গদ্য - সুবীর সরকার

কত রকমের মানুষ দেখি, কত কিসিমের জীবন দেখি


(১)


পুষণী রাভা। একটা তিন নদী আর দুই ফরেষ্টের পৃথিবীতে তার জন্ম যাপন। সত্তুর পেরিয়েছেন। এক মেয়ে। বিয়ে হয়েছে কুমারগ্রামে। চারদিকে আদিবাসী পাড়া। রাভাপল্লী। মেচদের পাড়া। কুলি লাইন। গির্জার ঘণ্টা। নাচ গানের মেলা উৎসবের এক লোকায়ত পৃথিবী। রাভা মেয়েরা দল বেঁধে মাছ ধরার নাচ নাচে। তুলে আনে যুদ্ধের নাচগান। ধামসা মাদলে দুলে ওঠে এক অলৌকিক জনপদ। হাতি চিতা হরিণ ময়ূর বাইসন বিষধর সাপ। জঙ্গলে ঘন্টার শব্দ। পুষণী জঙ্গল থেকে খড়ি কুড়িয়ে হাটে বিক্রি করে, শাককচু কুড়িয়ে আনে, ডোবা ও নদীর মাছ ধরে। এটাই তার জীবিকা। আর কোন পেশা নেই। মাঝে মাঝে স্থানীয় রিসোর্টে রান্নার কাজ পায়।নিয়মিত নয়।

২০১২ তে চিলাপাতার পাশে মুন্সিলাইনের মাঠে 'করম পূজার' মেলায় পুষণীর সাথে আমার পরিচয়।প্রায় মধ্যরাত অবধি সে আমাকে চালভাজা ও হাড়িয়া খাইয়েছিল। আমি তার কাছ থেকে শুনে নিচ্চিলাম রাভাদের গান নাচ জীবন ধর্ম লোকজীবনের বর্নময় সব গল্পগুলি। জার্মান রাভা বাঁধে ওরাও শনিচরি এক্কা ও চিকলিস মারান্ডির কথাও জেনেছিলাম তার কাছেই। এরপর কখন তিনি আমার বন্ধু, আত্মীয় কিংবা মায়ের মতই হয়ে পরেছিলেন। গঞ্জ হাট উৎসবের ভেতর পুষণী আর আমি অনেক ঘুরেছি। শিখেছি। অগণন মানুষ দেখেছি। জীবন দেখেছি। সমৃদ্ধ হয়েছি।

এই লকডাউনের সময় খুব অসহায় হয়ে পড়েছিলেন পুষণী রাভা। আমার প্রতিনিধির হাত দিয়ে দুই মাসের রেশন ও সামান্য নগদ অর্থ পৌঁছে দিয়েছিলাম। ফোনে কথাও বলেছি সেই প্রতিনিধি মারফত।

বার বার দেখতে চাচ্ছিলেন পুষণী আমাকে।

অবশেষে তার পৃথিবীতে পৌঁছে গেলাম আমি। নুতন শাড়ি ও গামছা নিয়ে। এবং সামান্য কিছু নগদ।

হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন। আমিও আবেগে রুদ্ধ হলাম।

কত কথা হলো। আমাকে ইচা মাছের চচ্চরি, ঢেকি শাক আর মুসুরির ডাল দিয়ে ভাত খাওয়ালেন।

আমার অনুরোধে একটি মাছ ধরবার গানের অংশ শোনালেন।

আমি ভাগ্যবান, এমন মানুষের ভালোবাসার আলো

আমাকে জড়িয়ে আছে।

ভালো থেকো পুষণী রাভা, আবার আসবো।

 

(২)


আচ্ছা মানুষ কি কখনো তার দেশ হারায়!জন্মমাটি, বেড়ে উঠবার যাপনভূমি ছেড়ে তাকে হয়তো চিরতরে নুতন এক দেশে চলে আসতে হয়। সেই দেশকে নিজের দেশ করে তুলতে হয়। কিন্তু মানুষ কিন্তু আদতে তার দেশ হারান না। তিনি তার অভ্যাসে, তার শরীরের পেশি ও মজ্জায় চিরদিনের সেই দেশকেই আমৃত্যু বহন করতে থাকেন। তাকে বহন করতেই হয়। এই তার নিয়তি। হারিয়ে যাওয়া দেশের নদী, বাড়ি,পথ প্রান্তর আর লোকগান খুব নিবিড় হয়ে বইতে শুরু করে, বয়েই যেতে থাকে তার অন্তর্গত রক্তস্রোতের ভেতরেই।

প্রিয়বালা দাস। বয়স ৭০। কোচবিহার জেলার এক প্রান্তিক গ্রামে বাড়ি। উনি তরুণ কবি বিকাশ দাস মানে বিল্টুর মা।

বাড়ি ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জে।ওখানেই বেড়ে উঠেছিলেন। বিয়ে হয় সেদেশেই।

তারপর অদ্ভুত এক বিপন্নতা নিয়ে ১৯৬৯-এর প্ৰথমদিকেই চিরতরে দেশ ছেড়ে চলে আসতে হয় এপারে। এই দেশ তার দেশ হয়ে ওঠে।

কিন্তু তার বন্ধ চোখের ভেতর এক বুক জলখণ্ডের মত জেগে থাকে তার দেশ। পূর্ববঙ্গের বাড়ি। বাড়ির কাছের সুতিগাঙ। সেই গাঙে ভেসে যাওয়া 'হাজারমনি নাও। তার স্মৃতির গহীনে 'নাও দৌড়ানো' মানে বাইচ খেলা। সারি গান।ময়মনসিংহের বিচ্ছেদী গানের করুন সুর। আমার অনুরোধে সেই গান গেয়েও শোনালেন। কিছুটা সঙ্গের এক ভিডিওতে ধরা রয়েছে। তার চোখে জল। তার চোখে দেশের বাড়ির মায়া। তিনি তো বয়েই  চলেছেন তার চিরদিনের দেশ।

প্রণাম মা, আপনাকে।

 

(৩)


লুৎফর হোসেন। মধ্যবয়সী। পেশায় ভ্যানচালক।শহর লাগোয়া গ্রামে থাকেন। দুই ছেলে। বাইরে আটকে এখনো।

লকডাউনের শুরুতে ভীষণ অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। আজ সকালে লুৎফর হোসেন এলেন। হাতে তার স্ত্রীর তৈরি 'সেমাই'।

বললেন-'ভাইজান। ধর ক্যানে। পায়েস খাবু'।

সেমাইয়ের পায়েস আমার প্রিয়।

আমিও একটা লুঙ্গি ও শাড়ি কিনবার টাকা দিলাম।কিছুতেই নেবেন না। একরকম জোর করেই দিলাম।

সাধারণ মানুষ সত্যিই অসাধারণ। এদের ভালোবাসা একেবারে খাঁটি।

লুৎফর হোসেনরা সাদামাটা। কিন্তু মহার্ঘ্য।


(৪)


মর্জিনা বিবি। কোচবিহার শহরের ফুটপাথে তার ছোট্ট পানের দোকান। অত্যন্ত স্বল্প আয়ের সংসার।মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, স্বামী নেই। ছেলে নেই।বোন ও দুলাভাইয়ের কাছে থাকেন।শহর লাগোয়া গ্রামে।লকডাউনের শুরু থেকেই ব্যক্তিগতভাবে আমি তার পরিবারের পাশে ছিলাম। প্রায় এক মাসের রেশন ও ওষুধের টাকার দায়িত্ব নিয়েছিলাম। এরপর থেকে সপ্তাহে 2 দিন তিনি আমাকে পৌঁছে দেন টাটকা ঢেকি শাক।না, কিছুতেই তাকে টাকা দেওয়া যায় না। তিনি পয়সা নেন না। আজ তিনি আসেন ঢেকি শাক নিয়ে। আমি তার হাতে তুলে দিলাম দুই বোনের জন্য শাড়ি। জামাইবাবুর জন্য লুঙ্গি। ফতুয়া।

ধৰ্ম নয়। সম্প্রদায় নয়। সব পেরিয়ে শুধু মানুষ।মানবতা।

আমার চোখে জল।

প্রনাম, সোনার বরণ মানুষ, আপনাদের।


(৫)


প্রতিদিনই বেরোতে হয়। মানে বেরোতে হয়েছে এই লক ডাউনের সময়ে। কিছু মানুষের কাছে যাই তাদের খোঁজ নিতে। বিগত ৪৫ দিনে এভাবেই পাশে থাকতে চেয়েছি নিজের মতন করে।

একদিন গেলাম কোনামালি ও বসন্তপুরে।

এই জায়গাদুটির কথা অনেক বছর আগে শুনেছিলাম ভাওয়াইয়া গানে-

'ওরে বসন্তপুরের নাল টমেটো

কোনামালির মাগুর মাছ

খায়া যান খায়া যান রে'

কোনামালির সুধীর দাস ও বসন্তপুরের রতন মন্ডল।প্রথমজন প্রান্তিক চাষি। দ্বিতীয়জন মুড়ি বিক্রি করেন হাটে হাটে।

গল্প করলাম অনেকটা সময়। তুলে দিয়ে এলাম আগামী ১০ দিনের জন্য সামান্য কিছু উপাদান।

তারপর পুন্ডিবাড়ি হয়ে বাড়ি ফিরলাম।

কতরকমের জীবন দেখি।

কত কিসিমের মানুষ দেখি।


(৬)


নদী তীরবর্তী এলাকায় হানিফ চাচার বাড়ি।একসময় অনেক জমি ছিল তার। ১৯৬৮-র বন্যায় ২০ বিঘে জমি তোর্সার গর্ভে হারিয়ে গেছে। এখন দেড় বিঘে জমি আর সংক্ষিপ্ত ভিটে তার সম্বল।হানিফ চাচার দুই মেয়ে। বিয়ে হয়ে গেছে। জামাইরা গাজিয়াবাদে থাকে। পরিযায়ী শ্রমিক। আটকে আছে এখনো। কোচবিহার শহরে একসময় রিকসা চালাতেন তিনি। আমি ক্লাস নাইন থেকেই হানিফ চাচাকে চিনি। পরবর্তীতে তার সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।অনেক পুরোনো দিনের গল্প শোনার আগ্রহে তার প্রতি আমার আলাদা টান ছিল।হানিফ চাচা এখন ৭৪। ১২ বা ১৩ বছর আর রিকসা চালান না।মানে, শারীরিক কারণেই পারেন না। সামান্য সবজি চাষ, বাড়িতে পোষা গরুর দুধ বিক্রি আর জামাইদের সাহায্যে সংসার চালান। লগডাউনের পর থেকে প্রায় ৪৭ দিন ধরে আমি ওনার পরিবারের পাশে নিজের মতন করে আছি।

ইদের আগে গিয়েছিলাম হানিফ চাচার বাড়ি। এখন রমজান মাস চলছে।চাচা ও চাচী রোজায় আছেন।

আমাকে দেখে মুখে স্বর্গীয় হাসি। টুল পেতে দিতে দিতে বললেন- 'বইস বাপ।বইস। আরাম করি বইস'।

কি অদ্ভুত আন্তরিকতা তার কন্ঠে।

সামনে খুশির ঈদ। চাচার হাতে তুলে দিলাম লুঙ্গি ও ফতুয়া। আর চাচীর জন্য একটা শাড়ি। সামান্য কিছু নগদও।

কথা হলো। সাবধানে থাকতে বললেন আমাকে।

হানিফ চাচাদের মতন মানুষরাই তো আমাদের শেকড়বাকর। এইসব সোনার বরণ ভুমিলগ্ন মানুষদের ভেতর কোন কৃত্রিমতা নেই।ভান নেই।

ভালো থাকবেন,হানিফ চাচা...


(৭)


রাহুল ,কৃষ্ণা, ইমন, দীপক, বিকাশ, মিঠুন, কৌশিক, রিপুঞ্জয়, জয়ন্ত, অশোক। সদ্য তরুনের দল। এদের কাজ ঘরের খেয়ে বনের মোশ তাড়ানো। মধ্যরাত থেকে ভোরবেলা,ভতপ্ত দুপুর থেকে গোধূলি।হাসপাতাল, রক্তদান, শ্মশান, ডাক্তারের চেম্বার-যেখানে ডাকা যাবে সেখানেই এদের পাওয়া যাবে।

এরাই আমার তরুণ ব্রিগেড। আমার অহংকার।আমার ভরসার জায়গা। যেমন, একদিন রাতে 50 জনকে রাতের খাবার দেবার পরিকল্পনা করা হয়েছে। আর আমার বাসায় এই তরুণ ব্রিগেড শুরু করে দিয়েছে রান্নার কাজ। তারপর এরাই বয়ে নিয়ে যাবে খাবার। বিতরণও করবে এরাই।

এক কাপ চা-ও তো খাওয়াতে পারি না রে তোদের।তারপরেও আমার পাশে থাকিস তোরা।

সত্যিই, গর্ব হয়।


(৮)


এক সন্ধেবেলায় একটা ফোন এলো। অসহায় মানুষের কথা শুনলাম। চলে গেলাম দুই তরুণ বন্ধুকে নিয়ে।ম ধুপুর এলাকায়। আকবর আলী ও নন্দ বর্মনের বাসায়। উঠোনে শুয়ে আছে কুকুর।পোষা কুকুর। বাচ্চার ওষুধ নেই। ঘরে চাল নেই।আলু, তেল নেই। হাতে নেই টাকা নগদ। লগডাউন বাড়ছে শুনে রীতিমত আতঙ্কিত তারা।

আগামী এক মাসের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ পৌঁছে দিয়ে এলাম তাদের কাছে। একান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে।

কিন্তু ভুলতে পারছি না চোখের জল।

সঙ্গে আছি। ব্যক্তিগত সমস্ত সম্পদ মানুযের জন্যই খরচ করবো আমি। এবং মানুষই জিতবে।


(৯)


মানুষের বিপন্নতার কোন অনুবাদ হয় না। অসহায় মানুষ দিন অনি দিন খাওয়া মাটির মানুষের মতন খাঁটি মানুষ খুব দূর থেকেই কেবল

দেখে যায় ত্রাণশিবিরের আলো।

আমি মানুষের ভেতর ঘুরি। মহল্লা বস্তি বসতি নদীর চরের জনজীবনের ভেতর। খুব কাছ থেকে দেখি আকলিমা বিবি, রওশন বেওয়া, নন্দ দাস, হামিদুল চাচা, পুলিন বর্মণ, রাধাকান্ত ঘোষ, চতুর্ভুজ যাদব, মহাদেবী মিশ্র-দেরকে। খুব বিপন্নতা বহন করতে থাকা বাতাসে উড়ে বেড়ায় মানুষের লবন হারিয়ে ফেলা চোখের জল। উত্তরহীন এক সময়ের আলেখ্য রচিত হতে থাকে বুঝি এভাবেই। এই অন্ধকার সময়ই তো আবার চিনিয়ে দেয় মানুষকে। মানবতাকে। কত কত মানুষ এই সংকটকালে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।দাঁড়াচ্ছেন।সব শ্রেণীর মানুষ।

ভালো লাগে।ভরসা পাই।

এই আলো বুঝিয়ে দেয় ভালো কখনো হারাবে না।ভালো কখনো হারায় না।

সকল সংকটকে পরাজিত করে শেষ হাসিটা মানুষই হাসবে।

'আবার নদীর জলে নেমে পড়বেন বাচ্চা হাতির

                                                    মাহুত

সাঁকোর ওপর বৃষ্টি।

দাওয়ায় বসে মুড়ি ভাজবেন হামিদা 

                                            বানু

আমরা কুর্নিশ ছুঁড়ে দেব মানুষের দিকেই

পকেট থেকে চিরুনি বের করে আনবেন 

                                   সার্কাসের জোকার

হাওয়া ও রোদের ভেতর ছড়িয়ে পড়বে

                                মাহুত বন্ধুর গান'।


(১০)


কার ও বিপন্ন সময়ে কত মানুষ কতরকমভাবে কাজ করছেন। ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত ভাবে। প্রান্তিক ও দিন আনি দিন খাওয়া মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন তারা। আমাদের তরুন প্রজন্ম আমাদের অহংকার। তাদের সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ খুব ভরসা জোগায়।

পারমিতা চোধুরী ও অর্চিষ্মান বন্দ্যোপাধ্যায় এমনই দুজন ঝকঝকে তরুণ। অর্চি প্রিয় ভাই আমার।ভালো লোকসংগীত গায়। আর পারমিতার সাথে পরিচয় কবি মিতুল দত্তের মাধ্যমে। আজ ওরা এলো। সামাজিক কাজ নিয়ে কিছু কথা হলো, মানুষের অসহায় মুখগুলি বুঝি পড়তে শুরু করলাম আমরা। ওদের কাজের শরিক তো আমিও। সামান্য অনুদান তুলে দিলাম। শেষে অর্চিষ্মান তার দরদী গলায় শোনালো শাহ আবদুল করিমের তিনটি অসামান্য লোকগান।

মানুষ হারবে না কারণ পারমিতারা আছেন।


উপসংহারের বদলে

এই অতিমারি। এই মহামারি। এই করোনার অন্ধকার ও বিপন্ন সময়ে মানুষের ভেতরে প্রবেশ করেছিলাম।ভছুটে গেছি গ্রাম ও গ্রামান্তরে। সোনার বরণ সব মানুষের কাছে। নানান অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আমার সেই জার্নি। সেসবের কয়েকটুকরো দিয়ে সাজিয়ে দিলাম এই গদ্য, যার শুরু ও শেষ জুড়ে কেবল অন্তহীন মানুষের ঢল।

চিত্র - শ্রীহরি

Comments

  1. সম্পাদক ও কবি গদ্যকারকে বিশেষ কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ। এমন অনালোকিত প্রান্তিক মানুষদের অসাধারণ জীবনযাত্রাকে শব্দরূপ দেবার জন্য।

    ReplyDelete

Post a Comment