গদ্য - বিশ্বদীপ দে

জোনাকির দিন


‘‘দেখি কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটা পা রান্নাঘরের ছাদে। আর একটা পা তোর বড়দাদুর ঘরের ছাদে। অন্ধকারে ভাল বোঝা যায় না। যে দাঁড়িয়ে আছে, সেও যে আর একটা অন্ধকার!’’ একথা যখন বড়দিদা বলত, চোখের মণির ভিতর যেন রহস্যের ধোঁয়া মিশে  ঘোলাটে রং ধরত। একটা শতাব্দীপ্রাচীন পুরনো বাড়ির রোয়াকে বসে এ গল্প শুনেছি? নাকি কোনও ঘরের ভিতরে বসে জানলার দিকে তাকিয়ে অন্ধকার বাগানের দিকে দেখতে দেখতে? মনে নেই। কেবল গল্পটা মনে আছে। শেষ পর্যন্ত গল্পই মনে থেকে যায়। কেননা গল্পেরা দীর্ঘজীবী হয়। 

সন্ধের অন্ধকারে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই প্রকাণ্ড ছায়াদানবের গল্পে ফিরি। বড়দিদা বলত, ‘‘সাক্ষাৎ অপদেবতা কিংবা কোনও বিরাট ক্ষমতাধর প্রেত! আমি তো দেখতে পেয়েই আঁচল দিয়ে দুধের গ্লাসটা ঢেকে নিয়ে... রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে তাড়াতাড়ি তোর মায়ের ঘরে ঢুকে গেলাম। কিন্তু রক্ষে করতে পারলাম কই। সেই তোর মা জ্বর বাঁধিয়ে বসল! অনেক দিন লেগেছিল। ওদের নজর তো খুব খারাপ হয়।’’

যৌথ সংসারে বড় হয়ে ওঠা আমার মা তার বাবা-মায়ের চেয়েও বেশি পেয়েছে বড় জ্যাঠা-জেঠির আদর। সেই আদরের ছোঁয়াচ আমিও পেয়েছি ছোটবেলায়। বাড়ির সদস্য সংখ্যা তখন কমের দিকে। নিজের দাদু-দিদা মারা গিয়েছে। মাসিদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বাড়িতে কেবল দুই মামা। তারাও সারাদিন বাইরে। সময় কাটত দুই বুড়োবুড়ির সঙ্গে। তাই সন্ধে নামলেই যেন ভয়টা বেশি করে জাঁকিয়ে বসত। মা বারণ করত, ‘‘কী দরকার ওই সব গল্প করার?’’ কিন্তু আমার আবার ওই ধরনের গল্পেই টান বেশি। দিদাকে খুঁচিয়ে চলতাম। যদি আরও কিছু গল্প বের করা যায়। করতামও। 

কিন্তু সব সময় গল্প শোনার সুযোগ হতো না। দিদা তো সারাক্ষণই খুটখুট করে কাজ করে চলেছে। বড়দাদুর ইজিচেয়ারটা পেতে রোয়াকে বসে থাকতাম। আর অল্প অল্প দুলতাম। এ বাড়ির চারদিকে গাছগাছালি। দাদু সারা বিকেল ধরে খুরপি হাতে নিয়ে বাগানময় ঘুরে বেড়াত। আমিও ঘুরতাম। বাগান। বাগান থেকে বাড়ির শেষ প্রান্তে অবস্থিত ইঁদারা। ততদিনে সেটা পরিত্যক্ত। দেখতে পেলেই প্রবল বকুনি খাব। তাই কায়দা করে অন্যদের চোখ এড়িয়ে সেই ইঁদারায় উঁকি দিতাম। দেখতাম শান্ত, কালো জল কোন গভীরে নেমে গিয়েছে। ওই ইঁদারা আমার কাছে পরম রহস্যময় একটা ব্যাপার ছিল। আর রান্নাঘরের ঠিক পাশের কাঁঠাল গাছটা। সন্ধে নামলেই সেটার শরীর জুড়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে অন্ধকার নামত। মাথার উপরে আকাশময় তারা। সেই সব আশ্চর্য সন্ধের রহস্য আমি আজও ভেদ করতে পারিনি।

আমার মামাবাড়ি। ছুটির রেলে চেপে কলকাতার বুক থেকে একেবারে সুদূর রানাঘাট। কালো আলকাতরার পোঁচ লাগানো বাইরের সদর দরজা। সেটা দিনের বেলায় খোলাই থাকত। কেবল একটা ছোট দরজা আটকানো থাকত। সেটা সরিয়ে ভিতরে ঢুকতে হতো। এল শেপের একটা বাড়ি। ঘরের বাইরেই লম্বা রোয়াক। চারপাশে বাগান। কোনার দিকে পরিত্যক্ত গোয়ালঘর। দূরে বাথরুম। কলতলা। একেবারে শেষ প্রান্তে পরিত্যক্ত সেই ইঁদারা। দাদুর বাবা কিনেছিলেন। অর্থাৎ তারও আগে তৈরি। কত বয়স নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। একশো-দেড়শো... কে জানে!

ছোটবেলার স্মৃতিরা কেমন এবড়ো খেবড়ো হয়। কোনওটা নিচু, সব সময় নজরে পড়ে না। কোনও খানিক উঁচু বলে নজরে পড়ে যায়। যেমন বড়দাদুর টেবিলের সেই পেন স্ট্যান্ডটা। একটা বাঘ। মুখ হাঁ করে গর্জন করছে। তার পিঠের উপরে বানানো দুটো খাপ। সেখানে পেন রাখতে হবে। আর সামনে একটা গর্ত। খাগের কলম তো কালি ডুবিয়েই লিখতে হতো। পুরোটাই চিনেমাটির। জিনিসটার এত চমৎকার ফিনিশং, যে মুগ্ধ না হয়ে উপায় ন‌েই। মামাবাড়ির স্মৃতি হিসেবে সেই বাঘটির কথা আমার আজও খুঁটিনাটি মনে আছে। যখনই যেতাম ওটা হাতে নিয়ে দেখতাম। মা-দিদি বকাবকি করত। ভেঙে যেতে পারে। কিন্তু বড়দাদুর প্রশ্রয় ছিল। তাই শেষমেশ ওটা আমার কাছছাড়া হতো না। অথচ রাতের বেলায় সেই বাঘটাকেই কী ভয়! আসলে চারপাশের গাছগাছালি, পুরনো আমলের বাড়ির কড়িবরগা, পাথরের মেঝে— ভিতরে ভিতরে কেমন দুলিয়ে দিয়ে যেত। মাঝরাতে জল তেষ্টা পেলে ঘুম ভাঙত। মনে হতো বাঘটা আর টেবিলের উপরে নেই! অন্ধকার ঘরের মধ্যেই পায়চারি করছে! 

আমি প্রথম মৃত্যু দেখেছিলাম এই মামাবাড়িতেই। মৃত্যু ঠিক নয়। মৃতদেহ। আমার ছোটদাদুর। মানে যিনি আমার আসল দাদু। উনি মারা গিয়েছিলেন শেষ রাতে। হাসপাতালে। শ্মশানে যাওয়ার আগে দাদুকে বাড়িতে নিয়ে আসা হল। উঠোনে এনে রাখা হল দেহ।

জীবনে সেই প্রথম আমি বিষণ্ণতাকে ছুঁয়েছিলাম। চারদিকে রোদ, মিঠে হাওয়া। তার সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান একটি মৃতদেহ। মুখটা সামান্য হাঁ করা। সেই হাঁ-মুখের ভিতরের অন্ধকার ওই রোদ্দুরের মধ্যে আরও প্রকট হয়ে উঠছিল। ওই বয়সে কেউ অত গুছিয়ে ভাবতে পারে না। এগুলো আমি পরে ভেবেছি। কিন্তু অনুভূতিটা একেবারে তখনকার। চারপাশের সুন্দরের মধ্যে বিষণ্ণতার একটা অন্ধকার ইঁদারার ভিতরে কেউ আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।

যে সকালের কথা বললাম, সেদিনই বিকেলবেলা। মামাবাড়ির উঠোনে ঠিক যে জায়গাটায় দাদুর শবদেহ রাখা হয়েছিল, সন্ধে হতেই সেখানে ধুপ আর মোমবাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হল। আমার খুব অবাক লেগেছিল। যেখানে রাখা ছিল শবদেহটি, সেখানে তখন কিচ্ছু নেই। ফাঁকা। তবু ওই শূন্যস্থানের সামনেই নির্জন মোমবাতি আর ধুপ রাখা হয়েছিল। পাশেই কাঁঠাল গাছটা। সেই গাছের অন্ধকার ছায়ায় জায়গাটা অন্য রকম হয়ে উঠেছিল। সন্ধের পেটের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছিল গুঁড়ো গুঁড়ো বিষণ্ণতা। আর তা হাওয়ায় উড়ে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছিল। আসলে সেগুলো ছিল খামখেয়ালি জোনাকির ঝাঁক।

ওই ঘটনার পরই আমি জ্বরে পড়ি। ধুম জ্বর। একশো তিন-চার পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল সেই জ্বর। 

জাম্প কাট টু ২০১৮। বারান্দার এক কোণে রাখা বাঘের মূর্তিটার কাছে এসে দাঁড়ালাম। ছোটবেলার বিস্ময় বড় হতেই উধাও হয়ে যায়। পরিত্যক্ত বাঘটার প্রতি আমার আর কোনও আকর্ষণ নেই। বাঘটা আমাকে বড়দাদু দিয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে ওটা আমাদের বাড়ির সদস্য।

হাতে নিয়ে দেখছিলাম কবেকার সেই পেন স্ট্যান্ডটা। আজ বিকেলেই শেষবারের মতো মামাবাড়ি গিয়েছিলাম। শেষবার, কেননা বাড়িটা বিক্রির কাজ আজই সম্পূর্ণ হয়ে গেল। ছোটমামা মারা যাওয়ার পর থেকে গত সাড়ে তিন বছর বাড়িটা জনশূন্য। বহু শরিকি বাড়ি। তাই প্রোমোটারকে বিক্রি করাটাও সহজ ছিল না। খেপে খেপে সই চলছিল। অবশেষে আজ সবার সই করা শেষ হল। এ বাড়ি আর আমাদের নয়। ওখানে কী এক ডায়াগনস্টিক সেন্টার হবে। 

রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে সই করার পরে বাড়ি ফেরার পথে শেষবারের জন্য গিয়েছিলাম মামাবাড়িতে। মামাবাড়ি! ভাবতেই বিষণ্ণ হাসি খেলে মুখে। শীতের ঝাপসা বিকেলে সেই বহু চেনা সদর দরজা ঠেলে খুলে দিতেই চমকে উঠেছি। বাড়ি ভাঙার কাজ আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। সেটা জানতাম। কিন্তু জানতাম না, এই পরিস্থিতি হয়ে রয়েছে। চারপাশের পাঁচিলের মাঝখানে ঘন জঙ্গল। পুরো বাড়িটাই মাটিতে মিশে গিয়েছে। আমরা কেউই সাহস করে ভিতরে যেতে পারলাম না। ততক্ষণে বেশ অন্ধকার নেমে এসেছে। বাইরে থেকে দেখছিলাম। কীই বা দেখার! পরিত্যক্ত এক ভুতুড়ে ভিটে। অন্ধকার। ইতিউতি জোনাকির আলো।

হারানো এক সভ্যতার শেষ চিহ্ন এই বাঘ। তার ভয়ঙ্কর মুখব্যদান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম। বুঝতে পারছিলাম আসলে সবটাই একটা ঘোর। একটা দীর্ঘস্থায়ী জ্বর। যে অসুখ থেকে আমি সেরে উঠিনি আজও। 

বাঘের মুখের ভিতরে একদলা অন্ধকার। এ অন্ধকার আমি চিনি। লোকে হারানো ভিটের মাটি কাছে রেখে দেয়। আমার কাছে রইল হারানো অন্ধকার। ঠান্ডা, নির্জন সেই অন্ধকারের ভিতর থেকে একদিন এক ঝাঁক নিষ্পাপ জোনাকি বেরিয়ে আসবে। আমি জানি। 

আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই।


চিত্র - শ্রীহরি

Comments