঙ্গি ডেরা টেরা না বানিয়ে ফেলে আমাদের ফ্ল্যাটটা। কিন্তু কথাটা বলাতে দুই পরিবারের কেউই রাজী হল না ওদের সঙ্গ দিতে। তখন দুই বন্ধু মিলে ঠিক করল তারা নিজেরাই যাবে বেড়াতে। তাতে রথ দেখা কলা বেচা দুইই হবে।

বেরিয়ে পড়ল তারা। সুলগ্না আর শম্পা। দুজনেই ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজিত। ভদ্র মহিলা সত্যি কথা বলেছে কি বলেন নি এই বার প্রমান হবে। কারন ইতিমধ্যেই তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট খুলে দেখে নিয়েছে ঐ নামে কোন অধ্যাপিকা নেই। কারন ভদ্রমহিলার কথার মধ্যে কোন সংগতি ছিল না। একবার তিনি বলছিলেন তার এখনো চাকরি আছে একবার বলছিলেন রিটায়ারমেন্টের কথা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে পৌঁছে ব্রততী রায়ের কথা বলতে বিভাগীয় প্রধান বললেন, না না ঐ নামে আমি কাউকে পাইনি। আমি তো নতুন এসেছি। আর আমাদের বিভাগের একটা আশ্চর্যের ব্যাপার এখানে সবাই নতুন। তবু সবচেয়ে সিনিয়র যিনি তাকে জিজ্ঞাসা করতাম কিন্তু তাঁর আজকে অফ্‌ডে। কি ব্যাপার বলুন তো? খুব কিছু দরকার থাকলে পুরনো খাতা পত্র নামাতে হবে। সুলগ্না নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, খুব অসুবিধায় পড়েই ছুটে এসেছি একটু যদি রেকর্ড দেখেন। বিভাগীয় প্রধান বললেন, দাঁড়ান আমাদের দপ্তরী সুখেন অনেক পুরনো মানুষ সে আপনাদের কিছু তত্ব দিতে পারে, বলে তিনি বেল টিপলেন।

সামনে এসে দাঁড়ালো ঢোলাঢালা প্যান্ট জামা পরা ক্ষয়াটে চেহারার একটা ছোটখাট লোক। বলল, বলুন ম্যাডাম। ম্যাডাম বললেন, সুখেন তুমি তো অনেক দিনের লোক দেখত এঁরা কি বলছেন, ব্রততী রায় বলে কেউ ছিলেন আমাদের এখানে?

নামটি শুনতেই লোকটি কেমন ছিটকে গেল তারপর বলল, কেন কি হবে তাকে দিয়ে? 

ম্যাডাম বললেন, তুমি চেন তাকে?

লোকটি কোন উত্তর না দিয়ে চুপ্‌ করে দাঁড়িয়ে রইল।

এবার সুলগ্না বলল, আপনি যদি ওঁকে চেনেন তবে একটু বলবেন কবে উনি রিটায়ার করেছেন আর ঠিক কি অসুবিধার মধ্যে উনি পড়েছিলেন? এবার লোকটি বিরক্ত ভাবে বলল, সে সব এখন জেনে আপনি কি করবেন? সে সব তো কবেই চুকে বেকে গেছে।

সুলগ্না বলল, না মানে একটু দরকার ছিল আর কি। তা কতদিন আগে উনি অবসর নিয়েছেন? 

সুখেন নামের লোকটি এবার ভুরু কুঁচকে তীব্র ভাবে সুলগ্নার দিকে তাকিয়ে বলল, সেই থেকে তো আমাকে জেরা করে যাচ্ছেন আগে বলুন তো কেন?

সুলগ্না বলল, উনি আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন। আমাদের মনে হচ্ছে উনি অসুস্থ। বলেছিলেন এখানে আসবেন, অনেকদিন হয়ে গেল ফ্ল্যাটে ফিরছেন না তাই...

সুলগ্নাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে সুখেন বলল, কি বললেন!    

 ব্রততী ম্যাডাম আপনাদের পাশের ফ্ল্যাটে থেকেন? না না, তবে এই ব্রততী সেই ব্রততী নয়।

শম্পা বলল, কিন্তু উনি তো বলেছিলেন উনি এখানেই চাকরি করতেন। কোন পুরনো ছবি দেখাতে পারবেন তাহলে যদি বুঝতে পারতাম।

এবার সুখেন বিরবির করে কি সব বলতে বলতে একটা পুরনো আলমারির কাছে গেল। সুলগ্নাদের কানে একটা কথাই গেল, আবার? আবার? সুখেন নিচু হয়ে বসে ধুলো ঝেড়ে একটা পুরনো ফটো ফ্রেম বার করল, বলল একবার একটা সেমিনারের সময় এই গ্রুপছবিটা তোলা হয়েছিল। দেখুন তো এর মধ্যে আপনাদের সেই প্রতিবেশীকে চিনতে পারেন কি না।

ফটোর ওপর ঝুঁকে পড়ল শম্পা আর সুলগ্না তারপর শম্পা আঙুল দিয়ে দেখালো, এই যে ইনি। 

মুহূর্তে পিঙ্গল হয়ে গেল সুখেনের মুখ। এবার সে বেশ জোরে বলল, আবার? এতদিন পরে? 

কি আবার? এই নীরব প্রশ্ন নিয়ে সুলগ্না আর শম্পা যখন সুখেনের দিকে তাকিয়ে আছে তখন সুখেন বলে উঠল আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগে উনি মারা গেছেন। বাড়িতে বোরো জঙ্গীরা ঢুকে গুলি করে ঝাঁজরা করে দিয়েছিল ওর শরীর। কিন্তু আমি জানি আসলে বাড়িতে জঙ্গীদের ঢুকিয়াছিল ওর ভাই। সুলগ্না আর শম্পার শিড়দাঁড়া দিয়ে কুল কুল করে বয়ে যাচ্ছিল শীতল রক্তের স্রোত। দুজনের কেউই কোন কথা বলতে পারছিল না। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়েছিল একে অপরের দিকে। সুখেন বলে যাছিল বিনবিন করে ভালো মানুষের বোধহয় এই পরিনতি হয়। ভিটে মাটি ছেড়ে বাংলাদেশ থেকে এখানে এসে বোনের বিয়ে দিয়েছিল, ভাইকে মানুষ করেছিল, মা বাবাকে শেষ দিন পর্যন্ত দেখেছিল। বাড়ি করেছিল, একটু কেমন ক্ষেপা ক্ষেপা ছিল। বিয়ে না করা মানুষ যেমন হয় আর কি। সেই জন্য ভার্সিটিতেও সবাই ওর পেছনে লাগত। মা বাবা মারা যাবার পর ভাইটা ওকে বাড়ি ছাড়া করবার জন্য উঠে পরে লেগেছিল। কারো সঙ্গে বেশি কথা বলত না। শুধু আমার সঙ্গে সে সুখ দুঃখের গল্প করত। বলত ভাইটা আমায় বাড়ি ছাড়া করবার জন্য উঠে পরে লেগেছে রে। দেখবি ও একদিন আমায় মেরে দেবে। আমি ভাবতাম মাথা খারাপ তো তাই বোধহয় ওরকম বলে। এই ঘটনার পর থেকে ভাইটা বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়েছে। এখানে ওরকম হামেশাই ঘটত তখন। বাড়িটা অনেকদিন হানা বাড়ির মত পড়েছিল। লোকে বলত জঙ্গীরা রাতের বেলা ওখানে কাজকম্ম করত। কেউ আবার বলত ম্যাডামকেই দেখা যেত বারান্দায়। তারপর ভিতরে ভিতরে বাড়িটা বিক্রি করে দিল ভাইটা। সেই থেকে মাঝে মাঝেই নাকি কোন নির্মিয়মান বাড়িতে ম্যাডামকে দেখা যেত। আহা অতৃপ্ত আত্মা তো শুধু বাড়ি খুঁজে বেড়াত। বলে সুখেন চোখ মুছল জামার হাতায়। বলল কিন্তু সেসব তো অনেকদিন আগের ঘটনা, এতদিন পরে আবার?

সুলগ্না ধীরে ধীরে উঠে পড়ল, বলল, নিশ্চয়ই আমাদের কোথাও ভুল হচ্ছে । এক রকম দেখতে তো কত মানুষ থাকে। এক নামের ও। সবটাই হয়ত কাকতালীয়।

ওখান থেকে বেরিয়ে শুধু কেবলই তার মনে হতে লাগল তাদের ফ্ল্যাট বাড়িটাও এমনই কোনো বাড়ি ভেঙে করা হয় নি তো! তার যে বন্ধুটা মারা গেল সেও তো কদিন আগেই একটা নতুন ফ্ল্যাট কিনেছিল! সব ফ্ল্যাট বাড়ির নীচেই হয়ত এক একটা কবর খানা, মায়া আর স্বপ্ন দিয়ে তৈরী এক একটা বাড়ির কবর খানা। সেখান থেকে যে কোন দিন যে কেউ উঠে আসবে এই তো স্বাভাবিক!

চিত্র - শ্রীহরি
               

Comments